রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ১০:২০ অপরাহ্ন

কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা

-মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী
-অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন *



ভূমিকা

সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা জ্ঞাপন করি, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমাদের মন্দ কর্ম এবং অন্তরের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহ তা‘আলা যাকে হেদায়াত দান করেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর আল্লাহ তা‘আলা যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তাকে কেউ হেদায়াত দিতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। আর আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উপর, তাঁর পরিবার-পরিজন, ছাহাবীগণ এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা উত্তম কর্মে তাঁর অনুসরণ করবে সকলের উপর অগণিত রহমত ও শান্তির ধারা বর্ষণ করুন।

অতঃপর এগুলো আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার প্রতি উৎসাহ দানকারী সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথা। এতে আমি উল্লেখ করেছি কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার তাৎপর্য এবং এ দু’টিকে গ্রহণ করে আমল করার আবশ্যকতা। নিশ্চয় কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। মূলত কুরআনের উপর আমল করার জন্যই তাকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহকে মেনে চলবে এবং এদু’টিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে তাঁর জন্যই রয়েছে হেদায়াত, সফলতা ও কল্যাণ। নবুওঅতের সবচেয়ে বড় উপদেশ হল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার উপদেশ। কুরআনুল কারীমে মানুষদেরকে সত্যের উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে এবং মতবিরোধ ও দলে দলে বিভক্ত হওয়া থেকে নিষেধ করে। কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মধ্যেই রয়েছে ফিতনার ভ্রষ্টতা থেকে মুক্তির (একমাত্র) পথ। আর কুরআন ও সুন্নাহকে পরিত্যাগ করায় হল লাঞ্ছনা, অপদস্ততা, দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির কারণ। আর সকল অনিষ্টতা এবং বিভক্তির মূল কারণ হল মতবিরোধ। তাই প্রত্যেকটি মানুষের উপর কুরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা ওয়াজিব। কেননা এতদুভয়কে মযবুতভাবে আঁকড়ে ধরার মধ্যেই রয়েছে যাবতীয় ফিতনা থেকে মুক্তির উপায়। আর যে ব্যক্তি কুরআন ব্যতীত অন্য কোথাও হেদায়াত অনুসন্ধান করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে পথভ্রষ্ট করে দিবেন।

কুরআন হল আল্লাহ তা‘আলার সুদৃঢ় রজ্জু, তাঁর উজ্জ্বল জ্যোতি এবং প্রজ্ঞাময় উপদেশ। আর কুরআনই হল ছিরাতে মুস্তাক্বীম তথা সরল-সঠিক পথ। কুরআন এমন একটি কিতাব, যার অনুসরণকারীরা কখনো প্রবৃত্তির দ্বারা বাতিল পথে পরিচালিত হয় না। (তা তেলাওয়াতে) জিহ্বাহ কখনো আড়ষ্ট হয় না। তার সাথে কারো মতের অমিল হয় না, জ্ঞানীগণ এটা তেলাওয়াত করে বিরক্ত হন না। মুত্তাক্বীরা এটা পাঠ করে ক্লান্তিবোধ করেন না। বার বার পাঠ করেও তাঁর স্বাদ শেষ হয় না। তাঁর অলৌকিকত্ব কখনো নিঃশেষ হবে না, যে কুরআনের জ্ঞান অর্জন করবে সে অগ্রগামী হবে, আর যে কুরআনের কথাকে সত্য বলে। যে এর মাধ্যমে বিচার-ফায়ছালা করে সে ন্যায়বিচার করে। যে কুরআনের উপর আমল করে সে প্রতিদানপ্রাপ্ত হবে। যে ব্যক্তি কুরআনের দিকে আহ্বান করে সে সঠিক পথের দিশা পাবে।[১]

কুরআন ও সুন্নাহর মর্যাদার গুরুত্ব দিতে গিয়েই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর খুত্ববায় বলতেন,

أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الْأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

‘হামদ ও ছানার পর, নিশ্চয় সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ হচ্ছে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল দ্বীনের মধ্যে (মনগড়াভাবে) নতুন জিনিস আবিষ্কার করা এবং সকল নতুন আবিষ্কারই গোমরাহী (পথভ্রষ্ট)’।[২]

আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন এই কথাগুলোকে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কবুল করেন। আর এর দ্বারা আমাকে যেন দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ দান করেন এবং এর দ্বারা যেন প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিকে উপকার দান করেন যার হাতেই পুস্তিকাটি পৌঁছবে। কেননা তিনিই হলেন সর্বোত্তম প্রার্থনা কবুলকারী এবং প্রত্যাশা পূরণকারী। আর তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং সর্বোত্তম অভিভাবক।

আমাদের নবী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবায়ে কেরামের উপর এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা উত্তম কর্মে তাঁদের অনুসরণ করবে তাদের সকলের উপর আল্লাহ তা‘আলা অগণিত রহমত, শান্তি ও বরকত অজস্র ধারায় বর্ষণ করুন।

দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা এবং ফিতনার ভ্রষ্টতা থেকে মুক্তির এক অনন্য উপায় হল আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা।[৩] (নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপন করা হল:)

প্রথমতঃ কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার অর্থ

নিঃসন্দেহ কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরায় হল দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তির প্রধানতম উপায়। আরবীতে এটাকে  الإِعْتِصَامُ বলা হয়। এর শাব্দিক অর্থ اَلْاِسْتِمْسَاكُ ‘মযবুতভাবে আঁকড়ে ধরা’।[৪] ইবনু মানযূর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الإِعْتِصَامُ  এর অর্থ হল اَلْاِسْتِمْسَاكُ بِالشَّيءِ ‘কোন জিনিসকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা’।[৫] সুতরাং الْإِعْتِصَامُ-এর অর্থ হল কোন জিনিসকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা। বলা হয়ে থাকে, استعصم-এর অর্থ আঁকড়ে ধরা।[৬]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا  ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধর’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১০৩)। আর اَلْإِعْتِصَامُ بِحَبْلِ اللهِ ‘আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা’-এর অর্থ হল, اَلْإِعْتِصَامُ بِعَهْدِ اللهِ ‘আল্লাহর অঙ্গীকারকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা’। কেউ বলেন, এর অর্থ হল يَعْنِي الْقُرْآن ‘কুরআনকে আঁকড়ে ধরা’। আবূ শুরাইহ আল-খুযাঈ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَقَالَ أَبْشِرُوْا وَأَبْشِرُوْا أَلَيْسَ تَشْهَدُوْنَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ؟ قَالُوْا بَالَى قَالَ إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ سَبَبُ طَرْفَهُ بِيَدِ اللهِ وَطَرْفَهُ بِأَيْدِيْكُمْ فَتَمَسَّكُوْا بِهِ فَإِنَّكُمْ لَنْ تَضِلُوْا وَلَنْ تَهْلِكُوْا بَعْدَهُ أَبَدًا

‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট এসে বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। তোমরা কি একথার সাক্ষ্য প্রদান কর না যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই আর আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)? ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, নিশ্চয় এই কুরআন একটি (মাধ্যম) রশি। যার একটি প্রান্ত আল্লাহর হাতে অপর প্রান্তটি তোমাদের হাতে। সুতরাং তোমরা এই কুরআনকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধর। কেননা তোমরা যদি কুরআনকে আঁকড়ে ধর তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, এরপরে কখনো ধ্বংসও হবে না।[৭] জুবাইর ইবনু মুত্বঈম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে জুহফাহ নামক স্থানে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট বের হয়ে বললেন,

أَلَيْسَ تَشْهَدُوْنَ أَنْ لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ وَأَنَّ الْقُرْآنَ مِنْ عِنْدِ اللهِ؟ قُلْنَا نَعَمْ قَالَ فَأَبْشِرُوْا فَإِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ طَرْفُهُ بِيَدِ اللهِ وَطَرْفُهُ بِأَيْدِيْكُمْ فَتَمَسَّكُوْا بِهِ وَلَا تَهْلِكُوْا بَعْدَهُ أَبَدًا

‘তোমরা কি সাক্ষ্য দাও না যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই, আর আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)? আর এই কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তাহলে তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা এ কুরআনের এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে আর অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে। সুতরাং তোমরা তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধর। তাহলে পরে তোমরা কখনো ধ্বংস হবে না’।[৮]

সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনুল কারীমকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল সে আল্লাহকেই শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ یَّعۡتَصِمۡ بِاللّٰہِ فَقَدۡ ہُدِیَ  اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে সুদৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে, নিশ্চয় সে সরল পথের দিকে পরিচালিত হবে’ (সূরা আলে ইমরান : ১০১)। অর্থাৎ যে আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং তাঁর আশ্রয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।[৯] আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের অনেক আয়াতে তাঁর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। আর আল্লাহর রজ্জু হল তাঁর কিতাব অর্থাৎ কুরআনুল কারীম।[১০]

