রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৯:১৭ অপরাহ্ন

শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি

-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন


(৪র্থ কিস্তি)

(৩) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সালাফে ছালেহীন যেভাবে বুঝেছেন, সেভাবেই বুঝা এবং তাঁদের মানহাজের অনুসরণ করা। নিজের ইচ্ছামত মনগড়া ব্যাখ্যা না দেয়া :

ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযাম শরী‘আতকে যেভাবে বুঝেছেন, সেভাবেই বুঝতে হবে এবং ব্যাখ্যা দিতে হবে। কারণ সর্বপ্রথম তাঁরাই শরী‘আতকে বহন করেছেন, আমল করেছেন এবং এর মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। আর তাঁরাই জান্নাতের প্রথম সারির মানুষ। তাঁদের চেয়ে বেশী বুঝলে এবং তাদের বুঝ ও ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করলে যে কেউ পথভ্রষ্ট হবে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈদের যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গকে ‘সালাফ’ বলা হয়। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের যুগকেই স্বর্ণযুগ বলেছেন।[১] আল্লাহ তা‘আলাও তাঁদেরকেই শ্রেষ্ঠ উম্মত বলেছেন (সূরা আলে ‘ইমরান : ১১০)। তাই তাঁদের অনুসরণ করলে আমরাও হেদায়াত পাব, অন্যথা পরিণাম জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَنۡ یُّشَاقِقِ الرَّسُوۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُ الۡہُدٰی وَ یَتَّبِعۡ غَیۡرَ  سَبِیۡلِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ نُوَلِّہٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصۡلِہٖ جَہَنَّمَ  وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا

‘হেদায়াত প্রকাশিত হওয়ার পর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের বিপরীত পথে চলে, সে যেদিকে চলতে চায়, আমরা তাকে সেদিকেই প্রত্যাবর্তিত করব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর এটা নিকৃষ্টতর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (সূরা আন-নিসা : ১১৫)।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সালাফদের মানহাজকে আঁকড়ে ধরা আবশ্যক করেছেন।[২] অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَّ اتَّبِعۡ سَبِیۡلَ مَنۡ اَنَابَ اِلَیَّ ‘আর তার পথ অনুসরণ কর, যে আমার দিকে অগ্রগামী হয়’ (সূরা লোক্বমান : ১৫)। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন,وَالسَّلَفُ الْمُؤْمِنُونَ مُنِيبُونَ أَيْ فَيَجِبُ اتِّبَاعُ سَبِيلِهِمْ ‘আর সালাফরাই হলেন প্রকৃত মুমিন, যারা আল্লাহর দিকে অগ্রগামী, অর্থাৎ তাদের মানহাজের আনুগত্য করা ওয়াজিব’।[৩] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَاِنۡ اٰمَنُوۡا بِمِثۡلِ مَاۤ  اٰمَنۡتُمۡ  بِہٖ فَقَدِ اہۡتَدَوۡا  وَ اِنۡ تَوَلَّوۡا فَاِنَّمَا ہُمۡ فِیۡ  شِقَاقٍ

‘অতএব তারা যদি তোমাদের ঈমান আনার মত ঈমান আনে, তবেই তারা হেদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারাই হঠকারিতার মধ্যে রয়েছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩৭)। অন্য আয়াতে এসেছে, একান্ত নিষ্ঠার সাথে যারা তাঁদের অনুসরণ করবে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন এবং চিরস্থায়ীভাবে তাঁদেরকে জান্নাতে থাকার সুযোগ করে দিবেন (সূরা আত-তওবা : ১০০)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (সূরা আত-তওবা : ১১৯)। উক্ত সত্যবাদীদের পরিচয় দিয়ে আল্লাহ বলেন,

لِلۡفُقَرَآءِ  الۡمُہٰجِرِیۡنَ  الَّذِیۡنَ  اُخۡرِجُوۡا  مِنۡ  دِیَارِہِمۡ وَ اَمۡوَالِہِمۡ یَبۡتَغُوۡنَ  فَضۡلًا مِّنَ اللّٰہِ  وَ رِضۡوَانًا وَّ یَنۡصُرُوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الصّٰدِقُوۡنَ

‘এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্য, যারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় এবং আল্লাহ এবং রাসূলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তারাই সত্যবাদী’ (সূরা আল-হাশর : ৮)।

