সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৪:৪০ অপরাহ্ন

ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ

-ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন*


(২য় কিস্তি)

নেতৃত্বের শর্তগুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা

১). মুসলিম হওয়া

কোন মুসলিম জামা‘আতের আমীর হতে গেলে তাকে মুসলিম হতে হবে; কোন অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামী জামা‘আতের আমীর হতে পারে না। এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ’র বিধান সুস্পষ্ট। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন :

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ

‘হে, যারা ঈমান এনেছ! আল্লাহকে মান্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর আর তোমাদের মধ্য থেকে যারা নির্দেশ দানের অধিকারী তাদের’ (সূরা আন্-নিসা : ৫৯)।

উপরিউক্ত আয়াতে নির্দেশদাতা “তোমাদের মধ্য থেকে” অর্থাৎ মুসলিমদের মধ্য থেকে হতে হবে- এ ব্যাপারে আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেছেন :

وَ لَنۡ یَّجۡعَلَ اللّٰہُ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ  سَبِیۡلًا

“আল্লাহ তা‘আলা কখনো কাফেদেরকে মুমিনদের উপর (বৈধ) কর্তৃত্ব দিবেন না (সূরা আন্-নিসা : ১৪১)।”

আহ্লে সুন্নাহ ওয়াল-জামা‘আতের সাধারণ নীতি এর উপরই প্রতিষ্ঠিত। সালাফে ছালেহীনের (ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে‘ তাবেঈ) সর্বোৎকৃষ্ট তিন যুগে কেউ মুসলিমদের ভূখণ্ডে কোন কাফিরের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বৈধতার কথা বলেননি, লিখেননি এবং এ জাতীয় কিছু চর্চাও হয়নি। কোনো যুগেই কোনো গ্রহণযোগ্য আলেম মুসলিমদের উপর কাফেরের নেতৃত্বের বৈধতার কথা বলেননি। মুসলিম জামা‘আতের নেতৃত্ব তা রাষ্ট্রীয়ই হোক বা সামাজিক, তা শুধুমাত্র দুনিয়াবী ও বৈষয়িক একটি পদ নয়; বরং সেটি একটি দ্বীনি মহান দায়িত্ব। কালেমাহ্’র পর ইসলামের প্রথম স্তম্ভ (রুকন) ছালাতের (নামাযের) জামা‘আতের ইমামত করার প্রাথমিক যোগ্যতা যার নেই, সেই অমুসলিমের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রীয় জামা‘আতের ইমামত বা নেতৃত্ব করার কল্পনা অবান্তর। এ বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনার জন্য এ পরিসর যথেষ্ট নয়। ইতঃপূর্বে ইমামত ও খিলাফত প্রসঙ্গে আল্লামাহ্ ক্বাযী ইবনু খালদূন ও ইমাম ক্বাযী আল-মাওয়ার্দীর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, 

"إنه نِيابةٌ عن صاحبِ الشريعةِ في حِفظِ الدينِ وسِياسةِ الدُنيا"

“খিলাফত ও ইমামত হলো দ্বীন রক্ষা ও দুনিয়ার শাসনের জন্য শরী’আত দাতা (নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম))-এর প্রতিনিধিত্ব।”[১] সুতরাং দ্বীন রক্ষা, দুনিয়ার শাসন ও নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিনিধিত্ব একজন অমুসলিমের দ্বারা কীভাবে সম্ভব? 

২). পুরুষ হওয়া

ইসলামী রাষ্ট্রের বা ইসলামী দলের সর্বোচ্চ নেতাকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে। ইসলামী বিদ্যার গ্রহণযোগ্য ইমামগণের সবাই এ পদের জন্য পুরুষ হওয়াকে আবশ্যক বলে উল্লেখ করেছেন। সর্বোৎকৃষ্ট তিন যুগে (ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে‘ তাবেঈ) এমনকি তাদের পরেও মুসলিম ভূখণ্ডে কোনো নারীর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বৈধতার কথা কেউ বলেননি। বিভিন্ন কারণে ও পরিস্থিতিতে এ জাতীয় ঘটনা কোথাও কোথাও ঘটেনি তা নয়; কিন্তু সেটি ইসলামী শরি‘আত  মোতাবেক শুদ্ধ- এমন কথা কেউ বলেননি। অশুদ্ধতা ও অবৈধতা সত্ত্বেও কখনো কখনো পরিস্থিতির খাতিরে সাময়িকভাবে এজাতীয় কিছু বিষয় মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়েছে মাত্র- এর বাইরে আর কিছু নয়। নারীর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব গ্রহণ কুরআন ও হাদীছের স্পষ্ট দলীলে নিষিদ্ধ। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন :

اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوۡنَ عَلَی النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰہُ بَعۡضَہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ

“পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বকারী, যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে পরস্পরের উপর (সৃষ্টিগত ভাবেই) শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন (সূরা আন্-নিসা : ৩৪)।” হাদীসে এসেছে :

عَنْ أَبِيْ بَكْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُم امْرَأَةً

আবূ বাকরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে জাতি কোন মহিলাকে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের দায়িত্ব দিবে তাদের কখনো মুক্তি মিলবে না।”[২]

হাদীছটির বর্ণনাকারী আবূ বাকরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ঐতিহাসিক ‘জামাল’-এর হাঙ্গামার সময় (৩৬ হি.) মা আয়েশাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে লক্ষ্য করে নারীর ময়দানে নেতৃত্ব করার অবৈধতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন এবং মা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর পক্ষ অবলম্বন করতে পারেননি শুধুমাত্র নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নারী নেতৃত্বের বিষয়ে উপর্যুক্ত নেবিাচক উক্তির কারণে।[৩] আর ইলমে হাদীছের অধিকাংশ ইমাম এই অর্থেই হাদীছটি বুঝেছেন ও তাঁদের গ্রন্থাবলীতে শিরোনাম করেছেন। হাদীছটির পাদটীকায় প্রখ্যাত ব্যাখ্যাদাতাগণের হাওয়ালাসমূহ দ্রষ্টব্য।

ইমাম ইবনু হাযম এ বিষয়ে বলেন,

وأن يَكونَ رَجلًا، لِقول رَسولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لا يُفلِح قومٌ أسنَدوا أمرَهم إلى امرأةٍ

“তাঁকে পুরুষ হতে হবে, কেননা রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন :  ‘সেই কওমের মুক্তি নেই যারা তাদের (জাতীয় সর্বোচ্চ) নির্বাহী দায়িত্ব কোন নারীর হাতে অর্পণ করে।”[৪] ইমাম ইবনু কাইয়েম আল-জাউযিয়্যাহ (মৃ. ৭৫১হি.) এক্ষেত্রে উল্লেখ করেন :

هذا إنّما هُو في الوِلايةِ والإمامةِ العُظمَى والقَضاءِ، وأمّا الرِوايةُ والشَهادةُ والفُتيا والإمامةُ (للنساء) فلا تَدخُل فِي هذا. ومِن العَجبِ أنّ مَن خالفَ هذه السُنّةَ (في إمامة النساء للنساء) جَوّز للمَرأةِ أن تَكونَ قاضِيةً تَلي أمورَ المُسلمينَ، فكيفَ أفْلَحوا وهِي حاكِمةٌ عَليهِم ولَم تُفلِحْ أخَواتُها من النساءِ إذا أمّتْهُنَّ؟

“এটি (নিষেধাজ্ঞা) হলো মূলত সর্বোচ্চ দায়িত্ব ও নেতৃত্ব এবং বিচারকার্যের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু রেওয়ায়াত করা (হাদীস বর্ণনা), সাক্ষ্য দেয়া, ফত্ওয়া দেয়া এবং ছালাতে (মহিলাদের) ইমামত করা ইত্যাদি এর (নিষেধাজ্ঞার) অন্তর্গত নয়। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, যারা এই সুন্নাতের (হাদীসের) বিরোধীতা করছে তারা মহিলার ক্বাযী (বিচারক) হওয়ার বৈধতা দিচ্ছেন, যিনি নাকি মুসলিমদের এই গুরু-দায়িত্ব বহন করবেন! তারা (মহিলা বিচারকরা) কীভাবে মুসলিমদের ফয়ছালাহ’র দায়িত্ব পালন করে মুক্তি পাবেন, যদি তাদের অপর বোনেরা মহিলাদের ইমামতি করে মুক্তি না পান?[৫]

প্রখ্যাত আহলে হাদীস নেতা আল্লামাহ্ আব্দুল্লাহেল কাফী সাহেব এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন : “ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক পুরুষ হওয়া আবশ্যক, নারী সর্বাধিনায়কত্বের পদ লাভ করিতে পারিবেন না...।”[৬]

