মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১১:১৯ অপরাহ্ন

মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব

- মূল : শায়খ ইবরাহীম ইবনু আব্দুল্লাহ আল-মাযরূঈ

- অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ


(২য় কিস্তি)

ফিকহী মাযহাবসমূহের উৎপত্তি

ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ছাহাবায়ে কিরামের যুগে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি কেন্দ্রিক কোন মাযহাবের অস্তিত্ব ছিল না। সমসাময়িক মাস’আলাসমূহের সমাধান পেতে তাঁরা কিতাব-সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতেন। অনুরূপভাবে তাবে‘ঈগণও কিতাব-সুন্নাহর দারস্থ হতেন। সেখানে সমাধান না মিললে ছাহাবায়ে কিরামগণের ইজমা‘র দিকে দৃষ্টি দিতেন। আর সেখানে না পেলে তাঁরা ইজতিহাদ করতেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ কোন একজন ছাহাবীর বক্তব্যকেই গ্রহণ করে নিতেন। দ্বিতীয় যুগের পর তৃতীয় যুগও এভাবেই অতিবাহিত হয়। সেকালে ইমাম আবূ হানিফা, মালেক, শাফেঈ এবং আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুমুল্লাহ) বিদ্যমান ছিলেন। তাঁরা তাঁদের পূর্ববর্তীদের মানহাজের উপরেই ছিলেন। তাঁদের যুগে এমন কোন মাযহাব ছিল না, যেটিকে কেন্দ্র করে তাঁরা আলাদাভাবে পড়াশুনা করতেন। পরবর্তীতে চার মুজতাহিদ ইমামের অনুমতি ছাড়াই কিছু সাধারণ মুক্বাল্লিদ তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই মাযহাবগুলো উদ্ভাবন করেছে। যে সমস্ত মুক্বাল্লিদ মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে, তাদের এই অপকর্মের সমর্থনে কোন মুজতাহিদকেই কিছু বলতে শুনিনি। বরং প্রথিতযশা ‘আলিমগণ এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে জ্ঞানপাপী কিছু ‘আলিমের অনিষ্টের ভয়ে চুপ থেকেছেন। আর এ কারণে প্রতিটি ইসলামী রাষ্ট্রে এই বিদ‘আতটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে গেছে এবং প্রতিটি মুসলিমের মাঝে ঢুকে পড়েছে।[১] আর সে যুগে অনেকগুলো মাযহাব ছিল। পরবর্তীতে এসে প্রসিদ্ধ চার মাযহাব ছাড়া বাকিগুলো টিকেনি। আর প্রতিটি মাযহাবের স্বতন্ত্র ফিক্বহী ভিত রয়েছে এবং নিজস্ব কিছু গ্রন্থাদি, মূলনীতি, ভিত্তি, ‘আলিমগণ ও গ্রন্থাকার ছিল।

মাযহাব হল, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিকল্পিত পথ। হতে পারে সেটি বিশ্বাস বা আচরণগত বা আহকামগত দিক থেকে। আর ইমামের মাযহাব হল, শরী‘আতের শাখা-প্রশাখাগত ইজতিহাদী হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে ইমামের নিজস্ব অভিমত। ঢালাওভাবে কোন মাযহাবের প্রতিটি মত সেই মাযহাবের ইমামের মত বলে চালিয়ে দেয়া জায়েয নয়। কারণ সেই মাযহাবের ইমামের মৃত্যুর পর উক্ত মাযহাবের ‘আলিমগণ কিছু মৌলনীতি এবং শাখাগতনীতি নির্ধারণ করেছেন। এজন্যই প্রতিটি মাযহাবে কিছু উক্তি দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন, মাযহাবের ইমামের নির্ভরযোগ্য মত হল এটি, মাযহাবের প্রাধান্যযোগ্য মত হল এটি, মাযহাবের জমহূর ‘আলিমগণ গ্রহণ করেছেন এটি এবং এজাতীয় কিছু বাক্য।

