সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা
-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর*
(৪র্থ কিস্তি)
(গ) সমমানের দ্রব্য নগদ নগদ ব্যতীত বিনিময় সূদ
সমমানের একই জাতীয় কোন দ্রব্য বিনিময় করতে চাইলে, নগদে সমান সমান বিনিময় কতে হবে। অন্যথা সূদ হিসাবে গণ্য হবে। কেননা সমমানের একই দ্রব্য বাকীতেও সমান সমান লেনদেন করা শরী‘আতে বৈধ নয়। অবশ্য হাতে হাতে অর্থাৎ নগদে বিনিময় হলে তা বৈধ।
عَنْ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ رِبًا إِلَّا هَاءَ وَهَاءَ وَالْوَرِقُ بِالْوَرِقِ رِبًا إِلَّا هَاءَ وَهَاءَ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ رِبًا إِلَّا هَاءَ وَهَاءَ وَالشَّعِيْرُ بِالشَّعِيْرِ رِبًا إِلَّا هَاءَ وَهَاءَ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ رِبًا إِلَّا هَاءَ وَهَاءَ
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণের লেনদেন যদি নগদে না হয়, তাহলে তা সূদ। রূপার বিনিময় রূপার লেনদেন যদি নগদে না হয়, তাহলে তা সূদ। গমের বিনিময় গমের লেনদেন যদি নগদে না হয়, তাহলে তা সূদ। জবের বিনিময় জবের লেনদেন যদি নগদে না হয়, তাহলে তা সূদ। খেজুরের বিনিময় খেজুরের লেনদেন যদি নগদে না হয়, তাহলে তা সূদ।[১]
একই শ্রেণীর দ্রব্য সমজাতীয় হলেও বাকীতে সমান সমান বিক্রি বা বিনিময় করাও সূদ। তবে তা নগদে বিনিময় হলে জায়েয। এ বিধানের মধ্যে ইসলামের ইনসাফপূর্ণ চমৎকার বিশ্লেষণ বিবেচিত হয়েছে। সমমানের সমজাতীয় দ্রব্য নগদে জায়েয। আর বাকীতে হলে সূদ। কারণ সময় পরিবর্তীত হওয়ার ফলে দ্রব্যের মূল্য কম-বেশী হতে পারে। যেমন কেউ এক মন গম মার্চ মাসে কারো কাছ থেকে ধার নিল, এই শর্তে যে, জুন মাসে সে এক মন গম দিয়ে দিবে। মার্চ মাসে একমন গমের বাজার দর হল ১২০০/= টাকা। জুন মাসে ঋণগ্রহীতা যখন একমন গম পরিশোধ করল তখন দেখা গেল তার বাজার মূল ১৫০০/= টাকা। তাহলে ঋণদাতা ঠকে গেল। আর যদি জুন মাসে গমের বাজার মূল্য ১০০০/= হয়, তাহলে ঋণগ্রহীতা ঠকে গেল। আবার কেউ তর্কের খাতিরে বলতে পারেন জুন মাসে একমন গমের দাম ১২০০/= টাকাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে শরী‘আতের বিধান হল এটা অস্পষ্ট তথা সন্দেহযুক্ত। আর সূদী কারবারে সন্দেহযুক্ত লেনদেনও হারাম বলে বিবেচিত।[২]
(ঘ) মুদ্রা লেনদেনে কম-বেশি করা সূদ
মুদ্রা বা টাকা-পয়সা লেনদেন করার সময় কম-বেশি করা সূদ। যা বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে চলমান রয়েছে। মুসলিম অমুসলিম সকলেই এরূপ ব্যবসায় যুক্ত হয়ে পড়েছে। মুদ্রা বিনিময় করার ক্ষেত্রে এক হাযার টাকা ঋণ প্রদান করে এক হাযার পঞ্চাশ টাকা গ্রহণ করা সূদের অন্তর্ভুক্ত। যা ইসলামের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হারাম। এ মর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تَبِيْعُوا الدِّيْنَارَ بِالدِّيْنَارَيْنِ وَلَا الدِّرْهَمَ بِالدِّرْهَمَيْنِ
ওছমান ইবনু আফ্ফান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা এক দিনার দুই দিনারের বিনিময়ে, এক দিরহাম দুই দিরহামের বিনিময়ে লেনদেন কর না’।[৩] অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, ‘দীনারের বিনিময়ে দীনার ও দিরহামের বিনিময়ে দিরহাম (বিক্রয়ে) সমান সমান হওয়া চাই। যে বেশি নিবে সে সূদী কারবার করবে’।[৪]
