বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৫ অপরাহ্ন

আল-কুরআনের আলোকে দাওয়াতের মাধ্যম

-আব্দুল গাফফার মাদানী*


ভূমিকা

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। এই পরিপূর্ণতার অংশ হিসাবে নাযিল করেছেন মহাপ্রজ্ঞাময় গ্রন্থ আল-কুরআন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আর আমরা আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ’ (সূরা আন-নাহল : ৮৯) । দাওয়াতী ময়দানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন সবচেয়ে সফল ব্যক্তিত্ব। তাঁর বৈষয়িক চলাফেরা সম্পর্কে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তো ছিলেন কুরআনেরই প্রতিচ্ছবি। সুতরাং কুরআনেও যে দাওয়াতী রীতি পদ্ধতি বিদ্যমান, তা স্পষ্ট। আমরা আলোচ্য নিবন্ধে কুরআনের আলোকে কিছু দাওয়াতী পথ ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

১. জ্ঞানার্জন ও তার প্রসার

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلَوۡ لَا نَفَرَ مِنۡ کُلِّ فِرۡقَۃٍ مِّنۡہُمۡ طَآئِفَۃٌ  لِّیَتَفَقَّہُوۡا فِی الدِّیۡنِ وَ لِیُنۡذِرُوۡا قَوۡمَہُمۡ اِذَا رَجَعُوۡۤا اِلَیۡہِمۡ لَعَلَّہُمۡ  یَحۡذَرُوۡنَ

‘অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১২২)। এ আয়াতটি দ্বীনের ইলম হাসিলের মৌলিক দলীল। বলা হয়েছে (لِّیَتَفَقَّہُوۡا فِی الدِّیۡنِ) ‘যাতে দ্বীনের মধ্যে বিজ্ঞতা অর্জন করে’ দ্বারা উদ্দেশ্যে হল, দ্বীনকে অনুধাবন করা কিংবা তাতে বিজ্ঞতা অর্জন করা। تَفَقَّهُ শব্দের অর্থও তাই। এটি فِقْهٌ থেকে উদ্ভূত। فِقْهٌ অর্থ বুঝা, অনুধাবন করা, সূক্ষ্মভাবে বুঝা। আর (وَ لِیُنۡذِرُوۡا قَوۡمَہُمۡ) দ্বারা ইলম অর্জনের পর তা প্রচার-প্রসারের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّيْنِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে তিনি দ্বীনের ফিক্বহ প্রদান করেন’।[১] অন্য হাদীছে এসেছে, تَجِدُوْنَ النَّاسَ مَعَادِنَ خِيَارُهُمْ فِى الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُهُمْ فِى الْإِسْلَامِ إِذَا فَقِهُوْا ‘মানুষ যেন গুপ্তধন, স্বর্ণ ও রৌপ্যের গুপ্তধনের মত। তাদের মধ্যে যারা জাহেলিয়াতে উত্তম তারা ইসলামেও উত্তম, যদি তারা দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে’।[২]

২. নে‘মতের কথা স্মরণ করা

পৃথিবীতে ও মানুষের মাঝে যত নে‘মত রয়েছে সবই আল্লাহর বিশেষ দান। তাইতো মহান রব্বুল আলামীন বলেন, وَ مَا بِکُمۡ مِّنۡ نِّعۡمَۃٍ فَمِنَ اللّٰہِ ‘আর তোমাদের কাছ যে সব নে‘মত আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে’ (সূরা আন-নাহল : ৫৩)। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষের সকল সফলতা আল্লাহরই দেয়া, প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা পানি, ফল-মূল, শাক-সব্জি, গাছ-পালা থেকে নিয়ে সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য নে‘মতস্বরূপ। শারীরিক সুস্থতা, আত্মার প্রশান্তি সবই মানুষের প্রতি আল্লাহর দেয়া বিশেষ নে‘মত। কাজেই আল্লাহর সাথে অংশীস্থাপন করা অন্যায়। আনুগত্য এবং উপাসনা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্যই। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা বিপদের সময় কিংবা অসুস্থতার সময় আল্লাহকে খুব ডাকে, আবার আল্লাহ যখন তাকে বিপদমুক্ত করেন তখন সে পুনরায় আল্লাহকে ভুলে যায় এবং মনে করতে থাকে অন্য কারো মাধ্যমে তার বিপদ দূর হয়েছে। এটাই হচ্ছে শিরক। সুখ-শান্তি হচ্ছে মানুষের প্রতি আল্লাহর দেয়া বিশেষ নে‘মত। এই নে‘মত যাতে আমাদেরকে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে নিতে না পারে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে।

