সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০১:১৯ অপরাহ্ন

শবেবরাত

-আল-ইখলাছ ডেস্ক*



‘শবেবরাত’ দু’টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। একটি ‘শব’ অন্যটি ‘বরাত’। ফার্সী ভাষা থেকে গৃহীত ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত বা রজনী। আরবী ভাষা থেকে গৃহীত ‘বরাত’ শব্দটির অর্থ বিমুক্তি, সম্পর্কহীনতা, মুক্ত হওয়া, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের দেশে ‘বরাত’ শব্দটিকে ‘ভাগ্য’ বা ‘সৌভাগ্য’ অর্থে ব্যবহার করা হয়, যা ঠিক নয়। ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ শরী‘আত নির্দেশিত কোন পর্ব নয়। এটি সর্বপ্রথম ৪৪৮ হিজরীতে বায়তুল মাক্বদিসে মধ্য শা‘বানের রজনীতে ‘ছালাতুল আলফিয়া’ নামে নতুন একটি ইবাদত চালু হয়। যার জন্য ব্যাপক আলোকসজ্জাও করা হত এবং এই বিদ‘আতী ছালাতের সাথে পাপাচার ও সীমালঙ্ঘন প্রকাশ পাওয়ায় পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবের ভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন (মিরক্বাত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৫০)।

ধর্মীয় ভিত্তি : আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে ‘শবেবরাত’ উদযাপন করা হয়। শবেবরাতের পক্ষে কিছু দলীল উপস্থাপন করে থাকে, যা সঠিক নয়। যেমন, (১) এই রাত্রিতে কুরআন অবতীর্ণ হয়। তাদের এ দাবী সঠিক নয়। কেননা এ আয়াতে বর্ণিত ‘বরকতময় রজনী’ দ্বারা রামাযানের ক্বদরের রাতকেই বুঝানো হয়েছে (তাফসীরে বাগাবী, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২২৭)।
(২) এই রাত্রিতে বান্দার গুনাহ মাফ হয়। এ মর্মে তাদের উপস্থাপিত সকল বর্ণনা দুর্বল ও অস্বীকৃত (যঈফ তিরমিযী, হা/৭৩৯; সিলসীলা ছহীহাহ, ৩/২১৮, ৫/১৫৪, হা/১৪৫১; তাক্বরীবুত তাহযীব ১/৪১৭ পৃঃ, রাবী নং-৩৯৪৫)। অথচ প্রত্যেক রাতেই আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা করে থাকেন মর্মে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে (ছহীহ বুখারী, হা/১১৪৫; মিশকাত, হা/১১৪৫)।
(৩) এ রাতে আগামী এক বছরের জন্য ভালমন্দ তাক্বদীর নির্ধারিত হয়। অথচ এ বক্তব্যেরও কোন ছহীহ ভিত্তি নেই। যা কিছু আছে সবই বানোয়াট, ভিত্তিহীন (তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৪৬)। তাছাড়া এই আক্বীদা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিরোধী (সূরা আল-ক্বামার : ৫২-৫৩; ছহীহ বুখারী, হা/৫০৭৬; , হা/৭৯, ৮৮)।
(৪) জীবনের সমস্ত গুনাহকে ক্ষমা করিয়ে নেয়ার জন্য এই রাত্রিতে ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করা হয়, যেখানে প্রতি রাক‘আতে ১০ বার করে সূরা ইখলাছ পড়া হয়, যা মওযূ‘ বা জাল বর্ণনা (আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ, পৃ. ২৫)।
(৫) মনে করা হয়, ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর যখন দাঁত ভেঙ্গে যায়, তখন তিনি হালুয়া খেয়েছিলেন’ তাই এ রাতে হালুয়া-রুটি তৈরি ও বিতরণ করা হয় এবং খাওয়া হয়। অথচ উক্ত বক্তব্য বাস্তবতার বিরোধী। কেননা ওহুদের যুদ্ধ শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু শবেবরাত পালন করা হয় শা‘বান মাসে। যা সত্যিই হাস্যকর।

