বিদ‘আত পরিচিতি
- ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
(১৫তম কিস্তি)
বিদ‘আতীদের ব্যাপারে আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অবস্থান
ইসলাম সৌহার্দময় শান্তিপূর্ণ জীবন বিধান। পারস্পরিক দয়া ও সহমর্মিতা, সাহায্য ও সহযোগিতা, হৃদ্যতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য ও ভূষণ। ইসলাম পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের যেমন তাকীদ দিয়েছে, তেমনি কতিপয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমাজের সাথে মৈত্রিতা ও শত্রুতা স্থাপনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। যার বাইরে কোন মুসলিম মৈত্রিতা ও শত্রুতা স্থাপন করতে পারে না। ইসলাম যাদের সাথে মৈত্রিতা স্থাপন সমর্থন করে না তাদের মধ্যে বিদ‘আতী গোষ্ঠী অন্যতম। কেননা ইহুদী-খ্রিষ্টান তথা অমুসলিমরা ইসলামের যেরূপ ক্ষতিসাধন করে থাকে, পথভ্রষ্ট বিদ‘আতীরাও এক্ষেত্রে কোন অংশে কম নয়। তাই পথভ্রষ্ট বিদ‘আতীদের সাথে সম্পর্ক কেমন হবে তা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
বিদ‘আতীদের পরিচয়
‘বিদ‘আতী’-এর আরবী রূপ হল اَهْلُ الْبِدْعَةِ, যা যৌগিক শব্দ। اَهْلٌ অর্থ অনুসারী, আর اَلْبِدْعَةُ অর্থ নতুন সৃষ্টি। অতএব সমষ্টিগত অর্থ শরী‘আতের নামে নতুন সৃষ্ট আমলের অনুসারী। বিদ‘আতীদের পরিচয় প্রদানে ইমাম আবূ ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ) (১১৩-১৮২ হি.) বলেন,
من انتحل من هذه الأهواء شيئا فهو صاحب بدعة فلا ينبغي للقوم أن يؤمَّهم صاحبُ بدعة وكذلك أصحاب الخصومات في الدين هم عندنا أهل البدعة، وإن صلّى خلفهم مُصَلٍّ جاز ذلك
‘যারা প্রবৃত্তির কিছু অংশ গ্রহণ করে তারা বিদ‘আতী। সুতরাং একজন বিদ‘আতীর কোন সম্প্রদায়ের ইমামতি করা উচিত নয়। এমনিভাবে যারা দ্বীনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদকারী, তারাও আমাদের নিকট বিদ‘আতী। তবে যদি কোন মুছল্লী তাদের পিছনে ছালাত আদায় করে, তাহলে সেটা বৈধ’।[১]
মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-খুমাইস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, أهل البدعة الذين يفرقون بين الصفات ‘যারা আল্লাহর গুণাবলীর মাঝে পার্থক্য করে তারাই বিদ‘আতী’।[২]
ছালেহ ইবনু আব্দুল আযীয আলে শায়খ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
أهل البدعة الذين شقوا صف الجماعة في باب الأسماء والصفات بل وفي باب القدر قالوا إن الله جل وعلا يقاس بخلقه
‘বিদ‘আতী তারাই, যারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সমূহ এবং তাক্বদীরের ব্যাপারে শ্রেণীবদ্ধ জামা‘আতকে বিভক্ত করে। তারা বলে, নিশ্চয় আল্লাহ জাল্লা ওয়া‘আলা তাঁর সৃষ্টির অনুরূপ’।[৩]
শায়খ ইসমাঈল আছ-ছাবূনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الذين أحدثوا في الدين ما ليس منه ‘যারা দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করে যার কোন অস্তিত্ব নেই (তাদেরকে বিদ‘আতী বলে)’।[৪]
বিদ‘আতীদের সাথে মৈত্রিতা ও শত্রুতার স্বরূপ
আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা ইসলামের মহান একটি মূলনীতি। এটা ছাড়া কারো ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। মু‘আয ইবনু আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ أَعْطَى لِلهِ وَمَنَعَ لِلهِ وَأَحَبَّ لِلهِ وَأَبْغَضَ لِلهِ وَأَنْكَحَ لِلهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ إِيْمَانَهُ
‘যে লোক আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে দান-খায়রাত করে, আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে (দান করা হতে) নিবৃত্ত থাকে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য ভালোবাসে, আল্লাহ তা‘আলার জন্যই ঘৃণা করে এবং আল্লাহ তা‘আলার (সন্তুষ্টির) উদ্দেশ্যে বিয়ে প্রদান করে, সে তাঁর ঈমান সুসম্পন্ন করেছে’।[৫]
জানার বিষয় হল- ইসলামে বিদ‘আতীদের সাথে মৈত্রিতা ও শত্রুতা স্থাপনের মূলনীতি কী?
