সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার
মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী
অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন*
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। তাঁর কাছে স্বীয় কু-প্রবৃত্তি ও অসৎ কর্মের অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাই। তিনি যাকে হেদায়াত দান করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ হেদায়াত দান করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। ছালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর, তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবায়ে কিরাম এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর সকল অনুসারীর উপর।*
نُوْرُالسَّنَّةِ وَظُلُمَاتِ الْبِدْعَةِ ‘সুন্নাতের আলো ও বিদ‘আতের অন্ধকার’ শীর্ষক গ্রন্থে আমি সুন্নাতের অর্থ ও আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পরিচয় বর্ণনা করেছি। ‘সুন্নাত’ একটি বিশেষ নে‘মত। তাই সুন্নাত ও সুন্নাতের অনুসারীদের পরিচয় ও মর্যাদা (আমল কবুলের শর্ত) সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি। পাশাপাশি বিদ‘আত ও বিদ‘আতপন্থীদের পরিচয়, বিদ‘আতের প্রকারভেদ, কারণ, বিধান এবং এর ক্ষতিকর দিকসমূহও তুলে ধরেছি। সমসাময়িক প্রচলিত বিদ‘আত, কবর কেন্দ্রিক বিদ‘আত ও তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করেছি। সাথে সাথে তার থেকে তওবাহ করার বিধান আলোচনা করেছি।
নিঃসন্দেহে সুন্নাত এমন এক আলোকবর্তিকা ও জীবনাদর্শ, যা বান্দাকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে এবং সফলতার পথ প্রদর্শন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یَّوۡمَ تَبۡیَضُّ وُجُوۡہٌ وَّ تَسۡوَدُّ وُجُوۡہٌ ‘যেদিন অনেক চেহারা উজ্জ্বল হবে ও অনেক চেহারা কৃষ্ণবর্ণ মলিন হবে অর্থাৎ কালো হবে’ (সূরা আলে ইমরান : ৩/১০৬)। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, تبيض وجوه أهل السنة والائتلاف وتسود وجوه أهل البدعة والتفرق ‘আহলুস সুন্নাহ অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ ব্যক্তিদের চেহারা উজ্জ্বল হবে ও বিদ‘আতপন্থীদের ও বিভক্ত সৃষ্টিকারীদের চেহারা কালো হবে’।[১] আর সুন্নাতের অনুসারীদের অন্তর জীবিত এবং তাদের আত্মা আলোকিত। তারা প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। পক্ষান্তরে বিদ‘আতপন্থীদের অন্তর মৃত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ও তাদের সকল কার্যক্রম অন্ধকারাচ্ছন্ন। আল্লাহ্ তা‘আলা যার কল্যাণ চান তাকে এ অন্ধকার হতে মুক্তি দিয়ে সুন্নাতের আলোকিত পথে নিয়ে আসেন।[২]
আমি আলোচ্য গ্রন্থটি দু’টি অধ্যায়ে ভাগ করেছি এবং প্রত্যেক অধ্যায়ের অধীনে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদ দ্বারা সাজিয়েছি। যেমন,
প্রথম অধ্যায় : সুন্নাতের আলো। এর অধীনে প্রথম পরিচ্ছেদ : সুন্নাতের পরিচিতি, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আহ এর গুণাবলী, তৃতীয় পরিচ্ছেদ : সুন্নাত একটি পূর্ণাঙ্গ নে‘মত, চতুর্থ পরিচ্ছেদ : সুন্নাতের অবন্থান, পঞ্চম পরিচ্ছেদ : সুন্নাত ও বিদ‘আতের অনুসারীর অবস্থান।