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا نُرْزَقُ تَمْرَ الْجَمْعِ وَهُوَ الْخِلْطُ مِنْ التَّمْرِ وَكُنَّا نَبِيْعُ صَاعَيْنِ بِصَاعٍ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا صَاعَيْنِ بِصَاعٍ وَلَا دِرْهَمَيْنِ بِدِرْهَم
আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের মিশ্রিত খেজুর দেয়া হত, আমরা তা দু’ ছা‘য়ের পরিবর্তে এক ছা‘ বিক্রি করতাম। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এক ছা‘-এর পরিবর্তে দু’ছা‘ এবং এক দিরহামের পরিবর্তে দু’দিরহাম বিক্রি করবে না’।[৫]
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّمَا الرِّبَا فِى الدَّيْنِ. قَالَ أَبُوْ مُحَمَّدٍ مَعْنَاهُ دِرْهَمٌ بِدِرْهَمَيْنِ
উসামা ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয় সূদ হল ঋণ লেনদেন’। আর আবূ মুহাম্মাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘একথার অর্থ হল এক দিরহাম ঋণ দিয়ে দুই দিরহাম ফেরত নেয়া’।[৬] অপর এক বর্ণনায় রয়েছে- لَا رِبًا إِلَّا فِى الدَّيْنِ ‘ঋণ লেনদেন ব্যতীত সূদ হয় না’।[৭]
এক দীনারের পরিবর্তে দুই দীনার অথবা এক দিরহামের পরিবর্তে দুই দিরহামে বিক্রি করা নিষেধ। তবে যদি তা নগদে এবং সামান সমান হয় তথা এক দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহামই হয় তবে তা বৈধ। বিনিময়ে কম-বেশী করলে তখনই সূদের মধ্যে পতিত হবে। তৎকালীন সময়ে দীনার ও দিরহামের মুদ্রা চালু ছিল। বিধায় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দীনার বা দিরহাম দিয়ে উদাহরণ দিয়েছেন। তাই বর্তমানে টাকা-পয়সা, ডলার, রিয়াল, রিংগিট, রূপী তথা সকল প্রকারের মুদ্রার ক্ষেত্রেও একই বিধান।
এক লাখ টাকা ঋন দিয়ে পরবর্তীতে এক লাখ দুই হাজার টাকা বা এক লাখের বেশি গ্রহণ করাই সুস্পষ্ট সূদ। তা ব্যক্তি পর্যায়ে হোক অথবা কোন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে হোক। যেমন- দাদন ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত লেনদেনে অথবা ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়। এ সূদী কারবারই বর্তমান বিশ্বের জন্য এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক শোষণের অগ্নিরাজ্য কায়েম হয়েছে। যার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে অসহায় দুঃখী মানুষ।
(ঙ) পাওনাদের নিকট থেকে হাদিয়া গ্রহণও সূদ
পাওনাদের নিকট থেকে কোন দ্রব্য বা মুদ্রা উপহার হিসাবে গ্রহণ করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। পাওনা পরিশোধের পূর্বে এরূপ হাদিয়া প্রদান সিদ্ধ নয়। কেননা এরূপ লেনদেনের মধ্যেও অবৈধ উপার্জনের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ইসলামে এ বিষয়ে সর্তকতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। যাতে করে কোন চোরাই পথে যেন সূদ-ঘুষ ঢুকে পড়তে না পারে।
عَنْ أَبِيْ بُرْدَةَ بْنِ أَبِيْ مُوْسَى قَالَ قَدِمْتُ الْمَدِيْنَةَ فَلَقِيْتُ عَبْدَ اللهِ بْنَ سَلَامٍ فَقَالَ إِنَّكَ بِأَرْضٍ فِيْهَا الرِّبَا فَاشٍ إِذَا كَانَ لَكَ عَلَى رَجُلٍ حَقٌّ فَأَهْدَى إِلَيْكَ حِمْلَ تَبْنٍ أَو حِملَ شَعِيْرٍ أَوْ حَبْلَ قَتٍّ فَلَا تَأْخُذْهُ فَإِنَّهُ رِبًا
