সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিতি

-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


(১২তম কিস্তি)

মূলনীতি-১১ : মানুষকে তাদের রবের ইবাদতের দিকে আহ্বানের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা শরী‘আত সম্মত নয়

ইসলাম বিশ্ব মানবতার জন্য পরিপূর্ণ জীবন বিধান। তাই এ দ্বীনের মধ্যে কোন কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের কারো সুযোগ নেই অধিকারও নেই। যদিও প্রকৃত কোন মুসলিম ব্যক্তির কাছে এই দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতার ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকালের মাত্র ৮১ দিন পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ঘোষণা করে আয়াত নাযিল করেন। তিনি বলেন,

اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا

‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)।

সুধী পাঠক! দ্বীনের পূর্ণতা একথা অত্যাবশ্যক করে যে, মানুষকে তাদের রবের ইবাদতের দিকে আহ্বানের ক্ষেত্রে ঐসকল পথ ও পদ্ধতি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট গ্রহণ করা বা ব্যবহার করা সম্ভবপর থাকা সত্ত্বেও তিনি যা করেননি, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে তা ব্যবহার করা কিংবা গ্রহণ করা দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত বলে গণ্য হবে। এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফৎওয়া রয়েছে। যা নিম্ন রূপ :

শায়খুল ইসলামকে একটি জামা‘আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল যে, তারা খুন, রাহাজানী, চুরি, মদপান ছাড়াও অন্যান্য বড় বড় পাপ কাজের উদ্দেশ্যে এক জায়গায় একত্রিত হয়। এমতাবস্থায় সুন্নাহর অনুসারী ও কল্যাণকর কাজে পরিচিত মাশায়েখের মধ্য থেকে একজন শায়খ উল্লিখিত ব্যক্তিদেরকে উক্ত পাপগুলো থেকে বাধা প্রদানের ইচ্ছা করেন। কিন্তু একটি কৌশল ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। তাহল এই যে, তিনি তাদের জন্য বাজনা ছাড়া ঢোল বাজিয়ে ও বাশি ছাড়া বৈধ কবিতার দ্বারা গায়কের গান শোনানোর জন্য একটি বৈঠকের আয়োজন করবেন, যেখানে তারা এই উদ্দেশ্যে একত্রিত হবে। যখন তিনি এ কাজটি করলেন, তখন তাদের মধ্য থেকে একদল মানুষ তওবাহ করল এবং যে ব্যক্তি ছালাত পড়ত না, চুরি করত, যাকাত দিত না সে এমন হল যে, এখন সে সন্দেহজনক কোন বিষয় পরহেয করে, ফরযগুলো আদায় করে ও হারামগুলো বর্জন করে। অতএব প্রশ্ন হল এই যে, এই পদ্ধতিতে উক্ত শায়খের গান শোনানোর বৈঠক আয়োজন করা কি বৈধ? কারণ তাতে কল্যাণ বিদ্যমান আছে। সাথে সাথে এভাবে ছাড়া তাদেরকে দা‘ওয়াত দেয়া সম্ভবপরও ছিল না।

উত্তরে মুহতারাম শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। এই মাসয়ালা ও তৎসাদৃশ্য মাসয়ালার জবাবের সারসংক্ষেপ  নিম্নরূপ:

পরিষ্কারভাবে জেনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করার জন্য সত্য দ্বীন ও হেদায়াত সহকারে প্রেরণ করেছেন। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। এর সাথে আরো জেনে রাখতে হবে যে, তিনি তাঁর এবং তাঁর উম্মতের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিকুলকে নির্দেশ প্রদান করেছেন তাদের মধ্যকার দ্বীনের বিবাদমান বিষয়াবলী যেন আল্লাহর প্রেরিত বিধানের দিকে ফিরিয়ে দেয়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡہُ اِلَی اللّٰہِ وَ الرَّسُوۡلِ  اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ  وَّ  اَحۡسَنُ  تَاۡوِیۡلًا

