যমযমের ইতিহাস ও ফযীলত
-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর*
ভূমিকা
আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য প্রদত্ত নে‘মত সমূহের মধ্যে পানি এক গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত। পানি ব্যতীত কোন প্রাণীই সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। পানি ছাড়া পৃথিবী অচল। তাই বলা হয় ‘বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন’। সৃষ্টি জগতের মূল উপাদান হল পানি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশ ও যমীনের মুখ বন্ধ ছিল? অতঃপর আমি (আল্লাহ) উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম’ (সূরা আল-আম্বিয়া: ৩০)। রসায়ন বিজ্ঞানের মূল উপাদান পানি। এই পানিকে রসায়ন বিজ্ঞানের প্রাণ বলা চলে। সৃষ্ট বস্তুর অধিকাংশই পানিতে দ্রাব্য।[১] তবে পানির মধ্যে ব্যতিক্রম ধর্মী সৃষ্টি হচ্ছে যমযমের পানি, যা সাধারণ পানির সাথে কোন ভাবেই তুলনীয় নয়। বলা যায় এই পানি তাওহীদপন্থীদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের নিদর্শন স্বরূপ। যমযমের পানির ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যের কথা আধুনিক বিজ্ঞানেও স্বীকৃত। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় যমযমের পানি অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ফেরেশতা জিবরীল আমীন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্ষ বিদারণের পর যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করেছিলেন।[২] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হৃদয় পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণে উক্ত পানিই ব্যবহৃত হয়েছিল। এ ঘটনা যমযমের পানির মর্যাদার ইঙ্গিত বহন করে। বক্ষমাণ প্রবন্ধে যমযম কূপের ইতিহাস, উক্ত পানির গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপনের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
যমযম কূপের ইতিহাস
সাঈদ ইবনু জুবাইর প হতে বর্ণিত, ইবনু আব্বাস য বলেন, ইবরাহীম ন হাজেরা ন এবং তাঁর শিশু পুত্র ইসমাঈল ন-কে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন এ অবস্থায় যে, হাজেরা ন শিশুকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে যেখানে কা‘বা ঘর অবস্থিত, ইবরাহীম ন তাঁদের উভয়কে সেখানে নিয়ে এসে মসজিদের উঁচু অংশে যমযম কূপের উপরে অবস্থিত একটি বিরাট গাছের নিচে রাখলেন। তখন মক্কায় না ছিল কোন মানুষ, না ছিল কোন পানির ব্যবস্থা। তিনি সেখানেই তাদের রেখে গেলেন, সাথে একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকের মধ্যে কিছু পরিমাণ পানি। অতঃপর ইবরাহীম ন ফিরে চললেন। তখন ইসমাঈল ন-এর মা পিছু পিছু আসলেন এবং বলতে লাগলেন, হে ইবরাহীম ন! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমাদেরকে এমন এক ময়দানে রেখে যাচ্ছেন, যেখানে না আছে কোন সাহায্যকারী, আর না আছে কোন ব্যবস্থা। তিনি একথা তাঁকে বারবার বললেন। কিন্তু ইবরাহীম ন তার দিকে তাকালেন না। তখন হাজেরা ন তাঁকে বললেন, এই আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ দিয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। হাজেরা ন বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না। অতঃপর তিনি ফিরে আসলেন। আর ইবরাহীম ন সামনে চললেন। চলতে চলতে যখন তিনি গিরিপথের বাঁকে পৌঁছলেন, যেখানে স্ত্রী ও সন্তান তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছে না, তখন তিনি কা‘বা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। অতঃপর তিনি দু’হাত তুলে এ দু‘আ করলেন, আর বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার সন্তানদের একাংশকে শস্যক্ষেতহীন উপত্যকায় তোমার সম্মানিত ঘরের নিকট পুনর্বাসিত করলাম। হে আমার প্রতিপালক! তারা যাতে ছালাত কায়েম করে। কাজেই তুমি মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও আর ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর, যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে’ (সূরা ইবরাহীম: ৩৭)।