বলা বাহুল্য, ধর্মীয় বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালন ও তা সমাজে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ইসলামী জামা‘আতের অন্যতম মূল লক্ষ্য। কোন মহিলার জন্য ইসলামী জামা‘আতের ঊর্র্ধ্বতন নেতৃত্বে বসে দ্বীন-শরী‘য়তের বিধিবিধান মেনে চলা যেমন সম্ভব নয় তেমনি দ্বীন শরী‘য়তের বিধিবিধানের মধ্যে থেকে জাতীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করাও তার জন্য অসম্ভব। যিনি পুরুষের ছালাতের জামা‘আতে ইমামত করতে পারেন না এবং রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীন জিহাদের নেতৃত্ব যার জন্য অসঙ্গত, তিনি ইছলামী রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক হতে পারেন না।[৭] ইমাম আল-মাওয়ার্দী কোনো মহিলার ‘মাজলিসুল ওযারা’ বা মন্ত্রী-পরিষদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রেও তার শরী‘য়তী সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন।[৮]

ইমামুল হারামাইন আবুল মা‘আলী আল-জুয়াইনী (মৃ. ৪৭৮ হি.) বলেছেন : “রাষ্ট্রীয় নেতার জন্য পুরুষ হওয়া আবশ্যক।”[৯] তিনি আরো বলেছেন, আমরা যতটুকু অকাট্যভাবে জেনেছি, তাতে নারীরা ‘আহলুল হাল্ল ওয়াল ’আক্দ’-এর সদস্য হতে পারেন না। কেননা এসকল ক্ষেত্রে নবী-কন্যা ফাতেমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) কিংবা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণের কাছে কখনো পরামর্শ করা হয়নি; বৈধ হলে তারাই নিঃসন্দেহে অধিকতর যোগ্য ছিলেন।[১০]

বিচারপতি আল্লামাহ্ ইবনু খালদূন তার মুকাদ্দিমাহ-এর তৃতীয় অধ্যায়ের সাতাশ অনুচ্ছেদে দ্বীনী দা‘ওআতী শক্তি ও সম গোত্রীয় শক্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে নারীর উচ্চতর নির্বাহী নেতৃত্ব প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে,

"وإذا نَظرتَ سِرَّ الله في الخِلافَة لَم تَعْدُ هَذا؛ لأنّه سُبحانَه إنَّما جَعلَ الخَليفَة نائِباً عَنه في القِيام بِأمورِ عِبادِه لِيَحمِلَهم على مَصالِحهِم ويَرُدَّهم عن مَضارِّهم، وهُو مُخاطَب بذالِك ولا يُخاطَب بِالأمر إلا مَن له قُدرَة عليه. . . . وأنَّهُنَّ فِي كَثير مِن الأحكامِ الشَّرعِية جُعِلنَ تَبعاً لِلرجال ولَم يَدخُلْنَ فِي الخِطابِ بِالوَضْعِ، وأنَّما دَخلْنَ عِنده بِالقِياس، وذَلك لَمَّا لَمْ يَكن لَهُنَّ مِن الأمرِ شَيئ، وكانَ الرِّجال قَوَّامِين عَليهِنَّ، اللهُمَّ إلّا في العِبادات التي كلُّ أَحَدٍ فِيها قائِمٌ عَلى نَفسِه، فَخِطابَهُنَّ فِيها بالوَضع لا بِالقِياس. ثُم إنَّ الوُجودَ شاهِد بذلك، فإنَّه لايَقومُ بأمر أُمَّة أو جِيل إلا مَن غَلبَ عَليهم، وقَلَّ أن يَكونَ الأمرُ الشَّرعِي مُخالفاً لِلأمر الوُجودِي، والله تَعالَى أعلم"

