রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৫ পূর্বাহ্ন

আল্লাহর ভালোবাসা 

 -ড. মুস্তফা মনজুর* 


(ক) গল্প- এক চাষা একবার বিয়ের সাজে সেজে রাজার বাড়ীর দিকে রওয়ানা হল। পথে যে-ই যাচ্ছে সে-ই জিজ্ঞাসা করছে, ব্যাপার কি? চাষার একই উত্তর, “রাজকন্যাকে খুব ভালোবাসি তো তাই তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি; বিয়ে প্রায় ফাইনাল।” জবাব শুনে অধিকাংশ লোকই হতবাক!!! একজন জিজ্ঞাসা করল, “ভাই, বুঝলাম আপনি ভালোবাসেন, কিন্তু রাজকন্যা বাসে তো?” চাষার নির্লিপ্ত জবাব, “তা জানিনা।”

প্রিয় ভাই, বিয়ে কি হবে? উত্তর ‘না’ হওয়ারই কথা। খুব যারা আশাবাদী তাঁরা হয়ত ভাববেন, বর যেহেতু রাজী তাহলে তো বিয়ের অর্ধেক কাজ শেষই, তাই না। কিন্তু বাস্তবতা নিশ্চিতই ভিন্ন। কারণ ভালোবাসা এমন এক জিনিস যা একতরফাভাবে পূর্ণতা লাভ করে না। তাই চাষা যতই আশাবাদী হোক, এটাকে ভালোবাসা না বলে পাগলামী বলাই সম্ভবত যুক্তিযুক্ত।

(খ) লিখার শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘আল্লাহর ভালোবাসা’। সচেতনভাবেই, এটা দ্বিমাত্রিক; প্রথমত আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি; আর দ্বিতীয়ত আল্লাহ আমাদের ভালবাসেন। অর্থাৎ দু’দিক থেকেই ভালোবাসা। গোটা দুনিয়ায় সম্ভবত এমন কোন মুসলিম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বলবে আমি আল্লাহকে ভালোবাসি না। কারণ আল্লাহকে ভালো না বাসলে যে ঈমানই থাকে না। কারণ মহব্বতের প্রথম ভাগই “আল্লাহর মহব্বত”। ঈমানের জন্যই এটা শর্ত।

পাশাপাশি ঈমানের পুর্ণতার জন্য শর্ত “আল্লাহর জন্য ভালোবাসা”। যতক্ষণ না আল্লাহর জন্য কাউকে বা কোন কিছুকে ভালোবাসা হবে, আর আল্লাহর জন্যই কারো প্রতি কিংবা কোন কিছুর প্রতি ঘৃণা করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সর্বপ্রধান হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি মহব্বত; তাঁর সুন্নাহ-এর প্রতি ভালোবাসা।

আমরা আল্লাহকে, তাঁর রাসূলকে মহব্বত করি; মহব্বতের দাবী করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কবুল করুন।

(গ) ভালোবাসার নিয়মনীতির অন্যতম হচ্ছে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানো। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন; তার হাজারো নমুনা দৃশ্যমান। যেমন, তিনিই লালন-পালন করেন, নানা নে‘মত দান করেন, দয়া করেন, ক্ষমা করেন। সবই তো ভালোবাসার প্রকাশ। বলতে পারেন, এসব তো তিনি কাফিরদেরও করেন। হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে মুমিনদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশও আছে। যারা ঈমানদার তাঁরা তা বুঝতে পারেন। দারিদ্র্যতা ও অসুস্থতাকে ভালোবাসার প্রকাশ হিসাবে নেয়া আমরা হয়ত বুঝি না; কিন্তু ছাহাবীগণ বুঝতেন, সালাফগণ বুঝতেন, এযুগের পূর্ণ ঈমানদারগণও বুঝেন। 

আল্লাহ তা‘আলা পরীক্ষা নেন এটাও এক ধরণের ভালোবাসা। কেননা তিনি আমাদের মর্যাদা উচ্চ করতে চান, নে‘মত বাড়িয়ে দিতে চান। নইলে পাপ করে তাওবাকারী কীভাবে আগের চাইতে বেশি মর্যাদাবান হয়? দুনিয়ার কোন হিসাবে কি মেলে? চাকরীতে ভুল করে ক্ষমা চাইলে কি প্রমোশন হয় কখনো?