উক্ত কারণেই আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ছিরাতে মুস্তাক্বীম চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আমরা বলি,

  اِہۡدِ نَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ  -  صِرَاطَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡہِمۡ

‘আপনি আমাদেরকে সোজা-সরল পথে পরিচালিত করুন, তাঁদের পথে- যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন’ (সূরা আল-ফাতিহা : ৬-৭)। আর আল্লাহ যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তাঁরা হলেন, নবীগণ, ছিদ্দীক্বগণ, শহীদগণ এবং সৎ বান্দাগণ। আর তাদের সান্নিধ্য কতই না উত্তম। এই অনুগ্রহ সরাসরি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে (সূরা আন-নিসা : ৬৯-৭০)। তাই শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أَمَرَ بِسُؤَالِهِ الْهِدَايَةَ إلَى صِرَاطِهِمْ ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের পথের আলোকেই হেদায়াত চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন’।[৪]

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা বলেন, ইহুদীরা বিভক্ত হয়েছে ৭১ দলে, খ্রীস্টানরা বিভক্ত হয়েছে ৭২ দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। একটি ব্যতীত সবই জাহান্নামে যাবে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)? ঐ জান্নাতী দল কোন্টি? তিনি বলেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপর আছি, তার উপর যারা থাকবে।[৫] অন্য হাদীছে ভবিষ্যদ্বাণী করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, 

فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

‘আমার পরে তোমাদের মধ্যে যে বেঁচে থাকবে, সে অচিরেই অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। তাকে শক্ত করে ধারণ করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তার উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর তোমরা শরী‘আতে নবাবিষ্কার থেকে সাবধান থাকবে। কেননা প্রত্যেকটি নবাবিষ্কৃত বিষয়ই বিদ‘আত আর প্রত্যেকটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[৬] এ ব্যাপারে শক্ত বক্তব্য এসেছে ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে-

عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ ঃ قَالَ مَنْ كَانَ مُسْتِنًّا فَلْيَسُنَّ بِمَنْ قَدْ مَاتَ فَإِنَّ الْحّيَّ لَا تُؤْمِنُ عَلَيْهِ الْفِتْنَةَ أُوْلَئِكَ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ ﷺ كَانُوْا أَفْضَلُ هَذِهِ الْأُمَّةِ أَبَرُّهَا قُلُوْبًا وَأَعْمَقُهَا عِلْمًا وَأَقَلُّهَا تَكَلُّفًا اِخْتَارَهُمُ اللهُ لِصُحْبَةِ نَبِيِّهِ وِلِإِقَامَةِ دِيْنِهِ فَاعْرَفُوْا لَهُمْ فَضْلَهُمْ وَاتَّبَعُوْهُمْ عَلَىْ آثَارِهِمْ وَتَمَسَّكُوْا بِمَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ أَخْلاَقِهِمْ وَسَيْرِهِمْ فَإِنَّهُمْ كَانُوْا عَلَىْ الْهُدِى الْمُسْتَقِيْمِ. رَوَاهُ رَزِيْنُ

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কেউ যদি অন্য কারো তরীক্বা অনুসরণ করতে চায়, সে যেন তাদের তরীক্বা অনুসরণ করে, যারা মৃত্যুবরণ করেছে। কারণ জীবিত ব্যক্তি ফিতনা হতে নিরাপদ নয়। আর তাঁরা হচ্ছেন- রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছাহাবীগণ, যাঁরা এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ লোক ছিলেন পরিচ্ছন্ন অন্তঃকরণ ও পরিপূর্ণ জ্ঞান হিসাবে এবং স্বল্পতম ছিলেন কৃত্রিমতার দিক থেকে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাঁর নবীর সাহচর্য এবং আপন দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমরা তাদের মান ও মর্যাদা উপলব্ধি করার চেষ্টা কর, তাদের পদচিহ্নের অনুসরণ কর এবং যথাসাধ্য তাদের আখলাক্ব ও চরিত্র আঁকড়ে ধর।‏ নিশ্চয় তারা সরল সঠিক পথের উপর ছিলেন।[৭]  