ইসমাঈলের মা ইসমাঈলকে স্বীয় স্তন্যের দুধ পান করাতেন এবং নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেন। অবশেষে মশকে যা পানি ছিল তা ফুরিয়ে গেল। তিনি নিজে তৃষ্ণার্ত হলেন এবং তার শিশু পুত্রটিও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল। তিনি শিশুটির দিকে দেখতে লাগলেন। তৃষ্ণায় তার বুক ছটফট করছে অথবা রাবী বলেন, সে মাটিতে ছটফট করছে। শিশু পুত্রের এ করুণ অবস্থার প্রতি তাকানো অসহনীয় হয়ে পড়ায় তিনি সরে গেলেন আর তাঁর অবস্থানের নিকটবর্তী পর্বত ‘ছাফা’-কে একমাত্র তাঁর নিকটতম পর্বত হিসাবে পেলেন। অতঃপর তিনি তার উপর উঠে দাঁড়ালেন এবং ময়দানের দিকে তাকালেন। এদিকে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোথাও কাউকে দেখা যায় কিনা? কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন ‘ছাফা’ পর্বত থেকে নেমে পড়লেন। এমন কি যখন তিনি নীচু ময়দান পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন তিনি তাঁর কামিজের এক প্রান্ত তুলে ধরে একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষের মত ছুটে চললেন। অবশেষে ময়দান অতিক্রম করে ‘মারওয়া’ পাহাড়ের নিকট এসে তার উপর উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর এদিকে সেদিকে তাকালেন, কাউকে দেখতে পান কিনা? কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। এমনিভাবে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন।
ইবনু আব্বাস য বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, এজন্যই মানুষ এ পর্বতদ্বয়ের মধ্যে (সাতবার) সাঈ করে থাকে। অতঃপর তিনি যখন মারওয়া পাহাড়ে উঠলেন, তখন একটি শব্দ শুনতে পেলেন এবং তিনি নিজেকেই নিজে বললেন, একটু অপেক্ষা কর। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তখন তিনি বললেন, তুমি তো তোমার শব্দ শুনিয়েছে। যদি তোমার নিকট কোন সাহায্যকারী থাকে। فَإِذَا هِيَ بِالْمَلَكِ عِنْدَ مَوْضِعِ زَمْزَمَ فَبَحَثَ بِعَقِبِهِ أَوْ قَالَ بِجَنَاحِهِ حَتَّى ظَهَرَ الْمَاءُ ‘হঠাৎ যেখানে যমযম কূপ অবস্থিত সেখানে তিনি একজন ফেরেশতা দেখতে পেলেন। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে জিবরীলকে দেখতে পেলেন। সেই ফেরেশতা (জিবরীল) আপন পায়ের গোঁড়ালী দ্বারা আঘাত করলেন অথবা তিনি বলেছেন, আপন ডানা দ্বারা আঘাত করলেন। ফলে পানি বের হতে লাগল। তখন হাজেরা ন-এর চারপাশে নিজ হাতে বাঁধ দিয়ে হাউযের মত করে দিলেন এবং হাতের কোষ ভরে তাঁর মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। তখনো পানি উপচে উঠছিল। ইবনু আব্বাস য বলেন, নবী করীম ধ বলেছেন, ইসমাঈলের মাকে আল্লাহ রহম করুন। যদি তিনি বাঁধ না দিয়ে যমযমকে এভাবে ছেড়ে দিতেন কিংবা বলেছেন, যদি কোষভরে পানি মশকে জমা না করতেন, তাহলে যমযম একটি কূপ না হয়ে একটি প্রবাহমান ঝর্ণায় পরিণত হত। রাবী বলেন, অতঃপর হাজেরা ন পানি পান করলেন, আর শিশু পুত্রকেও দুধ পান করালেন, তখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, আপনি ধ্বংসের কোন অশঙ্কা করবেন না।[৩]
উল্লেখ্য যে, আমাদের সমাজে অধিক প্রচলিত আছে যে, যমযম কূপ ইসমাঈল ন-এর পায়ের গোঁড়ালীর আঘাতে সৃষ্টি হয়েছে। অথচ ছহীহ বুখারীর হাদীছদ্বয় এ কথার সুস্পষ্ট বিরোধী। যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যমযম কূপ জিবরীল ন-এর পায়ের গোঁড়ালী অথবা ডানার আঘাতে সৃষ্ট। বিধায় মানুষের প্রচলিত বিশ্বাসটি ভিত্তিহীন।
যমযম কূপের নামকরণ
আরবী ভাষায় যমযম অর্থ অঢেল পানি। আর তিবরানী ভাষায় যমযম অর্থ থাম্ থাম্। মরুভূমিতে ২ বছরের শিশু সন্তান ইসমাঈলের সীমাহীন পিপাসা মিটানোর জন্য যখন বিবি হাজেরা ন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলেন আর কামনা করছিলেন আল্লাহর অপার করুণা, তখন আল্লাহ রহমতের এ পানি উদগত করেন মরুভূমির শুষ্ক মাটি থেকে। রহমতের এ পানি দেখে বিবি হাজেরা ন একে বাঁধ দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলেন এবং তিবরানী ভাষায় বলতে লাগলেন যমযম (থাম্ থাম্)। অনেকের ধারণা এ থেকেই এর নাম ‘যমযম’। যমযমকে ‘রাকাদাতু জিবরীল’ এবং ‘বীরে ইসমাঈল’ সহ ১২ টি নামে অভিহিত করা হয়। যমযম কূপের অবস্থান হারাম শরীফে কা‘বার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।
যমযম পানি পান
যমযম পানি পান করা উত্তম। মহান আল্লাহ এই পানি ইসমাঈল ন এবং তাঁর মা হাজেরা ন-এর জন্য প্রবাহিত করেন; যেটি আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং অশেষ কৃপায় অদ্যাবধি চালু রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জে ত্বাওয়াফ এবং মাক্বামে ইবরাহীমের পেছনে ছালাতান্তে যমযম পানি পান করেন এবং মাথায় দেন।[৪] জাবের ন থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ত্বাওয়াফে ইফাযার পরে এই পানি পান করেন।[৫] যমযম পানি দাঁড়িয়ে পান করাই হাদীছের অনুকূলে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ شَرِبَ النَّبِيُّ ﷺ قَائِمًا مِنْ زَمْزَمَ.