“আপনি যদি খিলাফতের মধ্যে আল্লাহর হিকমতের দিকে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন যে, এই বিষয়টি এড়ায় না। কেননা আল্লাহ্ সুবহানাহু খলীফাহ্কে তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি করেছেন তাঁর বান্দাদের কার্যক্রমের দায়িত্ব পালনের জন্য; যাতে তাদেরকে কল্যাণ দিতে পারেন এবং তাদের থেকে ক্ষতি রোধ করতে পারেন। আর এর জন্য তাকেই আহ্বান করা হয়েছে, আর যার যে কাজের জন্য সক্ষমতা রয়েছে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ঐ কাজের জন্য আহ্বান জানানো হয় না। ... নারীদেরকে শরি‘য়তের হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে পুরুষদের অনুগত করে দেয়া হয়েছে, তারা ঐসকল বিষয়ে মূল আহ্বানের অন্তর্গত নয়; বরং তারা ওগুলোর অন্তর্গত কিয়াস (সহানুমানের)-এর দিক থেকে। কেননা এসকল বিষয়ে মূলত তাদের কিছু করণীয় নেই; আর পুরুষরা তাদের উপর কর্তৃত্বকারী; কিন্তু ইবাদতসমূহ যেখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দায়িত্বশীল সে সকল ক্ষেত্রে নারীদেরকে মৌলিকভাবেই আহ্বান জানানো হয়েছে; কিয়াসের মাধ্যমে নয়। তদুপরি প্রকৃতিই এর সাক্ষী;  কেননা কোন উম্মতের বা প্রজন্মের শাসনকার্য সেই পরিচালনা করে যে তাদের উপর বিজয়ী ও ক্ষমতাবান হয়। আর শরি‘য়তের বিধান প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীত খুব কমই হয়ে থাকে - আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে অধিক জানেন।[১১]

উল্লেখ্য, কোথাও মহিলা রাষ্টপ্রধান বা সরকারপ্রধান হয়ে গেলে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি দ্বীনি কাজে বাধা না দিবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ঘটানো ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা উচিত নয়, কিন্তু সন্তোষ প্রকাশ করা যাবে না; বরং অসন্তুষ্টির সাথে সাধ্যমত নিরবতা অবলম্বন কিংবা উপদেশ প্রদান অথবা বিরোধ করতে হবে এবং পরিস্থিতির উন্নততর পরিবর্তনের জন্য দু’আ করতে থাকতে হবে।

৩). জ্ঞান-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা

নেতৃত্বের জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, অন্তরদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি অত্যন্ত প্রয়োজন। এ সকল গুণ যার মধ্যে যতটা বেশি তিনি কর্মক্ষেত্রে ততটা সফল হবেনÑ ইনশা-আল্লাহ্। আল্লাহ্ তা‘আলা বাদশাহ্ ত্বালূত প্রসঙ্গে বলেছেন :

وَ زَادَہٗ بَسۡطَۃً فِی الۡعِلۡمِ وَ الۡجِسۡمِ

“এবং তিনি তাকে বিস্তর জ্ঞান ও প্রচুর দৈহিক শক্তি দিয়েছেন (সূরা আল-বাকারাহ : ২৪৭)।” এ বিষয়ে আল্লামাহ্ ইবনু খালদূন বলেন :

"فأمَّا اشتِراطُ العِلم فًظاهِر؛ لأنَّه إنَّما يَكونُ مُنَفِّذًا لأحكامِ اللهِ تَعالى إذا كَان عالِمًا بِها، ومَا لَمْ يَعلَمْها لا يَصِحُّ تَقديمُه لَها، ولا يَكفي مِن العِلم إلا أن يَكونَ مُجتَهدًا؛ لأنَّ التَقليدَ نَقْص والإمامَةُ تَستَدعِي الكَمالَ فِي الأوصافِ والأحوالِ"

“আর (সর্বোচ্চ নির্বাহীর জন্য) জ্ঞানের শর্ত দেয়ার কারণ পরিস্কার; কেননা তিনি তখনই শরী‘আতের আহকাম বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হবেন, যখন তিনি তা জানতে পারবেন। আর তিনি যা জানেন না সে ক্ষেত্রে তার অগ্রসর হওয়া সঠিক নয়। আর মুজতাহিদ (উচ্চতর গবেষক পারদর্শী আলেম) পর্যায়ের নাহলে তার বিদ্যা যথেষ্ট নয়। কেননা তাক্লীদ হলো কমতি আর ইমামত (সর্বোচ্চ নেতৃত্ব) গুণাবলী ও অবস্থার দিক থেকে পূর্ণাঙ্গতার দাবি করে।”[১২]