মুসলিম লেবাসধারী পথভ্রষ্ট বিদ‘আতীরা ইসলামের নামে একদিকে ভ্রান্ত আক্বীদার বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে সমাজে বিভক্তি ও বিধ্বংসী বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা এমন সব আমলের জন্ম দিচ্ছে ও পালন করছে, শরী‘আতে যার কোন অস্তিত্ব নেই। দুঃখজনক হল- তারা ইহুদী-খ্রিষ্টানদের সাথে যে পরিমাণ শত্রুতা পোষণ করে, সুন্নাতের অনুসারীদের সাথে তার চেয়েও বেশি শত্রুতা পোষণ করে থাকে। বর্তমানে তার অসংখ্য প্রমাণও রয়েছে। যেমন, তারা আহলেহাদীছ মসজিদ ও মাদরাসা ভেঙ্গে দিচ্ছে, সেখানে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, জোরে আমীন ও রফঊল ইয়াদাইন করার কারণে মসজিদে থেকে বের করে দিচ্ছে, আহলেহাদীছ আক্বীদার ভাইদেরকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করছে, বিবাহ-শাদী থেকে বিরত থাকছে, গালি-গালাজ করছে, কাফের ফৎওয়া দিচ্ছে, বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করছে। এমনকি তারা আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরামের উপর অতর্কিত হামলা করছে, মিথ্যা মামলা-মোকাদ্দমা করে কারাগারে পাঠাচ্ছে এবং সকল ধরনের মিথ্যাচার ও হয়রানি করছে। ইসলামী সভা-সম্মেলন বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে, প্রশাসনের নিকট মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে দোষী সাব্যস্ত করছে। আহলেহাদীছ আলেমগণের লেখনী কিতাবপত্র কেড়ে নিচ্ছে, ছিড়ে ফেলছে, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও মাটিতে পর্যন্ত পুঁতে ফেলছে। এছাড়া বিভিন্ন হুমকি-ধমকি তো আছেই।
এভাবেই বিদ‘আতীরা সুন্নাতের অনুসারীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। এ প্রসঙ্গে ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) (১১৭৩-১২৫০ হি./১৭৫৯-১৮৩৪ খ্রি.) বলেন,
وَأما الْعَدَاوَة بَبن المتبع والمبتدع فَأمرهَا أوضح من الشمس فَإِن المتبع يعادي المبتدع لبدعته والمبتدع يعادي المتبع لاتباعه... وقد تبلغ عداوات أهل البدع لغيرهم من أهل الاتباع فوق عداوتهم لليهود والنصاري
‘সুন্নাতের অনুসারী এবং বিদ‘আতীর মধ্যকার শত্রুতা সূর্যের চেয়েও বেশি স্পষ্ট। কেননা সুন্নাতের অনুসারী বিদ‘আতীর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে তার বিদ‘আতের কারণে, আর বিদ‘আতী সুন্নাতের অনুসারীর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে তার সুন্নাতের অনুসরণ এবং সঠিক পথে থাকার কারণে’। একটু পরে তিনি আরো বলেন, ‘বিদ‘আতীরা ইহুদী-নাছারার সাথে যে শত্রুতা পোষণ করে, কখনও কখনও তার চেয়েও বেশী শত্রুতা পোষণ করে সুন্নাতের অনুসারীর সাথে’।[৬]
দুঃখজনক হল- যখন দেখা যায় যে, বিদ‘আতীরাই আহলেহাদীছদের মাদরাসা-মসজিদে অতিথির আসন গ্রহণ করছে, সভা-সম্মেলনে একই মঞ্চে বক্তৃতা করছে, তাদেরকে প্রমোট করছে এবং তারা প্রশংসিত হচ্ছে। এহেন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে বিদ‘আতীদের সাথে আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীদের মধ্যে ধর্মীয় ও বৈষয়িক সম্পর্ক কিরূপ হবে, তার স্বরূপ উন্মোচন হওয়া যরূরী।
বিদ‘আতীদের সাথে মৈত্রিতা ও শত্রুতার ধরন