ইবনু আব্বাস য হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম ধ দাঁড়ানো অবস্থায় যমযম পানি পান করেছেন।[৬] অপর এক বর্ণনায় ইবনু আব্বাস য বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ধ-এর নিকট যমযম পানি পেশ করলাম তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করলেন।[৭] বিধায় যমযম পানি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে দাঁড়িয়ে পান করায় শ্রেয়। তবে যমযম পানি পান করার সময় ইবনু আব্বাস য থেকে বর্ণিত বিশেষ দু‘আ পাঠের প্রচলিত হাদীছটি যঈফ।[৮]
যমযম পানির ফযীলত
আবু যার প রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের সংবাদ শুনে মক্কায় গিয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর অবশেষে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হল। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কতদিন যাবৎ এখানে অবস্থান করছ? তিনি বললেন, আমি এখানে ত্রিশদিন যাবৎ আছি। তিনি বললেন, তোমাকে কে খাদ্য দিত? আমি (আবু যার) বললাম, যমযম কূপের পানি ব্যতীত আমার জন্য অন্য কোন খাদ্য ছিল না। এ পানি পান করেই আমি স্থুলদেহী হয়ে গেছি, এমনকি আমার পেটের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে এবং আমি কখনও ক্ষুধার কোন দুর্বলতা বুঝতে পারিনি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ ধ বললেন, إِنَّهَا مُبَارَكَةٌ إِنَّهَا طَعَامُ طُعْمٍ ‘এটি অতিশয় বরকতময়। এটি খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ’ (যা অন্যান্য খাবারের মত পেট পূর্ণ করে দেয়)’।[৯] আবুদাঊদ আত-ত্বায়ালাসী তাঁর ‘মুসনাদ’-এ মুসলিমের সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেন এবং তিনি নিম্নোক্ত বাক্যটি উল্লেখ করেন, وشِفاءُ سقْمٍ ‘আর এটি রোগ-ব্যাধি নিরাময়কারী’।[১০]
যমযম পানির ফযীলত সম্পর্কে ইবনু আব্বাস য বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ وَفِيهِ طَعَامٌ مِنَ الطُّعْمِ وَشِفَاءٌ مِنَ السُّقْمِ.
