মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৮:২৮ অপরাহ্ন

ফাযায়েলে কুরআন

-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*


(৪র্থ কিস্তি)

কুরআন অবতরণ


মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّاۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ کَمَاۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی نُوۡحٍ وَّ النَّبِیّٖنَ مِنۡۢ بَعۡدِہٖ  ‘নিশ্চয় আমরা আপনার প্রতি সেরূপ অহি প্রেরণ করেছি যেরূপ নূহ ও তাঁর পরবর্তী নবীদের প্রতি অহি প্রেরণ করেছিলাম’ (সূরা আন-নিসা : ১৬৩)।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। হারিছ ইবনু হিশাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার নিকট অহি কিরূপে আসে? আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,  

أَحْيَانًا يَأْتِيْنِىْ مِثْلَ صَلْصَلَةِ الْجَرَسِ وَهُوَ أَشَدُّهُ عَلَىَّ فَيُفْصَمُ عَنِّىْ وَقَدْ وَعَيْتُ عَنْهُ مَا قَالَ ، وَأَحْيَانًا يَتَمَثَّلُ لِىَ الْمَلَكُ رَجُلًا فَيُكَلِّمُنِىْ فَأَعِىْ مَا يَقُوْلُ

‘কোন কোন সময় তা ঘন্টা বাজার মত আমার নিকট আসে। আর এটিই আমার উপর সবচেয়ে বেদনাদায়ক হয় এবং তা শেষ হতেই ফেরেশতা যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নিই; আবার কখনো ফেরেশতা মানুষের[১] রূপ ধারণ করে আমার সাথে কথা বলেন। যিনি যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নিই’। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘আমি তীব্র শীতের সময় অহি অবতীর্ণ অবস্থায় তাঁকে দেখেছি। অহি শেষ হলেই তাঁর ললাট হতে ঘাম ঝরে পড়ত’।[২]

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট সর্বপ্রথম যে অহি আসে, তা ছিল নিদ্রাবস্থায় বাস্তব স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে প্রভাতের আলোর ন্যায় প্রকাশিত হত। অতঃপর তাঁর নিকট নির্জনতা পছন্দনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং তিনি ‘হেরা’ গুহায় নির্জনে অবস্থান করতেন। আপন পরিবারের নিকট ফিরে এসে কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে- এভাবে সেখানে তিনি এক নাগাড়ে বেশ কয়েক দিন ‘ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। অতঃপর খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট ফিরে এসে আবার একই সময়ের জন্য কিছু খাদ্যদ্রব নিয়ে যেতেন। এভাবে ‘হেরা’ গুহায় অবস্থানকালে তাঁর নিকট অহি আসল। তাঁর নিকট ফেরেশতা এসে বলল, اِقْرَأْ ‘পাঠ করুন’। আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَا أَنَا بِقَارِئٍ ‘আমি পড়তে জানি না’। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, فَأَخَذَنِىْ فَغَطَّنِىْ حَتَّى بَلَغَ مِنِّى الْجَهْدَ ‘সে আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিল যে, আমার খুব কষ্ট হল’। অতঃপর সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘পাঠ করুন’। আমি বললাম, ‘আমি তো পড়তে জানি না’। সে দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিল যে, আমার খুব কষ্ট হল। অতঃপর সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘পাঠ করুন’। আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি তো পড়তে জানি না’। আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, অতঃপর তৃতীয়বারে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে বললেন,

اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ  -خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ  -اِقۡرَاۡ وَ رَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ

‘পাঠ করুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত পি- থেকে, পাঠ করুন, আর আপনার রব অতিশয় দয়ালু’ (সূরা আল-আলাক্ব : ১-৩)। অতঃপর এ আয়াত নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যাবর্তন করলেন। তাঁর হৃদয় তখন কাঁপছিল। তিনি খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট এসে বললেন,زَمِّلُوْنِىْ زَمِّلُوْنِىْ  ‘আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত কর, আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত কর’। তাঁরা তাঁকে চাদর দ্বারা আবৃত করলেন। এমনকি তাঁর শংকা দূর হল। তখন তিনি খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট ঘটনাবৃত্তান্ত জানিয়ে তাঁকে বললেন, لَقَدْ خَشِيْتُ عَلَى نَفْسِىْ ‘আমি নিজেকে নিয়ে শংকা বোধ করছি’। খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন,  

