রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৪ অপরাহ্ন

ইসলামী উত্তরাধিকার আইন:  উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা

-ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ*


ভূমিকা

ইসলামী উত্তরাধিকার আইন মূলত মহান আল্লাহ কর্তৃক আসমানী বিধানের আলোকে সাজানো ও রাসূল (ﷺ)-এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাস্তবায়িত এক বাস্তবসম্মত ন্যায়ানুগ ও ইনসাফভিত্তিক বিধান। সামান্য হউক বা বেশিÑ পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনরা যে সম্পদ মৃত্যুর পূর্বে রেখে যাবেন, তাতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও অংশ রয়েছে মর্মে আল-কুরআনে ঘোষণা এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্প হউক বা বেশি হউক, এক নির্ধারিত অংশ’ (সূরা আন-নিসা: ৪/৭)। এ আহ্বান ও নির্দেশনা এমন সময় এসেছে যখন আরবের জাহিলী সমাজে নারীদের সম্পত্তিতে কোন ধরনের অধিকার ছিল না। সর্বপ্রথম সূরা নিসার ১১-১২ আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে সম্পত্তিতে পুরুষের সাথে নারীরও অধিকার ঘোষণার সূত্রপাত হয়। অবশেষে বিদায় হজ্জের আগে উত্তরাধিকারের সর্বশেষ বিধান হিসাবে সূরা নিসার ১৭৬ নং কালালার আয়াতের মাধ্যমে সে বিধানের পরিসমাপ্তি হয়। নিম্নে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচিত হয়েছে।

প্রাক ইসলামী যুগের সমাজব্যবস্থায় উত্তরাধিকার প্রসঙ্গ

সুশৃঙ্খল সমাজ-জীবন সম্পর্কে প্রাচীন আরবদের কোন জ্ঞান ছিল না। ইসলাম পূর্ব যুগে মক্কায় বা বৃহত্তর আরবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বেও কথা জানা যায় না। তাই লেখাপড়ার প্রচলন বলতে গেলে ছিলই না। গোটা কুরাইশ বংশে নবী (ﷺ)-এর আবির্ভাবকালে মাত্র সতেরো ব্যক্তি অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন।[১] এমতাবস্থায় সে যুগে ঐ দেশে আইন পুস্তক বা সংকলন বলে কিছু থাকবে তা কল্পনাও করা যায় না। আরবের সিংহভাগ এলাকারই কোন সুনিয়ন্ত্রিত সরকার ছিল না, তাই সে সব এলাকার অজকের মত কোন আইন পরিষদ বা ঐরূপ আইন প্রস্তুতকারী সরকারি সংস্থার অস্তিত্ব ছিল না, যার মাধ্যমে বিরোধসমূহের মীমাংসা এবং অপরাধীদের শাস্তি বিধান করা যেতে পারে।[২] জাহিলিয়াতের যুগের আইন-কানূন, দিয়াত, উত্তরাধিকার প্রভৃতির অধিকার নিয়ন্ত্রিত ও মূল্যায়িত হতো। কোন্টা হক আর কোন্টা না হক তা নির্ধারণে নিজেদের অধিকার অর্জন এবং যারা অধিকার কেড়ে নিতো তাদের থেকে তা ফিরিয়ে আনতে শক্তিমত্তাই প্রধান ভূমিকা পালন করতো। তারপর এ ব্যাপারে বড় ভূমিকা ছিল নানারূপ গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতির। সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রব্যবস্থার অবর্তমানে ঐগুলোই ছিল তাদের অবলম্বন। কন্যা সন্তানের মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে অধিকার ছিল তখন কল্পনাতীত ব্যাপার। কারণ তারা বিভিন্ন গোত্রে ও বংশে বিভক্ত হয়ে যাযাবর রূপে বসবাস করতো। সামান্য বিষয়ে গোত্রে গোত্রে তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকতো। এ সকল যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ বিজিত পক্ষের নারীদের ধরে নিয়ে বিয়ে করতো। এই জন্যই আরবগণ কন্যা সন্তানের জন্মকে ভয় ও ঘৃণা করতো এবং পুত্র সন্তান জন্মকে পসন্দ করতো।[৩] কারণ পুত্র সন্তান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও যুদ্ধের ময়দানে সাহায্যকারী হতো। পুত্র সন্তানের মতো কন্যা সন্তানের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। এই কারণে আরবগণ কন্যাদেরকে জীবিত কবর দিয়ে হত্যা করতো।[৪] যেখানে কন্যা সন্তানের জন্ম এবং বেঁচে থাকাই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সেখানে পিতা-মাতার পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে অধিকারের তো প্রশ্নই আসে না।