কিন্তু আল্লামাহ্ ইবনু খালদূনের যুগে (মৃ.৮০৮হি./১৪০৬খ্রি.) মিসরীয় এলাকা সহ অন্যান্য মুসলিম ভূখণ্ডে মুজতাহিদ পর্যায়ের অনেক বড় বড় আলেম পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে তা কিছুটা দুর্লভ হয়ে পড়েছে; তবে প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি সহজলভ্য হয়েছে। তাই শাসক যদি অত বড় আলেম নাও হন তাঁর সাথে বিজ্ঞ আলেম ও মুফতিগণকে অবশ্যই সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত রাখতে হবে; যাতে তিনি তাঁদের সাথে পরামর্শ করে ও দিক নির্দেশনা নিয়ে তদানুযায়ী কাজ করতে পারেন। (এ বিষয়ে গ্রন্থের প্রথম বিভাগে উলুল আমর অধ্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে শূরা অধ্যায়ে আরো কিছু আলোচনা করা হবে -ইন্শা-আল্লাহ্।)

ইসলামী জামা‘আতের নেতৃত্ব দিতে হলে যথাযথ শারঈ জ্ঞানের সাথে সাথে সংগঠন পরিচালনার জন্য তার সাংগঠনিক ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক যত জ্ঞানের প্রয়োজন তা আয়ত্তে থাকা অত্যাবশ্যক। কেননা দ্বীনি, সাংগঠনিক ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জ্ঞান ছাড়া নেতা সংগঠন চালাতে ব্যর্থ হবেন - এটাই স্বাভাবিক। জ্ঞান পড়াশুনা করেও অর্জিত হয়, অভিজ্ঞতা লব্ধও হয় এবং যোগ্য সহকর্মীদের সহযোগিতায়ও হয়। প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সহজাতও হয় আবার লব্ধও হয়। সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে যদি অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটে তাহলে সেটা হলো সোনায় সোহাগা। কুরআন ও হাদীছে জ্ঞানের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও ফযীলত সম্পর্কে অনেক কিছু এসেছে যেমন এসেছে নেতার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা। আর এটা স্বভাবিক ভাবেও বুঝা যায়। আমীরের বিচক্ষণতা, উপলব্ধি শক্তির প্রখরতা ও অন্তর্দৃষ্টি বা ’ফিরাছাহ’ অত্যন্ত প্রয়োজন। রাষ্ট্রনায়কের অন্তর্দৃষ্টি ও গভীর উপলব্ধি প্রসঙ্গে শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ দেহলভী বলেন :

(قال الشاه ولي الله الدِّهلوي:) " ولا بُـدّ لِلمَلكِ من فِراسةٍ يتصرَّفُ بِها ما أضْمَرتْ نُفوسُهم ويَكون اَلمَعِيًا يظُنُّ بِكَ الظنّ كأنَّه قَد رَأى وقَد سَمِع"

“রাষ্ট্রনায়ককে এমন প্রখর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে যে, যার সাহায্যে তিনি তাঁর অধীনস্তদের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত বিষয় (গায়েব নয়) উপলব্ধি করে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেন। আর তিনি এমন বুদ্ধিদীপ্ত হবেন যে, কারো ক্ষেত্রে (অভিজ্ঞতাভিত্তিক) যে ধারণা তিনি গ্রহণ করবেন- তা যেন নিজ কানে শুনেছেন এবং স্বচক্ষে দেখেছেন (এমন মনে হবে)।”[১৩]