চার ইমামের প্রতি আমাদের ভালোবাসা

ফিক্বহী মাযহাবের ইমামগণ এই উম্মতের সর্বাধিক বিজ্ঞ ‘আলিম। তাঁরা এই উম্মতকে প্রকৃত দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছেন। প্রতিটি দলীলের মমার্থ বুঝে তাঁরা যে বক্তব্য প্রদান করেছেন সেটি অদ্যাবধি আলোকবর্তিকা হিসাবে রয়ে গেছে। যা থেকে হক্ব প্রয়াসী শিক্ষার্থীরা ফায়দা লুফে নিচ্ছে। তবে সবর্দা মাথায় রাখতে হবে যে, কিতাব-সুন্নাহর মমার্থ বুঝে তাঁরা যে বক্তব্য প্রদান করেছেন সেটিকে ছাহাবায়ে কিরাম, বিজ্ঞ তাবে‘ঈগণ এবং উম্মাহর পরবর্তী প্রথিতযশা ‘আলিমদের বুঝের সাথে সমন্বয় ঘটাতে হবে। আমরা এবং তাঁরা সকলেই নিজেদের প্রতি কিতাব-সুন্নাহর অনুসরণ করা অনিবার্য করে নিয়েছি। তবে কিতাব-সুন্নাহর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অন্য যে কারো প্রতি শ্রদ্ধাবোধের চেয়ে বহু উর্ধ্বে, এতে কোন সন্দেহ নেই। তথাপি, যে ব্যক্তি ইমামদের মানহানি করবে, তাঁদের শানে কটু মন্তব্য করবে বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পায়তারা করবে সে আমাদের মতাদর্শের অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ সালাফিয়্যাত মানেই হল, পূর্ববর্তী বিজ্ঞ ‘আলিমদের মানহাজ অনুসরণ করা এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা। আর মুজতাহিদ ইমামগণ সালাফী-কাফেলারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ।

তাদের ব্যাপারে আমরা ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ভাষায় বলব,

مَعْرِفَةُ فَضْلِ أَئِمَّةِ الْإِسْلَامِ وَمَقَادِيْرِهِمْ وَحُقُوْقِهِمْ وَمَرَاتِبِهِمْ، وَأَنَّ فَضْلَهُمْ وَعِلْمَهُمْ وَنُصْحَهُمْ لِلهِ وَرَسُوْلِهِ لَا يُوْجِبُ قَبُوْلَ كُلِّ مَا قَالُوْهُ، وَمَا وَقَعَ فِيْ فَتَاوِيْهِمْ مِنْ الْمَسَائِلِ الَّتِيْ خَفِيَ عَلَيْهِمْ فِيْهَا مَا جَاءَ بِهِ الرَّسُوْلُ فَقَالُوْا بِمَبْلَغِ عِلْمِهِمْ وَالْحَقُّ فِيْ خِلَافِهَا لَا يُوْجِبُ إطْرَاحَ أَقْوَالِهِمْ جُمْلَةً وَتَنَقُّصَهُمْ وَالْوَقِيْعَةَ فِيْهِمْ

‘দ্বীনের ইমামদের ইজ্জত-সম্মান, হক্ব, মর্যাদা জানা এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞান এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে আন্তরিক হওয়াটা, ঢালাওভাবে তাদের সকল বক্তব্য গ্রহণ করা আবশ্যক করে না। অনেক সময় তাদের ফাতাওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসিত বিষয়ে তাদের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনীত সমাধানটি গোপন থাকার কারণে তাঁরা তাঁদের ‘ইলমের বহরের উপর নির্ভর করে ফৎওয়া প্রদান করেছেন। অথচ পরবর্তীতে দেখা গেল হক্ব তাঁর উল্টো। (তবে এ জাতীয় ভুলের কারণে) একবাক্যে তাঁদের সকল বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা, তাদের মানহানি করা বা তাদের সাথে আক্রমণাত্মক আচরণ করা মোটেও সমীচীন নয়’।[২]