দ্বিতীয়তঃ আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার আবশ্যকতা

আল্লাহ তা‘আলা মহান কিতাব কুরআনুল কারীমকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। আর মানুষ যা কিছু অনুভব করে এবং যে বিষয়ে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ে সেগুলোকেও কুরআনের দিকে ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡہُ اِلَی اللّٰہِ وَ الرَّسُوۡلِ  اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ  تَاۡوِیۡلًا

‘যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান এনে থাক; এটাই উত্তম এবং সুন্দরতম সমাধান’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মুজাহিদ এবং অন্য একজন সালাফ বলেছেন,

أَيْ إِلَى كِتَاب الله وَسُنَّة رَسُوْلُهُ ﷺ وَهَذَا أَمْر مِنَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ بِأَنَّ كُلُّ شَيْء تَنَازَعَ النَّاس فِيْهِ مِنْ أُصُوْلِ الدِّيْن وَفُرُوعِهِ أَنْ يُرَدّ التَّنَازَع فِيْ ذَلِكَ إِلَى الكِتَاب وَالسُّنَّة كَمَا قَالَ تَعَالَى وَ مَا اخۡتَلَفۡتُمۡ فِیۡہِ مِنۡ شَیۡءٍ فَحُکۡمُہٗۤ اِلَی اللّٰہِ

‘অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়া। এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ। কেননা মানুষ শরী‘আতের মৌলিক এবং শাখাগত যে সকল বিষয়ে মতবিরোধ করে এরকম সকল বিষয়ের মতবিরোধকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে’। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَا اخۡتَلَفۡتُمۡ فِیۡہِ مِنۡ شَیۡءٍ فَحُکۡمُہٗۤ اِلَی اللّٰہِ ‘তোমরা যেসব বিষয়ে মতভেদ কর না কেন তার মীমাংসা তো আল্লাহর উপরই সোপর্দ’।[১১]

কুরআনুল কারীম আদেশ করেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনীত সকল বিষয়কে আঁকড়ে ধরতে এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ  فَخُذُوۡہُ ٭ وَ مَا نَہٰىکُمۡ  عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর, আর তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (সূরা আল-হাশর : ৭)।

নিঃসন্দেহে কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরাটা হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যকীয় কর্তব্য এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। কেননা শরী‘আতের দলীল ব্যতীত কারো মতামত গ্রহণ করাটা ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। তাইতো সাহল ইবনু হুনাইফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

اِتَّهِمُوْا رَأْيَكُمْ فَلَقَدْ رَأَيْتُنِيْ يَوْمَ أَبِيْ جَنْدَلٍ وَلَوْ أَسْتَطِيْعُ أَنْ أَرُدَّ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ أَمْرَهُ لَرَدَدْتُ وَ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَعْلَمُ

‘তোমরা নিজ মতামতকে বিশুদ্ধ মনে করো না। আমি নিজেকে আবূ জান্দালের দিন দেখেছি। আমি যদি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ রদ করতে পারতাম, তবে তা নিশ্চয় রদ করতাম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) সর্বাধিক অবগত’।[১২]      

এটাই সুদৃঢ় করে যে, কারো মতামতের উপর নির্ভর করা যাবে না। বরং নির্ভর করতে হবে একমাত্র কুরআন ও সুন্নাহের উপর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান এনে থাক; এটাই উত্তম এবং সুন্দরতম সমাধান’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)। তিনি আরো বলেন,

فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی  یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ  بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ  لَا  یَجِدُوۡا فِیۡۤ  اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا  مِّمَّا قَضَیۡتَ  وَ یُسَلِّمُوۡا  تَسۡلِیۡمًا

‘অতএব আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনও বিশ্বাস স্থাপনকারী হতে পারবে না, যে পর্যন্ত আপনাকে তাদের আভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক হিসাবে মেনে না নিবে, তৎপর আপনি যে বিচার করবেন তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না করবে এবং তা শান্তভাবে পরিগ্রহণ না করবে’ (সূরা আন-নিসা : ৬৫)। তিনি আরো বলেন,