অদূরদর্শী নেতৃত্ব : অদূরদর্শী নেতৃত্ব কোন দূরদর্শী বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিতে ও কর্মসূচি দিতে অক্ষম। সামনে কীভাবে কোন্ পর্যন্ত এগুতে হবে সে ব্যাপারে তিনি অন্ধকারে অবস্থান করেন। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে তিনি ভাবতে অপারগ। আর এ জাতীয় পরিস্থিতিতে তিনি কর্মীদেরকে দিকনির্দেশনা দিতে অসমর্র্থ; তাই কোন কাজে এক কদম আগালে তাকে তিন কদম পিছাতে হয়। যে নেতার দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর নেতৃত্বও ততটা বিস্তৃত ও সফল। সুতরাং নেতৃত্বকে অত্যন্ত নিবিষ্ট মনে সম্মুখে বহুদূরে তাকাতে হয়। মনের ভিতরেই বহু উপাত্ত সংগ্রহ করে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় তদুপরি দিক নির্দেশনা দিতে হয়; না হলে সংগঠন যথাগতিতে পথ চলতে অপারগ হয়ে পড়ে, দ্রুত খেই হারিয়ে ফেলে ও স্থবির হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ে ও কালক্রমে নিস্ক্রিয় হয়ে যায় বা অন্য কোন সক্রিয় সংগঠনের আশ্রয় নেয়। সুতরাং নেতৃত্বকে সব সময়ই সম্মুখের দিকে দৃষ্টি দিতে হয়, প্রয়োজনীয় কাজ হাতে রাখতে হয় এবং গঠনমূলক পরিকল্পনা সাজিয়ে ময়দান কর্মমুখর রাখতে হয়। তবে কাজের নামে অকাজ বা কুকাজের কর্মসূচি দেয়ার কোন অর্থ নেই- যা কিছু কিছু সংগঠন উদ্দশ্যমূলকভাবে সময়ে অসময়ে দিয়ে থাকে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের অবাঞ্চিত পরিবেশের অবতারণা হয়।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

তথ্যসূত্র :
[১]. মুকাদ্দিমাহ্, ইবনু খালদূন, পৃ. ২৩৯; আল-আহকাম আস্সুলত্বানিয়্যাহ্, আল-মাওয়ার্দী, পৃ. ৫।
[২]. বুখারী, আল-মাগাযী, অধ্যায় : কিসরা ও কাইসারের কাছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চিঠি, হা. নং. ৪৪২৫, বিভাগ : ফিতান, অধ্যায় : ১৮, নং. ৭০৯৯; তিরমিযী, ফিতান, অধ্যায় : যে কওম নারীকে শাসকের দায়িত্ব দেয় তাদের কখনো মুক্তি নেই, (র্শাহ : তুহফাতুল আহওয়াযী সহ) নং.২৩৬৫, (দারুস্সালাম, রিয়াদ এর বিন্যাস অনুযায়ী নং.২২৬২; নাসাঈ, বিভাগ : আল-কাযা, অধ্যায় : মহিলাদেরকে শাসক হিসাবে নিয়োগ নিষিদ্ধ, নং ৫৩৯০।
[৩]. বিস্তারিত দেখুন: বুখারী, মাগাযী, হা. নং ৪৪২৫।
[৪]. আল-ফিছাল ফিল মিলাল ওয়ান্নিহাল, পৃ. ৪/১২৮।
[৫]. ই’লামুল মুওয়াক্কি’য়ীন, পৃ. ২/৩৪২।
[৬]. পাকিস্তানের ইসলামী শাসন সংবিধান, আল্লামাহ্ কাফী, মাসিক তর্জুমানুল হাদীছ, ২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, ১৩৭০ হি. পৃ. ৩৪১।
[৭]. এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন : প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪১-৩৪৮।
[৮]. আল-আহকাম আস-সুলত্বানিয়্যাহ্, ইমাম আল-মাওয়ার্দী, পৃ ২৭।
[৯]. গিয়াছুল উমাম ফী ইলতিয়াছিয্যালাম, ইমামুল হারামাইন আবুল মা’আলী আল-জুয়াইনী, সম্পাদনা : ড. আব্দুল মুন’য়িম দীব, ধর্ম মন্ত্রণালয়, কাতার, ১ম সংস্করণ, ১৪০০ হি., পৃ. ৮২।
[১০]. গিয়াছুল উমাম, পৃ. ৬২।
[১১]. মুকাদ্দিমাহ্, ইবনু খালদূন,পৃ. ১/২৪৫।
[১২]. মুকাদ্দিমাহ্, ইবনু খালদূন পৃ. ১/২৪১।
[১৩]. শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (বৈরূত : দারু ইহইয়ায়ুল উলূম, ২য় সংস্করণ, ১৪১৩ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৫।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ
আল-কুরআনের ব্যাপারে অমুসলিমদের মিথ্যা অভিযোগ ও তার খণ্ডন - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৯ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
আল-কুরআন তেলাওয়াতের আদব - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সালাম প্রদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা - মুহাম্মাদ আরিফ হুসাইন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (২য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
কুরআনী প্রবাদ সংকলন : তাৎপর্য ও শিক্ষা (শেষ কিস্তি) - প্রফেসর ড. লোকমান হোসেন
আত্মহত্যাকারীর শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