বিদ‘আতীদেরকে বর্জন করা এবং তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা ও বাতিল দলের সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করা ছহীহ আক্বীদার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ আল-ক্বাহত্বানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
فأما من كانت بدعته كفرية أو شركية فهذا يتبرأ منه ويهجر هجرًا نهائيًا وليس له أي موالاة بل البراءة منه كالبراءة من الكافر الأصلي أو المشرك. وأما من كانت بدعته دون ذلك أي من المعاصي والذنوب التي لا تصل إلى حد الكفر أو الشرك فهذه تختلف أيضًا باختلاف الأشخاص والأزمان
‘বিদ‘আতীর বিদ‘আত যদি কুফরী বা শিরকী বিদ‘আত হয়, তাহলে তার সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করতে হবে; তার জন্য কোন প্রকার মৈত্রি থাকবে না। বরং মূল কাফের এবং মুশরিকের সাথে যেমন পুরোপুরি সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করতে হয়, তার সাথেও ঠিক তা-ই করতে হবে। পক্ষান্তরে যার বিদ‘আত পাপ ও গুনাহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে এবং কুফর বা শিরক পর্যন্ত পৌঁছবে না, তার সাথে ব্যক্তি ও সময় অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে’।[৭]
উল্লেখ্য, কারো পাপের কারণে তার নেকীর দিকটা ভুলে গিয়ে তাকে সম্পূর্ণরূপে বয়কট করা যাবে না। বরং তার প্রতি ঘৃণা যদি তাকে পাপ থেকে না ফিরায়, তবে তার ক্ষেত্রে ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হবে। কেননা তাকে বর্জন করলে যদি পাপ ও অনিষ্ট লোপ পায়, তাহলে সেই বর্জন শরী‘আত সম্মত। পক্ষান্তরে পাপী বা সাধারণ জনগণ কেউই যদি পাপ থেকে বিরত না থাকে, বরং পাপ বাড়ে এবং বর্জনকারী দুর্বল হয়, তাহলে সেই বর্জন শরী‘আত সম্মত নয়। সেজন্য কিছু কিছু মানুষকে বর্জন না করে মিলেমিশে চললেই বরং বেশী ফায়দা হয়। নবী করীম (ﷺ) কারো সাথে মিলেমিশে চলেছেন, আবার কাউকে বর্জন করেছেন।[৮]
সুন্নাতের অনুসারীদের কর্তব্য হল- বিদ‘আতীদের সাথে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যার মাধ্যমে তাদের সাথে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়; সেসকল বিষয়ে শত্রুতা প্রকাশ করা যরূরী। যেমন,
১. তাদেরকে সালাম প্রদান না করা
বিদ‘আতীদেরকে সালাম প্রদান করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাদের সাথে শত্রুতা প্রকাশ করা উচিত। কেননা সালামের মাধ্যমে পরস্পর ঘনিষ্টতা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা স্থাপিত হয়ে থাকে। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لَا تَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوْا وَلَا تُؤْمِنُوْا حَتَّى تَحَابُّوْا أَوَ لَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوْهُ تَحَابَبْتُمْ؟ أَفْشُوْا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ
‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ তোমরা ঈমান আনয়ন না করবে। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ তোমরা পরস্পরকে ভালো না বাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কথা বলে দিব না, যা করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে? তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন কর’।[৯]