আবূ বুরদা ইবনু আবূ মূসা (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি মদীনায় এসে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, তুমি এমন এলাকায় বাস কর, যেখানে সূদের প্রচলন অনেক বেশী। অতএব কারও উপর যদি তোমার কোন প্রাপ্য থাকে, আর সে যদি তোমাকে এক বোঝা খড়, এক গাঁটরি যব বা ঘাসের একটি বোঝাও উপঢৌকন দেয়, তাহলে তা গ্রহণ কর না। কেননা তা সূদ।[৮]
কোন ব্যক্তিকে টাকা-পয়সা বা কোন জিনিস ধার দেয়া হল। উক্ত ব্যক্তি ঐ ঋণ পরিশোধের পূর্বে কিছু হাদিয়া প্রদান করলে তা গ্রহণ করাও সূদ হিসাবে পরিগণিত হবে। বলা যায় এ বিষিয়ে ইসলামী অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। তবে যদি পূর্ব থেকেই তাদের মধ্যে হাদিয়া বিনিময় করার প্রচলন থাকে, তাহলে এ সময় গ্রহণ করাতে কোন দোষ নেই। কারণ তখন সেখানে তোষামদের কোন সম্ভাবনা থাকবে না। যেমনটি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
‘যখন তোমাদের কেউ (কাউকে) ঋণ দেয়। অতঃপর (ঋণ গ্রহীতার পক্ষ থেকে) তাকে কোন উপঢৌকন দেয়া হয় অথবা তাকে স্বীয় সওয়ারীতে চড়িয়ে কোথাও পৌঁছে দিতে চায় তবে সে যেন তার সওয়ারীতে না চড়ে এবং তার উপঢৌকনও গ্রহণ না করে। তবে হ্যাঁ, যদি এরূপ সদ্ব্যবহার (উপঢৌকন আদান-প্রদান ঋণ দেয়ার) পূর্ব থেকেই জারী থাকে তবে পরবর্তীতে অনুরূপ কিছু গ্রহণ করায় দোষ নেই’।[৯]
(চ) সূদের নিকটতম সন্দেহযুক্ত বিনিময়ও বৈধ নয়
সূদের কাছাকাছি কোন সন্দেহযুক্ত লেনদেনও শরী‘আতে সিদ্ধ নয়। যেন কেউ ভয়াবহ সূদে জড়িয়ে না যায় তাই এই সতর্কতা।
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ إِنَّ آخِرَ مَا نَزَلَتْ آيَةُ الرِّبَا وَإِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُبِضَ وَلَمْ يُفَسِّرْهَا لَنَا فَدَعُوا الرِّبَا وَالرِّيْبَةَ
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, সূদ হারাম হওয়ার আয়াতই শেষ আয়াত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুবরণ করেছেন, অথচ সূদের (অসংখ্য শাখা-প্রশাখার) পূর্ণ বিবরণ তিনি দিয়ে যাননি। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত সূদ এবং যে যে ক্ষেত্রে সূদের কোন সন্দেহ হয় সবই তোমরা বর্জন কর’।[১০]
সূদ সর্বতোভাবেই হারাম। যা স্পষ্ট সূদ তাতে তো কোন কথাই নেই। কিন্তু যে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। পরিষ্কার বুঝা যায় না। বরং সূদের মধ্যে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাও শরী‘আতে বৈধ নয়। এরূপ লেনদেন থেকেও প্রতিটি মুসলিমকে বাঁচতে বলা হয়েছে। কেননা সন্দেহযুক্ত জিনিস পরিহার করাই ইসলাম সমর্থিত বিধান। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِيْنِهِ وَعِرْضِهِ وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُّهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ ‘যে ব্যক্তি সন্দেহের বস্তুকে পরিহার করে চলবে, তার দ্বীন এবং ইজ্জত-আবরু, মান-সম্মান পাক-পবিত্র থাকবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহের কাজে লিপ্ত হবে, সে অচিরেই হারামেও লিপ্ত হয়ে পড়বে (ফলে তার দ্বীন এবং মান-সম্মান কলুষিত হবে)’।[১১] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন,دَعْ مَا يَرِيْبُكَ إِلَى مَا لَا يَرِيْبُكَ فَإِنَّ الصِّدْقَ طُمَأْنِيْنَةٌ وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيْبَةٌ ‘যে কাজে মনে খটকা লাগে, সে কাজ পরিহার করে খটকাহীন কাজ কর। কেননা সত্য অকাট্য এবং মিথ্যা সংশয়পূর্ণ’।[১২]
