দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*
ইবাদতের মাধ্যমে মানুষ মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করে। দু‘আ ও যিকর হল ইবাদতের মূল। তাই আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তী লাভের অন্যতম মাধ্যম হল দু‘আ ও যিকর। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকর দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখুন, আল্লাহর যিকর দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়’ (সূরা আর-রাদ : ২৮)। মহান আল্লাহ যার প্রতি অনুগ্রহ করেন সে দুনিয়ার সব কাজে প্রশান্তি লাভ করে। প্রশান্ত অন্তর ও আল্লাহর রহমত লাভে দু‘আ ও যিকরের বিকল্প নেই। এ কারণেই মহান আল্লাহ প্রশান্ত আত্মার অধিকারী হতে তার যিকরের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আর মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভকারী ও প্রশান্ত আত্মার অধিকারীরাই লাভ করবে সুনিশ্চিত জান্নাত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও প্রিয়পাত্র হয়ে। অনন্তর তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও, এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (সূরা আল-ফাজর : ২৭-৩০)। সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সুনিশ্চিত জান্নাত লাভে দু‘আ ও যিকরের বিকল্প নেই। দু‘আ ও যিকর শুধু তাসবীহ-তাহলীল পড়ার নামই নয় বা এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রত্যেক কাজে আল্লাহর নির্দেশ পালন করাও দু‘আ ও যিকর। সুতরাং মুমিনের উচিত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহকে ডাকা এবং তাঁর যিকর করা। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাকে আল-কুরআনে বর্ণিত ও নির্দেশিত দু‘আ ও যিকর যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
দু‘আর পরিচয়
الدعاءশব্দটি মাসদার। যা دعوশব্দ থেকে উৎপত্তি। বহুবচন دُعَاةٌ وَدَاعُوْنَ।[১] আভিধানিক অর্থ ইবাদত করা, সাহায্য চাওয়া, আহ্বান করা, প্রশংসা করা ইত্যাদি।[২] যেমন বলা হয় (دَعَا الْمُؤَذِّنُ النَّاسَ إِلَى الصَّلَاةِ) মুয়াজ্জিন মানুষকে ছালাতের জন্য আহ্বান করছে। অর্থাৎ সে আল্লাহর আহ্বানকারী এবং (دَعَوْتُ اللهَ) আমি আল্লাহকে আহ্বান করছি। অর্থাৎ আমি তাঁর নিকট মিনতি করছি এবং কল্যাণের প্রত্যাশা করছি। আসলে দু‘আ শব্দটি ব্যাপক অর্থবহ। আল-কুরআনে এ শব্দটি বিশেষ বিশেষ অর্থ বহন করে। যেমন-
১. ইবাদত করা : মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَا تَدۡعُ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مَا لَا یَنۡفَعُکَ وَ لَا یَضُرُّکَ ‘আর আল্লাহকে ছেড়ে এমন কিছুকে আহ্বান (‘ইবাদত) করো না, যা না তোমার কোন উপকার করতে পারে, না কোন ক্ষতি করতে পারে’ (সূরা ইউনুস : ১০৬)।
২. সাহায্য চাওয়া : মহান আল্লাহ বলেন, وَ ادۡعُوۡا شُہَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ‘আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সাহায্যকারীদেরকেও ডেকে নাও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩)।
৩. তাওহীদ : মহান আল্লাহ বলেন, وَّ اَنَّ الۡمَسٰجِدَ لِلّٰہِ فَلَا تَدۡعُوۡا مَعَ اللّٰہِ اَحَدًا ‘নিশ্চয়ই সিজদার স্থানসমূহ (সমস্ত ‘ইবাদত) আল্লাহর জন্য। সুতরাং তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকেও ডেকো না’ (সূরা আল-জিন : ১৮)।
৪. আহ্বান করা : মহান আল্লাহ বলেন, فَدَعَا رَبَّہٗۤ اَنِّیۡ مَغۡلُوۡبٌ فَانۡتَصِرۡ ‘তখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল; আমি তো পরাজিত। অতএব, আপনি আমাকে সাহায্য করুন’ (সূরা আল-ক্বমার : ১০)।
৫. কথা বলা : মহান আল্লাহ বলেন, دَعۡوٰىہُمۡ فِیۡہَا سُبۡحٰنَکَ اللّٰہُمَّ ‘সেখানে তাদের আহ্বান হবে, হে আল্লাহ! তুমি মহান, পবিত্র!’ (সূরা ইউনুস : ১০)।