প্রাক-ইসলামী যুগে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার ওয়ারিসদের উপর তৎকালিন সমাজে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বণ্টিত হতো।[৫] বিভিন্নভাবে আরবের জাহেলী পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ফুটে উঠে উত্তরাধিকার প্রসঙ্গের বিভিন্ন ‘মাসায়েল’ গুলোতে। যেখানে নারী বা কন্যা সন্তানকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছিল। বিভিন্ন রেওয়াজ-নীতির প্রচলন ছিল। এ সকল প্রথার অধিকাংশ ছিলো অযৌক্তিক, বৈষম্যমূলক এবং ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার পরিপন্থী। কারণ উত্তরাধিকারী হতে পারতো কেবল যাদের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো যোগ্যতা ছিল।[৬] শুধু মৃতের বংশধররাই যে তার উত্তরাধিকারী হবে তেমন কোনো নিয়ম ছিল না। তারপরও প্রাক ইসলামিক যুগের কিছু প্রথা মুসলিম আইনে গ্রহণ করা হয়। নাবালক বা নারী কিংবা নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত কোন ব্যক্তি মৃতের সম্পত্তির অধিকারী হতে না পারলেও কেবল মাত্র রক্ত সম্পর্কিত পুরুষ আত্মীয়গণই মৃতের সম্পত্তির অধিকারী হত। এদেরকে আসাবাত বা ‘স্বগোত্রীয় ওয়ারিসী’ বলা হত। এরা মাথাপিছু অংশ পেত। স্বগোত্রীয় ওয়ারিসী নীতির প্রধান বৈশিষ্ট ছিল ‘নিকটতর দূরবর্তীকে বঞ্চিত করে’। ইসলামী আইনে ‘নিকটতর দূরবর্তীকে বঞ্চিত করে’ নীতিটি গ্রহণ করা হয়েছে কেবল রক্ত সম্পর্কিত পুরুষ আত্মীয়গণের মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার নীতিটি বাদ দিয়ে প্রধানত নিম্নরূপ পরিবর্তন করা হয়েছে, ক. নাবালক, অজাত শিশু নারী এবং নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত, ব্যক্তিকে ওয়ারিশ করা হয়েছে। খ. ওয়ারিসগণকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন- ১. অংশিদার ২. অবশিষ্টভোগী এবং ৩. দূরবর্তী আত্মীয়।[৭]

ইসলাম আসার পূর্বে মহিলার প্রতি এই অবিচার করা হতো যে, স্বামী মারা গেলে তার (স্বামীর) পরিবারের লোকেরা সম্পত্তি ও সম্পদের মতো মহিলারও জোরপূর্বক উত্তরাধিকারী হয়ে বসতো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! জোর জবরদস্তি করে তোমাদের নিজেদেরকে নারীদের উত্তরাধিকারী গণ্য করা বৈধ নয়’ (সূরা আন-নিসা: ১৯)। এ ভাবে অজ্ঞতার যুগে পিতার মৃত্যুর পর তার পুত্র মাতার উত্তরাধিকারী হতো। সে নিজেই তাকে বিয়ে করতে পারতো। অথবা নিজ ইচ্ছানুসারে যে কোনো লোকের নিকট বিয়ে দিতে পারতো, আর সে তার বিয়ে বন্ধও করতে পারতো। মাতা অন্য স্বামী গ্রহণ করতে চাইলে পুত্রকে মুক্তিপণ দিতে হতো।[৮] এমনকি নিজ ইচ্ছায় তার সম্মতি ছাড়াই তাকে বিয়ে করে নিতো অথবা তাদের কোনো ভাই ও ভাইয়ের পুত্রের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিতো। এমনকি সৎপুত্রও মৃত পিতার স্ত্রী (সৎ মা) কে বিবাহ করতো।[৯] কন্যার উত্তরাধিকার, দেনমোহরের অধিকার, কিংবা ত্বালাক্ব কোনো কিছুতে মতামত প্রদান ও কোনো অধিকারেরও স্বীকৃতি ছিল না। এক কথায় প্রাক ইসলামী যুগে উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার থেকে নারী বঞ্চিত ছিল। সে সমাজে নারীর কোন ধরনের অধিকার ছিল না; সামগ্রিকভাবে নারীদের অবস্থা ছিল শোচনীয়।[১০] কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাদের অবস্থা কীরূপ হতো সে প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বলা হয়েছেÑ ‘তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তাদের মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানিহেতু সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে।... সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দিবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কতো নিকৃষ্ট’ (সূরা আন-নাহল: ৫৮-৫৯)।