‘ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হল যমযমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ হতে আরোগ্য’।[১১] জাবের প বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীছটিতেও এই পানির ফযীলত বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ ধ বলেন, مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ ‘যমযম পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হবে, সে উদ্দেশ্যই পূরণ হবে’।[১২] ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১ হি.) বলেন, سيِّدُ المياه وأشرفُهَا وأجلُّهَا قدراً وأحبُّها إلى النفوس وأغلاها ثمناً ‘যমযম পানি হচ্ছে পানির সরদার। এটি যেমন সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পানি, তেমনি তা মানুষের নিকটে প্রিয়তর। এটি মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান পানি’।[১৩]
যমযম পানি বহন করা এবং উপহার হিসাবে প্রদান করা
হজ্জ ও ওমরাহ পালনকারী পান করার, আরোগ্য লাভ করার এবং অন্যকে উপহার দেওয়ার জন্য বেশী করে যমযম পানি সঙ্গে নিতে পারে। এই পানি সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। কেননা এটি বরকতময় এবং রোগ-ব্যাধি নিরাময়কারী পানি। আয়েশা ম সঙ্গে করে যমযম পানি নিয়ে আসতেন। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও এই পানি সঙ্গে করে আনতেন’।[১৪]
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যমযম কূপের পানি
১৯৭১ সালের কথা। জনৈক মিসরীয় চিকিৎসক ইউরোপীয় পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, ‘আব-ই যমযম’ বা যমযম কূপের পানি পানীয়জল হিসাবে পানের উপযুক্ত নয়’। তিনি হয়ত লক্ষ করেছিলেন যে, যেহেতু খানা-ই কা‘বা সমুদ্র স্তর থেকে নিম্নে এবং মক্কার মাঝখানে অবস্থিত। ফলে শহরের সম্পূর্ণ ময়লা পানি চুয়ে যমযম কূপে গিয়ে জমা হয়। আমরা বিশ্বাস করি যে, খানা-ই কা‘বা শুধু মক্কার মধ্যস্থলে নয়, পৃথিবীর মধ্যস্থলে অবস্থিত। খানা-ই কা‘বা ও যমযম কূপ হল আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহের অন্যতম। জাগতিক দৃষ্টি দিয়ে তা বুঝা ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
মিসরীয় উক্ত বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য তৎকালীন বাদশাহ ফায়ছালের গোচরীভূত হয়। ফলে তিনি অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ন এবং রাগান্বিত হন। এ ধরনের বক্তব্য যে অসার, এ বিশ্বাস তাঁর ছিল। বাদশা ফায়ছাল সঙ্গে সঙ্গে সঊদী আরবের ‘কৃষি ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়’-কে বিষয়টি পরীক্ষা করতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ইউরোপের উচ্চমানের ল্যাবরেটরিগুলোতে পরীক্ষার জন্য যমযমের পানি প্রেরণ করা হোক। সঊদী ‘কৃষি ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়’ এ দায়িত্ব সম্পাদনের নির্দেশ দিলেন ‘জেদ্দা বিদ্যুৎ ও পানি লবণ মুক্তকরণ সংস্থা’-কে (ঔবফফধয ঢ়ড়বিৎ ধহফ উবংড়ষধঃরড়হ ঢ়ষধহঃং)। এই সংস্থাটি সমুদ্র থেকে পানি উত্তোলন করে তা লবণমুক্ত করে জেদ্দা শহরে বিতরণের দায়িত্বে ছিল। আমি (উক্ত কাজের গবেষক) ঐ সময় ‘জেদ্দা পাওয়ার এবং ডিসলেশন প্লান্টস’-এ লবণমুক্তকরণ প্রকৌশল হিসাবে নিযুক্ত ছিলাম। পেশায় এবং শিক্ষাগত ভাবে আমি একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ফলে ইউরোপীয় ল্যাবরেটরি সমূহে ‘আব-ই যমযম’ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার উপর পড়ল।