৬. চাওয়া এবং তালাশ করা : মহান আল্লাহ বলেন, وَ اِذَا سَاَلَکَ عِبَادِیۡ عَنِّیۡ فَاِنِّیۡ قَرِیۡبٌ ؕ اُجِیۡبُ دَعۡوَۃَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ ‘এবং যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্বন্ধে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন তাদেরকে বলে দিন, নিশ্চয় আমি সন্নিকটবর্তী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৬)।
৭. প্রশংসা করা : মহান আল্লাহ বলেন, قُلِ ادۡعُوا اللّٰہَ اَوِ ادۡعُوا الرَّحۡمٰنَ ؕ اَیًّامَّا تَدۡعُوۡا فَلَہُ الۡاَسۡمَآءُ الۡحُسۡنٰی ‘বলুন, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহ্বান কর বা ‘আর-রহমান’ নামে আহ্বান কর, তোমরা যে নামেই আহ্বান কর তাঁর সব নামই তো সুন্দর!’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১১০)।
পারিভাষিক অর্থে দু‘আ হল, আল্লাহকে পেতে চাওয়া বা আল্লাহর ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া।[৩] খাত্ত্বাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, দু‘আর অর্থ হল, اِسْتِدْعَاءُ الْعَبْدِ مِنْ رَبِّهِ الْعِنَايَةَ وَاسْتِمْدَادُهُ إِيَّاهُ الْمَعُوْنَةَ ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার অনুগ্রহ চাওয়া এবং একমাত্র তাঁর নিকট থেকেই সাহায্য লাভ করা’।[৪]
দু‘আর হুকুম
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ফক্বীহ, মুহাদ্দিছ এবং অধিকাংশ আলিমগণসহ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সালাফগণের নিকট নির্বাচিত মত হল, أَنَّ الدُّعَاءَ مُسْتَحَبٌّ ‘নিশ্চয় দু‘আ মুস্তাহাব’।[৫] মহান আল্লাহ বলেন, وَ قَالَ رَبُّکُمُ ادۡعُوۡنِیۡۤ اَسۡتَجِبۡ لَکُمۡ ‘তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব’ (সূরা আল-মুমিন : ৬০)। মহান আল্লাহ বলেন, اُدۡعُوۡا رَبَّکُمۡ تَضَرُّعًا وَّ خُفۡیَۃً ‘তোমরা বিনীতভাবে ও সংগোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাকবে’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৫)। তবে দু‘আ কখনো কখনো ওয়াজিবও হয়। যেমন, ছালাতের মধ্যে, জানাযার ছালাতে এবং কিছু ফক্বীদের মতে জুমু‘আর খুত্ববার মধ্যে।[৬]
দু‘আর ফযীলত
মহান আল্লাহ বলেন, وَ اِذَا سَاَلَکَ عِبَادِیۡ عَنِّیۡ فَاِنِّیۡ قَرِیۡبٌ ؕ اُجِیۡبُ دَعۡوَۃَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ ۙ فَلۡیَسۡتَجِیۡبُوۡا لِیۡ وَ لۡیُؤۡمِنُوۡا بِیۡ لَعَلَّہُمۡ یَرۡشُدُوۡنَ ‘এবং যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্বন্ধে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন তাদেরকে বলে দিন, নিশ্চয় আমি সন্নিকটবর্তী; কোন আহ্বানকারী যখনই আমাকে আহ্বান করে তখনই আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে থাকি; সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমাকে বিশ্বাস করে, তা হলেই তারা সঠিক পথে চলতে পারবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৬)। মহান আল্লাহ বলেন, اُدۡعُوۡا رَبَّکُمۡ تَضَرُّعًا وَّ خُفۡیَۃً ؕ اِنَّہٗ لَا یُحِبُّ الۡمُعۡتَدِیۡنَ ‘তোমরা বিনীতভাবে ও সংগোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাকবে, তিনি সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৫)। মহান আল্লাহ বলেন, قُلِ ادۡعُوا اللّٰہَ اَوِ ادۡعُوا الرَّحۡمٰنَ ؕ اَیًّامَّا تَدۡعُوۡا فَلَہُ الۡاَسۡمَآءُ الۡحُسۡنٰی ‘বলুন, তোমরা আল্লাহ নামে আহ্বান কর বা আর-রহমান নামে আহ্বান কর, তোমরা যে নামেই আহ্বান কর তাঁর সব নামই তো সুন্দর!’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১১০)। মহান আল্লাহ বলেন, وَ قَالَ رَبُّکُمُ ادۡعُوۡنِیۡۤ اَسۡتَجِبۡ لَکُمۡ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَسۡتَکۡبِرُوۡنَ عَنۡ عِبَادَتِیۡ سَیَدۡخُلُوۡنَ جَہَنَّمَ دٰخِرِیۡنَ ‘তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো। যারা অহংকারে আমাদের ইবাদত বিমুখ, তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে’ (সূরা আল-মুমিন : ৬০)।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, مَنْ لَمْ يَدْعُ اللهَ سُبْحَانَهُ غَضِبَ عَلَيْهِ ‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিকট দু‘আ করে না, আল্লাহ তার প্রতি অস্তুষ্ট হন।[৭]
নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ الدُّعَاءَ هُوَ الْعِبَادَةُ ‘দু‘আই ইবাদত। অতঃপর তিলাওয়াত করেন, (মহান আল্লাহ বলেন) ‘তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো’ (সূরা আল-মুমিন : ৬০)।[৮]
উবাদাহ ইবনু ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَا عَلَى الأَرْضِ مُسْلِمٌ يَدْعُو اللهَ بِدَعْوَةٍ إِلَّا آتَاهُ اللهُ إِيَّاهَا أَوْ صَرَفَ عَنْهُ مِنَ السُّوْءِ مِثْلَهَا مَا لَمْ يَدْعُ بِمَأْثَمٍ أَوْ قَطِيْعَةِ رَحِمٍ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ إِذًا نُكْثِرَ قَالَ اللهُ أَكْثَرُ.
‘পৃথিবীর বক্ষে যে মুসলিম লোকই আল্লাহ তা‘আলার নিকটে কোন কিছুর জন্য দু‘আ করে, অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা তাকে তা দান করেন কিংবা তার হতে একই রকম পরিমাণ ক্ষতি সরিয়ে দেন, যতক্ষণ না সে পাপে জড়িত হওয়ার জন্য অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দু‘আ করে। সমবেত ব্যক্তিদের একজন বলল, তাহলে আমরা অত্যধিক দু‘আ করতে পারি। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তার চাইতেও বেশী কবুলকারী’।[৯] সালমান ফারিসী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেন, إِنَّ اللهَ تَعَالَى حَيٌّ كَرِيْمٌ يَسْتَحْيِيْ إِذَا رَفَعَ الرَّجُلُ إِلَيْهِ يَدَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صَفْرًا خَائِبَتَيْنِ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা লজ্জাশীল ও মহান দাতা। তাঁর কোন বান্দা তাঁর নিকট দুই হাত উঠালে তা খালি ফিরিয়ে দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন’।[১০]
عَنْ جَابِرٍ ঃ قَالَ سَمِعَتُ النَّبِىَّ ﷺ يَقُوْلُ إِنَّ فِى اللَّيْلِ لَسَاعَةً لَا يُوَافِقُهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللهَ خَيْرًا مِنْ أَمْرِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَذَلِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ.
জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলছিলেন, রাতের মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যদি কোন মুসলিম তা লাভ করে এবং আল্লাহ্র নিকট দুনিয়া ও আখেরাতের কোন কল্যাণ চায়, আল্লাহ নিশ্চয় তাকে তা দান করেন। আর এই মুহূর্তটি প্রত্যেক রাতেই আছে।[১১]
বেশি বেশি দু‘আ করার ফযীলত
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, إِذَا سَأَلَ أَحَدُكُمْ فَلْيُكْثِر فَإِنَّمَا يَسْأَلُ رَبَّهُ ‘তোমাদের কেউ যখন আল্লাহর নিকট কিছু চায় তাহলে সে যেন বেশি করে চায়। কেননা সে তার রবের নিকট চায়’।[১২] আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَسْتَجِيْبَ اللهُ لَهُ عِنْدَ الشَّدَائِدِ وَالْكُرَبِ فَلْيُكْثِرِ الدُّعَاءَ فِي الرَخَاءِ ‘বিপদাপদ ও দুঃখের সময় যে ব্যক্তি এই মনে করে সন্তুষ্ট হতে চায় যে, আল্লাহ তার দু‘আ কবুল করবেন, তাহলে সে যেন সুখের সময় বেশি বেশি দু‘আ করে’।[১৩] আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, أَعْجَزُ النَّاسِ مَنْ عَجِزَ عَنِ الدُّعَاءِ ‘মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অক্ষম ঐ ব্যক্তি যে দু‘আ করতে অপারগ’।[১৪]
দু‘আ তাক্বদীরকে পরিবর্তন ও উপকার করে
সালমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لَا يَرُدُّ الْقَضَاءَ إِلَّا الدُّعَاءُ وَلَا يَزِيْدُ فِي الْعُمُرِ إِلَّا الْبِرُّ ‘দু‘আ ব্যতীত তাক্বদীরকে ফিরাতে পারে না’।[১৫] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, لَا يُغْنِي حَذَرٌ مِنْ قَدَرٍ وَالدُّعَاءُ يَنْفَعُ مِمَّا نَزَلَ وَمِمَّا لَمْ يَنْزِلْ ‘তাক্বদীরের ক্ষেত্রে কোন সতর্কতাই কোন কাজে আসে না, আর যা অবতীর্ণ হয়েছে ও যা অবতীর্ণ হয়নি এ ব্যাপারে দু‘আ উপকার করে’।[১৬]