কন্যা সন্তানের ব্যাপারে সে সময়ের আরব সমাজের মনোভাব ছিল অত্যন্ত জঘন্য। তারা কন্যা সন্তানকে পরিবারের জন্য বোঝা মনে করতো। কাজেই তারা তাকে মেরে ফেলাই শ্রেয় মনে করতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেনÑ ‘তোমাদের সন্তানদের দারিদ্রের ভয়ে হত্যা করবে না। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মহাপাপ’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ৩১)। জাহিলি যুগের মিরাসী পদ্ধতিতে নারীগণ তাদের সম্পর্কের আত্মীয়গত উত্তরাধিকার পেতেন না। সাধারণত নিকটতম পুরুষগণ উত্তরাধিকার লাভে সমর্থ হতেন। কন্যা, শিশু, দুর্বল এবং অল্প বয়ষ্কদের কোনো উত্তরাধিকার স্বীকৃত ছিল না। অথচ এমন কিছু লোক উত্তরাধিকারী হতো, আল-কুরআনে উপর্যুক্ত বিধান যাদের মীরাস থেকে বঞ্চিত করেছে। মুহাম্মদ (ﷺ) নিজে এই দিকে মনযোগ প্রদান এবং তা দমন না করা পর্যন্ত এই নিদারুণ ঘৃণ্য প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো।[১১]

জাহিলিয়াতের যুগে আরবদেশে তিনটি সূত্রে উত্তরাধিকার স্বীকৃত ছিল। আর তা হলো-

১. বংশধর হওয়া

জাহেলী যুগে বংশধর হওয়া ছিল উত্তরাধিকার সম্পত্তির হকদার হওয়ার প্রধান মানদণ্ড। তা পুরুষ বংশধরদের জন্য নির্দিষ্ট ও সীমিত ছিল, যারা ঘোড়ার সাওয়ার হতে পারতো, শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে পারতো এবং গণীমতের মাল নিয়ে আসতে সক্ষম হতো। মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের মালিকানা সে সকল সবল ও শক্তিশালী পুরুষলোকদের জন্যই নির্ধারিত ছিল। পক্ষান্তরে ইসলামও বংশধরদের জন্য উত্তরাধিকারী হওয়ার নীতি ঘোষণা করেন, যেমনটি জাহেলি যুগে বর্তমান ছিল। মহান আল্লাহ বলেন, وَ لِکُلٍّ جَعَلۡنَا مَوَالِیَ  مِمَّا تَرَکَ الۡوَالِدٰنِ وَ الۡاَقۡرَبُوۡنَ ‘এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন যে সম্পত্তি রেখে যায় আমি তার প্রত্যেকটির হকদার নির্দিষ্ট করে দিয়েছি’ (সূরা আন-নিসা: ৩৩)। শাইখ তানতাবী জাওহারী (১৮৭০-১৯৪০ হি.) এ আয়াতের শাব্দিক ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন: ‘(প্রত্যেক) পুরুষ এবং নারীর জন্য (আমি উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে দিয়েছি)। তারা চাচার সন্তান অথবা ভাই অথবা অন্যান্য আত্মীয়বর্গ। (পিতা-মাতা এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজন যা রেখে যায়) তারা তাদের পরিত্যক্ত সে সব সম্পদের অধিকারী হয়ে থাকে’।[১২] এখানে নারী-পুরুষ এবং পুত্র-কন্যাসহ সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়। যা ছিল জাহেলি যুগে খণ্ডিত পর্যায়ে। জাহেলি যুগের প্রচলিত প্রথা ভেঙ্গে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে নারীদের অধিকার প্রদানের বাণী নিয়ে ইসলাম আগমন করে। এখানে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ হলো মাওলা ও মাওয়ালী। যেখানে শক্তিমত্তা ও শারীরিক সক্ষমতাই সম্পদের হকদার হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা নয়। ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিক চেতনা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠে। সুন্দর এক নতুন সমাজ বিনির্মাণের মহান চেতনায় নারী-পুরুষ সকলের অধিকারের ঘোষণা আসে।[১৩] মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থাপনার এ সুনির্দিষ্টকরণ প্রক্রিয়া মহান প্রভুর পক্ষ থেকে দেয়া এক নির্দেশনা। যাতে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কাউকে বিশেষ কোন কারণে বঞ্চিত করা হয়নি।