ঐ সময় অন্য মুসলিমদের যমযম-এর পানি সম্পর্কে যে শ্রদ্ধামিশ্রিত অনুভূতি থাকে তার বেশি আমার কোন পূর্ব ধারণা ছিল না। এ পানির গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও আমার কোন পেশাগত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা ছিল না। অতঃপর আমি খানা-ই কা‘বা প্রশাসনের নিকট আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য সম্মতি চাইলাম এবং তাদের দফতরে রিপোর্ট করলাম। তাঁরাও সকল সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন এবং প্রয়োজনীয় জনবল আমাকে দিলেন। অতঃপর যমযম কূপ এলাকায় উপস্থিত হয়ে আমি কূপটির বিভিন্ন দিক পরীক্ষা করলাম। লক্ষ্য করলাম যে, অন্যান্য কূপের মত যমযম কূপটি গোলাকার নয়। এটা প্রায় ১৮ ফুট দীর্ঘ এবং ১৪ ফুট চওড়া একটি আয়তক্ষেত্রের মত। আর এই ক্ষুদ্র কূপটি হতে কোটি কোটি গ্যালন পানি প্রতি বছর হাজীগণ পান করেন, ব্যবহার করেন এবং স্বদেশে নিয়ে যান। এ ধারা অব্যাহত আছে ইবরাহীম ন-এর আমল থেকে।
যমযম কূপ পরীক্ষা ও তদন্তকালে আমি কূপটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছাড়াও অন্য দিকগুলো দেখতে চাইলাম। একজন লোককে কূপটিতে নামতে বললাম। তিনি গোসল করে পাক-পবিত্র হয়ে যমযম কূপে অবতরণ করলেন। তাঁর শারীরিক উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। তিনি ভক্তি ও সম্ভ্রম মিশ্রিত ভীতির সঙ্গে কূপে অবতরণ করলেন। সাহস সঞ্চয় করে কূপের মাঝখানে অগ্রসর হলেন এবং সোজা দাঁড়ালেন। কূপের পানির উচ্চতা তাঁর কাঁধ পর্যন্ত হল। তাকে নির্দেশ দেয়া হল কূপের এক পাশ থেকে অন্য পাশে, এক কোণ থেকে অন্য কোণে এবং সর্বত্র হেঁটে বেড়াতে। হেঁটে হেঁটে কোন্ জায়গা হতে পানি কূপের মধ্যে আসে, তা খুঁজে বের করতে তাঁকে নির্দেশ দেয়া হল। যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয়, তাতে এ ক্ষুদ্র কূপটি পূর্ণ হতে বহু ধারা বা পাইপ থাকার কথা। তিনি বহু চেষ্টা করেও কোন ছিদ্র বা পাইপ বা কোন্ গর্ত হতে পানিটা কূপে এসে জমা হচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে পারলেন না। কোন্ পথ দিয়ে পানি আসে তা আবিষ্কারের চেষ্টা ব্যর্থ হল। বাধ্য হয়ে আমাকে পানির উৎসধারা আবিষ্কারের জন্য বিকল্প চিন্তা করতে হল।
যমযম কূপ হতে উপরে পানি সঞ্চয় (স্টোরেজ) ট্যাঙ্কগুলোতে পানি তোলার জন্য কতগুলো পানি উত্তোলন পাম্প লাগানো ছিল। আমি ভাবলাম অধিক শক্তিসম্পন্ন বড় আকারে আরো অনেকগুলো পাম্প লাগালে অতি দ্রুত পানি তোলা যাবে এবং কূপটির পানি শুকিয়ে যাবে। যেভাবে একটি পুকুরের পানি বা হ্রদের পানি সেচ করে শুকিয়ে ফেলা হয়। সব পানি কিছু সময়ের জন্য পাম্প করে শুকিয়ে ফেলা হলে কোন্ দিক থেকে পানি আসে তা বুঝা যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় পাম্প করে যমযমের সব পানি তুলে কূপটি শুকানো গেল না।
কূপটি শুকিয়ে পানির উৎস বের করার জন্য কোন সফল পদ্ধতিও আমি চিন্তা করতে পারলাম না। ফলে আরও শক্তিশালী পাম্প লাগিয়ে পানি উত্তোলন করে তা দেখার চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম। তাতেও সফল হলাম না। যতই পানি তোলা হয়, ততই নতুন পানি জমা হয় এবং পানি একটি নির্দিষ্ট স্তরে থাকে। এ পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় ধরে কূপ শুকাবার কাজে কোন সফলতা অর্জন করা গেল না। তখন আমি কূপে নামানো লোকদের নির্দেশ দিলাম, এক স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। এদিকে পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রইল। আমি কূপে নামানো লোকদেরকে নির্দেশ দিলাম এবং গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করতে বললাম, পানি উত্তোলনের সময় কূপের মধ্যে কোন লক্ষণীয় ঘটনা ঘটে কি-না।
এ প্রক্রিয়া চলাকালে কূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি হঠাৎ করে হাত তুলে আল-হামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি পানির উৎসের সন্ধান পেয়েছেন। তা কোন ছিদ্র নয়; বরং তিনি যে বালির উপর দাঁড়িয়েছিলেন সেই ক্ষুদ্র বালুকণা মনে হচ্ছিল পায়ের নীচে নৃত্য করছে। অতঃপর তিনি কূপের তলায় বহুবার বিভিন্ন দিকে পদচারণা করলেন এবং পাম্প চলাকালে অনুরূপভাবে পায়ের নীচে বালুকণার নৃত্যভঙ্গি উপলব্ধি করলেন। বস্তুত কূপের তলার সমস্ত অংশে পানি উথলে উঠার গতি সমান বলে মনে হল। কূপের কোন অংশের পানির স্তর কম-বেশী হত না। কূপের মধ্যে সর্বত্র পানির উচ্চতা সমান ছিল।