كَلَّا وَاللهِ مَا يُخْزِيْكَ اللهُ أَبَدًا إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ وَتَحْمِلُ الْكَلَّ وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ وَتَقْرِى الضَّيْفَ وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ

‘আল্লাহর কসম! কখনই নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনও লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগীতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক্ব পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন’।

অতঃপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকাহ ইবনু নাওফাল ইবনু আব্দুল আসাদ ইবনু আব্দুল উয্যাহর নিকট গেলেন, যিনি অন্ধকার যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষায় লিখতে পারতেন এবং আল্লাহ্র তাওফীক্ব অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইঞ্জীল হতে ভাষান্তর করতেন। তিনি ছিলেন অতিবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁকে বললেন, ‘হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ওয়ারাকাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাতিজা! তুমি কী দেখ? আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা দেখেছিলেন, সবই বর্ণনা করলেন। তখন ওয়ারাকাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বললেন,هَذَا النَّامُوْسُ الَّذِىْ نَزَّلَ اللهُ عَلَى مُوْسَى يَا لَيْتَنِىْ فِيْهَا جَذَعًا لَيْتَنِىْ أَكُوْنُ حَيًّا إِذْ يُخْرِجُكَ قَوْمُكَ ‘এটা সেই বার্তাবাহক যাকে আল্লাহ মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর নিকট পাঠিয়েছিলেন। ‘আফসোস! আমি যদি সেদিন থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিস্কার করবে।

আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, أَوَمُخْرِجِىَّ هُمْ ‘তারা কি আমাকে বের করে দেবে’? তিনি বললেন,لَمْ يَأْتِ رَجُلٌ قَطُّ بِمِثْلِ مَا جِئْتَ بِهِ إِلَّا عُوْدِىَ وَإِنْ يُدْرِكْنِىْ يَوْمُكَ أَنْصُرْكَ نَصْرًا مُؤَزَّرًا ‘হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছো অনুরূপ (অহি) কিছু যিনিই নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে জোরালোভাবে সাহায্য করব’। এর কিছুদিন পর ওয়ারাকাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইন্তিকাল করেন। আর অহির বিরতি ঘটে।[৩]

عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ  أَنَّهُ سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُحَدِّثُ عَنْ فَتْرَةِ الْوَحْيِ قَالَ فَبَيْنَا أَنَا أَمْشِيْ سَمِعْتُ صَوْتًا مِنَ السَّمَاءِ فَرَفَعْتُ بَصَرِيْ فَإِذَا الْمَلَكُ الَّذِيْ جَاءَنِيْ بِحِرَاءٍ قَاعِدٌ عَلَى كُرْسِيٍّ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ فَجُئِثْتُ مِنْهُ رُعْبًا حَتَّى هَوَيْتُ إِلَى الْأَرْضِ فَجِئْتُ أَهلِيْ فَقُلْتُ زَمِّلُوْنِيْ زَمِّلُوْنِيْ فَأَنْزَلَ اللهُ تَعَالَى (یٰۤاَیُّہَا الۡمُدَّثِّرُ   -  قُمۡ   فَاَنۡذِرۡ  - وَ  رَبَّکَ فَکَبِّرۡ  -  وَ  ثِیَابَکَ فَطَہِّرۡ  - وَ الرُّجۡزَ  فَاہۡجُرۡ) ثُمَّ حُمِيَ الْوَحْيُ وَتَتَابَعَ

জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি অহি স্থগিত হওয়া সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘একদা আমি পথে চলছিলাম এমন সময় আমি আসমানের দিক হতে একটি আওয়ায শুনলাম। অতঃপর আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম যে, হেরা গুহায় যিনি আমার নিকট এসেছিলেন সেই ফেরেশতা আসমান ও যমীনের মাঝখানে একটি কুরসীতে বসে আছেন। তাঁকে দেখে আমি উদ্বিগ্ন হলাম, এমনকি আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। অতঃপর আমি আমার পরিবারের নিকট আসলাম এবং বললাম, আমাকে চাঁদর দিয়ে বস্ত্রাবৃত কর, আমাকে চাঁদর দিয়ে বস্ত্রাবৃত কর। অতঃপর মহান আল্লাহ অবতীর্ণ করলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত। উঠুন! অতঃপর ভীতি প্রদর্শন করুন। এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন, অপবিত্রতা হতে দূরে থাকুন’ (সূরা আল-মুদ্দাস্সির : ১-৫)। এরপর হতে পুরোদমে অহি একের পর এক অবতীর্ণ হতে লাগল।[৪]

