বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৩ অপরাহ্ন
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায়
-মূল : মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদক : আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ*

(৬ষ্ঠ কিস্তি)

সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করার সাথে-সাথে সিজদা করা।
আল-কুরআন তিলাওয়াতের আদব হল সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে সিজদা করা। আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা নবী ও সৎকর্মশীলদের প্রশংসা করেছেন এ কথা বলে যে, إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا ‘তাদের নিকটে দয়াময়ের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হলে তারা ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়ত’ (সূরা মারইয়াম : ৫৮)। ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,

أَجْمَعَ الْعُلَمَاءُ عَلَى شَرْعِيَّةِ السُّجُوْدِ هَاهُنَا اِقْتِدَاءً بِهِمْ وَاِتِّبَاعًا لِمُنَوَالِهِمْ

‘এখানে ক্রন্দনকারী, সিজদাকারী ও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিজদা করার বিষয়ে আলেমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন’।[১] ছালাতে তিলাওয়াতে সিজদার সময় সিজদা করা খুবই মর্যাদাপূর্ণ কাজ। এর দ্বারা ছালাতে মনোযোগ ও বিনয়াবনত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ یَخِرُّوۡنَ لِلۡاَذۡقَانِ یَبۡکُوۡنَ وَ یَزِیۡدُہُمۡ خُشُوۡعًا ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৯)। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত রয়েছে যে, তিনি ছালাতে সূরা নাজ্ম তিলাওয়াত করে সিজদা করেছেন। যা ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তার ‘ছহীহ’-তে আবূ রাফি‘ থেকে বর্ণনা করেছেন। আবূ রাফি‘ বলেন,

عَنْ أَبِىْ رَافِعٍ قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ أَبِىْ هُرَيْرَةَ الْعَتَمَةَ فَقَرَأَ اِذَا السَّمَآءُ انۡشَقَّتۡ فَسَجَدَ فَقُلْتُ لَهُ قَالَ سَجَدْتُ خَلْفَ أَبِى الْقَاسِمِ فَلَا أَزَالُ أَسْجُدُ بِهَا حَتَّى أَلْقَاهُ

‘আমি আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে এশার ছালাত আদায় করলাম, যখন তিনি اِذَا السَّمَآءُ انۡشَقَّتۡ তথা ‘সূরা ইনশিক্বাক্ব’ তিলাওয়াত করলেন, তখন সিজদা করলেন। আমি তাকে সিজদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি আবুল ক্বাসিম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পেছনে সিজদা করেছি, তাই যতদিন পর্যন্ত না তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় ততদিন আমি সিজদা করতেই থাকব’।[২] সুতরাং ছালাতে একজন মুছল্লীর জন্য আবশ্যক হল- তিলাওয়াতে সিজদাকে বিশেষভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে গুরুত্ব দেয়া।

ছালাতে তিলাওয়াতে সিজদায় সিজদা করার মাধ্যমে শয়তানকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হয় এবং তাকে কাঁদানো হয়। ফলে সিজদা শয়তানকে ছালাতে মুছল্লীদের ধোঁকা দেয়া ও চক্রান্ত করা হতে দুর্বল করে দেয়। এ মর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا قَرَأَ ابْنُ آدَمَ السَّجْدَةَ اعْتَزَلَ الشَّيْطَانُ يَبْكِى يَقُوْلُ يَا وَيْلَهُ أُمِرَ بِالسُّجُوْدِ فَسَجَدَ فَلَهُ الْجَنَّةُ وَأُمِرْتُ بِالسُّجُوْدِ فَعَصَيْتُ فَلِىَ النَّارُ

‘আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন আদম সন্তান সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে সিজদা করে, তখন শয়তান কাঁদতে-কাঁদতে দূরে সরে যায় এবং সে বলে, হায় আমার দুর্ভোগ, আদম সন্তানকে সিজদা করার জন্য আদেশ করা হয়েছে তাই সে সিজদা করছে, তাই তার জন্য রয়েছে জান্নাত। পক্ষান্তরে আমাকে সিজদা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু আমি নাফরমানি করেছি, তাই আমার জন্য জাহান্নাম’।[৩]