আমি আমার জ্ঞান, মেধা ও মনের উত্থাপিত প্রশ্ন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলাম, অতঃপর পানির স্যাম্পল নিলাম। এ স্যাম্পলগুলো ইউরোপের বহু ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য প্রেরণের যথাযথ ব্যবস্থা নিলাম। কা‘বার যমযম সংক্রান্ত দায়িত্ব সম্পাদন করে বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে আমি কা‘বা কর্তৃপক্ষকে মক্কা শহরের অপরাপর কূপগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। তারা জানালেন যে অধিকাংশ কূপই ঐ সময় অনেকটা শুষ্ক ছিল। আমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রিপোর্টটি আমার উপরস্থ কর্মকর্তার নিকট পেশ করলাম। তিনি গভীর উৎসাহ ও মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শুনলেন। সব কিছু শোনার পরে তিনি একটি মন্তব্য করলেন, যা মেনে নিতে আমার মন সায় দিল না। তিনি বললেন, ‘আভ্যন্তরীণভাবে যমযম কূপের সঙ্গে লোহিত সাগরের সংযোগ রয়েছে। লোহিত সাগরের পানি চুইয়ে চুইয়ে যমযম কূপে আসে। সাগরের পানি শেষ হবার নয়’।
আমার মনে নানা প্রশ্ন জাগল, মক্কা থেকে জেদ্দার দূরুত্ব ৭৫ কিলোমিটার। যমযম কূপের পানি যদি লোহিত সাগর থেকে আসে, তাহলে জেদ্দা থেকে মক্কার মধ্যবর্তী স্থানের কূপগুলোতেও কমবেশী পানি থাকবে। মক্কার পূর্বদিকের কূপগুলোতেও কিছু পানি আসবে। শুধু যমযম কূপেই লোহিত সাগরের পানি আসবে, অন্য কূপগুলোতে আসবে না কেন? কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হল- মক্কা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত এই এলাকার অধিকাংশ কূপই থাকে শুকনো। বেশি পানি তুললে পানি শেষ হয়ে যায়।
যমযম কূপের পানির যে স্যাম্পল ইউরোপের ল্যাবরেটরিগুলোতে পাঠানো হয়েছিল, তাদের থেকে পানি পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেল। আমরা আমাদের ল্যাবরেটরিতেও পানি পরীক্ষা করে রিপোর্ট প্রণয়ন করে রেখেছিলাম। দেখা গেল ইউরোপীয় ল্যাবরেটরি থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট এবং আমাদের রিপোর্ট-এর ফলাফল একই রকম।
ইউরোপীয় রিপোর্ট এবং আমাদের রিপোর্টের মধ্য হতে যে বিষয়টি প্রতীয়মান, তা হল যমযম কূপের পানিতে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম সল্টের পরিমাণ মক্কার অন্যান্য কূপের পানি হতে অপেক্ষাকৃত বেশি। ম্যাগনেশিয়াম সল্ট এবং ক্যালসিয়ামের আধিক্যের কারণেই যমযমের পানি খেয়ে ক্লান্ত হাজীদের ক্লান্তি বিদূরিত হয়। আরও একটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যমযমের পানিতে পরিলক্ষিত হল যে, এতে আছে অধিকতর ফ্লোরাইড। ফ্লোরাইডের একটি গুণ হল যে, সে পানিতে অত্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোন প্রকার জার্ম সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ প্রতিহত করে। ফলে যমযমের পানি বহু দিন পর্যন্ত রেখে দিলেও পানিতে শেওলা ধরে না এবং পানিতে পোকা জন্মে না। ইউরোপীয় ল্যাবরেটরি থেকে প্রাপ্ত রিপোর্টে উল্লেখ ছিল যে, ‘যমযমের পানি পানের উপযুক্ত’।
ইউরোপীয় ল্যাবরেটরি থেকে প্রাপ্ত রিপোর্টে এ বিষয়টিও প্রমাণিত হল যে, মিসরীয় ডাক্তারদের যমযম পানি সম্পর্কে প্রদত্ত বক্তব্যটি গবেষণা প্রসূত ছিল না, বরং ছিল বিদ্বেষজাত। এ বিষয়টি বাদশাহ ফায়ছালকে অবহিত করা হল। তিনি প্রীত হলেন এবং যে যে পত্রিকায় মিসরীয় ডাক্তারদের বক্তব্যটি প্রকাশ পেয়েছিল, সে সমস্ত পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠাবার নির্দেশ দিলেন।[১৫]
উপরিউক্ত বিশ্লেষণ হতে যমযমের পানির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন
(১) যমযম কূপটি কখনো শুকিয়ে যায়নি। পক্ষান্তরে পানির চাহিদা যত বেড়েছে, কূপের পানি সরবরাহও সে অনুপাতে বেড়েছে। এ পানি কোনদিন শেষ হবে না ইনশাআল্লাহ। কারণ রাসূল ধ প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে বলে গেছেন, ইসমাঈল ন-এর মা সেদিন পানি ছেড়ে দিলে বিশাল ঝর্ণা হয়ে যেত। নবী করীম ধ বলেছেন, ‘ইসমাঈলের মাকে আল্লাহ রহম করুন। যদি তিনি যমযম ছেড়ে দিতেন কিংবা যদি কোষভরে পানি মশকে জমা না করতেন, তাহলে যমযম একটি কূপ না হয়ে একটি প্রবাহমান ঝর্ণায় পরিণত হত’।[১৬] সাগর-মহাসাগর শুকিয়ে গেলেও যমযমের পানি শেষ হবে না ইনশাআল্লাহ।
(২) যমযম কূপের পানিতে লবণাক্ততা এবং স্বাদ সুদূর অতীতে যেমন ছিল বর্তমানেও তেমন আছে। এ পানির স্বাদ একটুমাত্রও পরিবর্তিত হয়নি।
(৩) যমযমের পানি পান করার গুণাবলী অতি প্রাচীন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান হতে হাজীগণ হজ্জ ও ওমরাহ উপলক্ষে মক্কায় এসে যমযমের পানি পান করে থাকেন। সারা বছরেই তাদের আগমন অব্যাহত থাকে। কিন্তু কেউ কোনদিন এ অভিযোগ করেননি যে, যমযমের পানি পান করে তাদের কোনরূপ অসুবিধা হয়েছে।
(৪) এ পানি শেফা বা রোগ নিরাময়ক হিসাবে বিবেচিত।
(ঙ) হাজীগণ যমযমের পানি যত বেশি তাদের পক্ষে সম্ভব পেট ভরে পান করে থাকেন এবং সঙ্গে করে নিয়েও যান।
(৫) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে পানির স্বাদের পরিবর্তন হয়। কিন্তু যমযমের পানির স্বাদ অপরিবর্তনীয়।
(৬) যমযমের পানি কখনও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিশোধনের প্রয়োজন হয়নি।
(৭) এ পানিতে ক্লোরিন মেশানো হয়নি বা ক্লোরিন দ্বারা জীবাণু মুক্ত করা হয়নি, যেমন বিভিন্ন নগর জনবহুল এলাকায় সরবরাহকৃত পানি ক্লোরিনের সাহায্যে পরিশোধিত করা হয়।
(৮) পানিতে সাধারণত জলজ উদ্ভিদ, শৈবাল, শেওলা বা ক্ষুদ্র আলজি (অষমধব) জন্মে। এমনকি জীবাণুর জন্ম হয়। এর ফলে পানির স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তন হয়। কিন্তু যমযমে কখনও জলজ জীবাণু বা উদ্ভিদের জন্ম হয়নি।
(৯) ফুটন্ত বা পরিশোধিত জীবাণু মুক্ত পানি রেখে দিলেও কিছুকাল পর তাতে জলজ উদ্ভিদ বা জীবাণুর সৃষ্টি হয়। কিন্তু বছরের পর বছর টিন, ক্যান বা বোতলে যমযমের পানি রেখে দিলেও দেখা যায় এতে কোন জীবাণুর সৃষ্টি হয় না।[১৭]
জাপানি অধ্যাপক মাসারু ইমোটো যমযম কূয়া সম্পর্কে তার গবেষণার কথা তুলে ধরে বলেছেন, ‘যমযম কূয়ার পানির সমতুল্য কোন পানি পৃথিবীতে নেই। বিশ্বের সব ধরণের পানির স্ফটিকের চেয়ে এই পানির স্ফটিকের গঠন ভিন্ন ধরনের। পরীক্ষায় দেখা গেছে, যমযম কূপের পানির বৈশিষ্ট্য অন্য সব পানির বৈশিষ্ট্যের চেয়ে ভিন্ন। যেমন, যমযমের পানি ছাড়া অন্য সব পানি দীর্ঘকাল আবদ্ধ অবস্থায় থাকলে ও পুরানো হতে থাকলে এসব পানির স্ফটিকের সুন্দররূপ নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু যমযমের পানির স্ফটিক সহজেই তার সুন্দররূপ হারায় না।
প্রতিদিন যমযম কূপ থেকে গ্যালন গ্যালন পানি তোলা হলেও তা শুকিয়ে যায় না। যা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। বলা যেতে পারে এটি ভূপৃষ্ঠের একটি আশ্চর্যময় ঘটনা। একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি সেকেন্ডে ৮০০০ লিটার পানি পাম্প করে উঠিয়ে নিয়ে পানির স্তর একটু নীচে নামলেও পাম্প থামানোর অল্প সময়ের মধ্যে এটি আবার তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। সুবহানাল্লা-হি ওয়াবি হামদিহি।
যমযম পানির উপাদান সমূহ
যমযমের পানি নিঃসন্দেহে অন্যান্য যে কোন পানি থেকে সাতন্ত্র, এতে প্রতি লিটারে ২০০০ মিলি গ্রাম প্রাকৃতিক উপাদান বিদ্যমান। স্বাভাবিকভাবে খনিজ পানীয়তে ২৬০ মিলিগ্রাম এর বেশী প্রাকৃতিক উপাদান থাকে না। প্রথমতঃ যমযম এর পানিতে রাসায়নিক দ্রব্য ধনাত্বক আয়ন্স, সোডিয়াম ২৫০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২০০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২০ মিলিগ্রাম এবং ম্যাগনেশিয়াম ৫০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে। দ্বিতীয়তঃ ঋণাত্বক আয়ন্স সালফার ৩৭২ মিলিগ্রাম, বাইকারবনেট ৩৬৬ মিলিগ্রাম, নাইট্রেড ২৭৩ মিলিগ্রাম, ফসফেট ০.২৫ মিলিগ্রাম এবং এমনিয়া ৬ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হাজীগণ আল্লাহ্র মেহমান হয়ে এখানে এসে থাকে। তারা তাদের ক্লান্তি এ পানি দ্বারা যেন দূর করতে পারে, সে উপাদান এতে রয়েছে।