দু‘আ আল্লাহর নিকট সম্মানিত জিনিস
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেন, لَيْسَ شَيْءٌ أَكْرَمَ عَلَى اللهِ سُبْحَانَهُ مِنَ الدُّعَاءِ ‘আল্লাহর নিকট দু‘আর চাইতে সম্মানিত আর কোন জিনিস নেই।[১৭]
জিন ও শয়তান হতে নিরাপত্তা লাভ
দু‘আর মাধ্যমে জিন ও শয়তান হতে নিরাপত্তা লাভ করা যায়। যেমন, পায়খানার স্থানসমূহ হচ্ছে জিন ও শয়তানের উপস্থিতির স্থান। সুতরাং যখন কেউ দু‘আ পড়ে তখন শয়তানের চক্ষু হতে নিরাপত্তা লাভ করে।[১৮] যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করে দু‘আ পড়ে, তখন শয়তান বলে, আমার হতে সে সারা দিনের জন্য রক্ষা পেল’।[১৯]
দু‘আ বিপদাপদকে প্রতিহত করে
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, وَإِنَّ البَلَاءَ لَيَنْزِلُ فَيَتَلَقَّاُه الدُّعَاءُ فَيَعْتَلِجَانِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘আর বিপদাপদ যখন আপতিত হয়, তখন দু‘আর তার (বিপদাপদের) সাথে সাক্ষাৎ করে ও ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে সংঘাতে লিপ্ত থাকে। তথা তাকে প্রতিহত করে’।[২০]
সমস্ত গুনাহ ক্ষমা লাভ করা
দু‘আর মাধ্যমে বান্দা সকল গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভ করে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুওয়াযযিনের আযান শুনে বলবে,
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ رَضِيْتُ بِاللهِ رَبًّا وَّبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا وَّبِالْإِسْلَامِ دِيْنًا.
তার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করা হবে’।[২১] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ইমাম যখন আমীন বলবে, তখন তোমরা আমীন বল। কারণ যার আমীন ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’।[২২] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যখন ইমাম বলবে ‘সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ’, তখন তোমরা বলবে, ‘আল্লা-হুম্মা রাব্বানা লাকাল হাম্দ’। নিশ্চয় যার কথা ফেরেশতাদের কথার সাথে মিলে যাবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’।[২৩]
শাফা‘আত যরূরী হওয়া
দু‘আর মাধ্যমে দু‘আকারীর জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আত যরূরী হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যখন তোমরা মুওয়াযযিনকে আযান দিতে শুনবে, তখন তার জওয়াবে বল মুওয়াযযিন যা বলে। অতঃপর আমার উপর দরূদ পড়। কেননা যে আমার উপর একবার দরূদ পড়ে, আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন। তারপর আমার জন্য আল্লাহর নিকট ‘ওয়াসীলা’ প্রার্থনা কর। আর তা হচ্ছে জান্নাতের একটি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে মাত্র একজন বান্দার জন্য উপযোগী। আমি আশা করি আমিই সেই বান্দা। অতএব যে ব্যক্তি আমার জন্য ‘ওয়াসীলা’ চাইবে তার জন্য আমার শাফা‘আত যরূরী হয়ে যাবে’।[২৪]
আরোগ্য লাভ
দু‘আর মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। অসুস্থ অবস্থায় اَللهم آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّار পড়লে আরোগ্য লাভ করা যায়।[২৫]
বিপদাপদ ও দুশ্চিন্তা দূর করার অন্যতম মাধ্যম হল দু‘আ
কেউ যদি বিপদাপদ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বলে,
اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ نَاصِيَتِيْ بِيَدِكَ مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ عَدْلٌ فِيَّ قَضَائُكَ أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِيْ كِتَابِكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِيْ عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيْعَ قَلْبِيْ وَجِلَاءَ حُزْنِيْ وَذَهَابَ هَمِّيْ وَغَمِّي.