সালামের প্রসার ঘটানো মুসলিমদের মধ্যে ভালোবাসা স্থাপনের একটি মাধ্যম। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য শরী‘আতে নতুন কিছু উদ্ভাবনের কারণে বিদ‘আতীদেরকে সালাম প্রদান করা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব, যতক্ষণ তারা বিদ‘আতকে অপসন্দ না করে এবং বিদ‘আত থেকে ফিরে না আসে। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
إذَا سَلَّمَ الرَّجُلُ عَلَى الْمُبْتَدِعِ فَهُوَ يُحِبُّهُ قَالَ النَّبِيُّ ﷺ أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إذَا فَعَلْتُمُوْهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ
‘যখন কোন বিদ‘আতীকে সালাম দেয়া হয়, তখন তাকে ভালোবাসাই হয়। যেমনটি নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কথা বলে দিব না, যা করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে? তাহল তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন কর’।[১০] কেউ কেউ বলেছেন, তাদেরকে যেমন আগে সালাম দেয়া যাবে না, তেমিন তারা সালাম দিলে উত্তরও দেয়া যাবে না। এমনকি এ ব্যাপারে কোনরূপ লজ্জাও করা যাবে না।[১১]
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, بئس القوم أهل الأهواء لا نسلم عليهم ‘প্রবৃত্তি পূজারী লোকেরাই কতই না খারাপ। তাদেরকে আমরা সালাম দিই না’।[১২] ইবনু বাত্তাহ (৯১৬-৯৯৭ হি.) বলেন, ‘ইবরাহীম আত-তামীমী ইবরাহীম আন-নাখঈকে অতিক্রম করার সময় তাকে সালাম দিলে তিনি তার সালামের উত্তর দেননি’।[১৩] কেননা ইবরাহীম আত-তামীমী একজন মুরসাল ও মুদাল্লিছ পর্যায়ের বর্ণনাকারী ছিলেন।[১৪]
ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) (৭৭৩-৮৫২ হি.) বলেন, ‘অধিকাংশ আলেমের মতে পাপাচারী ও বিদ‘আতীকে সালাম দেয়া যাবে না’।[১৫] ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৩১-৬৭৬ হি.) বলেন,
وأما المبتدع ومن اقترف ذنبا عظيما ولم يتب منه فينبغي أن لا يسلم عليهم ولا يرد عليهم السلام كذا قال البخاري و غيره من العلماء
‘যারা বিদ‘আতী ও বড় বড় পাপ কাজ সম্পাদনকারী, তারা সেখান থেকে তওবাহ না করা পর্যন্ত তাদেরকে সালাম দেয়া যাবে না এবং তাদের প্রদত্ত সালামের জবাবও দেয়া যাবে না। যেমনটি ইমাম বুখারী ও অন্যান্য আলেমগণও বলেছেন’।[১৬]
২. তাদের মজলিসে না বসা
আল্লাহ তা‘আলা কল্যাণকর ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকা ও তাদের মজলিসে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন[১৭] এবং প্রবৃত্তিপূজারী ও বিদ‘আতীদের মজলিসে বসতে নিরুৎসাহিত করেছেন। অর্থাৎ তাদের জালসা ও মাহফিল, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভায় উপস্থিত হওয়া, তাদের কোন বক্তৃতা শুনা, তাদের দারসে বসা এবং বিদ‘আতী কোন ক্বারীর কুরআন তেলাওয়াত শুনা থেকেও বিরত থাকা তাদের সাথে শত্রুতা পোষণের অন্যতম নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ قَدۡ نَزَّلَ عَلَیۡکُمۡ فِی الۡکِتٰبِ اَنۡ اِذَا سَمِعۡتُمۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ یُکۡفَرُ بِہَا وَ یُسۡتَہۡزَاُ بِہَا فَلَا تَقۡعُدُوۡا مَعَہُمۡ حَتّٰی یَخُوۡضُوۡا فِیۡ حَدِیۡثٍ غَیۡرِہٖۤ