আল্লাহ তা‘আলার নিকট শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা।
শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু। শয়তানের শত্রুতার ধরন হল, সে মুছল্লির ছালাতে কু-মন্ত্রণা, সন্দেহ সৃষ্টি করে, যাতে করে ছালাতে মুছল্লির খুশূ‘-খুযূ‘-একাগ্রতা ও বিনয়াবনত দূর হয়ে যায় এবং মুছল্লির ছালাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। একজন বান্দা যখনই আল্লাহ্র যিক্র অথবা অন্য ইবাদতের দিকে মনোযোগী বা আকৃষ্ট হয় শয়তান তখনই তাকে কু-মন্ত্রণা দিতে শুরু করে। সুতরাং একজন বান্দার জন্য আবশ্যক হল সে ইবাদতে অটল-অবিচল থাকবে, ধৈর্যধারণ করবে এবং যিক্র, ছালাত বা অন্যান্য ইবাদতে সদা-সর্বদা নিমগ্ন ও সচেষ্ট থাকবে, কোন ধরনের বিরক্তি-অস্বস্তি প্রকাশ করবে না। কেননা ইবাদত অব্যাহত রাখা ও তাতে লেগে থাকার মাধ্যমে শয়তানী ষড়যন্ত্র তার থেকে দূরে চলে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ کَیۡدَ الشَّیۡطٰنِ کَانَ ضَعِیۡفًا ‘নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল’ (সূরা আন-নিসা : ৭৬)।

একজন বান্দা যখনই তার অন্তর দ্বারা ইবাদতে আকৃষ্ট-মনোযোগী হতে চায়, শয়তান তখনই অন্য কোন একটি বিষয় তার সামনে এনে তাকে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে। এ জন্যই শয়তান হল ডাকাত কিংবা ছিনতাইকারীর ন্যায়। একজন বান্দা যখনই আল্লাহর পথে গমন করে বা বের হয়, তখনই শয়তান তাকে সে পথ থেকে বিচ্যুত করতে এবং বাধা দিতে চায়। এ জন্য একজন সালাফকে (মনীষীকে) জিজ্ঞেস করা হল, إِنَّ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى يَقُوْلُوْنَ لَا نُوَسْوَسُ قَالَ صَدَقُوْا وَمَا يَصْنَعُ الشَّيْطَانُ بِالْبَيْتِ الْخَرِبِ ‘নিশ্চয় ইহুদী-খ্রিষ্টানরা বলে যে, শয়তান আমাদেরকে কুমন্ত্রণা দেয় না। তখন তিনি বললেন, তারা সত্য কথাই বলেছে, খারাপ বা নষ্ট ঘরে শয়তান প্রবেশ করে কী করবে’?[৪]

এ বিষয়টিকে সুন্দর একটি উপমা দিয়ে উপস্থাপন করা যায়। যথা : তিনটি ঘর। তন্মধ্যে একটি বাদশাহর ঘর, যাতে রয়েছে বাদশাহর ধন-সম্পদ, গোলাবারুদের ভা-ার এবং মণি-মুক্তা। আরেকটি দাসের ঘর, যাতে রয়েছে দাসের ধন-সম্পদ, গোলাবারুদের ভা-ার এবং মণি-মুক্তা। তবে এসব গোলাবারুদের ভাণ্ডার, মণি-মুক্তা বাদশাহর মত নয়। আরেকটি খালি ঘর; যা শূন্য, তাতে কিছুই নেই। সুতরাং চোর যখন সেই ঘরগুলোতে চুরি করতে আসবে, তখন সে কোন্ ঘরে চুরি করার জন্য প্রবেশ করবে?[৫]