তাহলে মহান আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা দুর করে তার অন্তরকে খুশিতে ভরে দিবেন।[২৬] যে ব্যক্তি চিন্তা, দুঃখ-কষ্ট, অসুস্থতা, কিংবা ভোগান্তিতে পতিত হয়ে বলবে, (اَللهُ رَبِّيْ لَا شَرِيْكَ لَهُ) তাহলে তার বিপদাপদ দূর হয়ে যাবে।[২৭]
খাদ্যে বরকত লাভ
খাদ্যে বরকত লাভের অন্যতম মাধ্যম হল দু‘আ। যেমন কোন মেহমান খাবার শেষে যদি বলে, اَللّٰهُمَّ اَطْعِمْ مَنْ اَطْعَمَنِىْ وَاسْقِ مَنْ سَقَانِىْ ‘হে আল্লাহ! যে লোক আমার খাবারের ব্যবস্থা করে আপনি তার খাদ্যের ব্যবস্থা করুন। আর যে আমাকে পান করায় আপনি তাকে পান করান’। তাহলে উক্ত খাদ্যে বরকত হয়।[২৮]
ঋণমুক্ত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম
ঋণমুক্ত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হল দু‘আ। যেমন কেউ যদি বলে(اَللهم اكْفِنِيْ بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَأَغْنِنِيْ بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ) তাহলে বড় পাহাড় পরিমাণ ঋণ থাকলেও আল্লাহ তা পরিশোধ করে দিবেন।[২৯]
জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত হওয়া
দু‘আর মাধ্যমে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ওযূ করবে এবং উত্তমরূপে করবে, অতঃপর বলবে, (أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ) ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন হক্ব মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল’। অপর বর্ণনায় রয়েছে (أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ) ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন হক্ব মা‘বূদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল’। তাঁর জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে, সে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে।[৩০]
জান্নাতীদের দলভুক্ত হওয়া
দু‘আর মাধ্যমে জান্নাতীদের দলভুক্ত হওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘মুওয়াযযিন যা বলে, কেউ যদি মনে-প্রাণে ঐ বাক্যগুলো বলে, তাহলে সে জান্নাতে যাবে’।[৩১]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
যিকরের পরিচয়
যিকর (الذِّكْرُ) আরবী শব্দ। এটি মাছদার। অর্থ হল, কোন কিছু স্মরণ করা। কিসাঈ বলেন,الذِّكْرُ بِاللِّسَانِ ضِدُّ الإِْنْصَاتِ وَبِالْقَلْبِ ضِدُّ النِّسْيَانِ ‘যিকর হল মুখে উচ্চারণ করা যা চুপ থাকার বিপরীত এবং অন্তরে স্মরণ করা যা ভুলে যাওয়ার বিপরীত’। কেউ কেউ বলেন, (الذِّكْرُ) শব্দের দু’টি পরিভাষা রয়েছে।
১. الشَّيْءُ يَجْرِي عَلَى اللِّسَانِ أَيْ مَا يُنْطَقُ بِهِ ‘মুখে কোন কিছু উচ্চারণ করা অর্থাৎ যা বলা হয়’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ذِکۡرُ رَحۡمَتِ رَبِّکَ عَبۡدَہٗ زَکَرِیَّا ‘এটা তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দাহ যাকারিয়ার প্রতি’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত : ২)।
২. اسْتِحْضَارُ الشَّيْءِ فِي الْقَلْبِ ضِدُّ النِّسْيَانِ ‘অন্তরে কোন কিছু উপস্থিত হওয়া যা ভুলে যাওয়ার বিপরীত’। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَاۤ اَنۡسٰنِیۡہُ اِلَّا الشَّیۡطٰنُ اَنۡ اَذۡکُرَہٗ ‘শয়তানই ওর কথা বলতে আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল’ (সূরা আল-কাহফ : ৬৩)।[৩২] এ ভিত্তিতে যিকর দু’ ধরনের। ১. অন্তরে স্মরণ করা ২. মুখে উচ্চারণ করা। প্রত্যেক কথাকে যিকর বলা হয়। আবার অন্তর ও মুখের মাধ্যমেও যিকর হয়। মহান আল্লাহ বলেন,
فَاِذَا قَضَیۡتُمۡ مَّنَاسِکَکُمۡ فَاذۡکُرُوا اللّٰہَ کَذِکۡرِکُمۡ اٰبَآءَکُمۡ اَوۡ اَشَدَّ ذِکۡرًا ؕ فَمِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا وَ مَا لَہٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنۡ خَلَاقٍ.