প্রিয় ভাই, দেখুন ক্লাসে কোন ছাত্রকে শিক্ষক বেশি কাজ দেন, পড়া জিজ্ঞাসা করেন? নিশ্চয়ই ভাল ছাত্রকে। কেন? ছাত্রের মঙ্গলের জন্যই। আর খারাপ ছাত্রকে বেশি কাজ না দেয়া তাকে সুবিধা দেয়া নয়; বরং তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেয়া। কাফিরদের ক্ষেত্রে আল্লাহ দুনিয়াতে এমনই করে থাকেন। কিংবা ধরে নিন, আপনার কোম্পানীতে নতুন কোন ইভেন্ট করবেন। দায়িত্ব কাকে দেবেন? যে আপনার বিশ্বস্ত, যাকে আপনি ভালো জানেন ও যোগ্যতাসম্পন্ন। তাকেই তো? কাজ শেষ হয়ে গেলে পুরষ্কারও নিশ্চয়ই তিনিই পাবেন। আর যদি তিনি চ্যালেঞ্জ না নেন, পুরষ্কার সম্ভবত অন্যের ভাগ্যেই জুটবে।

আল্লাহ তা‘আলার পরীক্ষা মুমিনদের জন্য এমনই। এমন কোন পরীক্ষা তিনি নেন না, যাতে তাঁর ভালোবাসা লেগে থাকে না। এজন্যই দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার শিকার হয়েছেন নবীগণ, তারপর পর্যায়ক্রমে তাক্বওয়াবানগণ।

প্রিয় ভাই, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ভালোবাসার আরো একটি প্রমাণ রেখে দিয়েছেন। তাহচ্ছে, তিনি যাকে ভালোবাসেন, সকল মানুষের মাঝে সে ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেন। টাকা-পয়সা নেই, উচ্চতর ডিগ্রি নেই, ক্ষমতা কিংবা বড় চাকুরী নেই, নেই গাড়ি-বাড়িও, কিন্তু সমাজে তাঁর সম্মান আছে, লোকজন তাঁকে ভালোবাসে এমন নজীর আমাদের আশেপাশেই বিদ্যমান। একটু খুঁজলেই হয়ত পেয়ে যাব। কারণ? আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ভালবেসেছেন। মানুষ কি আর ভালো না বেসে পারে?

(ঘ) দুনিয়াতে ভালোবাসা প্রকাশেরও নিয়ম আছে। তা হচ্ছে প্রেমাস্পদের পছন্দনীয়ভাবে নিজের ভালোবাসা উপস্থাপন করে। ধরুন আপনি কাউকে ভালোবাসেন। কিন্তু কোনদিনই তা প্রকাশ করলেন না, কি লাভ হল? চোখের সামনেই দেখলেন আপনার প্রেমাস্পদ অন্যের হয়ে গেল। দোষ তখন কাকে দেবেন? নিজেই নিজের চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। ধরে নিলাম আপনি প্রকাশও করলেন। কিন্তু তা এতই ইঙ্গিতপুর্ণ যে আপনি ভেবে নিলেই এতেই চলবে। উনি বুঝে নেবেন। কিন্তু হলো না, উনি বুঝলেন না। ফলাফল একই; আর আপনার কাজ আফসোস করা।

হ্যাঁ, এবার আপনি সরাসরিই স্পষ্টভাবে ভালোবাসার কথা জানালেন। কিন্তু সমস্যা হলো ঠিক সময়ে না কিংবা ঠিক স্থানে না কিংবা সঠিক পন্থায় না। যেমন কারো পসন্দ দই, কিন্তু আপনি ভালোবাসা প্রকাশ করলেন মিস্টি দিয়ে। কারো পছন্দ বই, আপনি নিয়ে গেলেন খেলার সামগ্রী। তারপরও কথা থাকে। বই হলেই চলবে না, উপন্যাস পছন্দ হলে কবিতার বই দিলে চলবে কি? কিংবা থ্রিলার পড়ুয়া কে প্রবন্ধের বই? তা যতই ভাল হোক? ভালোবাসা হবে? নাকি প্রথমেই ঝামেলা লেগে যাবে। প্রিয় ভাই-বন্ধু, এসব উত্তর আপনারা খুব ভাল করেই জানেন।   

(ঙ) আমরাও দাবী করি, আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি। কিন্তু প্রকাশের দিক থেকে আমরা বড়ই কৃপণ। আমরা শুধু মুখে বলেই এই ভালোবাসা প্রকাশ করি। কাজে কর্মে তেমন কোন প্রকাশ দেখি না। হ্যাঁ, অনেক সময় বিশাল মিছিল-মিটিং, ওয়াজ-মাহফিলে যোগদান কিংবা মিলাদ-ক্বিয়ামের আয়োজন করেই মনে করি ভালোবাসার প্রকাশ হয়ে গেল। এতেই মহব্বতের হক্ব সর্বোত্তম উপায়ে আদায় করছি বলে মনে করি। প্রিয় ভাই, একবারও ভেবে দেখি না, এসব কি সত্যিই ভালোবাসার প্রমাণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য? আল্লাহ তা‘আলার পছন্দও কি এই? ইসলাম নির্দেশিত পন্থাও কি এগুলো? উত্তর আপনাদের হাতেই তোলা থাকল।