এতদ্ব্যতীত এদিনে অসংখ্য বিদ‘আতী কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। যেমন, ‘অর্ধ শা‘বান’-এর রাত্রিকে ‘ভাগ্য রজনী’ বলে মনে করা, বয়স ও রুযী বৃদ্ধি হয় বলে ধারণা করা, হালুয়া-রুটি ও রকমারী খাদ্য প্রস্তুত করা, বিধবা মহিলাদের মৃত স্বামীর আগমন করে বলে ভ্রান্ত বিশ্বাস করা এবং এজন্য ঘরে আলো জ্বেলে সারারাত মৃত স্বামীর রূহের আগমনের অপেক্ষা করা, আগরবাতি, মোমবাতি, ধুপ-ধুনা ইত্যাদি জ্বালানো, ব্যাপকভাবে পাড়া-গ্রাম ও শহর-মহল্লায় আলোকসজ্জা ও আগুন জ্বালানো, শবেবরাতের রাত্রি জাগরণ করা এবং ফযীলতের আশায় গোসল করা ইত্যাদি। এগুলো সবই মূর্খতা ও নিকৃষ্ট বিদ‘আত। এজন্য আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ) এই রাতে আলোকসজ্জা করা হিন্দুদের ‘দেওয়ালী’ উৎসবের অনুকরণ বলে উল্লেখ করেছেন। এমনকি বলেছেন যে, এগুলো ঐসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যেসবের কোন ভিত্তি গ্রহণযোগ্য কোন বিশুদ্ধ গ্রন্থে নেই। গ্রহণযোগ্য কোন কিতাবেও নেই। এ বিষয়ে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি। না কোন যঈফ না কোন মাওযূ‘ (মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ, পৃ. ২১৪-২১৫)। অতএব প্রচলিত বিদ‘আতী শবেবরাত থেকে বিরত থাকা একান্ত যরূরী।

শা‘বান মাসের সুন্নাতী আমল : আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘রামাযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণ মাস ছিয়াম পালন করতে দেখিনি। আর শা‘বান মাস ব্যতীত অন্য মাসে অধিক পরিমাণে নফল ছিয়াম পালন করতে দেখিনি’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৯৬৯)। উসামা ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলাম, শা‘বান মাসে আপনি যে পরিমাণ ছিয়াম রাখেন, অন্য কোন মাসে আপনাকে এত ছিয়াম রাখতে দেখি না! তিনি বললেন, ‘রজব ও রামাযান মাসের মধ্যবর্তী শা‘বান মাস সম্পর্কে লোকজন গাফেল থাকে; অথচ এ মাসে মানুষের আমল আল্লাহ তা‘আলার নিকটে উপস্থাপন করা হয়, আর আমি এটাই ভালোবাসি যে, আমার আমল এমন অবস্থায় উপস্থাপিত হোক যখন আমি ছিয়াম পালনকারী’ (নাসাঈ, হা/২৩৫৭, সনদ হাসান)। এছাড়া শা‘বান মাসের একদিনের নফল ছিয়াম অন্য মাসের দুই দিনের ছিয়ামের সমান। ইমরান বিন হুছাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বা অন্য কাউকে বলেছেন, ‘তুমি কি শা‘বানের গোপনভাগে (শেষে) ছিয়াম রেখেছ? তিনি বললেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যখন তুমি (রামাযানের ছিয়াম) শেষ করবে, তখন দুইদিন ছিয়াম রেখে দিবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৯৮৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬১; ত্বাবারাণী কাবীর, হা/২২০; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬১; ফাৎহুল বারী, হা/১৯৮৩-এর আলোচনা দ্র.)।

অতএব এমাসে বেশি বেশি ছিয়াম পালন করতে হবে। তবে যারা শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন, তাদের জন্য শেষার্ধে ছিয়াম পালন করা উচিত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যখন শা‘বান মাস অর্ধেক অতিবাহিত হয়, তখন তোমরা আর (নফল) ছিয়াম রেখ না’ (আবূ দাঊদ, হা/২৩৩৭; মিশকাত, হা/১৯৭৪, সনদ ছহীহ)। অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করতে পারবেন (ছহীহ বুখারী, হা/১৯১৪; মিশকাত, হা/১৯৭৩, ২০৩৮)।

পরিশেষে বলা যায় যে, শা‘বান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত। কিন্তু শুধু ১৫ই শা‘বান একদিন শবেবরাতের নিয়তে ছিয়াম পালন করা বিদ‘আত।




পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
আত্মহত্যাকারীর শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
রজব মাসের বিধানসমূহ - অনুবাদ : ইউনুস বিন আহসান
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমের শ্রেষ্ঠত্ব (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বিদ‘আত পরিচিতি (৭ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (২৬তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ক্রোধের ভয়াবহতা ও তার শারঈ চিকিৎসা - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক

ফেসবুক পেজ