বাস্তবেই কল্যাণকর কাজ করলে সেখানে হৃদয়ে প্রশান্তি লাগে। এর মধ্যে আলাদা কিছু মজা অনুভব করা যায়। আর অবৈধ কাজে মানসিক অশান্তি তৈরী হয়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য সুবিধামত বিনিময় বৈধ
একই জাতীয় দ্রব্য না হয়ে বিভিন্ন প্রকারের দ্রব্য ইচ্ছামত বিনিময় করার সুযোগ ইসলামে রয়েছে। যেমন খেজুরের সাথে গমের বিনিময় করা। তবে শর্ত হল তা নগদে বিনিময় করতে হবে। উবাদা ইবনু ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اَلذَّهَبُ بِالذَّهَبِ مِثْلًا بِمِثْلٍ وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ مِثْلًا بِمِثْلٍ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ مِثْلًا بِمِثْلٍ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ مِثْلًا بِمِثْلٍ وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلًا بِمِثْلٍ وَالشَّعِيْرُ بِالشَّعِيْرِ مِثْلًا بِمِثْلٍ فَمَنْ زَادَ أَوِ ازْدَادَ فَقَدْ أَرْبَى بِيْعُوا الذَّهَبَ بِالْفِضَّةِ كَيْفَ شِئْتُمْ يَدًا بِيَدٍ وَبِيْعُوا الْبُرَّ بِالتَّمْرِ كَيْفَ شِئْتُمْ يَدًا بِيَدٍ وَبِيْعُوا الشَّعِيْرَ بِالتَّمْرِ كَيْفَ شِئْتُمْ يَدًا بِيَدٍ
‘সমপরিমাণ স্বর্ণের পরিবর্তে সমপরিমাণ স্বর্ণ হতে হবে; সমপরিমাণ রূপার পরিবর্তে সমপরিমাণ রূপা হতে হবে; সমপরিমাণ খেজুরের পরিবর্তে সমপরিমাণ খেজুর হতে হবে; সমপরিমাণ গমের পরিবর্তে সমপরিমাণ গম হতে হবে; সমপরিমাণ লবণের পরিবর্তে সমপরিমাণ লবণ হতে হবে এবং সমপরিমাণ যবের পরিবর্তে সমপরিমাণ যব হতে হবে। যে লোক এগুলো লেনদেনে বেশি পরিমাণ দিবে অথবা নিবে সে সূদে লেনদেনকারী বলে বিবেচিত হবে। তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী রূপার পরিমাণের পরিবর্তে স্বর্ণের পরিমাণ নির্ধারণ করে নগদ বিক্রয় করতে পার। তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী খেজুরের পরিমাণের পরিবর্তে গমের পরিমাণ নির্ধারণ করে নগদ বিক্রয় করতে পার। তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী খেজুরের পরিমাণে যবের পরিমাণ ঠিক করে নগদে বিক্রয় করতে পার’।[১৩] অপর বর্ণনায় রয়েছে- ‘তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী বার্লির পরিমাণের পরিবর্তে গমের পরিমাণ নির্ধারণ করে (পরিমাণে কম-বেশি করে) নগদে বিক্রয় করতে পার’।[১৪]
উপরিউক্ত হাদীছের উপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞ আলিমগণ বলেন, ‘সমপরিমাণ গমের পরিবর্তে সমপরিমাণ গম এবং সমপরিমাণ যবের পরিবর্তে সমপরিমাণ যব বিক্রয় করতে কোন সমস্যা নেই। বিনিময়ের বস্তু দুটি যদি একই প্রজাতির না হয় তাহলে পরিমাণে কম-বেশি হলে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে নগদ আদান-প্রদান হতে হবে। এই একই মত পোষণ করেছেন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ ছাহাবী ও তাবেঈগণ। সুফিয়ান ছাওরী, আহমাদ ও ইসহাকেরও একই মত।[১৫]