দ্বিতীয় অধ্যায় : বিদ‘আতের অন্ধকার। এর অধীনে প্রথম পরিচ্ছেদ : বিদ‘আতের পরিচয়, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : আমল কবুল হওয়ার শর্তাবলী, তৃতীয় পরিচ্ছেদ : দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আতের তিরস্কার বা নিন্দা, চতুর্থ পরিচ্ছেদ : বিদ‘আতের কারণসমূহ, পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বিদ‘আতের প্রকারভেদ, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : বিদ‘আতের শার‘ঈ বিধান ও তার প্রকার, সপ্তম পরিচ্ছেদ : কবরকেন্দ্রিক বিদ‘আতের প্রকার, অষ্টম পরিচ্ছেদ : সমকালীন প্রচলিত বিদ‘আত, নবম পরিচ্ছেদ : বিদ‘আতীর তওবা, দশম পরিচ্ছেদ : বিদ‘আতের কু-প্রভাব ও তার ক্ষতিকর দিক।
আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন এ কাজে বরকত দান করেন। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশই করার তাওফীক দান করেন। এ আমলকে আমার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর বরকতময় আমল হিসাবে গ্রহণ করেন এবং পাঠকদের উপকৃত করেন। তিনিই সর্বোত্তম প্রার্থনা কবুলকারী ও আশ্রয়দানকারী, তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং সর্বোত্তম তত্ত্বাবধায়ক। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ব্যতীত কারো পাপ থেকে বাঁচার ও সৎ আমল করার শক্তি নেই। আল্লাহ তা‘আলার স্বীয় বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর উপর রহমত, বরকত ও তাঁর সকল একনিষ্ট অনুসারীদের উপর।
প্রথম অধ্যায় : সুন্নাতের আলো
প্রথম পরিচ্ছেদ : সুন্নাতের পরিচয়
সুন্নাতের কিছু অনুসারী আছে যারা জামা‘আতবদ্ধ সুদৃঢ় আক্বীদা-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। যাদেরকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ’ বলা হয়। এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে। যথা : (১) আক্বীদা (২) আহলুস সুন্নাহ ও (৩) আল-জামা‘আহ। নিম্নে প্রত্যেকটির পরিচয় দেয়া হল।
প্রথমতঃ ‘আক্বীদা’-এর শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
‘আক্বীদা’-এর শাব্দিক অর্থ বর্ণনায় অভিধানবিদগণ বলেন,
كلمة "عقيدة" مأخوذة من العقد والربط، والشد بقوة، ومنه الإحكام والإبرام، والتماسك والمراصة، يقال: عقد الحبل يعقده: شدّه، ويقال: عقد العهدَ والبيع: شدّه، وعقد الإزارَ: شده بإحكام، والعقد: ضد الحل
‘আক্বীদা শব্দের শাব্দিক অর্থ হল, ‘আক্বীদা শব্দটি ‘আক্বদ মূল ধাতু থেকে গৃহীত। عَقْدٌ শব্দের অর্থ হচ্ছে- বন্ধন, শক্ত করে বাঁধা, মজবুতকরণ, সুদৃঢ়করণ, দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা। যেমন বলা হয়, عقد الحبل يعقده ‘রশিতে গিরা/গিট দিয়েছে বা দিবে’। আরো বলা হয়, عقد العهدَ والبيع ‘চুক্তি ও ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হয়েছে তথা সুদৃঢ় করা হয়েছে’। আরবরা আরো বলে, عقد الإزارَ‘সে শক্তভাবে লুঙ্গি বেঁধেছে’। عقد ‘বন্ধন’ শব্দটি الحل ‘মুক্ত’-এর বিপরীত’।[৩]
‘আক্বীদা’-এর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায শায়খ ড. নাছের আল-আকল বলেন,
العقيدة تطلق على الإيمان الجازم والحكم القاطع الذي لا يتطرق إليه شكٌّ، وهي ما يؤمن به الإنسانُ ويعقد عليه قلبه وضميره، ويتخذه مذهباً وديناً يدين به؛ فإن كان هذا الإيمان الجازم والحكم القاطع صحيحاً كانت العقيدة صحيحة كاعتقاد أهل السنة والجماعة، وإن كان باطلاً كانت العقيدة باطلة كاعتقاد فرق الضلالة