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর অনুগত হও ও রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের অন্তর্গত আদেশদাতাগণের; অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে কোন মতবিরোধ হয় তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে থাক; এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর সমাধান’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)।

অতঃপর তিনি বলেন, যখন এই কথা জানবে নিশ্চয় আল্লাহ পথভ্রষ্টদের হেদায়াত দেন, পথহারাদের পথ দেখান এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের তাওবাহ কবুল করেন। তবে অবশ্যই তা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যে কিতাব ও সুন্নাতসহ প্রেরণ করেছেন, সে অনুযায়ী হতে হবে। আর যদি আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন সে অনুযায়ী না হয়, তাহলে তা আমার নিকট যথেষ্ট নয়। জানা বাঞ্ছনীয় যে, নিশ্চয় আমলে ছালেহ আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্দেশিত নির্দেশ, ওয়াজিব ও মুস্তাহাব। আর আমলে ফাসিদাহ হল, আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নিষিদ্ধ আমল। আর যে কোন আমলে কল্যাণ-অকল্যাণ উভয় বিষয় বিদ্যমান থাকে। তখন মহাবিজ্ঞ শরী‘আত প্রনেতা এভাবে সমাধান প্রদান করেছেন যে, যদি তাতে অকল্যাণের চেয়ে কল্যাণের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে সেটিকে শরী‘আতসম্মত করেছেন। আর যদি তার কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে সেটিকে শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত করেননি। বরং তা থেকে নিষেধ করেছেন। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الۡقِتَالُ وَ ہُوَ کُرۡہٌ لَّکُمۡ ۚ وَ عَسٰۤی اَنۡ تَکۡرَہُوۡا شَیۡئًا وَّ ہُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ ۚ وَ عَسٰۤی اَنۡ تُحِبُّوۡا شَیۡئًا وَّ ہُوَ شَرٌّ لَّکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ  وَ اَنۡتُمۡ  لَا تَعۡلَمُوۡنَ

‘তোমাদের জন্য জিহাদকে অপরিহার্য করা হয়েছে এবং এটা তোমাদের নিকট অপ্রীতিকর; বস্তুত তোমরা এমন বিষয়কে অপসন্দ করছ, যা তোমাদের পক্ষে বাস্তবিকই মঙ্গলজনক, পক্ষান্তরে তোমরা এমন বিষয়কে পসন্দ করছ, যা তোমদের জন্য বাস্তবিকই অনিষ্টকর এবং আল্লাহই অবগত আছেন আর তোমরা অবগত নও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৬)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِؕ قُلۡ فِیۡہِمَاۤ اِثۡمٌ  کَبِیۡرٌ  وَّ مَنَافِعُ  لِلنَّاسِ ۫ وَ اِثۡمُہُمَاۤ  اَکۡبَرُ مِنۡ نَّفۡعِہِمَا

‘মাদক দ্রব্য ও জুয়া খেলা সম্বদ্ধে তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে, (হে নবী!) আপনি বলুন, এ দু’টির মধ্যে গুরুতর পাপ রয়েছে এবং কোন কোন লোকের (কিছু) উপকার আছে, কিন্তু ও দু’টির লাভ অপেক্ষা পাপই গুরুতর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৯)। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা এদু’টিকে হারাম করেছেন।