আবূ সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ও ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, لَبِثَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَكَّةَ عَشْرَ سِنِيْنَ يُنْزَلُ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ وَبِالْمَدِيْنَةِ عَشْرًا ‘নবী মক্কায় দশ বছর অবস্থান করেন। এ সময় তাঁর প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং মদীনাতেও দশ বছর (তাঁর প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে)।[৫]

আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ক্রমাগত অহি অবতীর্ণ করতে থাকেন এবং তাঁর ইন্তিকালের নিকটবর্তী সময়ে মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অহি অবতীর্ণ করেন। এরপর তাঁর মৃত্যু হয়।[৬]

পবিত্র কুরআন দু’টি পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়েছে। ১. লাওহে মাহফূয থেকে লাইলাতুল ক্বদরে পূর্ণ কুরআন এক সাথে দুনিয়ার আকাশে। ২. দুনিয়ার আকাশ থেকে ২৩ বছর সময়ব্যাপী প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে খণ্ড খণ্ড ভাবে এবং ক্রমে ক্রমে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র রামাযান মাসের লাইলাতুল ক্বদরের রাত্রীতে পূর্ণ কুরআন লাওহে মাহফূয থেকে দুনিয়ার আকাশে বায়তুল ‘ইযযাহ নামক স্থানে কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেছেন।[৭] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اِنَّاۤ  اَنۡزَلۡنٰہُ  فِیۡ  لَیۡلَۃِ  الۡقَدۡرِ  ‘আমরা কুরআনকে ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা আল-ক্বদর : ১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّاۤ  اَنۡزَلۡنٰہُ  فِیۡ  لَیۡلَۃٍ  مُّبٰرَکَۃٍ ‘আমরা তো ইহা অবতীর্ণ করেছি এক রবকতময় রজনীতে’ (সূরা আদ-দুখান : ৩)। এখানে বরকতময় রজনী হল লাইলাতুল ক্বদর।[৮] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ

‘রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন। যা মানুষের হেদায়াত এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)।

সমগ্র কুরআন একবারে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর অবতীর্ণ হয়নি, যেভাবে পূর্ববর্তী নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম)-এর উপর কিতাবসমূহ অবতীর্ণ হয়েছিল। বরং সমগ্র কুরআন লওহে মাহফুয থেকে রামাযান মাসে ক্বদরের রাতে একত্রিতভাবে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ করা হয়। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর পর্যায়ক্রমে অবতীর্ণ করতে থাকেন।

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘সম্পূর্ণ কুরআন এক সাথে লাইলাতুল ক্বদরে দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ করা হয়েছে। এরপর তা বিশ বছরে অবতীর্ণ করা হয়েছে। অতঃপর ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) (কুরআনের আয়াত) পাঠ করেন, وَ لَا یَاۡتُوۡنَکَ بِمَثَلٍ  اِلَّا جِئۡنٰکَ بِالۡحَقِّ وَ  اَحۡسَنَ  تَفۡسِیۡرًا ‘তারা আপনার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করেনি যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমরা আপনাকে দান করিনি’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৩৩)। মহান আল্লাহ বলেন,وَ قُرۡاٰنًا فَرَقۡنٰہُ لِتَقۡرَاَہٗ  عَلَی النَّاسِ عَلٰی  مُکۡثٍ  وَّ  نَزَّلۡنٰہُ  تَنۡزِیۡلًا ‘আমরা কুরআন অবতীর্ণ করেছি খণ্ড খণ্ড ভাবে যাতে আপনি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পারেন ক্রমে ক্রমে; এবং আমরা তা যথাযথভাবে অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৬)।[৯] ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আরো বলেন, ‘পূর্ণ কুরআন একত্রিতভাবে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ করা হয়। এ অবতরণ প্রক্রিয়া ছিল ‘মাওয়াকি‘উন নুযূম’[১০] এর ন্যায়। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবীর উপর এর একটি অংশ অপর অংশের পর অবতীর্ণ করেন।[১১] অতঃপর তিনি (কুরআনের আয়াত) পাঠ করেন, 

وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَوۡ لَا نُزِّلَ عَلَیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ جُمۡلَۃً  وَّاحِدَۃً  کَذٰلِکَ  لِنُثَبِّتَ بِہٖ  فُؤَادَکَ وَ رَتَّلۡنٰہُ تَرۡتِیۡلًا

‘কাফিররা বলে, সমগ্র কুরআন তাঁর নিকট একবারে অবতীর্ণ হল না কেন? এভাবেই আপনার হৃদয়কে ওটা দ্বারা মজবূত করার জন্য এবং ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেছি’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৩২)।

আল-কুরআন কুরাইশ ও আরবদের ভাষায় অবতীর্ণ


‘আল-কুরআন’ কুরাইশ এবং আরবদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ کَذٰلِکَ اَنۡزَلۡنٰہُ  قُرۡاٰنًا عَرَبِیًّا ‘এরূপেই আমরা কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায়’ (সূরা ত্বা-হা : ১১৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, بِلِسَانٍ عَرَبِیٍّ مُّبِیۡنٍ ‘অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়’ (সূরা আশ-শুআ‘রা : ১৯৫)।

আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যায়দ ইবনু ছাবিত, সা‘ঈদ ইবনুল ‘আস, ‘আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়র এবং ‘আব্দুর রহমান ইবনু হারিছ ইবনু হিশাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-কে পবিত্র কুরআন গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার জন্য আদেশ দিলেন এবং তাদেরকে বললেন,

إِذَا اخْتَلَفْتُمْ أَنْتُمْ وَزَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ فِىْ عَرَبِيَّةٍ مِنْ عَرَبِيَّةِ الْقُرْآنِ فَاكْتُبُوْهَا بِلِسَانِ قُرَيْشٍ فَإِنَّ الْقُرْآنَ أُنْزِلَ بِلِسَانِهِمْ

‘আল-কুরআনের কোন শব্দের আরাবী হওয়ার ব্যাপারে যায়দ ইবনু ছাবিতের সঙ্গে তোমাদের মতভেদ দেখা দিলে তোমরা তা কুরাইশদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে। কারণ, কুরআন তাদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে’। অতএব তাঁরা তাই করলেন।[১২]

আল-কুরআন সাত রীতিতে অবতীর্ণ


আল-কুরআন সাত আঞ্চলিক ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু  হিযামকে আমি যেভাবে পড়ি, তার থেকে ভিন্নরূপে সূরা ‘ফুরক্বান’ পড়তে শুনলাম। আর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে তা পড়িয়েছেন। অতএব আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলাম। কিন্তু ছালাত শেষ করা পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দিলাম। অতঃপর আমি তাকে তার চাদর গলায় পেঁচিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট নিয়ে গেলাম। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি আমাকে যেরূপে পড়িয়েছেন তা হতে ভিন্নরূপে আমি একে সূরা ‘ফুরক্বান’ পড়তে শুনেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে ছেড়ে দাও এবং বললেন, তুমি পড়। তখন আমি তাকে যেরূপ পড়তে শুনেছিলাম সে সেরূপই পড়ল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এরূপে এটি নাযিল হয়েছে অতঃপর আমাকে বললেন, তুমি পড়। সুতরাং আমিও পড়লাম। তখন তিনি বললেন, এটা এরূপেও নাযিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,إِنَّ الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ ‘এই কুরআন সাত রীতিতে নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের যেরূপ সহজ হয় সেরূপই পড়’।[১৩]

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,أَقْرَأَنِيْ جِبْرِيْلُ عَلَى حَرْفٍ فَرَاجَعْتُهُ فَلَمْ أَزَلْ أَسْتَزِيْدُهُ وَيَزِيْدُنِيْ حَتَّى إِنْتَهَى إِلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ ‘জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে একভাবে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। এরপর আমি তাঁকে অন্যভাবে পাঠ করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলাম এবং বার বার অন্যভাবে পাঠ করার জন্য ক্রমাগত অনুরোধ করতে থাকলে তিনি আমার জন্য তেলাওয়াত পদ্ধতি বাড়িয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে তিনি সাত আঞ্চলিক ভাষায় তেলাওয়াত করে সমাপ্ত করলেন’।[১৪]