আবূ বাকরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, تَبَايَعُوا الذَّهَبَ بِالْفِضَّةِ كَيْفَ شِئْتُمْ وَالْفِضَّةَ بِالذَّهَبِ كَيْفَ شِئْتُمْ ‘তোমরা রূপার বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রয় করবে, যেভাবে তোমাদের ইচ্ছা, আর স্বর্ণের বিনিমেয় রূপা, যেভাবে তোমাদের ইচ্ছা’।[১৬] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, فَإِذَا اخْتَلَفَتْ هَذِهِ الأَصْنَافُ فَبِيْعُوْا كَيْفَ شِئْتُمْ إِذَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ ‘যখন বস্তুগুলোর মধ্যে প্রকারভেদ থাকবে (ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হবে) তখন নগদে তোমরা ইচ্ছানুযায়ী বিক্রয় করতে পার’।[১৭] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,وَبِيْعُوا الذَّهَبَ بِالْفِضَّةِ وَالْفِضَّةَ بِالذَّهَبِ كَيْفَ شِئْتُمْ ‘রূপার বদলে সোনা এবং সোনার বদলে রূপা যেভাবে ইচ্ছা, কেনা বেচা করতে পার’।[১৮]
উপরিউক্ত হাদীছগুলোতে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন প্রকারের দ্রব্য নগদে সুবিধা মতো শর্তে বিনিময় করা বৈধ। যেমন গমের সাথে বার্লি বা সোনার সথে রূপা বা খেজুরের সাথে গম, কম-বেশী করে লেনদেন করা বৈধ। তবে লেনদেন হবে হাতে হাতে তথা নগদে। সাধরণত বাকীতে লেনদেনের ক্ষেত্রেই সূদ হয়।
সূদ হয় মূলত বাকী লেনদেনে
সূদ হয় মূলত বাকী লেনদেনের ক্ষেত্রে। আর বাকীতে সূদী কারবার কার্যকর হয়ে থাকে। প্রত্যেকটা সূদী ব্যবসা-বণিজ্য বাকীতেই চলে। কোন ব্যবসায়ী নগদে কেনাবেচায় সূদী কারবার করে না। নগদ লেনদেনে সূদপ্রথা বাস্তাবায়নের কোন সুযোগও নেই। আর এ ব্যবস্থায় সূদ চলবেও না। তাই প্রতিটি সূদ কারবারী বাকীতেই এ নীতি প্রয়োগ করে থাকে। মুদ্রার বিনিময় কেন্দ্রিক সকল প্রকার সূদ লেনদেন বাকীতে পরিচালিত হয়। যেমন একাধিক ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِنَّمَا الرِّبَا فِى النَّسِيْئَةِ ‘নিশ্চয়ই সূদ হল বাকীতে’।[১৯] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, لَا رِبًا إِلَّا فِى النَّسِيْئَةِ ‘বাকী বিক্রয় ব্যতীত সূদ হয় না’।[২০] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, لَا رِبًا فِيْمَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ ‘হাতে হাতে নগদ লেনদেনে কোন সূদ নেই’।[২১]
উপরিউক্ত হাদীছগুলোতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, বাকীতে লেনদেনেই সূদ হয়ে থাকে। সাধারণত নগদ লেনদেনে সূদ হয় না। আর স্বভাবতই সূদী ব্যবসা বাকীতেই সমাধা হয়ে থাকে। সর্বোপরি কথা হল সর্বাবস্থায় সূদী কারবার পরিত্যাজ্য।
সূদের ভয়াবহতা ও নির্মম পরিণতি