২. পালকপুত্র বা মুখ ডাকা পুত্র

জাহেলী যুগে অন্য ব্যক্তির পুত্রসন্তানকে নিজের মুখ-ডাকা পুত্র বা পালিত পুত্র বানাবার রেওয়াজ ব্যাপকভাবে ছিল। ফলে সে ঔরসজাত পুত্রের মতোই উত্তরাধিকারী হতো। ইসলাম জাহেলি যুগের মুখ-ডাকা সন্তানের উত্তরাধিকার নাকচ করে দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের মুখ-ডাকা পুত্রকে তোমাদের (প্রকৃত) পুত্র বানাননি’ (সূরা আন-নিসা: ৩৩)।

৩. চুক্তিভিত্তিক উত্তরাধিকার

মৈত্রী ও চুক্তি- একজন অপরজনকে বলতো, আমার রক্ত তোমার রক্ত বা আমার ধ্বংস তোমার ধ্বংস। অর্থাৎ আমার রক্তপাত হলে তোমার রক্তপাত হবে। আর তুমি আমার উত্তরাধিকারী হবে, আমি তোমার উত্তরাধিকারী হবো। আমার কারণে তোমাকে খোঁজ করা হবে এবং তোমার কারণে আমাকে তালাশ করা হবে। এভাবে দুইজন লোক পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হলে পরে একজন অপরজনের পূর্বে মারা গেলে জীবিত মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে তাই পেতো যা শর্ত করা হতো। ইসলাম জাহেলি যুগের ন্যায় চুক্তিভিত্তিক উত্তরাধিকার প্রথমে স্বীকার করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আল্লাহ যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি ও ওয়াদা রয়েছে তাদের অংশ তোমরা তাদের দাও।[১৪] এভাবে তারা ইসলামী যুগেও পরস্পরের পরিত্যক্ত মোট সম্পদের এক ষষ্ঠাংশের উত্তরাধিকারী হতো। এ অংশ প্রদানের পর অন্য উত্তরাধিকারীরা অবশিষ্ট সম্পদ থেকে তাদের প্রাপ্য লাভ করত। এর পর এ নিয়ম রহিত করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং রক্ত সম্পর্কের অধিকারীরা একে অপরের অধিক নিকটবর্তী’ (সূরা আল-আযহাব: ৬)। এরই মাধ্যমে জাহেলি যুগের মীরাসী পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে এবং নতুন আঙ্গিকে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন নতুনত্ব লাভ করে।