যখন বান্দা ছালাতে দণ্ডায়মান হয় তখন শয়তান তার উপর ঈর্ষা ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে। কেননা বান্দা তখন একটি সুমহান স্থান ও আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছে আর তা শয়তানের জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক, ক্রোধ, রাগ-বিরাগের স্থান এবং তার জন্য খুবই কঠিন একটি বিষয়। একজন বান্দা যেন যথাযথভাবে ছালাতকে সম্পাদন করতে না পারে সে জন্য শয়তান প্রাণপণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে এমনকি ছালাতে মুছল্লীকে বিভিন্ন ধরনের আশার বাণী এবং প্রতিশ্রুতি-অঙ্গীকার দেয়। এভাবে সে মুছল্লির ছালাতকে ভুলিয়ে দেয়ার জন্য বিরতিহীনভাবে তার চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যয় করার দ্বারা লেগেই থাকে। শয়তান একজন বান্দাকে ছালাত থেকে বিরত রাখার জন্য তার সৈন্য-সামন্ত যেমন হাতি-ঘোড়া ব্যবহার সহ আরও যত ধরনের কলা-কৌশল প্রয়োগ করা যায় সব ধরনের প্রচেষ্টা প্রয়োগ করে। যাতে করে বান্দা ছালাতের মর্যাদাকে তুচ্ছ মনে করে, এক পর্যায়ে সে ছালাতকেও গুরুত্বহীন মনে করে এবং ছালাত আদায় করা ছেড়ে দেয়।

পক্ষান্তরে শয়তান যখন কোন বান্দার ছালাতের মনোযোগ বিনষ্ট করতে অক্ষম হয় এবং বান্দাও শয়তানের ফাঁদে না পড়ে তার বিদ্রোহ করে এবং ছালাতে দণ্ডায়মান হয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন আল্লাহ্র চরম শত্রু শয়তান বান্দার মাঝে ও তার অন্তরের মাঝে ভয়ানকভাবে প্রবেশ করে এবং বান্দা যাতে ছালাতে মনোযোগী হতে না পারে সেজন্য তার মাঝে ও তার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা বা দেয়াল তৈরি করে এবং মনোযোগ অন্য দিকে ফিরিয়ে দেয়। শয়তান বান্দার ছালাতে এমন এমন বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দেয় যেগুলো বান্দার ছালাতে দ-ায়মান হওয়ার পূর্বে স্মরণে ছিল না। এমনকি বান্দার এমন কিছু বিষয় যা তার প্রয়োজনীয় এবং সে তা থেকে নিরাশ হয়ে গেছে সেসব ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দেয়। যাতে করে ছালাতে মুছল্লির অন্তরকে এসব চিন্তা-ভাবনায় ব্যস্ত রাখা যায় এবং মহান আল্লাহর স্মরণ ও ভয়-ভীতি থেকে দূরে এবং বিরত রাখা যায়। সুতরাং বান্দা এক পর্যায়ে ছালাতে মনোসংযোগ বিহীন অবস্থায় দণ্ডায়মান হয়।

আল্লাহকে মনে-প্রাণে সামনে রেখে তাঁকে স্মরণ করে মনোযোগ সহকারে একজন ছালাত আদায়কারী ব্যক্তি যেরূপ আল্লাহর নৈকট্য, সান্নিধ্য ও প্রতিদান অর্জন করতে পারে যার অন্তর ছালাতে নেই সে অনুরূপ নৈকট্য, সান্নিধ্য ও প্রতিদান অর্জন করতে পারে না। সে ছালাতের পূর্বে যেরূপ বিশাল-ভারী পাপের বোঝা নিয়ে দণ্ডায়মান হয়েছিল অনুরূপ পাপের ভারী বোঝা নিয়েই ছালাত থেকে প্রত্যাবর্তন করে। এমনভাবে তার ছালাত আদায়ের কারণে তার পাপের বোঝা সামান্য পরিমাণও হালকা হল না। কেননা নিশ্চয় ছালাত ঐ মুছল্লির পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়, যে ছালাতের হক্বসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে, ছালাতের খুশূ‘-খুযূ‘ মনোযোগের সাথে পরিপূর্ণ করে এবং ছালাত আদায় করার সময় মহান আল্লাহ্র সামনে মন-প্রাণ সহকারে একনিষ্ঠভাবে দণ্ডায়মান হয়।[৬]

শয়তানের ষড়যন্ত্র ও তার কুমন্ত্রণাকে প্রতিহত করার জন্য নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের নিম্নে উল্লিখিত চিকিৎসার মাধ্যমে দিক-নির্দেশনা শিক্ষা দিয়েছেন। যথা :

عن أَبِى الْعَاصِ رضى الله عنه قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ حَالَ بَيْنِىْ وَبَيْنَ صَلَاتِىْ وَقِرَاءَتِىْ يَلْبِسُهَا عَلَىَّ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ذَاكَ شَيْطَانٌ يُقَالُ لَهُ خِنْزَبٌ فَإِذَا أَحْسَسْتَهُ فَتَعَوَّذْ بِاللهِ مِنْهُ وَاتْفِلْ عَلَى يَسَارِكَ ثَلَاثًا قَالَ فَفَعَلْتُ ذَلِكَ فَأَذْهَبَهُ اللهُ عَنِّى

আবুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! নিশ্চয় শয়তান আমার মাঝে ও আমার ছালাতের মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এবং আমার কিরাআত পড়ার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এটা ‘খিনযাব’ নামক শয়তান। যখন তুমি অনুভব করবে তথা বুঝতে পারবে (যে সে তোমাকে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে), তখন আল্লাহর নিকটে শয়তানের প্ররোচণা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং বামদিকে তিনবার থুথু ফেলবে। তিনি বলেন, আমি এরূপ করলে আল্লাহ তা‘আলা আমার থেকে শয়তানকে দূর করে দেন’।[৭]

ছালাতে মুছল্লীকে শয়তানের চক্রান্ত-কুমন্ত্রণা দেয়া এবং তা থেকে উত্তরণের চিকিৎসা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে অবহিত করেছেন যে,

إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا قَامَ يُصَلِّى جَاءَ الشَّيْطَانُ فَلَبَسَ عَلَيْهِ حَتَّى لَا يَدْرِى كَمْ صَلَّى فَإِذَا وَجَدَ ذَلِكَ أَحَدُكُمْ فَلْيَسْجُدْ سَجْدَتَيْنِ وَهُوَ جَالِسٌ

‘যখন তোমাদের কেউ ছালাতে দ-ায়মান হয়, তখন শয়তান এসে তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে অর্থাৎ, তার ছালাতকে এলোমেলা করে দেয় এবং তাকে সংশয়-সন্দেহে পতিত করে। এমনকি তার এমন অবস্থা হয় যে, সে কত রাক‘আত ছালাত আদায় করল তা সে জানে না অর্থাৎ সে ভুলে যায়। অতএব যখন তোমাদের কারো এরূপ অবস্থা হবে, তখন সে যেন বসা অবস্থাতেই দু’টি সিজদা করে নেয়’।[৮] অনুরূপভাবে শয়তানের ষড়যন্ত্র ও ধোঁকা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে তার বাণীর মাধ্যমে জানিয়েছেন যে,

إِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ فِى الصَّلَاةِ فَوَجَدَ حَرَكَةً فِىْ دُبُرِهِ أَحْدَثَ أَوْ لَمْ يُحْدِثْ فَأَشْكَلَ عَلَيْهِ فَلَا يَنْصَرِفْ حَتَّى يَسْمَعَ صَوْتًا أَوْ يَجِدَ رِيْحًا

‘তোমাদের কেউ যদি ছালাত আদায়রত অবস্থায় পশ্চাৎ-দ্বারে স্পন্দন অনুভব করে, অথবা বায়ু নির্গত হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে তার সন্দেহ সৃষ্টি হয়, তাহলে শব্দ না শুনা কিংবা গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত সে ছালাত ছেড়ে দিবে না’।[৯] বরং শয়তানের ষড়যন্ত্র অনেক সময় আশ্চর্যের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। যেমনটি নিম্নে বর্ণিত হাদীছ দ্বারা স্পষ্ট হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত,

أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم سُئِلَ عَنِ الرَّجُلِ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ فِيْ صَلَاتِهِ أَنَّهُ أَحْدَثَ وَلَمْ يُحْدِثْ

‘নিশ্চয় নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল যার মনে হচ্ছে যে, ছালাতরত অবস্থায় তার বায়ু নির্গত হয়ে তার ওযূ নষ্ট হয়ে গেছে অথচ তার ওযূ নষ্ট হয়নি’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,

إِنَّ الشَّيْطَانَ يَأْتِيْ أَحَدَكُمْ وَهُوَ فِيْ صَلَاتِهِ حَتَّى يَفْتَحَ مَقْعَدَتَهُ فَيُخَيَّلُ إِلَيْهِ أَنَّهُ أَحْدَثَ وَلَمْ يُحْدِثْ فَإِذَا وَجَدَ أَحَدُكُمْ ذَلِكَ فَلَا يَنْصَرِفَنَّ حَتَّى يَسْمَعَ صَوْتَ ذَلِكَ بِأُذُنِهِ أَوْ يَجِدَ رِيحَ ذَلِكَ بِأَنْفِهِ