৩. সংলাপের মাধ্যমে

দাওয়াতী কাজে সংলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আর অবস্থার প্রেক্ষিতে পরস্পরের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় সহ দ্বীনের বিষয়ে আলোচনা করতে আল-কুরআন উদ্বুদ্ধ করে বলে যে, ‘আপনি তাদের কাছে দু’ব্যক্তির উদাহরণ বর্ণনা করুন। আমি তাদের একজনকে দু’টি আঙ্গুরের বাগান দিয়েছি এবং এ দু’টিকে খর্জুর বৃক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছি এবং দু’য়ের মাঝখানে করেছি শস্যক্ষেত্র। উভয় বাগানই ফলদান করে এবং তা থেকে কিছুই হ্রাস করত না এবং উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে আমি নহর প্রবাহিত করেছি। সে ফল পেল। অতঃপর কথা প্রসঙ্গে সঙ্গীকে বলল, আমার ধন-সম্পদ তোমার চেয়ে বেশি এবং জনবলে আমি অধিক শক্তিশালী। নিজের প্রতি যুলম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমার মনে হয় না যে, এ বাগান কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আমি মনে করি না যে, ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। যদি কখনও আমার পালনকর্তার কাছে আমাকে পৌঁছে দেয়া হয়, তবে সেখানে এর চাইতে উৎকৃষ্ট পাব। তার সঙ্গী তাকে কথা প্রসঙ্গে বলল, তুমি তাঁকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর বীর্য থেকে, অতঃপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন তোমাকে মানবাকৃতিতে। কিন্তু আমি তো একথাই বলি, আল্লাহই আমার পালনকর্তা এবং আমি কাউকে আমার পালনকর্তার সাথে শরীক করি না। যদি তুমি আমাকে ধনে ও সন্তানে তোমা চেয়ে কম দেখ, তবে যখন তুমি তোমার বাগানে প্রবেশ করলে, তখন একথা কেন বললে না; আল্লাহ যা চান, তাই হয়। আল্লাহর দেয়া ব্যতীত কোন শক্তি নেই। আশাকরি আমার পালকর্তা আমাকে তোমার বাগান অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কিছু দেবেন এবং তার (তোমার বাগানের) উপর আসমান থেকে আগুন প্রেরণ করবেন। অতঃপর সকাল বেলায় তা পরিষ্কার ময়দান হয়ে যাবে। অথবা সকালে তার পানি শুকিয়ে যাবে। অতঃপর তুমি তা তালাশ করে আনতে পারবে না। অতঃপর তার সব ফল ধ্বংস হয়ে গেল এবং সে তাতে যা ব্যয় করেছিল, তার জন্য সকালে হাত কচলিয়ে আক্ষেপ করতে লাগল। বাগনটি কাঠসহ পুড়ে গিয়েছিল। সে বলতে লাগল, হায়! আমি যদি কাউকে আমার পালনকর্তার সাথে শরীক না করতাম’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৩২-৪২)।

৪. পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের ঘটনাবলী

আমাদের পূর্বে অনেক জাতি বিভিন্ন ধরনের অপরাধের দরুন নানান গজবের সম্মুখীন হতে হয়েছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে। কুরআন তার সাক্ষী বহন করে। যেমন,