প্রাক ইসলামী যুগে উত্তরাধিকার আইন প্রসঙ্গ

ইসলামপূর্ব যুগে মক্কায় লেখাপড়ার প্রচলন বা গোটা আরবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে গেলে ছিলই না। রাসূল (ﷺ)-এর আবির্ভাবকালে মাত্র সতেরো ব্যক্তি অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন।[১৫] সুতরাং বলাই যায় ঐ দেশে আইন পুস্তক বা সংকলন বলে কিছুই ছিল না। জাহেলী যুগের কোন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির বলে কথিত কিছু বাণী, অভিমত ও বিধান অথবা দক্ষিণ আরবের ইসলাম পূর্ব যুগের রাজা-বাদশাহদের ব্যবসা ও রাজস্ব সংক্রান্ত বিধান বা ব্যবসা-বাণিজ্য ও হত্যা সংক্রান্ত বিধি-বিধান কিছুটা থাকলেও ঐ গুলোকে সাধারণত আমরা আইন বলতে যা বুঝে থাকি ঠিক ঐরূপ আইন বলা চলে না। ঐ গুলো বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সাময়িক বিধান মাত্র।[১৬] আইন-কানুন তাদের বিভিন্ন জনপদ জাতি-গোষ্ঠীর রঈসদের অভিমত অনুসারে তৈরি হতো।[১৭] আরবদের মধ্যে হক বা অধিকার বলতে বুঝাতো শক্তিমানের বাহুবল ও অধিকার; যার থাকতো অস্ত্রশস্ত্র ও লোকবল, যা প্রয়োগ করে সে তার স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণে এবং অত্যাচার অবিচারের সম্মুখীন হলে আত্মরক্ষায় পরঙ্গম ছিল। এই শক্তির ভিত্তিতেই জাহিলিয়াতের যুগের আইন-কানুন, দিয়াত, উত্তরাধিকার প্রভৃতির অধিকার নিয়ন্ত্রিত ও মূল্যায়িত হতো।[১৮] যুল-মাজাসিদ নামে মশহূর ‘আমির ইবনে জুশাম ইবনে গানাম ইবনে হাবীব সর্বপ্রথম বিধান দিয়েছিলেন কন্যা সন্তানদেরকে উত্তরাধিকার প্রদানের, অথচ আরবদের মধ্যে কেবল পুত্র সন্তানদেরকেই উত্তরাধিকার প্রদানের প্রচলন ছিল। আর যুল মাজাসিদ সর্বপ্রথম কন্যা সন্তানদেরকে পুত্র সন্তানদের অর্ধেক হারে উত্তরাধিকার প্রদানের বিধান প্রবর্তন করেন। পরে ইসলাম তার এ মতকে বহাল রাখে।[১৯]

ইসলাম পূর্ব যুগে তাদের মত করে বিচার ব্যবস্থা চালু হয় জুরহুমী যুগে মক্কা শহরে; বিখ্যাত হরবে ফিজারের পর এটি পুনর্জীবিত হয়। এ সব বিচার মীমাংসার বিষয় বস্তুর মধ্যে অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার বা তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা, নিজেদের অসমীচীন গর্ব প্রকাশ, উত্তরাধিকার, কুয়ো বা ঝর্ণাধারা সংক্রান্ত বিরোধ থেকে শুরু করে নরহত্যা পর্যন্ত সবকিছুই থাকতো।[২০] জাহেলী যুগে বংশের ভিত্তিতে নারী ও শিশু  উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করত না। যুদ্ধ ও গণীমতের মাল আহরণ করতে সক্ষম পুরুষরাই উত্তরাধিকারী হত। সে কালে যারা শত্রুর বিরেুদ্ধে বা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ধরতে পারত তারাই উত্তরাধিকার লাভ করত। নারীরা অস্ত্র ধরতে পারতনা। বিধায়, তারা উত্তরাধিকার পেত না।[২১] প্রাক ইসলামিক আরবে নারীর কোন নিজস্ব সত্ত্বা ছিল না। পুরুষের ভোগের সামগ্রী হিসাবে গণ্য হত নারী। তবে কোন আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কারো কাছ থেকে দান, ওয়াসিয়াত বা বিক্রয় প্রক্রিয়ায় সম্পত্তি পেতে পারত।[২২] কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে নারী কোন কিছুই পেত না।

নবী যুগের আইন, বিচার ব্যবস্থা ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গ