‘নিশ্চয় শয়তান তোমাদের ছালাতে উপস্থিত হয়ে তার পায়ু পথ খুলে দেয়। ফলে সে মনে করে তার ওযূ নষ্ট হয়ে গেছে অথচ তার ওযূ নষ্ট হয়নি। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন এরূপ সমস্যার সম্মুখীন হবে, তখন সে যেন ছালাত থেকে ফিরে না যায় যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার নিজ কানে বায়ুর শব্দ শুনতে না পায় অথবা তার নাকে বায়ুর গন্ধ না পায়’।[১০]

মাসআলা
ছালাতে এক ধরনের শয়তানী ধোঁকা রয়েছে, যে ধোঁকা ‘খিনযাব’ নামক শয়তান উত্তম ও মনোযোগী মুছল্লিদের দিয়ে থাকে। আর তাহল ছালাতে মুছল্লির মনোযোগকে ছালাত থেকে সরিয়ে অন্যান্য ইবাদতের চিন্তা-ভাবনায় ব্যতিব্যস্ত করে দেয়া। যেমন মুছল্লির মনোসংযোগকে বিভিন্ন দাওয়াতী কাজের দিকে এবং ইলমী মাসআলার দিকে নিমগ্ন করে দেয়া। ফলে মুছল্লীগণ সেই চিন্তাতেই ডুবে যায় এবং তারা ছালাতের একটি অংশে কী করল তা বুঝতেই পারে না।

কখনও কখনও মুছল্লীগণ এটা মনে করে ধোঁকায় পড়ে যে, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছালাতে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করতেন (এজন্য ছালাতে ইলমী কিংবা ইবাদতের আলোচনা করা বৈধ)। এই বিষয়টি আমরা শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর আলোচনা থেকে স্পষ্ট আকারে জানব। তিনি বিষয়টি স্পষ্টাকারে আলোচনা করেছেন এবং এর সুস্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন।

ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন,

وَإِنِّيْ لَأَجَهِّزُ جَيْشِيْ وَأَنَا فِي الصَّلَاةِ

‘আমি ছালাতে আমার সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করি’।[১১] এটা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে নির্দিষ্ট একটি বিষয়। কেননা তিনি আমীরুল মুমিনীন হওয়ায় জিহাদের জন্য আদিষ্ট ছিলেন এবং তিনি জিহাদের আমীরও ছিলেন। ফলে একদিক থেকে তিনি ঐ মুছল্লির ন্যায় যে শত্রুর মুখোমুখি হওয়া অবস্থায় যুদ্ধের মাঠেই ‘ছালাতুল খওফ’ তথা ভীতির ছালাত আদায় করছে; হয়ত সে যুদ্ধরত অবস্থায় আছে কিংবা যুদ্ধরত অবস্থায় নেই। তবে সে যেমনিভাবে ছালাতের জন্য আদিষ্ট অনুরূপভাবে জিহাদের জন্যও আদিষ্ট। সুতরাং তার সক্ষমতানুসারে তাকে দু’টি ওয়াজিব কাজই একসাথে সম্পাদন করতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمۡ فِئَۃً فَاثۡبُتُوۡا وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা কোন দলের মুখোমুখি হও তখন তোমরা স্থির, অবিচল থাক আর আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। অবশ্যই তোমরা সফলকাম হবে’ (সূরা আল-আনফাল : ৪৫)। একথা আমাদের সকলের জানা যে, জিহাদ চলাকালীন সময়ে আমাদের অন্তরের অবস্থা এবং সাধারণ সময়ে আমাদের অন্তরের অবস্থা এক রকম নয়। সুতরাং যদি এমন হয় যে, জিহাদের কারণে ছালাতের কোন বিষয়ে কমতি হয়েছে কিংবা অন্য কোন দিকে মনোযোগ চলে গেছে, তাহলে এর কারণে মুছল্লির ঈমানের পূর্ণতা ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে তা কোন ধরনের আঘাত হানবে না।

একারণেই সাধারণ অবস্থার ছালাতের চেয়ে ‘ছালাতুল খওফ’কে হালকা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যখন ‘ছালাতুল খওফ’-এর কথা উল্লেখ করেন, তখন বলেন,