আধুনিক অর্থনীতিবিদগণও এ কথা স্বীকার করেছেন, যে সমাজে সূদের হার একেবারে শুণ্যের কোঠায় পৌঁছেছে এবং বিনাসূদে ঋণ দেয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থা রয়েছে, বস্তুত তাই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা উন্নত ও সুসভ্য সমাজ। নীতিগতভাবে বিনাসূদে ঋণ দেয়ার যৌক্তিকতা পাশ্চত্য চিন্তাবিদগণ স্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু তা কার্যকররূপে চালু করার কোন ব্যবস্থায়ই আজ পর্যন্ত তারা পেশ করতে পারেনি। তাঁরা যে সমবায় ঋণ দান সমিতি বা ব্যাংকের ব্যবস্থা দিয়েছে, তা মানুষকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দানের পরিবর্তে সূদের অক্টোপাশে সমগ্র দেশকে বেধে ফেলেছে।[২২]
বর্তমানে সমাজের সর্বত্র সূদের জয়জয়কর অবস্থা। সমাজের সর্বস্তরে সূদের বিস্তার ঘটেছে। সূদী লেনদেন এখন খুবই সহজলভ্য একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। অধিকাংশ মানুষই এই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ছোবলের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে। এমনকি অনেক আলেমও এরূপ সূদী অর্থ ব্যবস্থার সাথে জড়িত। সূদবিহীন অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা যেন এখন রূপ কথার কাহিনীর মত। সূদবিহীন অর্থনীতি সমাজে চলতে পারে এ যেন ভাবতেও অবাক লাগে। মনে হয় এ যেন কল্পনাতীত একটি লেনদেন। অথচ সূদের ভয়াবহ পরিণতির দিকে কেউ খেয়াল করে না। সূদী অর্থনীতির পরিণামের দিকে দৃষ্টি দিলে একজন মুসলিম কোন ভাবেই এর সাথে আপোষ করতে পারে না। বরং যে কোন মূল্যে সূদী কারবার থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে। সূদের ভয়াবহ পরিণতি আমাদেরকে সে কথারই দিক নির্দেশনা দেয়।
১. সূদখোর সরাসরি হারাম কর্মে লিপ্ত
সূদী লেনদেন এমন এক অর্থব্যবস্থা যার মাধ্যমে একজন মুসলিম সরাসরি হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। ইসলামে অনেক নিন্দনীয় কাজ রয়েছে যেগুলোকে সরাসরি হারাম বলা হয়নি। কিন্তু সূদী কারবারকে সরাসরি হারাম বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَحَلَّ اللّٰہُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ‘আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৫)। সূদী কারবার হারাম তা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। অস্পষ্টতার কোন সুযোগই নেই। এরূপ প্রত্যক্ষ হারাম কাজে কোন মুসলিম সম্পৃক্ত হতে পারে না। শক্তিশালী ঈমানদার মুসলিম তা পরিহারে সচেষ্ট থাকারই কথা। দুর্বল ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষেই এরূপ হারাম কর্মে জড়িত হওয়া সম্ভব।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৭০, ২১৭৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৬; আবূ দাউদ, হা/৩৩৪৮; তিরমিযী, হা/১২৪৩; নাসাঈ, হা/৪৫৫৮; ইবনু মাজাহ, হা/২২৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬২; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫০১৩; মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/২৩৪৫; মিশকাত, হা/২৮১২।
[২]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৫০; মিশকাত, হা/২৮৩০, সনদ ছহীহ।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৫; মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/২৩৩৫; মুস্তাদরাক হাকেম, হা/২১৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৮৮৫।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৬।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৮০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৪৯৩।