৬১০ খৃষ্টাব্দে সর্বশেষ প্রত্যাদেশ নিয়ে রাসূল (ﷺ) নবুয়াত লাভের পর থেকে আরবে তথা গোটা বিশ্বে এক নবযুগের সূচনা হয়। রাসূল (ﷺ)-এর নবুয়্যাত লাভের পরও বিবাহ, ত্বালাক্ব ও উত্তরাধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাহেলী যুগের রীতি চালু ছিল। মক্কায় উত্তরাধিকার আইনের রাসূল (ﷺ) কর্তৃক কোন নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে রাসূল (ﷺ)-এর মদীনায় হিজরতের পর তিনি কেবল মুসলিমদেরই নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ইয়াসরিববাসীরই নেতা এবং প্রধান রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন। মদীনার স্বল্প পরিসরে হলেও তিনি ছিলেন ঐ নগর রাষ্ট্রের প্রধান শাসক এবং বিচারক। মুসলিমদের তো বটেই অমুসলিম আহলে কিতাবদের মোকাদ্দামাসমূহের ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত আইন (পার্সোনাল ল’) অনুসারে ফায়সালা দিতেন। তাই অধিকাংশ ঐতিহাসিকই এমন অন্তত দু’টি মামলার কথা উল্লেখ করে থাকেন, যেগুলোতে নবী (ﷺ) তাওরাতের বিধান অনুসারে ইয়াহূদীদের মামলা নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন।[২৩] তাফসীরে জাসসাসের বর্ণনায় এসেছে-

ইবনে জুরাইজ বলেন, আমি ‘আত্বা (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি এ বিষয়টি অবহিত যে, রাসূল (ﷺ) মানুষকে বিয়ে, ত্বালাক্ব কিংবা উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের মধ্যে পূর্ব থেকে প্রচলিত রীতি-নীতির উপরই জীবন-যাপন করতে অনুমতি দিয়েছিলেন? তিনি বললেন এটাই আমরা জেনেছি।[২৪]

উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের ভিত্তি হিসাব কাজ করত পরস্পরিক চুক্তি[২৫] এবং কাউকে পালকপুত্র হিসাবে গ্রহণ করা। ইসলামের আগমনের পরও কিছুদিন যাবত এ নিয়মইে বিদ্যমান ছিল। পরে তা ‘রক্ত সম্পর্কের উত্তরাধিকারীরা একে অপরের অধিক নিকটবর্তী’ এ আয়াতের মাধ্যমে রহিত করা হয় (সূরা আল-আহযাব: ৬)।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।