‘আক্বীদা এমন সুদৃঢ় ও সঠিক ঈমানকে বলে, যার মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না এবং তা এমন সুদৃঢ়বন্ধন যার প্রতি মানুষ ঈমান আনতে অন্তরে গেঁথে/বেঁধে নেয় এবং সেটাকেই জীবন পরিচালনার রাস্তা ও দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করে, যে ধর্মের উপর সে চলে। সুতরাং যদি তার সেই সুদৃঢ় বিশ্বাস বিশুদ্ধ হয়, তাহলে আক্বীদাও সঠিক হবে। যেমন- আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আহর আক্বীদা। আর যদি তা ভ্রান্ত হয়, তাহলে আক্বীদাও ভ্রান্ত এবং বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন- বিভিন্ন ভ্রান্ত পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের আক্বীদাও বিশ্বাস’।[৪]
দ্বিতীয়তঃ ‘আহলুস সুন্নাহ’এর পরিচয়
‘সুন্নাহ’-এর শাব্দিক অর্থ বর্ণনায় ইবনু মানযূর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الطريقة والسيرة، حسنة كانت أم قبيحة ‘পথ বা জীবনাদর্শ, তা উৎকৃষ্ট হোক বা নিকৃষ্ট হোক’।[৫]
ক. ইসলামী আক্বীদার ‘উলামায়ে কিরামের পরিভাষায় সুন্নাহ হল,
الهدي الذي كان عليه رسول الله ﷺ وأصحابه: علماً واعتقاداً، وقولاً، وعملاً، وهي السنة التي يجب اتباعها ويُحمد أهلُها، ويُذمُّ من خَالَفها؛ ولهذا قيل: فلان من أهل السنة: أي من أهل الطريقة الصحيحة المستقيمة المحمودة
‘রাসূল (ﷺ) ও তাঁর ছাহাবীগণ যে জীবনাদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করেছেন, জ্ঞান, বিশ্বাস, কথা ও কাজের ক্ষেত্রে সে জীবনাদর্শকে ‘সুন্নাহ’ বলা হয়। এটা এমন এক আদর্শ, যা অনুসরণ করা ওয়াজিব। এ সুন্নাতের অনুসীদের প্রশংসা করা হয়। পক্ষান্তরে এর বিরোধীদের নিন্দা করা হয়। এ জন্যই বলা হয় অমুক ব্যক্তি আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আহর অনুসারী অর্থাৎ সে সুদৃঢ় ও প্রশংসিত আদর্শের অনুসারী’।[৬]
খ. হাফেয ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
السنة هي الطريقة المسلوكة، فيشمل ذلك التمسك بما كان عليه صلّى الله عليه وسلّم هو وخلفاؤه الراشدون: من الاعتقادات، والأعمال، والأقوال، وهذه هي السنة الكاملة
‘সুন্নাহ হল অনুসরণীয় পদ্ধতি, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের বিশ্বাস, আমল ও বক্তব্যসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটাই পরিপূর্ণ সুন্নাত’।[৭]
গ. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
السُّنَّةَ هِيَ مَا قَامَ الدَّلِيْلُ الشَّرْعِيُّ عَلَيْهِ بِأَنَّهُ طَاعَةٌ لِلهِ وَرَسُوْلِهِ سَوَاءٌ فَعَلَهُ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ أَوْ فُعِلَ عَلَى زَمَانِهِ أَوْ لَمْ يَفْعَلْهُ وَلَمْ يُفْعَلْ عَلَى زَمَانِهِ لِعَدَمِ الْمُقْتَضِي حِينَئِذٍ لِفِعْلِهِ أَوْ وُجُودِ الْمَانِعِ مِنْهُ
‘সুন্নাত হল ঐ সকল আমল, যা পালনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অনুগত হওয়ার ব্যাপারে দলীল রয়েছে। চাই তা রাসূল (ﷺ) নিজে পালন করেছেন বা তাঁর যুগে পালন করা হয়েছে অথবা চাহিদা না থাকায় কিংবা অসুবিধার কারণে সে যুগে তিনি নিজে করেনি ও অন্যরাও করেননি। এসবই সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত’।[৮] এই অর্থে সুন্নাত হল, ‘বাহ্যিক ও আভ্যান্তরীণ সকল ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীছের অনুসরণ করা ও মুহাজির-আনছার ছাহাবীদের আদর্শের অনুসরণ করা’।[৯]
তৃতীয়তঃ জামা‘আতের পরিচয়
‘জামা‘আহ’-এর শাব্দিক অর্থ হল, ‘জামা‘আহ’ (جماعة) শব্দটি জামঊন(جمع) মূল ধাতু হতে গৃহীত, যার অর্থ- জমা করা, একত্রিত হওয়া, দল, গোষ্টী, সম্প্রদায় ইত্যাদি। জামা‘আহ (দলবদ্ধ) শব্দটি তাফাররুক (تفرق) (দলাদলি/ বিভক্তি) এর বিপরীত। ইবনু ফারেস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