ক. ছামূদ ও ‘আদ জাতির ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ছামূদ ও ‘আদ আকস্মিকভাবে সংঘটিতব্য সে মহা ঘটনাকে অস্বীকার করেছিল তাই ছামূদকে একটি কঠিন মহাবিপদ দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। আর ‘আদকে কঠিন ঝঞ্ঝাবাত্যা দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে, যা তিনি সাত রাত ও আট দিন ধরে বিরামহীনভাবে তাদের ওপর চাপিয়ে রেখেছিলেন। (তুমি সেখানে থাকলে) দেখতে পেতে তারা ভূলণ্ঠিত হয়ে পড়ে আছে যেন খেজুরের পুরানো কাণ্ড। তুমি তাদের কাউকে অবশিষ্ট দেখতে পাচ্ছ কি? ফেরাঊন, তার পূর্ববর্তী লোকেরা এবং উলটপালট হয়ে যাওয়া জনপদসমূহও একই মহা অপরাধে অপরাধী হয়েছিল। তারা সবাই তাদের রবের প্রেরিত রসূলের কথা অমান্য করেছিল। তাই তিনি তাদের অত্যন্ত কঠোরভাবে পাকড়াও করেছিলেন। যে সময় পানির তুফান সীমা অতিক্রম করল তখন আমি তোমাদেরকে জাহাজে সওয়ার করিয়েছিলাম। যাতে এ ঘটনাকে আমি তোমাদের জন্য একটি শিক্ষনীয় স্মৃতি বানিয়ে দেই যেন স্মরণকারীর কান তা সংরক্ষণ করে’ (সূরা আল-হা-ক্কাহ : ৪-১২)।

খ. আল্লাহ তা‘আলা ফেরআঊন সম্প্রদায়ের শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তারপর আমি পাকড়াও করেছি ফেরাঊনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল ফসলের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে, যাতে করে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। অতঃপর যখন শুভদিন ফিরে আসে, তখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, এটাই আমাদের জন্য উপযোগী। আর যদি অকল্যাণ এসে উপস্থিত হয় তবে তাতে মূসার এবং তাঁর সঙ্গীদের অলক্ষণ বলে অভিহিত করে। শুনে রাখ তাদের অলক্ষণ যে, আল্লাহরই ইলেমে রয়েছে, অথচ এরা জানে না। তারা আরও বলতে লাগল, আমাদের উপর জাদু করার জন্য তুমি যে নিদর্শনই নিয়ে আস না কেন আমরা কিন্তু তোমার উপর ঈমান আনছি না। সুতরাং আমি তাদের উপর পাঠিয়ে দিলাম তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত প্রভৃতি বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক। তারপরেও তারা গর্ব করতে থাকল। বস্তুত তারা ছিল অপরাধপ্রবণ। আর তাদের উপর যখন কোন আযাব পড়ে তখন বলে, হে মূসা! আমাদের জন্য তোমার পরওয়ারদেগারের নিকট সে বিষয়ে দু‘আ কর যা তিনি তোমার সাথে ওয়াদা করে রেখেছেন। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে এ আযাব সরিয়ে দাও, তবে অবশ্যই আমরা ঈমান আনব তোমার উপর এবং তোমার সাথে বনী-ইসরাঈলদেরকে যেতে দেব। অতঃপর যখন আমি তাদের উপর থেকে আযাব তুলে নিতাম নির্ধারিত একটি সময় পর্যন্ত-যেখান পর্যন্ত তাদেরকে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য ছিল, তখন তড়িঘড়ি তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করত। সুতরাং আমি তাদের কাছে থেকে বদলা নিয়ে নিলাম। বস্তুত তাদেরকে সাগরে ডুবিয়ে দিলাম। কারণ, তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল আমার নিদর্শনসমূহকে এবং তৎপ্রতি অনীহা প্রদর্শন করেছিল। আর যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তাদেরকেও আমি উত্তরাধিকার দান করেছি এ ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের যাতে আমি বরকত সন্নিহিত রেখেছি এবং পরিপূর্ণ হয়ে গেছে তোমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত কল্যাণ বনী-ইসরাঈলদের জন্য তাদের ধৈর্যধারণের দরুন। আর ধ্বংস করে দিয়েছ সে সবকিছু যা তৈরি করেছিল ফেরাঊন ও তার সম্প্রদায় এবং ধ্বংস করেছি যা কিছু তারা সুউচ্চ নির্মাণ করেছিল’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৩০-১৩৭)।