বুঝা যাচ্ছে যে, আমাদেরকে সালাফদের পথেই চলতে হবে। কারণ সেটাই ছিরাতে মুস্তাক্বীম, সেটাই জান্নাতের পথ। বিশেষ করে বর্তমান বিভক্তি, বিভ্রান্তি ও মতানৈক্যের যুগে তাঁদের মানহাজের অনুসরণ করা আবশ্যক। অন্যথা ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা জান্নাতের পথ থেকে আমরা ছিটকে পড়ব। মূলত  সালাফদের মানহাজকে প্রাধান্য না দেয়ার কারণেই মুসলিম উম্মাহ মর্মান্তিক বিভক্তির শিকার হয়েছে এবং কুরআন-সুন্নাহর হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

এই ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তির মূল কারণ হল, পথভ্রষ্ট প্রত্যেকটি ফের্কা কুরআন-হাদীছ থেকেই দলীল পেশ করে মানুষকে ধোঁকা দেয়া। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ছাহাবায়ে কেরাম কুরআন-হাদীছ যেভাবে বুঝেছেন সেই বুঝটা তারা গ্রহণ করে না; বরং নিজেদের মত করে বুঝে মনগড়া ব্যাখ্যা করে এবং সালাফদের ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করে। এভাবে তারা ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। অথচ উপরের আলোচনায় আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম যে কুরআন-সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে মূলনীতি হল, ‘সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহ্র অনুসরণ করা ওয়াজিব’ (وُجُوْبُ اِتِّبَاعِ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ عَلٰى فَهْمِ سَلَفِ الْأُمَّةِ) উক্ত মূলনীতির অনুসরণ করলে উম্মতের বিভক্তি এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করত না। তাই ইমাম আওযাঈ (৮৯-১৫৮ হি./৭০৭-৭৭৪ খ্রি.) বলেন,

اصْبِرْ نَفْسَكَ عَلَى السُّنَّةِ وَقِفْ حَيْثُ وَقَفَ الْقَوْمُ وَقُلْ بِمَا قَالُوا وَكُفَّ عَمَّا كَفُّوا عَنْهُ وَاسْلُكْ سَبِيلَ سَلَفِكَ الصَّالِحِ

‘সুন্নাতের উপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখ, সালাফগণ যেখানে থেমেছেন, তুমিও সেখানে থাম, তারা যা বলেছেন, তুমিও তাই বল, তারা যা থেকে বিরত থেকেছেন, তুমিও তা থেকে বিরত থাক। তুমি তোমার অর্গবর্তী সালাফে ছালেহীনের পথে চলতে থাক’।[৮]

তাই আমাদেরকে আক্বীদা, আমল, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আদব-আখলাক্বসহ মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীনের মানহাজের অনুসরণ করতে হবে। তবেই হেদায়াত পাওয়া যাবে এবং জান্নাতের পথ সুগম হবে ইনশাআল্লাহ। ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে শরী‘আতের শাখা-প্রশাখাগত সামান্য ইখতিলাফ পরিলক্ষি হলেও আক্বীদাগত এবং মৌলিক শারঈ মূলনীতির ব্যাপারে কোন ইখতিলাফ ছিল না। অনুরূপ তাদের মাঝে দলাদলি ও বিভক্তিও ছিল না। তাই শুধু আক্বীদা কিংবা আমল ছহীহ হলেই হবে না। মানহাজ ছহীহ হতে হবে। অর্থাৎ সার্বিক জীবনে সালাফী মানহাজের অনুসরণ করতে হবে। ‘মানহাজুস সালাফিছ ছালেহ’ বা সালাফে ছালেহীনের মানহাজ। ‘মানহাজ’ শব্দটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।[৯] আর ‘মিনহাজ’ শব্দটি কুরআনেও এসেছে, হাদীছেও এসেছে।[১০] এর অর্থ সরল-সোজা পথ, স্পষ্ট রাস্তা, প্রশস্ত চলার পথ। ‘সালাফ’ শব্দটিও কুরআনে এসেছে এবং হাদীছেও এসেছে। কুরআনে এসেছে ‘অগ্রবর্তী বা গত হওয়া অর্থে এবং উপদেশ, শিক্ষা অর্থে (নিসা ২২, ২৩; মায়েদাহ ৯৫; যুখরুফ ৫২)। হাদীছে এসেছে, অগ্রগামী অর্থে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর মেয়ে ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বলেছিলেন, فَإِنِّى نِعْمَ السَّلَفُ أَنَا لَكِ ‘নিশ্চয় আমি তোমার জন্য কতই না উত্তম অগ্রগামী’।[১১] অর্থাৎ ‘সালাফে ছালেহীনের মানহাজ’ বলতে পূর্ববর্তী বা অগ্রগামী সৎ বান্দাদের পথ, রীতি, পদ্ধতি ও মূলনীতিকে বুঝায়। সেই মানহাজেরই অনুসরণ করা ফরয।