‘নিশ্চয় তিনি তোমাদেরকে কিতাবের মধ্যে নির্দেশ করেছেন যে, যখন তোমরা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি অবিশ্বাস করতে এবং তার প্রতি উপহাস করতে শ্রবণ কর, তখন তাদের সাথে বসবে না, যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথার আলোচনা করে’ (সূরা আন-নিসা : ১৪০)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণের সরদার ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
دخل في هذه الآية كلُّ مُحْدِث في الدين وكلُّ مبتدع إلى يوم القيامة
‘উক্ত আয়াতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত দ্বীনের মধ্যে সকল নতুন সৃষ্টি বিষয় এবং সকল বিদ‘আতী অন্তর্ভুক্ত’।[১৮] তিনি আরো বলেন,
لا تجالس أهل الأهواء فإن مجالستهم ممرضة للقلوب
‘তোমরা প্রবৃত্তি পূজারীদের মজলিসে বস না। কেননা তাদের মজলিসগুলো অন্তরসমূহকে রোগাক্রান্ত করে দেয়’।[১৯] আইয়ূব সাখতিয়ানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
رَآنِى سَعِيدُ بْنُ جُبَيْرٍ جَلَسْتُ إِلَى طَلْقِ بْنِ حَبِيبٍ فَقَالَ لِى : أَلَمْ أَرَكَ جَلَسْتَ إِلَى طَلْقِ بْنِ حَبِيبٍ؟ لَا تُجَالِسَنَّهُ. وَفِيْ رِوَايَةٍ لَا تُجَالِسُهُ فَإِنَّهُ مُرْجِىِءٌّ
‘আমাকে সাঈদ ইবনু জুবাইর দেখেছেন যে, আমি ত্বালক্ব ইবন হাবীবের নিকট বসে আছি। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, তোমাকে ত্বালক্ব ইবনু হাবীবের নিকট বসে থাকতে দেখা গেল। তুমি কখনো তার নিকট বসবে না’। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, তুমি তার নিকট বসবে না, কেননা সে একজন মুরজি‘আহ’।[২০]
হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
لا تجالسوا أهل الهواء ولا تجادلوهم ولا تسمعوا منهم
‘তোমরা প্রবৃত্তি পূজারীদের নিকট বস না, তাদের সাথে ঝগড়া কর না এবং তাদের কোন কথা শ্রবণ কর না’।[২১]
ইয়াহইয়া ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
إذا لقيت صاحب بدعة في طريق فخذ في طريق أخر
‘যখন রাস্তায় কোন বিদ‘আতীর সাথে সাক্ষাৎ হবে, তখন তুমি অন্য রাস্তা ধর’।[২২]
সালাফ ও আহলেহাদীছগণের আক্বীদা বর্ণনা করতে গিয়ে শায়খ ইসমাঈল আছ-ছাবূনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
يبغضون أهل البدع الذين أحدثوا في الدين ما ليس منه ولا يحبونهم ولا يصحبونهم ولا يسمعون كلامهم ولا يجالسونهم ولا يجادلونهم في الدين ولا يناظرونهم
‘তাঁরা (আহলেহাদীছগণ) বিদ‘আতীদের উপর বিদ্বেষ পোষণ করে। কেননা তারা দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করে যার কোন অস্তিত্ব নেই। তাঁরা তাদেরকে ভালোবাসে না, তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে না, তাদের কোন বক্তব্য শ্রবণ করে না, তাদের মজলিসে বসে না এবং দ্বীনের কোন বিষয়ে তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক ও বাহাছ-মুনাযারা করে না’।[২৩]
আল্লাহ তা‘আলা বাণী- وَ اِذَا رَاَیۡتَ الَّذِیۡنَ یَخُوۡضُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِنَا ‘যখন তুমি দেখবে লোকেরা আমার আয়াতসমূহে দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করছে’ (সূরা আল-আন‘আম : ৬৮)-এর ব্যাখ্যায় আল্লামা শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
وَفِيْ هَذِهِ الْآيَةِ مَوْعِظَةٌ عَظِيْمَةٌ لِمَنْ يَتَسَمَّحُ بِمُجَالَسَةِ الْمُبْتَدِعَةِ الَّذِيْنَ يُحَرِّفُوْنَ كَلَامَ اللهِ وَيَتَلَاعَبُوْنَ بِكِتَابِهِ وَسُنَّةِ رَسُوْلِهِ