চার মাযহাবের পরবর্তী যুগের ফক্বীহগণের রচিত কিতাবসমূহ গ্রহণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি

তাঁদের গ্রন্থাবলীতে এমন বহু মাস’আলা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যেগুলোর সমর্থনে শারঈ কোন দলীল নেই। এর পাশাপাশি বেশ কিছু যঈফ এবং জাল হাদীছও রয়েছে। বরং গ্রন্থগুলোতে পরবর্তী যুগের ‘আলিমদের মতামতকে কিতাব-সুন্নাহ এবং নিজেদের মাযহাবের ইমামদের বক্তব্যসমূহের উপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সুতরাং যখন একজন শিক্ষার্থী যঈফ ও অন্যান্য হাদীছের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হবে এবং প্রতিটি মাস’আলার উপর অন্যান্য বিভিন্ন কিতাব থেকে শারঈ দলীল সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে, তার জন্য এ গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করে ফায়দা হাসিল করাতে কোন বাধা নেই। কারণ, গ্রন্থগুলো বিপুল পরিমাণ ফিক্বহী তত্ত্বে (সম্পদে) ভরপুর।

ইতোমধ্যে আমরা অবগত হয়েছি যে, কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা আবশ্যক। আমাদের ইমামগণও কিতাব ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন এবং কিতাব ও সুন্নাহ পরিপন্থী বিষয়ে তাঁদেরকে তাক্বলীদ বা অন্ধানুসরণ করা থেকে নিষেধ করেছেন। অনুরূপভাবে তাদের অনুসারীদের মধ্যে মুহাক্কিক্ব ‘আলিমগণও একই পথ অবলম্বন করেছেন। তার পরবর্তীতে ফিক্বহী মাযহাবের বিশেষ করে চার মাযহাবের উৎপত্তি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। এরপর সকল ইমামগণের প্রতি, বিশেষ করে চার ইমামের প্রতি আমাদের ভালোবাসার কথা  বর্ণনা করেছি। এতকিছুর পরেও কোন্ যুক্তিতে সুন্নাহ এবং অন্যান্য ইমামগণের মতামতকে উপেক্ষা করে শুধু তাদের নিজস্ব মতামত আর মাযহাব নিয়ে পড়ে থাকব! মূলত মাযহাবী গোঁড়ামি কী? তার কারণ ও উপমা কেমন হতে পারে? তার বিষক্রিয়া ও ক্ষতিগুলো কী?

মাযহাবী গোঁড়ামি

মাযহাবী গোঁড়ামি হল, এমনটা বলা যে, শুধু তাঁর মাযহাবই সঠিক, বাকিগুলো ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সেই মাযহাবের প্রতিপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা, বিবাদে লিপ্ত হওয়া। বিদ‘আতী ও পথভ্রষ্ট হিসাবে আখ্যা দেয়া, মুসলিমদের কালেমাতে বিভক্তি, মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ে স্বীয় মাযহাব থেকে সমাধান গ্রহণ করা এবং শুধু মাযহাবি গোঁড়ামিবশত স্পষ্ট বিশুদ্ধ দলীলের বিরোধিতা করা। আর মাযহাবী গোঁড়ামি জায়েয নেই এই (এ বিষয়ে ইতোমধ্যে) আমরা দলীল ও ইমামদের বক্তব্য উল্লেখ করেছি। এছাড়া অচিরেই এর কুপ্রভাব ও ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে (সেগুলোর মাধ্যমেও স্পষ্টভাবে প্রমাণ হবে যে মাযহাবী গোঁড়ামি বৈধ নয়।)

মাযহাবী গোঁড়ামির কারণসমূহ

১. প্রবৃত্তি বা খেয়াল-খুশীর অনুসরণ  

মহান আল্লাহ বলেন,

فَاِنۡ لَّمۡ یَسۡتَجِیۡبُوۡا لَکَ فَاعۡلَمۡ  اَنَّمَا یَتَّبِعُوۡنَ  اَہۡوَآءَہُمۡ ؕ وَ مَنۡ اَضَلُّ  مِمَّنِ اتَّبَعَ ہَوٰىہُ بِغَیۡرِ ہُدًی مِّنَ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ  لَا  یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ.