الجيم والميم والعين أصل واحد يدل على تضامّ الشيء، يقال: جمعت الشيء جمعًا
‘জীম, মীম ও ‘আঈন হরফ দ্বারা গঠিত শব্দ কোন বস্তুর একত্রিত হওয়া বুঝায়’।[১০]
ইসলামী আক্বীদার ‘উলামায়ে কিরামের পরিভাষায় জামা‘আহ
‘জামা‘আহ’ হল, উম্মতে মুহাম্মাদীর পূর্ববর্তী ব্যক্তিবর্গ। যেমন, ছাহাবায়ে কিরাম, তাবি‘ঈ, তাবি‘ তাবি‘ঈ এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসারীগণ, যারা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল (ﷺ)-এর উপর ঐক্যমত পোষণকারী’।[১১]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
الجماعة ما وافق الحق وإن كنت وحدك وفي طريق أخرى فضرب على فخذي وقال : ويحك إن جمهور الناس فارقوا الجماعة وإن الجماعة ما وافق طاعة الله عز و جل قال نعيم بن حماد : يعني إذا فسدت الجماعة فعليك بما كانت عليه الجماعة قبل أن تفسد وإن كنت وحدك فإنك أنت الجماعة حينئذ
‘জামা‘আহ বলে, যা সত্যের অনুকূলে হয়, যদিও তাতে তুমি একা হও। ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নু‘আঈম ইবনু হাম্মাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যখন জামা‘আত ভেঙ্গে যাবে তখন তোমার জন্য ‘আবশ্যক’ হল ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্বেই জামা‘আত যে আদর্শের উপর ছিল সে আদর্শের উপর অটল থাকা, যদিও তুমি একা হও। কেননা সে সময় তুমি একাই জামা‘আত হিসাবে গণ্য হবে’।[১২]
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ’-এর গুণাবলী
(১) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ
هم من كان على مثل ما كان عليه النبي ﷺ وأصحابه، وهم المتمسكون بسنة النبي ﷺ وهم الصحابة، والتابعون، وأئمة الهدى المُتَّبِعون لَهُم، وهم الذين استقاموا على الاتِّباع وابتعدوا عن الابتداع في أي مكان وفي أي زمان، وهم باقون منصورون إلى يوم القيامة
‘তারা যারা রাসূল (ﷺ) ও তাঁর ছাহাবীগণ যার উপর ছিল তার উপর থাকবে এবং রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। তারা হচ্ছে- ছাহাবী, তাবেঈ ও অনুসরণীয় ইমামগণ এবং যারা সকল কালে সকল যুগে সুন্নাতের অনুসরণে সুদৃঢ় ও সকল প্রকার বিদ‘আত থেকে দূরে থাকে। এরাই ক্বিয়ামত পর্যন্ত সাহায্যপ্রাপ্ত জামা‘আহ’।[১৩] তাদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত হিসাবে নামকরণের কারণ হচ্ছে; রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকার কারণে ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীনভাবে তাদের কথা, কাজ ও বিশ্বাসে গ্রহণের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণে’।[১৪] আওফ ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
افْتَرَقَتِ الْيَهُوْدُ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً فَوَاحِدَةٌ فِى الْجَنَّةِ وَسَبْعُوْنَ فِى النَّارِ وَافْتَرَقَتِ النَّصَارَى عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً فَإِحْدَى وَسَبْعُوْنَ فِى النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِى الْجَنَّةِ وَالَّذِىْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَتَفْتَرِقَنَّ أُمَّتِىْ عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً فَوَاحِدَةٌ فِى الْجَنَّةِ وَثِنْتَانِ وَسَبْعُوْنَ فِى النَّارِ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ مَنْ هُمْ قَالَ الْجَمَاعَةُ