৫. উৎসাহ ও ভীতি প্রদর্শন

আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের কল্যাণার্থে ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন আবার কখনো অন্যায় ও পাপের কাজ থেকে সতর্ক ও ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡۤ  اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ-  وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ الرَّسُوۡلَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ-  وَ سَارِعُوۡۤا اِلٰی مَغۡفِرَۃٍ  مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ جَنَّۃٍ عَرۡضُہَا السَّمٰوٰتُ وَ الۡاَرۡضُ ۙ اُعِدَّتۡ  لِلۡمُتَّقِیۡنَ

‘আর তোমরা সেই জাহান্নামের ভয় কর, যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আর আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য স্বীকার কর যেন তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও। তোমরা স্বীয় রবের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ধাবিত হও, যার প্রসারতা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সদৃশ, ওটা ধর্মভীরুদের জন্য নির্মিত হয়েছে’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৩১-১৩৩)।

সুধী পাঠক! এ আয়াতে ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতামূলকভাবে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ ও রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্যের পর এটি দ্বিতীয় নির্দেশ। এখানে ক্ষমার অর্থ আল্লাহর কাছে সরাসরি ক্ষমা চাওয়া হতে পারে। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, এখানে এমন সব সৎকর্ম উদ্দেশ্য, যা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা লাভ করার কারণ হয়। এছাড়া এ আয়াতে ক্ষমাকে জান্নাতের পূর্বে উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা সম্ভবতঃ এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন যে, জান্নাত লাভ করা আল্লাহর ক্ষমা ছাড়া সম্ভব নয়। কেননা মানুষ যদি জীবনভর পুণ্য অর্জন করে এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে, তবুও তার সমগ্র পুণ্যকর্ম জান্নাতের মূল্য হতে পারে না। জান্নাত লাভের পন্থা মাত্র একটি। তা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা ও অনুগ্রহ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন,

سَدِّدُوْا وَقَارِبُوْا وَأَبْشِرُوْا فَإِنَّهُ لَا يُدْخِلُ أَحَدًا الْجَنَّةَ عَمَلُهُ قَالُوْا وَلَا أَنْتَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ وَلَا أَنَا إِلَّا أَنْ يَتَغَمَّدَنِىْ اللهُ بِمَغْفِرَةٍ وَرَحْمَةٍ

‘সততা ও সত্য অবলম্বন কর, মধ্যবর্তী পথ অনুসরণ কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের সুসংবাদ লাভ কর। কারও কর্ম তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে না। শ্রোতারা বলল, হে আল্লাহ রাসূল (ﷺ)! আপনাকেও নয়কি। উত্তরে তিনি বলেন, আমার কর্ম আমাকেও জান্নাতে নেবে না। তবে আল্লাহ যদি স্বীয় রহমত দ্বারা আমাকে আবৃত করে নেন’।[৩]

মোটকথা এই যে, আমাদের কর্ম জান্নাতের মূল্য নয়। তবে আল্লাহ তা‘আলার রীতি এই যে, তিনি স্বীয় অনুগ্রহ ঐ বান্দাকেই দান করেন, যে সৎকর্ম করে। বরং সৎকর্মের সামর্থ্য লাভ হওয়াই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির লক্ষণ। অতএব সৎকর্ম সম্পাদনে ক্রটি করা উচিত নয়।

৬. ব্যাপক চ্যালেঞ্জ

আল্লাহ রব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমে বিভিন্নভাবে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন:

وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِہٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُہَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ  اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ- فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُہَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ  ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ

‘এবং আমরা আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, যদি তোমরা তাতে সন্দিহান হও তাহলে তৎসদৃশ একটি ‘সূরা’ আনয়ন কর এবং তোমাদের সেই সাহায্যকারীদেরকে ডেকে নাও যারা আল্লাহ হতে পৃথক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও! যদি তোমরা না পার এবং কখনো পারবেও না, তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, যা প্রস্তুত রয়েছে কাফেরদের জন্য’ (সূরা আল-বাক্বারা : ২৩-২৪)।

সুধী পাঠক! মহান আল্লাহ কাফির-মুনাফিক তথা আল্লাহদ্রোহী শক্তির প্রতি চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে বলেছেন, আমার প্রিয় বান্দা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি আমার প্রেরিত যে কিতাব (আল-কুরআন) নাযিল করেছি, তা আমার প্রেরিত কিনা, সে বিষয়ে তোমাদের মনে যদি কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় জেগে থাকে, তাহলে তোমরা অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে এসো। না পারলে সমগ্র পৃথিবী হতে তোমাদের সকল সমর্থক ও একমনা লোকদের সাহায্য-সহায়তা নিয়ে হলেও কুরআনের একটি ছোট সূরা রচনা করে আনয়ন করো। কিন্তু না, তোমরা তা কখনই পারবে না। আল্লাহ ব্যতীত এ কাজ কেউই করতে পারবে না। জাহান্নামের আগুন ও কঠিন শাস্তিকে ভয় কর। কেননা এতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এটা মানব রচিত কোন গ্রন্থ নয়। কুরআনের এ আয়াতখানা বিশ্ববাসীর প্রতি চ্যালেঞ্জ। তৎকালীন আরব বিশ্বের সমস্ত কবি-সাহিত্যিক সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়েও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেনি এবং তারা লজ্জায় নির্বাক ও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আরবের অন্যতম কবি লাবীদ কুরআনের ক্ষুদ্রতম সূরা আল-কাউছারের অনুরূপ কোন সূরা রচনায় ব্যর্থ হয়ে বলেছিলেন- ھذا لیس من كلام البشر ‘এটা কোন মানুষের বাণী নয়’।

কুরআনের অন্যতম মু‘জিযা হল, আল্লাহর চিরন্তন ভবিষ্যদ্বাণী ও চ্যালেঞ্জ। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, কাফির, মুশরিক ও অমুসলিমগণ সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করলেও কুরআনের অনুরূপ কোন সূরা তারা রচনা করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলার এ ঘোষণা ও চ্যালেঞ্জ শোনার পর কাফির ও মুশরিকরা ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। মানুষ ও পাথর হবে যার জ্বালানি দ্বারা বুঝা যায় যে, কেবল কাফিররাই জাহান্নামের জ্বালানি হবে না; বরং সে সাথে তাদের নিজেদের হাতে গড়া পাথরের মূর্তিসহ যেগুলোকে তারা দেবতা হিসাবে উপাসনা করত, সেগুলোও জাহান্নামের ইন্ধন এবং জ্বালানি হবে। এসব দেবতা ও মূর্তিগুলো কোন অবস্থাতেই আল্লাহর সমকক্ষ নয়, তা সেখানে বাস্তবে দেখানো হবে। কুরআনের আয়াতে এরূপ চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানেও এ চ্যালেঞ্জ কার্যকর রয়েছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তা কার্যকর ও বলবৎ থাকবে। কিন্তু কোন যুগেই কোন পক্ষ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সে ঘোষণাই জারি করেছেন।

৭. নরম ও কোমল কথা

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পথে দাওয়াত প্রদানে নরম ও কোমলভাষী হতে নির্দেশ দিয়েছেন, যা তিনি তাঁর নবী মূসা ও হারুন (আলাইহিস সালাম)-কে শিক্ষা দিয়েছেন,