‘অতঃপর যদি তারা আপনার আহ্বানে সাড়া না দেয়, তাহলে জানবেন যে, তারা তো শুধু নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথ-নির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে পথ-নির্দেশ করেন না’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫০)।

সত্য প্রত্যাখান করার অন্যতম একটি কারণ হল, প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। এটি ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। যে ব্যক্তি কোন মাস’আলার ক্ষেত্রে কিতাব-সুন্নাহ অথবা এ দু’টির যেকোন একটির বিরুদ্ধে গিয়ে স্বীয় মাযহাবের পক্ষপাতিত্ব করবে প্রকৃতপক্ষে সে তাঁর প্রবৃত্তি পূজারী। ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

يَجِبُ عَلَيْهِ اتِّبَاعُ النُّصُوْصِ وَإِنْ لَمْ يَفْعَلْ كَانَ مُتَّبِعًا لِلظَّنِّ وَمَا تَهْوَى الْأَنْفُسُ وَكَانَ مِنْ أَكْبَرِ الْعُصَاةِ لِلهِ وَلِرَسُوْلِهِ

‘শারঈ দলীল অনুসরণ করা তার জন্য আবশ্যক। যদি তা না করে, তাহলে পারতপক্ষে সে তার ধারণা ও মনোপ্রবৃত্তিতে মগ্ন রয়েছে। আর সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর চরম বিরুদ্ধাচরণকারী’।[৩]

২. গোঁড়ামির অন্যতম আরেকটি কারণ হল, ঢালাওভাবে অন্ধানুসরণ করা

একজন মানুষ যখন ছোট থেকে বড় প্রতিটি বিষয়ে শুধু একজন ইমামের অনুসরণ করে, ঠিক তখনই অন্ধ গোঁড়ামির সূত্রপাত ঘটে। আর সেই গোঁড়া ব্যক্তি নিজ ইমাম, বাপদাদা এবং তার দেশের অধিবাসীদের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যা পেয়েছে তাই আঁকড়ে ধরে। একপর্যায়ে সেই মাযহাব অনুসরণ করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। সেই মাযহাবকে শারঈ দলীল ভেবে তার আনুগত্য করাকে নিজের উপর আবশ্যক করে নেয় এবং সেটিকে হক্ব ভেবে তা হতে বিন্দু মাত্র পিছু হটে না। এমনকি তার নিকট যখন দলীল ও প্রমাণ উপস্থিত হয় তখনও স্বীয় মাযহাবের সাহায্যার্থে বা প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে গিয়ে সেগুলোকে পরিহার করে নিজ মাযহাবের পক্ষপাতিত্বে লেগে থাকে। ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

وَأَكْثَرُ النَّاسِ إنَّمَا الْتَزَمُوا الْمَذَاهِبَ بَلِ الْأَدْيَانَ بِحُكْمِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ فَإِنَّ الْإِنْسَانَ يَنْشَأُ عَلٰى دِيْنِ أَبِيْهِ أَوْ سَيِّدِهِ أَوْ أَهْلِ بَلَدِهِ  فَكُلُّ مَنْ عَدَلَ عَنِ اتِّبَاعِ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَطَاعَةِ لِلهِ وَالرَّسُوْلِ إلٰى عَادَتِهِ وَعَادَةِ أَبِيْهِ وَقَوْمِهِ فَهُوَ مِنْ أَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ الْمُسْتَحِقِّيْنَ لِلْوَعِيْدِ