আব্দুল্লাহ  ইবনু  মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে কুরআন পড়তে শুনলাম, অথচ আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তার বিপরীত পড়তে শুনেছি। সুতরাং আমি তাকে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট নিয়ে গেলাম এবং তা জানালাম। তখন আমি তাঁর চেহারায় বিরক্তির ভাব লক্ষ্য করলাম। তিনি বললেন, كِلَاكُمَا مُحْسِنٌ فَلَا تَخْتَلِفُوْا فَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ اِخْتَلَفُوْا فَهَلَكُوْا ‘তোমাদের উভয়ই শুদ্ধ। সুতরাং তোমরা এটা নিয়ে মতবিরোধ কর না। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত হয়েছিল, ফলে তারা ধ্বংস হয়েছিল।[১৫]

উবাই  ইবনু  কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মসজিদে ছিলাম এমন সময় এক ব্যক্তি এসে ছালাত পড়তে লাগল। সে এমন রীতিতে ক্বিরাআত পড়ল, যা আমার অজানা ছিল। অতঃপর অপর এক ব্যক্তি আসল এবং প্রথম ব্যক্তি হতে ভিন্ন রীতিতে ক্বিরাআত পড়ল। যখন আমরা ছালাত শেষ করলাম সকলেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট গেলাম এবং আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! এ ব্যক্তি এমন রীতিতে ক্বিরাআত পড়েছে, যা আমার জানা নেই। অতঃপর দ্বিতীয় ব্যক্তি এসে ভিন্ন রীতিতে ক্বিরাআত পড়ল। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের উভয়কে নির্দেশ দিলেন, তারা কুরআন পড়ল আর তিনি উভয়ের পড়াকেই শুদ্ধ বললেন। এতে আমার মনে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি এমন এক সন্দেহের সৃষ্টি হল, যা জাহেলিয়াতের যুগেও হয়নি। অতঃপর যা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লক্ষ্য করে আমার সিনার উপর হাত মারলেন। এতে আমি ঘামে ভিজে গেলাম এবং এতই ভীত হলাম যেন আমি আল্লাহকে দেখছি। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন,

يَا أُبَيُّ أُرْسِلَ إِلَيَّ أَنِ اقْرَإِ الْقُرْآنَ عَلَى حَرْفٍ فَرَدَدْتُ إِلَيْهِ أَنْ هَوِّنْ عَلَى أُمَّتِيْ فَرَدَّ إِلَيَّ الثَّانِيَةَ إِقْرَأْهُ عَلَى حَرْفَيْنِ فَرَدَدْتُ إِلَيْهِ أَنْ هَوِّنْ عَلَى أُمَّتِيْ فَرَدَّ إِلَيَّ الثَّالِثَةَ إِقْرَأْهُ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ وَلَكَ بِكُلِّ رَدَّةٍ رَدَدْتُكَهَا مَسْأَلَةٌ تَسْأَلُنِيْهَا

‘হে উবাই! আমার নিকট অহি পাঠানো হয়েছিল যে, এক রীতিতে কুরআন পড়ুন। কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট আরয করলাম যে, আপনি আমার উম্মতের প্রতি সহজ করে দিন। তখন আল্লাহ দ্বিতীয়বারে উত্তর দিলেন, তবে দুই রীতিতে পড়ুন। আমি পুনরায় আরয করলাম, আপনি আমার উম্মতের প্রতি আরও সহজ করে দিন, আল্লাহ তৃতীয়বারে উত্তর দিলেন, তবে সাত রীতিতে পড়ুন। আর আপনার প্রত্যেক আবেদনের পরিবর্তেই আমি আপনাকে যা দিয়েছি, সেগুলোর প্রতিটির সাথে আরো একটি করে আবেদনের অধিকার আপনার আছে, তা আপনি চেয়ে নিতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমি বললাম, 