‘এই আয়াতে যারা বিদ‘আতীদের মজলিসে বসা থেকে দূরে থাকে তাদের জন্য উত্তম দৃষ্টান্ত রয়েছে। কেননা তারা (বিদ‘আতীরা) আল্লাহর কালামের পরিবর্তন আনয়ন করে, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত নিয়ে খেল-তামাশা করে’।[২৪]
শায়খ আব্দুর রহমান ইবনু হাসান আলে শায়খ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
واما أهل البدعة فيجب هجرهم والإنكار عليهم إذا ابتليتم بهم
‘বিদ‘আতের মাধ্যমে যখন (আহলে সুন্নাতদেরকে) কষ্ট প্রদান করে থাকে, তখন তাদেরকে পরিত্যাগ করা ও তাদেরকে থেকে দূরে থাকা ওয়াজিব’।[২৫] ফুযাইল ইবনু ঈয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
من جالس صاحب بدعة لم يعط الحكمة
‘যে ব্যক্তি বিদ‘আতীর মজলিসে বসে, তাকে হিকমত বা প্রজ্ঞা প্রদান করা হয় না’।[২৬]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবুল মুযাফফর মানছূর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আত-তামীমী, আল-ইনতিছারু লি আছহাবিল হাদীছ, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ ইবনু হুসাইন ইবনুল হাসান আল-জীযানী (সঊদী আরব : মাকতাবাতু আযওয়াইল মানার, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৬ খ্রি.), পৃ. ১৭।
[২]. মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-খামীস, ঊছূলুদ দ্বীন ‘ইনদাল ইমাম আবী হানীফা (সঊদী আরব : দারুছ ছামীঈ, তা.বি.), পৃ. ৩০৬।
[৩]. ছালেহ ইবনু আব্দুল আযীয আলে শায়খ, শারহু ‘আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৬০।
[৪]. আবূ ওছমান ইসমাঈল ইবনু আব্দির রহমান আছ-ছাবূনী, আক্বীদাতিস সালাফি ওয়া আছহাবিল হাদীছ (রিয়াদ : দারু ‘আছিমাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৯ হি./১৯৯৮ খ্রি.), পৃ. ২৯৮।
[৫]. তিরমিযী, হা/২৫২১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৬৫৫; মুসতাদরাকু আলাছ ছহীহাইন, হা/২৬৯৪, সনদ হাসান।
[৬]. মুহাম্মাদ ইবনু আলী আশ-শাওকানী, ক্বাত্বরুল অলি ‘আলা হাদীছিল অলি (প্রকাশ স্থান, সংস্থা বিহীন, ১ম সংস্করণ, ১৪৩৫ হি./২০১৪ খ্রি.), পৃ. ১৫৪।
[৭]. মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ আল-ক্বাহতানী, আল-অলা ওয়াল-বারা ফিল ইসলাম (রিয়াদ : দারু ত্বাইয়েবা, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৪১৩ হি.), পৃ. ৩০৮।
[৮]. তাক্বীউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৮তম খণ্ড (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), পৃ. ২০৬; আদ-দুরার আস-সানিইয়্যাহ ফিল আজবিবাতিন নাজদিইয়্যাহ, তাহক্বীক্ব : আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ক্বাসেম (৬ষ্ঠ প্রকাশ, ১৪১৭ হি./১৯৯৬ খ্রি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ৮৩।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৪; মিশকাত, হা/৪৬৩১।
[১০]. আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু মুফলিহ আল-মাক্বদেসী, আল-আদাবুশ শার‘ঈয়্যাহ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় সংস্করণ, ১৪১৯ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫১।