‘অধিকাংশ মানুষ নিজেদের ‘ইলম অনুপাতে বিভিন্ন মাযহাব রবং বিভিন্ন দ্বীন লালন করছে। কেননা মানুষ তার পিতৃপুরুষ অথবা তার নেতা অথবা স্বদেশী লোকদের দ্বীনের রীতি অনুসরণ করে বেড়ে উঠেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি কিতাব ও সুন্নাহর অনুসরণ এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণ উপেক্ষা করে নিজস্ব খেয়াল-খুশি, পিতৃপুরুষ এবং স্বগোত্রীয় মতবাদের অনুসরণ করে, সে জাহেলী যুগের বর্বরদের অন্তর্ভুক্ত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধী’।[৪]

মহান আল্লাহ বলেন, وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ  اتَّبِعُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَاۤ اَلۡفَیۡنَا عَلَیۡہِ اٰبَآءَنَا ‘এবং যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার অনুসরণ কর; তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষগণকে পেয়েছি’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭০)।

৩. মাযহাবী গোঁড়ামি প্রসারের অন্যতম কারণ হল,

এমন কিছু নেতৃবৃন্দ ও শাসকগোষ্ঠি মাযহাবের অনুসারী ছিল যারা জনগণের উপর মাযহাব অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিল। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ও শাসকদের সান্নিধ্য লাভের জন্য তাকে শর্ত করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ব্যাপক আকারে অন্ধানুসরণের ব্যাপারে এবং অন্ধ গোঁড়ামি ছড়িয়ে পড়েছিল।

৪. অন্যতম আরেকটি কারণ হল,
 
এই দাবি করা যে, প্রত্যেক মুজতাহিদই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম। অথচ বহু ‘আলিম তাদের এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তন্মধ্যে আবূ ‘ওমর ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত ‘জামি‘ঊল বয়ানিল ‘ইলমি ওয়া ফাযলিহি’ গ্রন্থে (তাদের এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন) এবং তিনি এই গ্রন্থে ছাহাবায়ে কিরাম ও তাদের পরবর্তী সময়ে যাঁরা ছিলেন তাদের অনাকাক্সিক্ষত কিছু ভুলত্রুটি তাদের একজন অপরজনের মতকে পরিহার করার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। সুতরাং প্রত্যেক মুজতাহিদ সঠিক সিদ্ধান্ত পৌঁছতে সক্ষম নন; বরং (যে মুজতাহিদ ইজতিহাদ করে) ভুল করেন তিনি একটি ছওয়াবের অধিকারী হন। আর কেউ ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হলে দ্বিগুণ ছওয়ারের অধিকারী হবেন।

৫. মাযহাবী গোঁড়ামির অন্যতম আরেকটি কারণ হল,

বিভিন্ন মাযহাবের ‘আলিমগণের মধ্যে প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটা। যারা একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক (মনোভাব পোষণ করেন)। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে একই মাযহাবের এক ‘আলিম অপরজনকে (খোঁচা মেরে কথা বলেন)। শুধু তাদের নিজেদের মাযহাবকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য বিভিন্ন যঈফ ও জাল হাদীছের মাধ্যমে এমন দলীল উপস্থাপন করেন, যা তাদের মাযহাবকে অন্যান্য মাযহাবের তুলনায় শক্তিশালী করে। তাছাড়া ফিক্বহী গ্রন্থগুলোর পুরোটা জুড়েই তাদের ইমামদের ত্রুটিপূর্ণ বক্তব্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর মূল কারণ হল, তারা যে বক্তব্য প্রদান করেছেন সে বিষয়ে তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল না। এমনকি তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি রয়েছে যে শুধু মাযহাবের স্বার্থে হাদীছের মধ্যে বিভিন্ন শব্দাবলী সংযোজন-বিয়োজন করেছেন। এসবের দৃষ্টান্ত দেখতে চোখ রাখুন আবূ শামা (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৬৬৫ হি.)-এর রচিত مختصر المؤهل নামক গ্রন্থে।