‘অনন্তর যখন তোমরা তোমাদের (হজ্জের) অনুষ্ঠানগুলো সম্পন্ন করে ফেল তখন যেরূপ তোমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে স্মরণ করতে, তদ্রƒপ আল্লাহকে স্মরণ কর বরং তদপেক্ষা দৃঢ়তর ভাবে স্মরণ কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২০০)।
যিকর-এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। ১. মুখ থেকে যা উচ্চারণ করা হয়। ২. অন্তরে কোন কিছু স্মরণ করা। ৩. কোন জিনিস সম্পর্কে সতর্ক করা। শরী‘আতের পরিভাষায় যিক্র হল, বান্দা তার রবকে স্মরণ করা। হোক তা তাঁর নাম, গুণ অথবা কাজ নিয়ে, প্রশংসা বা কুরআন তেলাওয়াত করে, এককত্বের ঘোষণা করে, তাঁর নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করে বা তার কাছে কিছু চেয়ে।[৩৩]
যিক্র দু’ প্রকার। যথা- কওলী বা কথার মাধ্যমে যিক্র ও আমলী বা কাজের মাধ্যমে যিক্র। প্রথম প্রকার যিকরের মধ্যে রয়েছে- কুরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম ও ছিফাতসমূহের আলোচনা ও স্মরণ করা এবং তাঁর এককত্বের ঘোষণা ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় প্রকারে রয়েছে- ইলম অর্জন করা ও শিক্ষা দেয়া, আল্লাহর হুকুম-আহকাম ও আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ইত্যাদি।[৩৪] আসলে যিকর শব্দটি ব্যাপক অর্থবহ। আল-কুরআনে এ শব্দটি বিশেষ বিশেষ অর্থ বহন করে। যেমন-
১. কুরআন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ وَ اِنَّا لَہٗ لَحٰفِظُوۡنَ ‘নিশ্চয় আমরাই যিকর (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমরা অবশ্যই তার সংরক্ষক’ (সূরা আল-হিজর : ৯)।
২. লাওহে মাহফুয : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَقَدۡ کَتَبۡنَا فِی الزَّبُوۡرِ مِنۡۢ بَعۡدِ الذِّکۡرِ اَنَّ الۡاَرۡضَ یَرِثُہَا عِبَادِیَ الصّٰلِحُوۡنَ ‘আর অবশ্যই আমরা যিকর এর পর যাবূরে লিখে দিয়েছি যে, যমীনের অধিকারী হবে আমার যোগ্য বান্দারাই’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৫)। সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যিকর হল যা আসমানে রয়েছে। মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যিকর হল আল্লাহর নিকট মূল যে কিতাব রয়েছে।[৩৫] আর আসমানের উপর আল্লাহর নিকট মূল কিতাবই হল লাওহে মাহফুয।
৩. ফেরেশতা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَالۡمُلۡقِیٰتِ ذِکۡرًا ‘শপথ তাদের যারা মানুষের অন্তরে পৌঁছে দেয় উপদেশ’ (সূরা আল-মুরসালাত : ৫)। এখানে ফেরেশতা উদ্দেশ্য।[৩৬]
৪. তাওরাত ও ইঞ্জীলের অভিজ্ঞ আলেম : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ اِلَّا رِجَالًا نُّوۡحِیۡۤ اِلَیۡہِمۡ فَسۡـَٔلُوۡۤا اَہۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ‘আর আপনার আগে আমরা অহীসহ কেবল পুরুষদেরকেই পাঠিয়েছিলাম, সুতরাং তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি না জান’ (সূরা আন-নাহল : ৪৩)। এখানে যিকর অর্থ আহলে কিতাব।[৩৭]
৫. সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব, উল্লেখ, আলোচনা, বিবরণ এবং উপদেশ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, صٓ وَ الۡقُرۡاٰنِ ذِی الذِّکۡرِ ‘ছোয়াদ, শপথ উপদেশপূর্ণ কুরআনের (সূরা ছোয়াদ : ১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَقَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ کِتٰبًا فِیۡہِ ذِکۡرُکُمۡ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ‘আমরা তো তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি কিতাব যাতে আছে তোমাদের আলোচনা’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০)।[৩৮]
৬. সীমালংঘনকারীদের জন্য আল্লাহর শাস্তি : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَفَنَضۡرِبُ عَنۡکُمُ الذِّکۡرَ صَفۡحًا اَنۡ کُنۡتُمۡ قَوۡمًا مُّسۡرِفِیۡنَ ‘আমরা কি তোমাদের থেকে এ উপদেশবাণী সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে নেব এ কারণে যে, তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়? (সূরা আয-যুখরুফ : ৫)। এখানে যিকর অর্থ শাস্তি।[৩৯]
৭. ফরয ছালাত : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, رِجَالٌ ۙ لَّا تُلۡہِیۡہِمۡ تِجَارَۃٌ وَّ لَا بَیۡعٌ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ ‘এমন সব লোক যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে বিরত রাখে না’ (সূরা আন-নূর : ৩৭)। এখানে যিকর অর্থ ছালাত প্রতিষ্ঠার জন্য মসজিদে উপস্থিত হওয়া।[৪০]
৮. জুমু‘আর ছালাত : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ.