অনুরূপভাবে মানুষ যে আমলকে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম মনে করে কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে শরী‘আত হিসাবে গণ্য করেননি, তখন ধরে নিতে হবে সে আমলের উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। অন্যথা যদি ক্ষতির চেয়ে লাভের পরিমাণ বেশি হত, তাহলে শরী‘আত প্রণেতা সেটাকে ছেড়ে দিতেন না। কেননা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন বিজ্ঞ ব্যক্তি, তিনি দ্বীনের কল্যাণ কখনো ছেড়ে দিতেন না। আর মুমিনরাও আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের সুযোগ হাত ছাড়া করতেন না। এটা যখন স্পষ্ট হয়ে গেল, তখন আমরা প্রশ্নকারীকে বলব, উল্লিখিত শায়খ চেয়েছিলেন, কাবীরা গুনাহকারী দলটি তাওবাহ করুক, কিন্তু তিনি তা সম্ভব করতে না পেরে বিদ‘আতী পন্থা অবলম্বন করেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত শায়খ শরী‘আতে সীমালঙ্গনকারীদের তাওবার পন্থা সম্পর্কে অজ্ঞ। অথবা তিনি শরী‘আত সম্পর্কে জানতে অক্ষম। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), ছাহাবীগণ ও তাবেঈগণ কাফের, ফাসেক এবং সীমালঙ্গনকারীদের আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন শরী‘আতের পন্থায়। ফলে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা বিদ‘আত থেকে মুক্ত করেছেন। আর একথা বলা জায়েয নেই যে, সীমালঙ্গনকারীদের তাওবার পথ মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শরী‘আত নেই।

ইলমুল ইযতিরার ও মুতাওয়াতির জ্ঞানের মাধ্যমে জানা যায় যে, অসংখ্য কাফের, ফাসেক, ধর্মদ্রোহী শারঈ পন্থায়  তাওবাহ করেছেন। যাতে বিদ‘আতের সংমিশ্রণ ছিল না। সুতরাং একথা বলা সম্ভব নয় যে, ধর্মদ্রোহীরা এই বিদ‘আতী পন্থা ব্যতীত তাওবাহ করতে পারবে না। নিশ্চয় আলোচ্য শায়খ শরী‘আত সম্পর্কে বুঝতে অক্ষম। তার কিতাব ও সুন্নাহ সম্পর্কে যথেষ্ট কোন জ্ঞান নেই। আর মানুষকে কিভাবে সম্বোধন করতে হয় সেটাই সে জানে না। এভাবেই তাদের শুনায়, তাহলে কিভাবে আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করবেন? অতঃপর শায়খ শরী‘আতের পন্থার সাথে বিদ‘আতী পন্থার সামঞ্জস্য করেছেন। হতে পারে কোন মহৎ উদ্দেশ্যে, যদি সে দ্বীনদার হয় অথবা হতে পারে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে অন্যায়ভাবে তাদের সম্পদ গ্রহণ করা উদ্দেশ্যে।[১]

সুধী পাঠক! কিছু কিছু মানুষ এই মূলনীতি সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যে, মানুষের নিকট দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে এর মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা  উপকার করে, যেগুলো নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে ছিল না। কতিপয় আলেম মানুষকে তাদের প্রতিপালকের ইবাদতের দিকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে ঐ মূলনীতিগুলোকে মুস্তাহাব বলেছেন।

উক্ত অভিযোগের জবাব হল, উক্ত যুক্তি কেবল যুুক্তিই। যার কোন ভিত্তি নেই। কেননা এখানে এ মূলনীতির উদ্দেশ্য হল- এমন কাজ যা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে বিদ্যমান ছিল কিন্তু তা নিষেধ করার মত কোন বিষয় উত্থাপন হয়নি এবং সাথে সাথে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও তা করেননি। সুতরাং এরূপ কাজ নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগের পরে সম্পাদন করলে তা বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে।[২]

শায়খুল ইসলামের নিকট উত্থাপিত উক্ত প্রশ্নের একটু ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে যে, দাওয়াতের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিদ‘আতী পন্থা অবলম্বন করা যাবে না। এপ্রসঙ্গে আব্দুল আযীয ইবনু রাইস আর-রাইস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উক্ত ঘটনাটির মাঝে বেশ কয়েকটি বিষয় একত্রিত হয়েছে। যেমন,

১. দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ হেদায়াতের পূর্বে তাদের দূরবস্থার বিষয়। কারণ তারা খুন-খারাবি, চুরি করা ও রাহাজানির মত বড় বড় পাপের মাঝে নিমজ্জিত ছিল।

২. দাওয়াত দাতার সততার বিষয়। কারণ তিনি ছিলেন একজন বিদ্বান যিনি সুন্নাহ অনুসরণে ও ভাল কাজে প্রসিদ্ধ।

৩. তিনি তার সেই কাজের মাধ্যমে কল্যাণ চেয়েছিলেন।

৪. তিনি তাদের সাথে বড় বড় হারাম কাজগুলোতে লিপ্ত হননি। তিনি শুধু এতটুকু করেছেন যে, বাজনা ছাড়াই ঢোল বাজিয়েছেন এবং বাঁশি ছাড়াই বৈধ কবিতার গান গেয়েছেন।

৫. তাদের হেদায়াতের জন্য উক্ত পন্থা অবলম্বন করা ব্যতীত তার পক্ষে দাওয়াত দেয়া সম্ভব ছিল না।

৬. উক্ত পন্থার উপর একটি বড় কল্যাণ ও বিরাট মঙ্গল অর্জিত হয়েছে।[৩]

অতএব উক্ত বিষয়গুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সত্ত্বেও ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে তার আবেগ পরাজিত করতে পারেনি এবং তিনি তাঁর আবেগের জন্য ভেঙ্গেও পড়েননি। বরং তিনি তার ফৎওয়াকে শারঈ দলীল ও কার্যকরী কায়েদার উপর প্রতিষ্ঠিত করে অত্যন্ত মযবুত ও শক্ত ফৎওয়া প্রদান করেছেন। সুতরাং মানুষকে তাদের রবের ইবাদতের দিকে আহ্বানের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা একদম শরী‘আত সম্মত হবে না। বরং বিদ‘আত হিসাবে পরিগণিত হবে।

মূলনীতি-১২ : কোন একটি ইবাদত যদি একজন ছাহাবী থেকে প্রমাণিত হয়, তবে তা শরী‘আতসম্মত হবে এবং তা বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে না

প্রথমেই বলে রাখি, ছাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রত্যেকেই ন্যায়পরায়ণ। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদেরকে ন্যায়পরায়ণ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। সেজন্য দেখা যায় যে, মুহাদ্দিছগণ হাদীছ বর্ণনাকারীগণের ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেতেন। সনদের কোন্ বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত আর কে যঈফ, তা তাঁরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন। কিন্তু সনদের ধারাবাহিকতা যখন ছাহাবী পর্যন্ত পৌঁছত, তখন তাঁরা আর কোন বিশ্লেষণই করতেন না। কেননা তাঁরা নিশ্চিত জানতেন যে, সকল ছাহাবী ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বস্ত। সেকারণে আপনি যখন ‘রিজাল শাস্ত্র’-এর গ্রন্থসমূহ পড়বেন, তখন সেখানে দেখবেন, গ্রন্থকারগণ তাবেঈন থেকে শুরু করে সকলের অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, অমুক বিশ্বস্ত, অমুক হাফেয, অমুক যঈফ, অমুক এমন...। কিন্তু ছাহাবীগণ কি ন্যায়পরায়ণ, না-কি ন্যায়পরায়ণ নন? তাঁরা কি বিশ্বস্ত, না-কি বিশ্বস্ত নন? ইত্যাদি বিষয়ে তাঁরা কোন আলোচনাই করেননি। এর মূল কারণ হল- ছাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) সবাই ন্যায়পরায়ণ। এছাড়া আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত এবং অসংখ্য হাদীছে তাঁদেরকে ন্যায়পরায়ণ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন’।[৪]