৬. মাযহাবী গোঁড়ামি প্রসারের অন্যতম কারণ হল,

আহলুস সুন্নাতের বিরুদ্ধাচরণ করা, তাদের প্রতি সংকীর্ণমনা হওয়া এবং যুগ যুগ ধরে ধর্মীয় কোন পদে তাদেরকে অবস্থান না দেয়া, এমনকি সেই তৃতীয় শতাব্দীতে তাক্বলীদ শুরু হওয়ার পর থেকে নিয়ে অদ্যাবধি একই অবস্থা।[৫]

৭. মাযহাবী গোঁড়ামির অন্যতম কারণ হল,

ইমামগণের সম্মান প্রদর্শনে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি করা। আর সকল বিষয়ে বাড়াবাড়ি বা অতিরঞ্জন করা নিন্দনীয়। মহান আল্লাহ বলেন, یٰۤاَہۡلَ الۡکِتٰبِ لَا تَغۡلُوۡا فِیۡ دِیۡنِکُمۡ ‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা স্বীয় দ্বীনে সীমা অতিক্রম কর না’ (সূরা আন-নিসা : ১৭১)।

ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে ঐ সমস্ত ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন, যারা আল্লাহর কিতাবে বিকৃতি ঘটিয়েছে, খুবই যতসামান্য মূল্যের বিনিময়ে তা বিক্রয় করে দিয়েছে, সেটিকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করে তথা প্রত্যাখ্যান করে তাদের বিরোধপূর্ণ (বানোয়াট) মতবাদকে বরণ করে নিয়েছে, আল্লাহর দ্বীন মানতে গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির অন্ধানুসরণ করেছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের বিশপ ও পাদ্রীদেরকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছে’।[৬] আর নিন্দনীয় সীমালঙ্ঘনের আরেকটি রূপ হল, ইমামগণের বক্তব্যকে শরী‘আতের স্পষ্ট দলীলের উপর অগ্রাধিকার দেয়া, যে কোন একটি ফিক্বহী মাযহাব গ্রহণ করাকে আবশ্যক বলা, কোন মুসলিমের তার মাযহাব থেকে বের হওয়াকে হারাম বলা এবং অন্যান্য মাযহাব থেকে কোন বিধান গ্রহণ করা হারাম ঘোষণা দেয়া।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* পাঁচরুখী, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ।

তথ্যসূত্র :
[১]. মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলী ইবনু মুহাম্মাদ আশ-শাওকানী, আল-ক্বওলুল মুফীদ ফী আদিল্লাতিল ইজতিহাদ ওয়াত তাক্বলীদ (কুয়েত : দারুল ক্বলাম, ১৩৯৬ হি.), পৃ. ৪৩-৪৪।
[২]. মুহাম্মাদ ইবনু আবি বকর ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযী, ই‘লামুল মুয়াক্কি‘ঈন, ৩য় খণ্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪১১ হি.), পৃ. ২২০।
[৩]. তাক্বীউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ ইবনু আব্দিল হালীম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, তাহক্বীক্ব : আব্দুর রহমান ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ক্বাসিম, ২০তম খণ্ড (মদীনা : মাজমা‘ঊল মুলক, ১৪১৬ হি.), পৃ. ২১৩।
[৪]. প্রাগুক্ত, ২০তম খণ্ড, পৃ. ২২৪।
[৫]. মুক্বাদ্দিমাতু ইবনি খালদূন, পৃ. ৪৩৪।
[৬]. আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, তাহক্বীক্ব : সামী ইবনু মুহাম্মাদ, ৮ম খণ্ড (দারুত ত্বায়্যিব, ১৪২০ হি.), পৃ. ২০, সূরা আল-হাদীদের ১৬ নং আয়াত দ্র.।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি (৩য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন - হাসিবুর রহমান বুখারী
বিদ‘আত পরিচিতি (১৮তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২০তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রেম ও ভালোবাসা - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ফিলিস্তীন, হে মুসলিম! - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী

ফেসবুক পেজ