وَ مَا اخۡتَلَفۡتُمۡ فِیۡہِ مِنۡ شَیۡءٍ فَحُکۡمُہٗۤ اِلَی اللّٰہِ ؕ ذٰلِکُمُ اللّٰہُ رَبِّیۡ عَلَیۡہِ  تَوَکَّلۡتُ ٭ۖ وَ  اِلَیۡہِ  اُنِیۡبُ

‘তোমরা যে সব বিষয়ে মতভেদ কর না কেন তার মীমাংসা তো আল্লাহর উপরই সোপর্দ, সেই আল্লাহই আমার প্রতিপালক, আমি তাঁর উপরই নির্ভর করি, আর তাঁরই অভিমুখী হই’ (সূরা আ-শুরা : ১০)। সুতরাং মানুষের মাঝে ফায়ছালা করার ক্ষেত্রে মূলনীতি হল- ফায়ছালাকে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে’।[১৩]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।

তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী হা/২৯০৬; মিশকাত, হা/২১৩৮। আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এই হাদীছটি যঈফ বলেছেন।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭; মিশকাত, হা/১৪১।
[৩]. মূলত এই গ্রন্থটি একটি প্রবন্ধ, যা আমার কাছে ‘আদ-দা‘ওয়াহ বিওয়াজারাতিশ শুয়ূনিল ইসলামিয়্যাহ ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দা‘ওয়াহ ওয়াল ইরশাদ’ মন্ত্রণালয় চেয়েছিল। অতঃপর মন্ত্রণালয় ‘আল-জাজিরাহ’ নামক পত্রিকায় ১৭/০৮/১৪২২ হিজরীতে ১০৬২৭ তম সংখ্যার ২৭ পৃষ্ঠায় জুমু‘আর দিনে প্রবন্ধটি প্রকাশ করে।
[৪]. ইছফাহানী, মুফরাদাতু আলফাযিল কুরআন, পৃ. ৫৬৯।
[৫]. লিসানুল ‘আরব, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪০৪।
[৬]. ইছফাহানী, মুফরাদাতু আলফাযিল কুরআন, পৃ. ৫৭০।
[৭]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, ১ম খণ্ড, ৩২৯, হা/১২২; ইমাম মুনযিরী, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৫, হা/৫৯; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৪৯১; আল্লামা আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (১/১২৪) গ্রন্থে একে ছহীহ বলেছেন। আর ইবনু নাছর ‘ক্বিয়ামুল লাইল’ নামক গ্রন্থে পৃ. ৭৪-এ ছহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন; শু‘আঈব আরনাউত্ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী এর সনদ হাসান।
[৮]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৬, হা/১৫৩৯; আল-মু‘জামুছ ছাগীর (মাজমাঊল বাহরাইন, হা/২৫২); হাইছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৯। আর তাতে আবূ আবীদাহ আয-যাওরাক্বী নামক একজন মাতরূক বা পরিত্যক্ত রাবী রয়েছে। আল্লামা আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৪, হা/৩৯-এ হাদীছটিকে ছহীহ লি গায়রিহি বলেছেন।
[৯]. তাফসীরে আস-সা‘দী, পৃ. ১৫৯।
[১০]. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ৭৬-৮৩; ৯ম খণ্ড, পৃ, ৫, ৮ এবং ৩৬তম খণ্ড, পৃ. ৬০।
[১১]. সূরা আশ-শূরা : ১০; তাফসীরে ইবনু কাছীর, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৫।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৮১ ‘জিযইয়াহ কর ও সন্ধি স্থাপন’ অধ্যায়, ‘হাদ্দাছানা আবদান’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৮৫ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ‘হুদায়াবিয়ার সন্ধি’ অনুচ্ছেদ।
[১৩]. ইমাম ত্বাবারী, জামি‘ঊল বায়ান ফী তা‘বীলল কুরআন, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫০৪; তাফসীরে ইবনু কাছীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১৯।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ মুসলিম জাহান
বিদ‘আত পরিচিতি (৯ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
হজ্জ ও ওমরার সঠিক পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামে ব্যবসায়িক মূলনীতি - ছাদীক মাহমূদ
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ক্রোধের ভয়াবহতা ও তার শারঈ চিকিৎসা - হাসিবুর রহমান বুখারী
কুরআনী প্রবাদ সংকলন : তাৎপর্য ও শিক্ষা - প্রফেসর ড. লোকমান হোসেন
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
ক্যারিয়ার : শিক্ষক নিবন্ধনের প্রস্তুতির ধরন ও বিষয়াবলী - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন

ফেসবুক পেজ