‘হে ঈমানদারগণ! জুমু‘আর দিনে যখন ছালাতের জন্য ডাকা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং কেনা-বেচা ত্যাগ কর’ (সূরা আল-জুমু‘আহ : ৯)। এখানে যিকর অর্থ জুমু‘আর ছালাত।[৪১]
৯. কুরআনের বিধি-বিধান : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ اَعۡرَضَ عَنۡ ذِکۡرِیۡ فَاِنَّ لَہٗ مَعِیۡشَۃً ضَنۡکًا وَّ نَحۡشُرُہٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اَعۡمٰی ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকবে, নিশ্চয় তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমরা তাকে ক্বিয়ামতের দিন জমায়েত করব অন্ধ অবস্থায়’ (সূরা ত্বা-হা : ১২৪)।[৪২]
১০. তাসবীহ-তাহলীল করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاِذَا قَضَیۡتُمُ الصَّلٰوۃَ فَاذۡکُرُوا اللّٰہَ قِیٰمًا وَّ قُعُوۡدًا وَّ عَلٰی جُنُوۡبِکُمۡ ‘অতঃপর যখন তোমরা ছালাত সমাপ্ত করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে’ (সূরা আন-নিসা : ১০৩)।
যিকিরের হুকুম
যিকির করা মুস্তাহাব। তবে কিছু ক্ষেত্রে শরী‘আতে নিষেধ আছে। যেমন পেশাব-পায়খানা করার সময় এবং খুত্ববাহ চলাকালীন সময়। মুস্তাহাবের দলীল হিসাবে মহান আল্লাহ বহু আয়াতে যিকির করার নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং তা থেকে গাফেল থাকতে ও ভুলে যেতে নিষেধ করেছেন। কখনো কখনো যিকির ওয়াজিব হয়। যেমন, ছালাতের মধ্যে যিকির-আযকার, কুরআন তেলাওয়াত, আযান, ইক্বামত, সালামের জবাব, যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলা। কখনো কখনো যিকির করা হারাম হয়। যা শিরকের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন জাহিলি সমাজের হজ্জের তালবিয়া বলা। আবার খাছ করে কিছু সময় যিকির করা হারাম। যেমন খুত্ববাহ চলাকালীন সময় অর্থাৎ জুমু‘আর ছালাত।[৪৩]
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[১]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব (বৈরূত : দারু ছদর), ১৪তম খ-, পৃ. ২৫৭; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাতু (কুয়েত : ওযারাতুল আওক্বাফ ওয়াশ শুয়ূনিল ইসলামিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪০৪-১৪২৭ হি.), ২০তম খ-, পৃ. ২৫৬।
[২]. শামসুদ্দীন আফগানী, জুহূদু উলামাইল হানাফিয়্যাতি ফী ইবত্বালি ‘আক্বাইদিল ক্বুবূরিয়্যাতি (দারুল ছামীঈ, ১৪১৬ হি.), পৃ. ১৩৯৮।
[৩]. মুহাম্মাদ আব্দুর রাযযাক আল-হুসায়নী, তাজুল ঊরূস মিন জাওয়াহিরি ক্বমূস (দারুল হিদায়াহ), ৩৮তম খ-, পৃ. ৪৬।
[৪]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাতু, ২০তম খ-, পৃ. ২৫৬; জুহূদু উলামাইল হানাফিয়্যাতি ফী ইবত্বালি ‘আক্বাইদিল ক্বুবূরিয়্যাতি, পৃ. ১৩৯৮।
[৫]. ইমাম নববী, আযকারুন নববী, পৃ. ৩৯৫; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাতু, ২০তম খ-, পৃ. ২৫৭; ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শারহ মিশকাতুল মাছাবীহ (বানারস : ইদারাতুল বহূছিল ইলমিয়্যাহ ওয়াদ দা‘ওয়াতি ওয়াল ইফতা, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৪ হি.), ৭ম খ-, পৃ. ৩৪০।
[৬]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাতু, ২০তম খ-, পৃ. ২৫৭।
[৭]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮২৭, সনদ হাসান।
[৮]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮২৮, সনদ ছহীহ।
[৯]. তিরমিযী, হা/৩৫৭৩, সনদ হাসান ছহীহ।
[১০]. তিরমিযী, হা/৩৫৫৬; সনদ ছহীহ।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৫৭; মিশকাত, হা/১২২৪।