[৬]. দারেমী, হা/২৫৮০; মুসনাদে আবু আওয়ানাহ, হা/৫৪২১; আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৪৪২, সনদ ছহীহ।
[৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৮৬৬; মুসনাদে আবু আওয়ানাহ, হা/৫৪২১; আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৪৩৬; সনদ ছহীহ।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮১৪; বায়হাক্বী শু‘আাবুল ঈমান, হা/৫৫৩৩; মিশকাত, হা/২৮৩৩।
[৯]. ইবনু মাজাহ, হা/২৪৩২; বায়হাক্বী, হা/১১২৩৫; ত্বাবারাণী আওসাত্ব, হা/৪৫৮৫; মিশকাত, হা/২৮৩১, উক্ত হাদীছের সনদকে শেখ নাছিরুদ্দীন আলবানী মিশকাতের তাহক্বীক্বে ছহীহ বলেছেন। তবে ইবনু মাজাহসহ একাধিক গ্রন্থে যঈফ বলেছেন। তবে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া একে হাসান হিসাবে উল্লেখ করেছে। দ্র. ফাতাওয়াল কূবরা, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ১৫৯; ফাতাওয়া আল ইসলাম, ফাতাওয়া নং ৪৯০১৫; ইবনু তাইমিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদও হাসান হিসাবে উল্লেখ করেছেন। দ্র. ফাতওয়া শায়খ ছালেহ আল মুনাজ্জিদ।
[১০]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৫০; মিশকাত, হা/২৮৩০, সনদ ছহীহ।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/৪১৮১; মিশকাত, হা/২৭৬২।
[১২]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৭২৩; তিরমিযী হা/২৫১৮; নাসাঈ হা/৫৭১১; মিশকাত, হা/২৭৭৩, সনদ ছহীহ।
[১৩]. তিরমিযী, হা/১২৪০; নাসাঈ, হা/৪৫৬০; ইবনু মাজাহ, হা/২২৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৭৮১; সনদ ছহীহ।
[১৪]. তিরমিযী, হা/১২৪০; ইবনু মাজাহ, হা/২২৫৪; আল-মুসনাদুল জামে‘, হা/৫৫৫৪, সনদ ছহীহ।
[১৫]. তিরমিযী, হা/১২৪০-এর আলোচনা দ্র.; মুওয়াত্ত্বা মালেক (দামেস্ক : ১৯৯১ খ্রি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭০।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৭৫; নাসাঈ, হা/৪৫৭৯; তাবারাণী আওসাত, হা/৪৬৫১; ছহীহুল জামে‘, হা/২০৯৬, সনদ ছহীহ।
[১৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪১৪৭, ১৫৮৭; আবূ দাঊদ, হা/৩৩৫০; নাসাঈ, হা/৪৫৫৯; ইবনু মাজহ, হা/২২৫৪; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫০১৮; দারাকুৎনী, হা/২৯১৫; মিশকাত, হা/২৮০৮।
[১৮]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৭৫; নাসাঈ, হা/৪৫৭৯; আল-জামে‘ আছ-ছহীহ, হা/৫২১৮।
[১৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪১৭৩; তিরমিযী, হা/১২৪১; নাসাঈ, হা/৪৫৮১; ইবনু মাজাহ, হা/২২৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৭৯১।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৭৯; নাসাঈ, হা/৪৫৮০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৮১০; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫০২৩।
[২১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪১৭৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৭৯১; আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৪৪৮; মিশকাত, হা/২৮২৪।
[২২]. ইসলামের অর্থনীতি, পৃ. ২৪৬।