اِذۡہَبَاۤ  اِلٰی  فِرۡعَوۡنَ  اِنَّہٗ  طَغٰی-فَقُوۡلَا لَہٗ  قَوۡلًا لَّیِّنًا لَّعَلَّہٗ  یَتَذَکَّرُ اَوۡ یَخۡشٰی

‘তোমরা উভয়ে ফিরআঊনের নিকট যাও, সেতো সীমালংঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে, অথবা ভয় করবে’ (সূরা ত্বো-হা : ৪৩-৪৪)।

দাওয়াত হবে নরম ভাষায়, যাতে তা তাঁর অন্তরে প্রতিক্রিয়া করে এবং দাওয়াত সফল হয়। এ আয়াতে দাওয়াত প্রদানকারীদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ফিরআঊন হচ্ছে সবচেয়ে বড় দাম্ভিক ও অহংকারী। আর মূসা হচ্ছেন আল্লাহর পসন্দনীর লোকদের অন্যতম। তারপরও ফিরআঊনকে নরম ভাষায় সম্বোধন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (ইবনু কাছীর)। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার বাহক হোক না কেন, তার সাথেও সংস্কার ও পথ প্রদর্শনের কর্তব্য পালনকারীদের নম্রভাবে কথাবার্তা বলতে হবে। এরই ফলশ্রুতিতে সে কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হতে পারে এবং তার অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হতে পারে। মানুষ সাধারণত দু’ভাবে সঠিক পথে আসে। সে নিজে বিচার-বিশ্লেষণ করে বুঝে-শুনে ও উপদেশবাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করে, অথবা অশুভ পরিণামের ভয়ে সোজা হয়ে যায়। তাই আয়াতে ফিরআঊনের জন্য দু’টি সম্ভাবনাই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য আয়াতে মূসা (আলাইহিস সালাম) কিভাবে সে নরম পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন সেটার বর্ণনা এসেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার কি আগ্রহ আছে যে, আপনি পবিত্র হবেন। আর আমি আপনাকে আপনার রবের দিকে পথপ্রদর্শন করি যাতে আপনি তাঁকে ভয় করেন? (সূরা আন-নাযি‘আত : ১৮-১৯)।

এ কথাটি অত্যন্ত নরম ভাষা। কেননা প্রথমে পরামর্শের মত তাকে বলা হয়েছে যে, আপনার কি আগ্রহ আছে? কোন জোর নয়, আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়তঃ বলা হচ্ছে যে, আপনি পবিত্র হবেন। এটা বলা হয়নি যে, আমি আপনাকে পবিত্র করব। তৃতীয়তঃ তার রবের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, যিনি তাকে লালন-পালন করেছেন (তাফসীরে সা‘দী)।

৮. প্রজ্ঞা ও কৌশলে দাওয়াত প্রদান

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁর পথে দাওয়াতি কাজের জন্য যে পথ ও পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে প্রজ্ঞা ও কৌশল অন্যতম। এ ব্যাপারে আল-কুরআনে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, اُدۡعُ  اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ ‘তুমি মানুষকে তোমার রবের পথে আহবান কর হিকমত দ্বারা’ (সূরা আন-নাহল : ১২৫)।

‘دعوة’-এর শাব্দিক অর্থ ডাকা, আমন্ত্রণ জানানো, আহ্বান করা। নবীগণের সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে মানবজাতিকে আল্লাহর দিকে আহবান করা। এরপর নবী ও রাসূলগণের সমস্ত শিক্ষা হচ্ছে এ দাওয়াতেরই ব্যাখ্যা। কুরআনুল কারীমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিশেষ পদবী হচ্ছে, আল্লাহর দিকে আহবানকারী হওয়া। এক আয়াতে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে- وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا ‘আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী রূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে’ (সূরা আল-আহযাব : ৪৬) এবং অন্য এক আয়াতে আরো বলা হয়েছে یٰقَوۡمَنَاۤ  اَجِیۡبُوۡا دَاعِیَ اللّٰہِ ‘হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দাও’ (সূরা আল-আহকাফ : ৩১)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদাংক অনুসরণ করে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া উম্মতের উপরও ফরয করা হয়েছে। আর ‘হেকমত’ শব্দটি কুরআনুল কারীমে অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এস্থলে কোন কোন মুফাসসির হেকমতের অর্থ নিয়েছেন কুরআন, কেউ কেউ বলেছেন, কুরআন ও সুন্নাহ (তাবারী)। আবার কেউ কেউ অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ স্থির করেছেন (ফাৎহুল কাদীর)। আবার কোন কোন মুফাসসিরের মতে বিশুদ্ধ ও মযবুত ছহীহ কথাকে হেকমত বলা হয় (ফাৎহুল কাদীর) ।      