[১২]. ইবনু হিব্বান, হা/৮৮৬; সনদ ছহীহ।
[১৩]. তিরমিযী, হা/৩৩৮২; সনদ হাসান।
[১৪]. তাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৫৫৯১; ছহীহুল জা‘মে‘, হা/১০৪৪; সনদ ছহীহ।
[১৫]. তিরমিযী, হা/২১৩৯; সনদ হাসান।
[১৬]. মুসতাদরাক হাকেম, হা/২৮১৩; ছহীহুল জা‘মে‘, হা/৭৭৩৯; সনদ হাসান।
[১৭]. তিরমিযী, হা/৩৩৭০; সনদ হাসান।
[১৮]. তিরমিযী, হা/৬০৬; মিশকাত, হা/৩৫৮, সনদ ছহীহ।
[১৯]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬৬; মিশকাত, হা/৭৪৯; সনদ ছহীহ।
[২০]. মুসতাদরাক হাকেম, হা/২৮১৩; ছহীহুল জা‘মে‘, হা/৭৭৩৯; সনদ হাসান।
[২১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৬।
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৮০, ৭৮২, ৬৪০২; ছহীহ মুসলিম, হা/৪০৯, ৪১০; আবূ দাঊদ, হা/৯৩২, ৯৩৩; তিরমিযী, হা/২৪৮, ২৫০; নাসাঈ, হা/৯২৮; মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/২৮৮; দারেমী, হা/১২৪৭; মিশকাত, হা/৮২৫।
[২৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৯৬, ৩২২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৪০৯; আবূ দাঊদ, হা/৮৪৮; তিরমিযী, হা/২৬৭; নাসাঈ, হা/১০৬৩; মিশকাত, হা/৮৭৪।
[২৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৪, ৬১৪, ৪৭১৯; আবূ দাঊদ, হা/৫২৩; তিরমিযী হা/৩৬১৪।
[২৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৮৮; মিশকাত, হা/২৫০২।
[২৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৪৩১৮; ছহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৯৭২; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৯৯।
[২৭]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৩৯৬; সনদ হাসান; ছহীহুল জামে‘, হা/৬০৪০।
[২৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৮৬০।
[২৯]. তিরমিযী, হা/৩৫৬৩; বায়হাক্বী, আদ-দাওয়াতুল কাবীর, হা/৩০৩; মিশকাত, হা/২৪৪৯।
[৩০]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৪।
[৩১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৫; আবূ দাঊদ, হা/৫২৭; মিশকাত, হা/৬৫৮।
[৩২]. লিসানুল আরব, ৪র্থ খ-, পৃ. ৩০৮; তাজুল ঊরূস মিন জাওয়াহিরি ক্বমূস, ১১তম খ-, পৃ. ৩৭৭; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাতু, ২১তম খ-, পৃ. ২১৯; আবূ মানছূর মুহাম্মাদ আযহারী, তাহযীবুল লুগাহ (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল আরাব, ২০০১ হি.), ১০ম খ-, পৃ. ৯৪।
[৩৩]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাতু, ২১তম খ-, পৃ. ২২০।
[৩৪]. ড. আবূ বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর), ১ম খ-, পৃ. ১৪৩-১৪৪।
[৩৫]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৫ম খ-, পৃ. ৩৮৪-৩৮৫।
[৩৬]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ২৩তম খ-, পৃ. ৫৮৮।
[৩৭]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৪র্থ খ-, পৃ. ৫৭৩।
[৩৮]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৫১৯।
[৩৯]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ২০তম খ-, পৃ. ৫৪৮।
[৪০]. মা‘আলিমুত তানযীল, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৫১।
[৪১]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ২২তম খ-, পৃ. ৬৩৭; মা‘আলিমুত তানযীল, ৮ম খ-, পৃ. ১১৫; তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৬৩।
[৪২]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৫ম খ-, পৃ. ৩২২-৩২৩।
[৪৩]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাতু, ২১তম খ-, পৃ. ২২৩।