ছাহাবীগণের বৈশিষ্ট্যই ছিল সুন্নাতের আনুগত্য করা এবং বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করা। সুতরাং কোন একজন ছাহাবীর নিকট থেকে যদি কোন ইবাদত বর্ণিত হয়, যার পক্ষে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন বর্ণনা পাওয়া না যায়, তাহলে সেটাও শরী‘আত হিসাবে গণ্য হবে, বিদ‘আত হিসাবে ধর্তব্য হবে না। কেননা কোন ছাহাবী এমন কোন ইবাদত নিয়ে আসবেন না, যার ব্যাপারে তাঁর নিকট কোন দলীল ও ইজতিহাদী মাসয়ালা থাকবে না। যেমনটি প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ও মুহাক্বিক্ব আল্লামা ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) (১৩৩২-১৪২০ হি./১৯১৪-১৯৯৯ খ্রি.) বলেছেন,

كل أمر لا يمكن أن يشرع إلا بنص أو توقيف ولا نص عليه، فهو بدعة إلا ما كان عن صحابي وتكرر ذلك العمل منه دون نكير

‘প্রত্যেক ঐ আমল, যা শরী‘আতের কোন দলীল দ্বারা সাব্যস্ত করা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে তার কোন দলীলও নেই। সেটাই বিদ‘আত। তবে যদি কোন ছাহাবীর পক্ষ থেকে কোন আমল সাব্যস্ত হয়, যে আমল তিনি বারবার সম্পাদন করেছেন, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে না’।[৫]

সুধী পাঠক! উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের উপর কিছু লিখতে নিষেধ করেছেন।[৬] ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) (১৩২৭-১৪১৪ হি.) বলেন, ‘উক্ত বর্ণনা ছহীহ। সুতরাং কবরের উপর কিছু লেখার ব্যাপারে কোন আমল করা যাবে না। কেননা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কোন মুসলিম ইমামগণের কবরের উপর কোন কিছু লিখিত হয়নি। এটা গ্রহণ করা সালাফদের বিরোধী কাজ। আর কোন ছাহাবী এরূপ কাজ করেছেন মর্মে আমরা জানিও না। যদিও কোন কোন তাবেঈ এ ব্যাপারে কিছু বর্ণনা করেছেন কিন্তু তাদের নিকট এ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞার সংবাদ পৌঁছায়নি বলেই তারা এটা করেছেন’।[৭]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

 

* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. তাক্বীউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, তাহক্বীক্ব : আনওয়ারুল বায ও আমিল আল-জাযযার (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ১১তম খণ্ড, পৃ. ৬২০-৬২৫।
[২]. যাকারিয়া ইবনু গোলাম কাদির আল-পাকিস্তানী, মিন উছূলিল ফিক্বহি আলা মানহাজি আহলিল হাদীছ (দারুল খারায লিন নাশর, ১ম সংস্করণ, ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি.), পৃ. ২১০।
[৩]. আব্দুল আযীয ইবনু রাইস আর-রাইস, আল-ইমামু ইবনি তাইমিয়্যাহ ওয়া জামা‘আতিত তাবলীগ (তয় সংস্করণ, তাবি), পৃ. ৪৩।
[৪]. আব্দুর রাযযাক ইবনু আব্দুল মুহসিন আল-বদর, ওয়াজিবুনা নাহওয়াছ ছাহাবাহ (মদীনা মুনাওয়ারা : ১ম সংস্করণ, ১৪৩৩ হি./২০১১ খ্রি.), পৃ. ১০-১১।
[৫]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, আহকামুল জানাইয ওয়া বিদাঊহা (রিয়াদ :মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি./১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ৩০৬।
[৬]. তিরমিযী, হা/১০৫২, সনদ ছহীহ।
[৭]. ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ (বানারাস, ভারত : ইদারাতুল বুহূছিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াদ দা‘ওয়াতি ওয়াল ইরশাদ, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৪ হি./১৯৮৪ খ্রি.), ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৪৫।




আল-কুরআন এক জীবন্ত মু‘জিযা - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১১তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৪র্থ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
কুরআন মাজীদের উপর বিদ‘আতের আবরণ - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