উক্ত মানহাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে মুসলিমরা অসংখ্য দলে-উপদলে বিভক্ত হয়েছে।
(ক) দেখা যায় একশ্রেণীর লোক আমলে, বক্তব্যে ও চলাফেরায় সালাফী, ইবাদতে খুবই পরহেযগার, কিন্তু আক্বীদায় পাক্কা খারেজী-চরমপন্থী। তারা মুসলিমদেরকে ঠুনকো কারণে কাফের-মুশরিক বলে ফৎওয়া দিয়ে থাকে।

(খ) আরেকশ্রেণীর দাঈ আছে, যারা আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সালাফী মানহাজে বিশ্বাসী, কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে শী‘আ রাজনীতির অন্ধভক্ত ও শিরকী গণতন্ত্রের নর্দমায় নিমজ্জিত এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে সূদী অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষক। তারা রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে সালাফী মানহাজে বিশ্বাসী নয়। পক্ষান্তরে আহলেহাদীছগণ শী‘আ রাজনীতিতে যেমন বিশ্বাসী নয়, তেমনি জাতীয়-বিজাতীয় মতবাদ ভিত্তিক কোন জীবন দর্শনেও বিশ্বাসী নয়। তাই তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আহলেহাদীছ বা সালাফীদের বিরুদ্ধাচরণ করে থাকে এবং প্রতিহত করার চক্রান্তে লিপ্ত থাকে। আহলেহাদীছ মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা এবং সমাজ কল্যাণমূলক দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যোগায়। আহলেহাদীছ একটা রোগ, আহলেহাদীছরা শিরকে আকবারের সাথে জড়িত, তথাকথিত আহলেহাদীছ ইত্যাদি ভাষায় তারা চিত্রিত করে। আহলেহাদীছ বলা যাবে না, সালাফী বলে পরিচয় দেয়া যাবে না, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত উচ্চারণ করা যাবে না; বরং সবাই মুসলিম, মুসলিম বলেই পরিচয় দিতে হবে, কোন ভাগাভাগি করা যাবে না, শী‘আ-সুন্নী বলে কোন ভেদাভেদ নেই, শী‘আ-কাদিয়ানীরাও আমাদের ভাই (নাঊযুবিল্লাহ)। সঊদী আরবের সালাফী বিদ্বানগণ সম্পর্কে চরম ঘৃণা প্রদর্শন করে বলে, তারা বাদশার গোলাম, রিয়ালের বিনিময়ে শরী‘আত বিক্রি করে, তারা ইক্বামতে দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ, জিহাদকে অবজ্ঞা করে ইত্যাদি। সঊদী আরবের শাসকগোষ্ঠী মুনাফিক, ইহুদী খ্রিস্টানদের দালাল। ইমাম বুখারী, ইবনু তায়মিয়াহ, আলবানীসহ প্রমুখ আপোসহীন সংস্কারক এবং মুহাদ্দিছ উলামায়ে কেরামকে তারা সহ্যই করতে পারে না।

(গ) আরেকশ্রেণীর ব্যক্তি আক্বীদা ও আমলে কোনটাতেই সালাফী নয়, কিন্তু জনগণের সামনে সালাফী হওয়ার ভান ধরে এবং মুখে সালাফদের কথা বলে (মুতাসাল্লিফ)। এরা মানুষের মাঝে ঘাপটি মেরে থাকে এবং কূট-কৌশলে আহলেহাদীছ সমাজের ক্ষতি করে থাকে। এরা মূলত মানহাজ গোপনকারী, মানসিকভাবে অন্ধ-কট্টর মাযহাবী আর চরম আহলেহাদীছ বিদ্বেষী। তারা সালাফী আক্বীদা ও আমল সম্পর্কে পরিষ্কার কোন কথা বলে না। সব সময় কৌশলে পাশ কাটিয়ে যায় এবং গোঁজামিল দিয়ে মিশ্রির ছুরির ন্যায় সুন্দর করে কথা বলে মানুষের মন জয় করে। জনগণকে খুশি করার জন্য স্থান ও পরিবেশ বুঝে আমল করে এবং কথা বলে। গোল আলুর মত, সব জায়গায় চলে। সমাজের সাথে আপোস করে তাল মিলিয়ে চলে এবং এটাও ঠিক, ওটাও ঠিক বলে সবার কাছে ভাল থাকার চেষ্টা করে। এরা কোন্ মানহাজের তা ধরা দিতে চায় না। এই ধরনের দাঈ মুসলিমদের জন্য বেশী ক্ষতিকর।