৯. যুক্তি ও তর্ক উপস্থাপন

আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) এবং তার জাতির মাঝে মূর্তির ইবাদতকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটেছিল,

قَالَ اَفَتَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مَا لَا یَنۡفَعُکُمۡ شَیۡئًا وَّ لَا یَضُرُّکُمۡ

‘সে বলল, তাহলে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যারা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না’? (সূরা আল-আম্বিয়া : ৬৬)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسۡتَمِعُوۡا لَهٗ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ لَنۡ یَّخۡلُقُوۡا ذُبَابًا وَّ لَوِ اجۡتَمَعُوۡا لَهٗ ؕ وَ اِنۡ یَّسۡلُبۡهُمُ الذُّبَابُ شَیۡئًا لَّا یَسۡتَنۡقِذُوۡهُ مِنۡهُ ؕ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَ الۡمَطۡلُوۡبُ

‘হে লোকসকল! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ কর। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারাতো কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ উদ্দেশ্যে তারা সবাই একত্রিত হলেও; এবং মাছি যদি তাদের নিকট হতে কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় ওটাও তারা ওর নিকট হতে উদ্ধার করতে পারবে না। পূজারী ও পূজিত কতই না দুর্বল!’ (সূরা আল-হজ্জ : ৭৩)।

আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া তারা যাদের ইবাদত করে, এরা সবাই যদি একত্রিত হয়ে একটি মাছি বানাতে চেষ্টা করে তবে তাতেও সমর্থ হবে না। যেমন এক হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আর তার চেয়ে বড় যালেম আর কে, যে আমার সৃষ্টির মত সৃষ্টি করতে চায়? তাহলে সে একটি পিপড়া বা ছোট বস্তু তৈরি করে দেখাক, অথবা একটি মাছি তৈরি করুক অথবা একটি দানা তৈরি করে দেখাক’।[৪] অন্য বর্ণনায় আরও এসেছে, ‘সে যেন একটি যবের দানা তৈরি করে দেখায়’।[৫] অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘সে যেন একটি মশা তৈরি করে দেখায়’।[৬] বস্তুত তারা একটি মাছি তৈরি করতেও সক্ষম নয়। বরং তার চেয়েও তাদের অবস্থা আরও অধম (ইবনু কাছীর)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡ حَآجَّ اِبۡرٰهٖمَ فِیۡ رَبِّهٖۤ اَنۡ اٰتٰىهُ اللّٰهُ الۡمُلۡکَ ۘ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ رَبِّیَ الَّذِیۡ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ۙ قَالَ اَنَا اُحۡیٖ وَ اُمِیۡتُ ؕ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ فَاِنَّ اللّٰهَ یَاۡتِیۡ بِالشَّمۡسِ مِنَ الۡمَشۡرِقِ فَاۡتِ بِهَا مِنَ الۡمَغۡرِبِ فَبُهِتَ الَّذِیۡ کَفَرَ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ

‘তুমি কি তার প্রতি লক্ষ্য করনি যে ইবরাহীমের সাথে তার রব্ব সম্বন্ধে বিতর্ক করেছিল, যেহেতু আল্লাহ তাকে রাজত্ব প্রদান করেছিলেন। ইবরাহীম বলেছিল, আমার রব্ব তিনিই যিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু দান করেন। সে বলেছিল, আমিই জীবন ও মৃত্যু দান করি। ইবরাহীম বলেছিল, নিশ্চয় আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক হতে আনয়ন করেন, কিন্তু তুমি ওকে পশ্চিম দিক হতে আনয়ন কর; এতে সেই অবিশ্বাসকারী হতবুদ্ধি হয়েছিল; এবং আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৮)। এ আয়াত দ্বারা বোঝা গেল যে, যখন আল্লাহ তা‘আলা কোন কাফের ব্যক্তিকে দুনিয়াতে মান-সম্মান এবং রাজত্ব দান করেন, তখন তাকে সে নামে অভিহিত করা জায়েয। এতে একথাও বোঝা যাচ্ছে যে, প্রয়োজন বোধে তার সাথে তর্ক-বিতর্ক করাও জায়েয, যাতে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য প্রকাশ হয়ে যেতে পারে।

১০. উওম পন্থায় বিতর্ক করা

আল্লাহর বাণী, وَ جَادِلۡهُمۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ ؕ اِنَّ رَبَّکَ هُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِهٖ وَ هُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُهۡتَدِیۡنَ ‘এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন’ (সূরা আন-নাহল : ১২৫)। এখানে جادل শব্দটি مجادلة ধাতু থেকে উদ্ভূত। مجادلة বলে এখানে তর্ক-বিতর্ক বোঝানো হয়েছে। بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ এর অর্থ এই যে, যদি দাওয়াতের কাজে কোথাও তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে তর্ক-বিতর্কও উত্তম পন্থায় হওয়া দরকার। উত্তম পন্থার মানে এই যে, কথাবার্তায় নম্রতা ও কমনীয়তা অবলম্বন করতে হবে (ইবনু কাছীর; ফাৎহুল কাদীর)। এমন যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতে হবে, যা প্রতিপক্ষ বুঝতে সক্ষম হয়। কুরআনুল কারীমের অন্যান্য আয়াত সাক্ষ্য দেয় যে, উত্তম পন্থায় তর্ক-বিতর্ক শুধু মুসলিমদের সাথেই সম্পর্কযুক্ত নয়; বরং আহলে কিতাব সম্পর্কে বিশেষভাবে কুরআন বলে যে, وَ لَا تُجَادِلُوۡۤا اَہۡلَ الۡکِتٰبِ اِلَّا بِالَّتِیۡ ہِیَ  اَحۡسَنُ ‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৪৬)।

উপসংহার

আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। বর্তমানে দাওয়াতি ময়দানে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চলছে। এটাকে যদি আল-কুরআন ও সুন্নাহর বেড়ি দিয়ে আটকানো না যায়, তবে সঠিক দাওয়াত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা এই দ্বীনের হিফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেহেতু আমাদের একমাত্র চিন্তা করতে হবে: কিভাবে আমরা সেই দলের সারথী হতে পারব?  আর দাওয়াতি কাজ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। সুতরাং সবাই এটাতে একই সক্ষমতা ও সফলতা দেখাতে পারে না। একমাত্র মহান আল্লাহর দয়া ও ইখলাছের বদৌলতেই কেবল পরকালীন মুক্তির আশা করা যায়, দাওয়াতে যথাযথ সফলতা লাভ হবে।

* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩৭।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫২৬।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১৬।
[৪]. মুসনাদে আহমাদ, ২/৩৯১ পৃ.।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৫৩, ৭৫৫৯।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, ২/২৫৯ পৃ.।




প্রসঙ্গসমূহ »: কুরআনুল কারীম
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য (৪র্থ কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৫ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
কালো কলপ ব্যবহারের শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
নফল ছিয়াম - আল-ইখলাছ ডেস্ক
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (শেষ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ - ড. মেসবাহুল ইসলাম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১৫তম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের ভূমিকা (শেষ কিস্তি) - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৭ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন : সংশয় নিরসন (৪র্থ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