[১১]. মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু সালিম আস-সাফফারীনী আল-হাম্বালী, গিযাউল আলবাব শারহু মানযূমাতিল আদাব (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি.), পৃ. ২০৮।
[১২]. জালালুদ্দীন আস-সুয়ূত্বী, আল-আমরু বিল ইত্তিবা‘ ওয়ান নাহিউ ‘আনিল ইবতিদা‘ (রিয়াদ : দারু ইবনিল ক্বাইয়িম, ১ম সংস্করণ, ১৪১০ হি./১৯৯০ খ্রি.), পৃ. ৮৩।
[১৩]. উবাইদুল্লাহ ইবনু বাত্তাহ আল-হাম্বালী, আল-ইবানাতু আন শার‘আতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াতি ওয়া মুজানিবাতিল ফিরাক্বিল মাযমূমাহ (রিয়াদ : দারুল রায়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৯১।
[১৪]. ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী, তাক্বরীবুত তাহযীব, পৃ. ৯৫।
[১৫]. ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ১৩৭৯ হি.), ১১তম খণ্ড, পৃ. ৪০।
[১৬]. মুহীউদ্দীন আবূ যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারফ আন-নববী, আল-আযকারু মিন কালামি সাইয়িদিল আবরার (রিয়াদ : মাকতাবাতু বাযযার মুছত্বফা আল-বাব, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি.), পৃ. ২৯৪।
[১৭]. সূরা আল-কাহ্ফ : ২৮; আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারু ত্বাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৫২।
[১৮]. মুহিউস সুন্নাহ আবূ মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনু মাসঊদ আল-বাগাভী, মা‘আলিমুত তানযীল (দারুত তাইয়েবা, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০১।
[১৯]. আল-ইবানাতু আন শার‘আতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াতি ওয়া মুজানিবাতিল ফিরাক্বিল মাযমূমাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩৮।
[২০]. দারেমী, হা/৩৯২, সনদ ছহীহ; আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আস-সুন্নাহ (দাম্মাম : দারু ইবনিল ক্বাইয়িম, ১ম সংস্করণ, ১৪০৬ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৩, আছার নং-৬৫৯।
[২১]. হিবাতুল্লাহ ইবনুল হাসান ইবনু মানছূর আল-লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদ আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত মিনাল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ ওয়া ইজমাঈছ ছাহাবাহ (রিয়াদ : দারু ত্বাইয়েবা, ১৪০২ হি.), পৃ. ১৩৩, আছার নং-২৪০।
[২২]. আবূ ইসহাক্ব আশ-শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম (মিশর : আল-মাকতাবাতুজ তিজারিয়াতিল কুবরা, তা.বি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৪।
[২৩]. আক্বীদাতিস সালাফি ওয়া আছহাবিল হাদীছ, পৃ. ২৯৮।
[২৪]. মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ আশ-শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর (দামেস্ক : দারু ইবনি কাছীর, ১ম সংস্করণ, ১৪১৪ হি.), ২য় খ-, পৃ. ১৪৬।
[২৫]. মাজমূ‘আতুর রাসাইলি ওয়াল মাসাইলি, ৪র্থ খ-, পৃ. ৩৭১।
[২৬]. আল-হাসান ইবনু আলী ইবনু খালফ আল-বারবাহারী, কিতাবু শারহিস সুন্নাহ (দাম্মাম : দারু ইবনিল ক্বাইয়িম, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হি.), পৃ. ৬০, আছার নং-১৩০।
প্রসঙ্গসমূহ »:
শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কার