(ঘ) সমাজে উচ্চ শিক্ষিত একটি শ্রেণী রয়েছে, যারা আমলে সালাফী কিন্তু আক্বীদায় সালাফীও না আবার খারেজীও না, বরং অতি সালাফী হতে গিয়ে আমলে মুরজিয়া ও আক্বীদায় সূক্ষ্মভাবে খারেজীদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এই শ্রেণীটাই এখন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। সারা বিশ্বেই এর প্রভাব রয়েছে। তারা মূলত কুরআন-হাদীছ কিছু চর্চা করতে গিয়ে নিজেদের মত করে বুঝে। সালাফী মানহাজ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি তাদের নেই। সালাফী মানহাজের আলেমদেরকে তারা অপসন্দ করে না। গোঁড়া, কট্টর, চরমপন্থী ইত্যাদি বলে তাচ্ছিল্য করে থাকে। সালাফী কোন দাঈর মাঝে সাধারণ ত্রুটি লক্ষ্য করলেই বিভিন্ন নামে চিত্রিত করে। তারা মূলত অতি সালাফী। মু‘তাযেলীদের বিরোধিতা করতে গিয়ে যেমন মাতরুদী আক্বীদার জন্ম হয়েছে, তেমনি বর্তমানে তারা বেশী বুঝতে গিয়ে নতুন মানহাজের আমদানি করেছে। 

(ঙ) আরেকশ্রেণীর মানুষ আদব-আখলাক, স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহারে, কথা-বার্তায়  ভাল, কিন্তু আক্বীদা ও আমলে গোঁড়া বিদ‘আতী, সর্বদা মাযার ও কবর পূজায় ব্যস্ত। তারা পীর-ওলী-দরবেশ-বুযর্গের মুরীদ হয়ে তাদেরকে আল্লাহ্র সমকক্ষ মনে করে (নাঊযুবিল্লাহ)। তারা ঢল-তবলা-একতারা নিয়ে খানকায় বসে গান-বাজনা করে এবং বিভিন্ন প্রকার যিকির ও অযীফা চর্চা করে। লক্ষ লক্ষ তরীকা ও শ্রেণীতে তারা বিভক্ত। এদেরকে ব্রেলভী বললে সহজেই চেনা যায়।

(চ) সমাজের বড় একটি শ্রেণী আক্বীদায় মাতরুদী আর আমলে হানাফী মাযহাবের অনুসারী। আদব, আখলাক, দাওয়াত ও তাবলীগে ইলিয়াসী নীতিতে বিশ্বাসী। এটা তাদের প্রকাশ্য ঘোষণা। তাদের কাছে সালাফী মানহাজের কোন মূল্য নেই, বরং পাত্তাই দেয় না। তারা দেওবন্দী মানহাজকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। তারা প্রচলিত কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নখশাবন্দীয়, সোহরাওয়ার্দিয়া এই চার তরীকার বায়‘আত নিয়ে এর অসীলায় মুক্তি কামনা করে। উক্ত দুই শ্রেণীর লোকই হানাফী বলে দাবী করে। কিন্তু  তাদের মধ্যে ইমাম আবু হানীফ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর আক্বীদা-আমলের লেশমাত্র নেই। শুধু তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে তার উপর নানা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে ধর্মীয় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী (১২৬৪-১৩০৪ হি.) বলেন,