উপসংহার
যমযমের পানি একদিকে যেমন ক্ষুধা ও তৃষ্ণা উভয়টিই নিবারণ করে থাকে। অপরদিকে তেমনি পেটের হজম শক্তি বাড়িয়ে শরীরকে পুষ্ট ও বলিষ্ঠ করে তোলে। এই পানিতে খাদ্য ও পানীয় উভয় চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। যার ফলেই দেখা যায়, ইসলামের প্রথম যুগে আবু যার গিফারী ভ ৩০ দিন যাবৎ শুধুমাত্র যমযমের পানি খেয়েই জীবন ধারণ করেছিলেন। এতে করে তাঁর কোন ক্ষতি হওয়া তো দূরের কথা, শরীরে মেদ জমে তিনি মোটা হয়ে গিয়েছিলেন। যমযমের পানি ঔষধীগুণ সমৃদ্ধ। এই পানি দ্বারা আমাশয়, পেট-কামড় ও পেট ব্যাথা ভাল হয়ে যায়। পেশাবজনিত রোগে এবং মুত্রাশয় ও মুত্রথলীর রোগে ইহা বেশ উপকারী। ডায়রিয়া ও কলেরা রোগেও এতে সুফল পাওয়া যায়। মোট কথা, যে নিয়তে এই পানি পান করবে, আল্লাহ তার সেই নিয়তই পূরণ করবেন। এই পানি আল্লাহর বিশেষ নিদর্শন।
* পরিচালক, ইয়াসিন আলী সালাফী কমপ্লেক্স, রাজশাহী।
[১]. মোহম্মদ নূরুল ইসলাম, বিজ্ঞান না কোরআন (কলিকাতা : মল্লিক ব্রাদার্স, ৫ম মুদ্রণ, ডিসেম্বর, ১৯৯৭ ইং), পৃ. ২৮৬।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬৩৬।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৬৪ ও ৩৩৬৫।
[৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫২৪৩, মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীছটির সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৫০।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬১৭।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬৩৭; ছহীহ মুসলিম হা/২০২৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬০৮।
[৮]. ইরওয়াউল গালীল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৩২-৩৩; হা/১১২৬-এর আলোচনা দ্র.।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৭৩।
[১০]. মুসনাদে ত্বায়ালাসী, হা/৪৫৯; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১১৬২, সনদ ছহীহ।
[১১]. ত্বাবারাণী-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৩৯১২; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১১৬১; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০৫৬, সনদ হাসান।
[১২]. ইবনু মাজাহ, হা/৩০৬২; আল-মুসতাদরাক ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/১৭৩৯; ইরওয়াউল গালীল, হা/১১২৩, সনদ ছহীহ।
[১৩]. মুহাম্মাদ ইবনু আবুবকর ইবনু আইয়ূব ইবনু সা‘দ শামসুদ্দীন ইবনে ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়া, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ইবাদ (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ২৭ তম সংস্করণ ১৪১৫ হিঃ/১৯৯৪ খ্রি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৯২।
[১৪]. তিরমিযী, হা/৯৬৩; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হা/৪৬৮৩, সনদ হাসান।
[১৫]. জনাব মঈনুদ্দীন আহমাদ রচিত বক্ষ্যমান প্রবন্ধটি ১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই করাচির ইংরেজি দৈনিক ‘ডন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মূল ইংরেজী থেকে অনুবাদ করেছেন জনাব, এ জেড এম শামসুল আলম, তথ্য : কারেন্ট ওয়ার্ল্ড, আগষ্ট ২০০০ সংখ্যা, গৃহীত : মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী, এপ্রিল-২০০১, পৃ. ১৭-১৯।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৬৪।
[১৭]. তদেব।
প্রসঙ্গসমূহ »:
বিধি-বিধান