‘ইহূদীরা একাত্তর দলে (ফিরক্বায়) বিভক্ত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি দল (ফিরক্বা) জান্নাতী এবং অবশিষ্ট সত্তর দল (ফিরক্বা) জাহান্নামী। নাছারারা (খ্রিষ্টানরা) বাহাত্তর দলে (ফিরক্বায়) বিভক্ত হয়েছে। তন্মধ্যে একাত্তর দল (ফিরক্বা) জাহান্নামী একটি দল (ফিরক্বা) জান্নাতী। সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! অবশ্যই আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে (ফিরক্বায়) বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে একটি মাত্র দল (ফিরক্বা) হবে জান্নাতী এবং অবশিষ্ট বাহাত্তরটি দল (ফিরক্বা) জাহান্নামী। জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তারা কারা? তিনি বললেন, তারা হল জামা‘আত (একতাবদ্ধ দল)’।[১৫]
‘তিরমিযী’র অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) হতে বর্ণিত, ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তারা কারা? উত্তরে তিনি বললেন, مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ ‘যার উপরে আমি ও আমার ছাহাবীগণ আছি’।[১৬]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।
তথ্যসূত্র :
[১]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইজতিমাঊল জুয়ূশিল ‘ইলমিয়্যাহ্ ‘আলা গাযওয়াল মু‘আত্তালা ওয়াল জাহমিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯।
[২]. ইজতিমাঊল জুয়ূশিল ‘ইলমিয়্যাহ্ ‘আলা গাযওয়াল মু‘আত্তালা ওয়াল জাহমিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৮-৪১।
[৩]. ইবনু মানযূর, লিসানুল ‘আরব, ‘আরবী হরফ (دال) ‘দাল’ অধ্যায়, (عين), ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯৬ ‘আঈন’ অনুচ্ছেদ; মুহাম্মাদ ইবনু ইয়া‘কুব আল ফাইরূযাবাদী, আল-কামুসুল মুহীত্ব, পৃ. ৩৮৩ ‘আরবী হরফ (دال) দাল’ অধ্যায়, (عين) ‘আঈন’ অনুচ্ছেদ; ইবনু ফারিস, মু‘জামুল মাকায়ীসিল লুগাহ, পৃ. ৬৭৯ ‘আরবী হরফ দাল’ অধ্যায়।
[৪]. শায়খ ড. নাছের আল-আকল, মাবাহিছু ফী আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃ. ৯-১০।
[৫]. ইবনু মানযূর, লিসানুল ‘আরব, ১৩শ খণ্ড, পৃ. ২২৫ ‘আরবী হরফ নূন’ অধ্যায়, ‘সীন’ অনুচ্ছেদ।
[৬]. মাবাহিছু ফী আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃ. ১৩।
[৭]. জামিঊল ঊলুম ওয়াল হিকাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২০।
[৮]. ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২১তম খণ্ড, পৃ. ৩১৭।
[৯]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৫৭।
[১০]. মু‘জামুল মাকায়িসিল লুগাহ, পৃ. ২২৪ ‘আরবী হরফ জীম’ অধ্যায়।
[১১]. ইবনু আবীল ‘ইয, শরহু আক্বীদাতুত ত্বাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৬৮; আল্লামা মুহাম্মাদ খলীল হিরাস, শারহু আক্বীদাতিল ওয়াসিত্বিয়্যাহ্ লি ইবনি তাইমিয়াহ, পৃ. ৬১।
[১২]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭০ বর্ণনায় করে ইমাম বায়হাক্বীর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন।
[১৩]. ড. নাছের বিন আব্দুল করীম আল-আকল, মাবাহিছু ফী আক্বীদাতি আহলিস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আহ, পৃ. ১৩-১৪।
[১৪]. মুহাম্মাদ ইবনু উছায়মীন, ফাৎহুর রাব্বিল বারিয়্যাহ বি-তাখলিছিল হামুবিয়্যাহ্, পৃ. ১০; ছালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান, শরহুল আল-আক্বীদাতুল ওয়াসিত্বিয়্যাহ, পৃ. ১০।
[১৫]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৯২, সনদ ছহীহ।
[১৬]. তিরমিযী, হা/২৬৪১, সনদ হাসান।