فَكَمْ مِنْ حَنَفِىٍّ حَنَفِىٌّ فِى الْفُرُوْعِ مُعْتَزِلِىٌّ عَقِيْدَةً .. وَكَمْ مِنْ حَنَفِىٍّ حَنَفِىٌّ فَرْعًا مُرْجِىٌّ أَوْ زَيْدِىٌّ أَصْلاً وَبِالْجُمْلَةِ فَالْحَنَفِيَّةُ لَهَا فُرُوْعٌ بِاعْتِبَارِ اخْتِلاَفِ الْعَقِيْدَةِ فَمِنْهُمُ الشِّيْعَةُ وَمِنْهُمُ الْمُعْتَزِلَةُ وَمِنْهُمُ الْمُرْجِئَةُ فَالْمُرَادُ بِالْحَنَفِيَّةِ هَاهُنَا هُمُ الْحَنَفِيَّةُ الْمُرْجِئَةُ الَّذِيْنَ يَتَّبِعُوْنَ أَبَاحَنِيْفَةَ فِى الْفُرُوْعِ وَيُخَالِفُوْنَهُ فِى الْعَقِيْدَةِ بَلْ يُوَافِقُوْنَ فِيْهَا الْمُرْجِئَةَ الْخَالِصَةَ

‘অনেক হানাফী শাখা-প্রশাখায় হানাফী আর আক্বীদায় মু‘তাযেলী। ... আবার অনেকে শাখা-প্রশাখায় হানাফী, কিন্তু মূলে তারা মুরজিয়া অথবা ‘যায়দী’ (শী‘আদের একটি উপদল)। মোট কথা আক্বীদাগত পার্থক্যের কারণে হানাফীরা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত। তাদের মধ্যে কেউ শী‘আ, কেউ মু‘তাযেলী, কেউ মুরজিয়া। তবে এখানের আলোচ্য বিষয় হল মুরজিয়া হানাফী, যারা শাখা-প্রশাখায় আবু হানীফার অনুসরণ করে এবং আক্বীদায় তাঁর বিরোধিতা করে। বরং আক্বীদার ক্ষেত্রে তারা খাঁটি মুরজিয়াদের সাথে মিল রেখে চলে’।[১২]

অতএব এই বিভ্রান্তির যুগে দ্বীন অনুসরণ করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং সালাফদের মানহাজ সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা জান্নাতের পথে চলার জন্য সালাফী মানহাজের অনুসরণ করা ছাড়া আর বিকল্প কোন পথ নেই। সেজন্য সালাফদের মানহাজ ছাড়া অন্য যত তরীক্বা, পথ, মত, দল, দর্শন, মাযহাব, মতবাদ প্রচলিত আছে, সবকিছুকেই নিঃশর্তভাবে চিরতরে বর্জন করতে হবে।

 (ইনশাআল্লাহ চলবে)

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৫।
[২]. তাফসীরে ত্বাবারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ২০৪- ويتبع طريقًا غير طريق أهل التصديق، ويسلك منهاجًا غير منهاجهم، وذلك هو الكفر بالله،  لأن الكفر بالله ورسوله غير سبيل المؤمنين وغير منهاجهم।
[৩]. ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২০তম খণ্ড, পৃ. ৫০০।
[৪]. ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২০তম খণ্ড, পৃ. ৫০০।
[৫]. তিরমিযী, হা/২৬৪১; আবূ দাঊদ, হা/৪৫৯৬; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৯২, সনদ ছহীহ।
[৬]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, সনদ ছহীহ।
[৭]. ইবনু আব্দিল বার্র (৩৬৮-৪৬৩ হি.), জামিউ বায়ানিল ইলম, হা/১৮১০; মিশকাত, হা/১৯৩; সিলসিলাহ ছহীহাহ, হা/২৬৪৯-এর আলোচনা দ্রঃ; সনদ হাসান, ছহীহ মিশকাত, হা/১৬০।
[৮]. লালকাঈ (মৃ. ৪১৮ হিঃ), শারহু উছূলিল ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জাম‘আহ, পৃ. ১৫৪, নং ৩১৫।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৮৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯২০, সনদ হাসান।
[১০]. সূরা আল-মায়েদাহ, ৪৮; আহমাদ, হা/১৮৪৩০, সনদ ছহীহ।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০।
[১২]. আর-রাফউ ওয়াত-তাকমীল, পৃ. ৩৮৫-৩৮৬।




জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : মুহাম্মদ ইমরান বিন ইদরিস
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৪তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সুন্নাতের রূপরেখা (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
ব্যভিচার ও ধর্ষণ: সমাধান কোন্ পথে
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১৩তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামী শিষ্টাচার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
অহংকার করা ও তার পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৭ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সালাম প্রদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আরিফ হুসাইন

ফেসবুক পেজ