فَاِذَا اطۡمَاۡنَنۡتُمۡ فَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ اِنَّ الصَّلٰوۃَ کَانَتۡ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ کِتٰبًا مَّوۡقُوۡتًا

‘অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হও তখন ছালাত সম্পাদন কর। নিশ্চয় ছালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত’ (সূরা আন-নিসা : ১০৩)। সুতরাং নিরাপদ অবস্থায় যেভাবে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ভীতির অবস্থায় তেমনিভাবে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়নি।

এছাড়াও মানুষরা এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত পোষণ করে থাকে। যখন বান্দার ঈমান শক্তিশালী হবে, তখন সে অন্যান্য বিষয়ের চিন্তার সাথে সাথে ছালাতেও অন্তর দিয়ে মনোযোগী হবে। আর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু); আল্লাহ তা‘আলা তার জবান ও অন্তরে সত্যকে স্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন মুহাদ্দিছ তথা হাদীছের বর্ণনাকারী এবং মুলহাম তথা সত্য পথের দিক-নির্দেশনাপ্রাপ্ত। তাই তার মত একজন মহান ব্যক্তির পক্ষে ছালাতে সৈন্যবাহিনী পরিচালনার সাথে সাথে অন্তরের পূর্ণ মনোযোগী হওয়াকে নাকচ করা যায় না। কিন্তু ইহা অন্যদের ক্ষেত্রে অসম্ভব একটা বিষয়। এতে কোন সন্দেহ যে, ছালাতে সৈন্যবাহিনী পরিচালনার বিষয়টি আসার চেয়ে না আসলেই বরং অধিক বেশী অন্তরের মনোযোগ থাকে। আর এতেও কোন সন্দেহ নেই যে, বাহ্যিক কার্যাবলীর দিক দিয়ে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিরাপদ অবস্থার ছালাত ভীতিকর অবস্থার ছালাতের চেয়ে অধিক পরিপূর্ণ। যেহেতু মহান আল্লাহ তা‘আলা ভীতিকর অবস্থার ছালাতে কিছু বাহ্যিক ওয়াজিব বিষয় আদায় না করাকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে আভ্যন্তরীণ অন্তরের বিষয়াবলী তো আরও বেশী ক্ষমার দাবীদার।

মোটকথা একজন মুছল্লী তার ছালাতে এমন একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করা, যে বিষয়ে চিন্তা করা যরূরী, আবশ্যক এবং তা নিয়ে ছালাতের পরে চিন্তা করার সময় নেই। আর একজন মুছল্লির এমন বিষয়ে চিন্তা করা যা যরূরী ও আবশ্যক নয় এবং তা নিয়ে ছালাতের বাইরে চিন্তা করার সুযোগ আছে। এই দু’টি বিষয় এক রকম নয়। হয়ত ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঐ সময় সৈন্যবাহিনী নিয়ে চিন্তা করা ছাড়া উপায়ন্তর ছিল না। আর তিনি হলেন মুসলিম উম্মাহর ইমাম এবং তার কাছে অনেক বিষয় মানুষের নিকট থেকে উত্থাপিত হয়। প্রত্যেকটি মানুষ তার মর্যাদানুযায়ী এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। আর মানুষ সর্বদাই ছালাতে এমনসব বিষয় স্মরণ করে যা ছালাতের বাইরে স্মরণ করে না। এগুলো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।

যেমন সালাফদের থেকে একটি ঘটনা বর্র্ণিত আছে যে, একজন লোক কিছু টাকা মাটিতে পোতে রাখল। কিছুদিন পর লোকটি টাকা পোতে রাখার স্থান ভুলে গেল। তখন একজন সালাফ ব্যক্তি তাকে পরামর্শ দিলেন যে, তুমি ছালাতে দণ্ডা য়মান হও, তাহলে তোমার স্মরণে আসবে। তখন লোকটি ছালাতে দাঁড়াল এবং তার পোতে রাখার স্থান স্মরণে আসল। লোকটিকে জিজ্ঞেস করা হল, তুমি কোত্থেকে এটা জানলে? তখন লোকটি বলল, আমি জানি শয়তান কোন মুছল্লীকে ছালাতে মনোযোগী থাকতে দেয় না যতক্ষণ না সে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়, যা মুছল্লিকে ছালাত থেকে অমনোযোগী করে দেয়। কিন্তু চতুর ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি অন্যান্য কার্যাবলী পরিপূর্ণভাবে করার সাথে সাথে ছালাতেও পূর্ণ মনোযোগী হতে সদা-সচেষ্ট থাকে। মূলত আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য ব্যতীত পাপ থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই এবং ইবাদত করারও কোন ক্ষমতা নেই।