أَللهمّ اغْفِرْ لِأُمَّتِيْ اللهم اغْفِرْ لِأُمَّتِيْ وَأَخَّرْتُ الثَّالِثَةَ لِيَوْمٍ يَرْغَبُ إِلَيَّ الْخَلْقُ كُلُّهُمْ حَتَّى إِبْرَاهِيْمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ

‘হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতকে ক্ষমা করে দিন! হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতকে ক্ষমা করে দিন। আর তৃতীয়টি আমি এমন দিনের জন্য পিছিয়ে রাখলাম, যে দিন সমগ্র সৃষ্টি আমার সুপারিশের দিকে চেয়ে থাকবে, এমনকি ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)ও’।[১৬]

উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর সাক্ষাৎ লাভ করলেন এবং বললেন, ‘হে জিবরীল (আলাইহিস সালাম)! আমি একটি নিরক্ষর উম্মতের প্রতি প্রেরিত হয়েছি, এদের মধ্যে প্রবীণ বৃদ্ধা, প্রবীণ বৃদ্ধ, কিশোর, কিশোরী এবং এমন ব্যাক্তি, যে কখনও কোন বই পড়েনি। তিনি বললেন, يَا مُحَمَّدُ إِنَّ الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ ‘হে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কুরআন সাত রীতিতে নাযিল করা হল’।[১৭]

সুনানু নাসাঈর বর্ণনায় এসেছে যে , রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) ও মীকাঈল (আলাইহিস সালাম) আমার নিকট আসলেন এবং জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমার ডান দিকে ও মীকাঈল (আলাইহিস সালাম) আমার বাম দিকে বসলেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি এক রীতিতে কুরআন পড়ুন। তখন মীকাঈল (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি তাঁর নিকট বৃদ্ধির আবেদন করুন। অবশেষে তা সাত রীতি পর্যন্ত পৌঁছল।[১৮]

আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফতকালে লোকজনের বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ ছাহাবীগণকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! ইহুদী ও নাছারাদের ন্যায় আল্লাহর কিতাবে বিভিন্নতা সৃষ্টির পূর্বে আপনি এই জাতিকে রক্ষা করুন। সুতরাং ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উম্মুল মুমিনীন হাফছা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট বলে পাঠালেন, আপনার নিকট রক্ষিত কুরআনের ছহীফাসমূহ আমাদের নিকট পাঠিয়ে দিন। আমরা তা বিভিন্ন মাছহাফে অনুলিপি করে অতঃপর তা আপনাকে ফিরিয়ে দিব। হাফছা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তা ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যায়েদ ইবনু ছাবেত, আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়র, সাঈদ  ইবনুল ‘আছ, আব্দুল্লাহ ইবনু হারেছ ও ইবনু হিশাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-কে তা লিপিবদ্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। তাঁরা মাসহাফে তা লিপিবদ্ধ করলেন। সে সময় ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তিন সদস্যের কুরাইশ দলকে বললেন, إِذَا اخْتَلَفْتُمْ أَنْتُمْ وَزَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ فِىْ شَىْءٍ مِنَ الْقُرْآنِ فَاكْتُبُوْهُ بِلِسَانِ قُرَيْشٍ فَإِنَّمَا نَزَلَ بِلِسَانِهِمْ  فَفَعَلُوا ذَلِكَ ‘যখন কুরআনের কোন স্থানে আপনাদের মতভেদ হবে, তখন আপনারা তা কুরাইশদের রীতিতেই লিপিবদ্ধ করবেন। কেননা কুরআন তাদের রীতিতেই অবতীর্ণ হয়েছে’। তাঁরা সে মতে কাজ করলেন। অবশেষে যখন তাঁরা সমস্ত ছহীফা বিভিন্ন মাছহাফে লিপিবদ্ধ করলেন, ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উক্ত ছহীফাসমূহ হাফছা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট ফেরত পাঠালেন এবং তাঁরা যা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার এক এক কপি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন, আর এটা ছাড়া যে কোন ছহীফায় বা মাছহাফে লেখা কুরআনকে জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।[১৯]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

*পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. জিবরীল (আলাইহিস সালাম) ছাহাবী দাহইয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর রূপ ধরে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কথা বলতেন। যেনন হাদীছে এসেছে, আবূ ‘উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে অবগত করা হয়েছে যে, একদা জিবরীল (আলাইহিস সালাম) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আগমন করলেন। তখন উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর কাছে ছিলেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? অথবা তিনি এ রকম কোন কথা জিজ্ঞেস করলেন। উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, ইনি দাহইয়া। তারপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভাষণে জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর খবর না শুনা পর্যন্ত আমি তাঁকে দাহইয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-ই মনে করেছি।-দ্র. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৮০, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘অহি কিভাবে অবতীর্ণ হয় এবং সর্বপ্রথম যা অবতীর্ণ হয়েছিল’ অনুচ্ছেদ।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/২, ৩২১৫, ‘অহির সূচনা’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি কিভাবে অহি শুরু হয়েছিল’ অনুচ্ছেদ।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩, ৪৯৫৩, ‘অহির সূচনা’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি কিভাবে অহি শুরু হয়েছিল’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৪, ৩২৩৮, ৪৫২৬, ‘অহির সূচনা’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি কিভাবে অহি শুরু হয়েছিল’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬১।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৭৮, ৪৯৭৯, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘অহি কিভাবে অবতীর্ণ হয় এবং সর্বপ্রথম যা অবতীর্ণ হয়েছিল’ অনুচ্ছেদ।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৮২, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘অহি কিভাবে অবতীর্ণ হয় এবং সর্বপ্রথম যা অবতীর্ণ হয়েছিল’ অনুচ্ছেদ।
[৭]. আবূ হাতিম আর-রাযী, তাফসীর ইবনু আবী হাতিম (ছাইদা : আল-মাকতাবাতুল ‘আছরিয়্যাহ, তা.বি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৬৯০।
[৮]. আবূ মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনু মাসঊদ আল-বাগাবী, তাফসীরে বাগাবী, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২২৭; আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু আবূ বকর ইবনু ফারহুল আনছারী শামসুদ্দীন কুরতুবী, ‘আল-জা‘মেঊ লি-আহকামিল কুরআন (রিয়াদ : দারুল আলিমিল কুতুব, তাবি), ১৬তম খণ্ড, পৃ. ১২৫; তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৪৫; মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ শাওকানী, তাফসীরে ফাৎহুল ক্বাদীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪২২।
[৯]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা‘বীলিল কুরআন, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ১১৩; মুসতাদরাক হাকিম, হা/২৮৭৮, ৩৯৫৮; সনদ ছহীহ।
[১০]. ‘মাওয়াকি‘উন নুযূম’ হল- আকাশে যেমন তারকারাজী একটির পর একটি বিচ্ছিন্নভাবে উদিত হয় এবং সমস্ত আকাশ ছেয়ে যায়। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ঘটনা এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরআনের আয়াতগুলো যেভাবে আল্লাহ তা‘আলা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর অবতরণ করার ইচ্ছা পোষণ করেন, ঠিক সেভাবেই তিনি আয়াতগুলো প্রথম আসমানে অবতীর্ণ করেন।-দ্র. ড. মুহাম্মাদ শফিকুল্লাহ, ‘উলূমু‘ল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৩।
[১১]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা‘বীলিল কুরআন, ২৪তম খণ্ড, পৃ. ৫৪৩; মুসতাদরাক হাকিম, হা/২৮৭৮, ৩৯৫৮; সনদ ছহীহ।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৮৪, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৪১, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৮১৮।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯১, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৭৬, ‘আহাদীছুল আম্বিয়া’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৪; মিশকাত, হা/২২১২।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮২০, ‘ছালাতুল মুসাফিরীন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৮।
[১৭]. তিরমিযী, হা/২৯৪৪, ‘ক্বিরাআত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১১; মিশকাত, হা/২২১৫।
[১৮]. নাসাঈ, হা/৯৪১, ‘আল-ইফতিতাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৭; মিশকাত, হা/২২১৫।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৮৭, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘জাম‘উল কুরআন’ অনুচ্ছেদ; তিরমিযী, হা/৩১০৪; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৫০৬; মিশকাত, হা/২২২১।




প্রসঙ্গসমূহ »: কুরআনুল কারীম
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় (শেষ কিস্তি) - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম সাধনা - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ফাযায়েলে কুরআন (৭ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৩তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২০তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