তথ্যসূত্র :
[১]. ফুতুহুল  বুলদান, (ঢাকা: ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, ১৯৮২), পৃ. ৪৮৫।
[২]. ইসলামী আইন ও আইন বিজ্ঞান, ৩য় খণ্ড, (ঢাকা: ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, ২০১৯), পৃ. ১২৬।
[৩]. আব্দুল খালেক, নারী ও সমাজ, (ঢাকা: ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৪), পৃ. ১৭।
[৪]. Rustum and Zurayk, History of the Arabs and Arabic Culture (Beirut, 1940), p. 36.
[৫]. মোহাম্মদ মজিবুর রহমান, মুসলিম পারিবারিক আইন পরিচিতি (ঢাকা: কামরুল বুক হাউজ, ২০০২), পৃ. ১৫৬।
[৬]. ইমামুদ্দীন ইসমাইল, ইবনে কাছীর: তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (মিশর: দারুত তাকওয়া লিত-তুরাছি, ১৯৭৮), পৃ. ৫৩১।
[৭]. অধ্যক্ষ মো: আলতাফ হোসেন, ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন সহায়িকা, (ঢাকা: সিটি ল’ বুকস, ২০০৭), পৃ. ৩১।
[৮]. Said Abdullah Seif Al-Hatimy, Woman in Islam (Lahore: Islamic Publication Ltd. 1879), p. 15.
[৯]. আব্দুল হামিদ ফাইযী আল মাদানী, ফারায়েজ শিক্ষা, (ঢাকা: তাওহিদ প্রেস এন্ড পাবলিকেসন্স, ২০১১), পৃ-৭; ড. মোস্তফা আস সাবায়ী, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, বাংলা অনু. আকরাম ফরুক (ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ১৯৯৮), পৃ. ১৬।
[১০]. সৈয়দ আমীর আলী, দ্য স্পিরিট অব ইসলাম (কলিকাতা: মল্লিক ব্রাদার্স, ১৯৯৫), পৃ. ৩২২।
[১১]. ‘This revolting custom prevailed extensively until it was suppressed by Muhammad peace be on him’. O'Leary, De Lacy, Arabia Before Muhammad, (London: 1927), p. 202.
[১২]. শায়খ তানতাবী জওহারী, আল-জাওয়াহির ফী তাফসীরিল কুরআনিল কারীম, ৩ খণ্ড  (বৈরুত: দারু ই্হইয়াইত্ তুরাসিল আরবি, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৯১), পৃ. ৩৮।
[১৩]. সূরা আন-নিসা: ৩৩।
[১৪]. তদেব।
[১৫]. ফুতুহুল বুলদান (ঢাকা: ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮২), পৃ. ৪৮৫।
[১৬]. ড. জাওয়াদ আলী, আল-মুফাস্সাল ফী তারিখিল আরব কাবলাল ইসলাম (বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত, ১৯৯৩), ২য় সংস্করণ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৯-৪৭০।
[১৭]. ‘রঈস’ শব্দের অর্থ গোত্র প্রধান।
[১৮]. সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী আইন ও আইন বিজ্ঞান (ঢাকা: ইফাবা, ২০১২), ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৬।
[১৯]. মুহাম্মদ ইব্ন হাবীব, আল মুহাব্বার, পৃ. ২৩৬।
[২০]. তারীখে ইয়াকূবী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৯।
[২১]. আব্দুর রহিম, মুহামেদান জুরিস প্রুডেন্স (১৯৬৩),১৫; এম হাবিবুর রহমান, “দি রোল অব কাস্টমস ইন দি ইসলামিক ল অব সাকসেশন”, ইসলামিক এন্ড কমপ্যারেটিভ ল কোয়াটারলি, খণ্ড ৮, নং ১ দিল্লী, মার্চ ১৯৮৮, পৃ. ৪৮।
[২২]. মাওলানা আব্দুর রহিম, নারী, (ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০০৫), পৃ. ১২।
[২৩]. প্রথম মোকাদ্দামার জন্যে দেখুন: সহীহ বুখারী, ইবনে হিশাম, পৃ. ৯৩-৯৫; আবু দাউদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫২; মাসউদী আততাম্বীহ, পৃ. ২৪৭। দ্বিতীয় মোকাদ্দমার জন্যে দেখুন: তাফসীর তাবারী, ২৭ খ., পৃ. ৪৪-৫০; বুখারী, মুসলিম, আবুদাউদ, ইবনে মাজাহ, নাসাঈ, দারেমী এবং মুসনাদে আহমদ হাম্বলেও ঘটনাটি বর্ণনা রয়েছে।
[২৪]. আবু বকর আহমাদ ইবনে আলী আর রাযী আল-জাস্সাস, আহকামুল কুরআন, ১১শ খণ্ড (লেবানন: দারুল কুতুল ইলমিয়্যা, ১৯৭৮) পৃ. ৯০।
[২৫]. ‘আর যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ তাদের অংশ দিয়ে দাও’। দ্র.: সূরা আন-নিসা: ৩৩। এ আয়াত সম্পর্কে শায়বান (রাহিমাহুল্লাহ) কাতাদার এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, জাহেলী যুগে এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তির সাথে এ কথা বলে চুক্তি করত যে, আমার রক্ত যেন তোমার রক্ত এবং আমার সম্মানহানি যেন তোমার সম্মানহানী। আমি তোমার উত্তরাধিকারী হব। তুমি আমার উত্তরাধিকারী হবে। এভাবে তারা চুক্তিবদ্ধ হত। দ্র.: ইসলামী ফিকহ বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, (ঢাকা: বাংলদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার, ২০১৬), পৃ. ৪৯৭।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিধি-বিধান
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
তাক্বওয়াই মুক্তির সোপান (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুর রশীদ
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
আল-কুরআন এক জীবন্ত মু‘জিযা - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় (শেষ কিস্তি) - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির

ফেসবুক পেজ