ছালাতে সালাফে ছালেহীনদের অবস্থা কেমন ছিল তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা।
সালফে ছালেহীনদের ছালাত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার দ্বারা ছালাতে মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং তাদের অনুসরণের দিকে মুছল্লীকে ধাবিত ও আকৃষ্ট করে। সুতরাং তাদের কাউকে যদি ছালাত আদায় করতে দেখতে এবং সে যখন ছালাতে দণ্ডায়মান হয়ে মেহরাবে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করতে গিয়ে তার প্রতিপালকের সাথে কথা বলতে আরম্ভ করত, তখন তার অন্তরে এ অনুভূতি জাগ্রত হত যে, এটি এমন জায়গা যেখানে মানুষ আল্লাহর সামনে দ-ায়মান হয়, তার অন্তর উন্মোচিত হওয়ার উপক্রম হয় এবং বিবেক-বুদ্ধি হ্রাস হয়ে যায়।[১২] মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

كَانَ إِذَا قَامَ أَحَدُهُمْ يُصَلِّي يَهَابُ الرَّحْمَنَ أَنْ يَشُدَّ بَصَرَهُ إِلَى شَيْءٍ أَوْ يَلْتَفِتَ أَوْ يُقَلِّبَ الْحَصَى أَوْ يَعْبَثَ بِشَيْءٍ أَوْ يُحَدِّثَ نَفْسَهُ مِنْ شَأْنِ الدُّنْيَا إِلَّا نَاسِيًا مَا دَامَ فِي صَلَاتِهِ

‘সালাফদের কেউ যখন ছালাতে দ-ায়মান হতেন, তখন আল্লাহকে এতটাই ভয় করতেন যে, ছালাতরত অবস্থায় কোন কিছুর দিকে দৃষ্টিপাত করতেন না, অথবা এদিকে ওদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন না, অথবা পাথর সরাতেন না, অথবা কোন অনর্থক কাজ করতেন না, অথবা দুনিয়াবী কোন চিন্তা-ভাবনা মনের মাঝে আনতেন না। তবে ভুলবশতঃ উপরিউক্ত কোন কিছু সংঘটিত হলে তা ভিন্নকথা এ ক্ষেত্রে ছালাত হয়ে যাবে’।[১৩]

আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন ছালাতে দণ্ডায়মান হতেন, তখন তিনি একাগ্রতা ও বিনয়াবনতার কারণে কাঠের ন্যায় হয়ে যেতেন। একদা তিনি সিজদারত অবস্থায় ছিলেন, তখন একটি কামানের গোলা (এক ধরনের অস্ত্র) এসে তার কাপড়ের এক পার্শ্ব ছিঁড়ে নিয়ে যায় কিন্তু তিনি ছালাতরত অবস্থাতেই থাকলেন। তার মাথা সিজদা থেকে উঠালেন না।[১৪] মাসলামাহ ইবনু বাশ্শার (রাহিমাহুল্লাহ) মসজিদে ছালাত আদায় করছিলেন, তখন মসজিদের কিছু অংশ ভেঙ্গে কতিপয় মুছল্লিদের উপর পড়ল। তখন মুছল্লীগণ ছালাত ছেড়ে চলে গেল কিন্তু তিনি ছালাতেই অটল থাকলেন, কোন কিছুই অনুভব করলেন না অর্থাৎ, ছালাত ছাড়লেন না।[১৫]

সালাফদের সম্পর্কে আমাদের নিকট আরও সংবাদ পৌঁছেছে যে, তারা যখন ছালাতে দণ্ডায়মান হতেন, তখন পড়ে থাকা কাপড়ের ন্যায় হয়ে যেতেন অর্থাৎ, কোন ধরনের নড়া-চড়া করতেন না। তাদের কেউ যখন ছালাত শেষ করতেন, তখন মহান আল্লাহ তা‘আলার সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার কারণে তাদের মুখম-লের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যেত।[১৬] অনুরূপভাবে তাদের কেউ কেউ এমন ছিল যে, যখন ছালাতে দণ্ডায়মান হতেন, তখন তাদের ডানে ও বামে কে ছালাতে দণ্ডায়মান হয়েছে, তাকে তারা চিনতে পারতেন না। আবার তাদের কেউ যখন ছালাতের জন্য ওযূ করতেন, তখন তার চেহারা হলুদ হয়ে যেত। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, আমরা দেখলাম যে, আপনি যখন ছালাতের জন্য ওযূ করলেন, তখন আপনার অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেল। এর কারণ কী? তখন তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি এখন আমি কার সামনে দ-ায়মান হব (তাই আমার চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে)।[১৭]

আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন ছালাতে দণ্ডায়মান হতেন, তখন তার চেহারায় কম্পন শুরু হয়ে যেত এবং তার রং পবিবর্তিত হয়ে বিবর্ণ হয়ে যেত। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনার কী হয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমানত আদায়ের সময় এসে গেছে, যে আমানতকে আল্লাহ তা‘আলা আসমানসমূহ, যমীন ও পাহাড়কে গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করলে তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং গ্রহণ করতে ভয় করে আর আমি তা গ্রহণ করেছি।[১৮]

সাঈদ আত্-তানূখী (রাহিমাহুল্লাহ) ছালাতে দণ্ডায়মান হতেন, তখন তার চোখের পানি গাল, চেহারা গড়িয়ে দাড়ি পর্যন্ত পৌঁছত। কোন কোন তাবেঈ সম্পর্কে আমাদের নিকট আরও সংবাদ পৌঁছেছে যে, নিশ্চয় তিনি যখন ছালাতে দণ্ডায়মান হতেন, তখন তার চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেত, তিনি বলতেন, তোমরা কি জান, আমি কার সামনে দণ্ডায়মান হব এবং কার সাথে নীরবে কথাবার্তায় লিপ্ত হব। তোমাদের মাঝে কে আছে যার অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার জন্য এরূপ ভয়-ভীতি রয়েছে?[১৯]

[ইনশাআল্লাহ চলবে]

* অধ্যয়নরত, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৩৮।
[২]. ছহীহ বুখারী, আযান অধ্যায়, ‘ইশার ছালাতে কিরাআত উচ্চৈঃস্বরে পড়ার’ অনুচ্ছেদ।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৩।
[৪]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৬০৮।
[৫]. আল ওয়াবিলুছ্ ছায়্যিব, পৃ. ৪৩।
[৬]. আল ওয়াবিলুছ ছায়্যিব, পৃ. ৪৬।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২০৩।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৩২।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৯।
[১০]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ১১তম খণ্ড, পৃ. ২২২, হা/১১৫৫৬; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ, ১/২৪২; হাদীছের বর্ণনাকারীগণ ছহীহ হাদীছের বর্ণনাকারী।
[১১]. আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, আল-ফাতাওয়াউল কুবরা (দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হি./১৯৮৭ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ২২০ ও ২২৪; মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৬০৩ ও ৬০৯।
[১২]. ইবনু রজব, আল-খুশূ‘ ফিছ ছালাত, পৃ. ২২।
[১৩]. তা‘যীমু ক্বাদরিছ ছালাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৮।
[১৪]. আব্দুল আযীয সালমান, ছালাহুল ইয়াক্বযান লি ত্বারদিশ শায়ত্বান, পৃ. ২০৯।
[১৫]. প্রাগুক্ত।
[১৬]. প্রাগুক্ত।
[১৭]. প্রাগুক্ত।
[১৮]. প্রাগুক্ত।
[১৯]. প্রাগুক্ত।




প্রসঙ্গসমূহ »: ছালাত আমল
বিদ‘আত পরিচিতি - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
হাদীছ বর্ণনায় আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অবদান - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৪র্থ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (৮ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
সালাফী জামা‘আত বনাম ভ্রান্তদল সমূহ - আল-ইখলাছ ডেস্ক
রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি (৩য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
গাযওয়াতুল হিন্দ : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