হ্যাঁ, এটা ঠিক, মুহাব্বাতের দাবী রাখা ঈমানের দাবী। শুধু অন্তরে সত্যি সত্যি ভালোবাসাও নাজাতের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হল, এই কর্মহীন ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয় না; এক পর্যায়ে এসব ভালোবাসা আল্লাহর জন্য না হয়ে নিজ প্রবৃত্তির জন্য হয়ে যায়। নিজের খেয়াল-খুশি মত কাজ আল্লাহর নামে করার সূত্রপাতও এরূপ ভালোবাসা।

তাই দু’এক ব্যতিক্রম থাকলেও শুধু মৌখিক ভালোবাসার দাবীদারদের স্ববিরোধী, মিথ্যাবাদী ও প্রতারক বলা সম্ভবত অযৌক্তিক নয়। কেননা প্রিয় নবীজী (ﷺ) থেকে আজ পর্যন্ত এরূপ মানুষকে ফেতনা-ফাসাদকারী হিসাবেই দেখা গেছে।

প্রিয় ভাই, এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন। কেন আমি ছালাত পড়ি না? আল্লাহ তা‘আলা যেখানে আমাকে আহ্বান করছেন, সেখানে কিসের কারণে আমি যাচ্ছি না? প্রধান কারণ সম্ভবত, অলসতা কিংবা নিজের ভালো না লাগা। যারা ছালাত পড়ি তাঁরা প্রশ্ন করি, কেন আমি সামাজিকতায় ইসলাম পরিত্যাগ করছি? উত্তর হবে, সম্মান, মর্যাদা আর ক্ষমতার লোভে। তাহলে আমি কাকে ভালোবাসলাম, আল্লাহকে নাকি আমার প্রবৃত্তিকে? আল্লাহর মহব্বত করার দাবী কি মিথ্যা নয়?

(চ) অনেকে বলে, ‘ছালাত না পড়লে কি হবে ঈমান শক্ত আছে’ কিংবা ‘সুন্নাহ না মানতে পারলেও আমি আল্লাহকে ভালোবাসি, তাঁর রাসূলকে (ﷺ) ভালোবাসি’। প্রিয় ভাই ‘মহব্বতই সবকিছু (আমলের দরকার নেই)’ এমন বক্তব্য ইসলামের না। এটা ‘ভক্তিতে মুক্তি’ চেতনারই অন্যপ্রকাশ। সনাতনধর্মী বা খ্রিস্টানদের এসব বক্তব্য ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামে এমন নজীর একটিও নেই যেখানে কোন ছাহাবী, কিংবা কোন তাবেঈ নতুবা কোন তাবে-তাবেঈ অথবা আমাদের পূণ্যবান সালাফগণ শুধু ভালোবাসার কথা বলে গেছেন, আমলের কথা বলেননি বা নিজে আমল ত্যাগ করেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে কোন সুন্নাত ছেড়ে দেয়ার নজীরই আমরা তাঁদের মধ্যে খুব একটা দেখি না। সেখানে শুধু মহাব্বাত দিয়ে কীভাবে নাজাত সম্ভব আমার জ্ঞানে ধরে না।

হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা চাইলে যে কাউকেই ক্ষমা করে দিতে পারেন। তবে সেটা আল্লাহ তা‘আলার নিয়মের ব্যতিক্রম। আর শতাংশের হিসাবে সে ধরণের নাজাতপ্রাপ্ত এক ভাগও হবে কিনা সন্দেহ। এবার প্রিয় ভাই, আপনি কি ব্যতিক্রমের পেছনেই দৌঁড়াবেন? দুনিয়ার কাজে তো লাভ-লোকসানের হার ৫০শতাংশ হলেও তা এড়িয়ে যান। তাহলে আখিরাতের প্রশ্নে কেন এক-দুই ভাগের আশায় বসে থাকা। এটা কি স্ববিরোধিতা না? নাকি আখিরাতের প্রতি, আল্লাহর প্রতি উদাসীনতা? 

প্রিয় বন্ধু, ‘ভক্তিতেই মুক্তি’ শ্লোগানের ফলে সনাতন আর খ্রিস্টান ধর্মের কি হাল তা তো নিজের চোখেই দেখছেন। এখন সেসব শুধু আচার সর্বস্ব ধর্ম হিসাবেই আছে। রাম, কৃষ্ণ কিংবা মহাদেবকে নিয়ে ট্রল করলেও তাঁদের কিছু আসে যায় না; ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে ফিল্ম বানালেও খ্রিস্টানদের ঈমানে ধাক্কা লাগে না। কারণ অন্তরে ভক্তি আর মহব্বত থাকলেই তো হল; কাজকর্মে থাকার দরকার কি? এমনই হবে যদি আমল বাদ দিয়ে শুধু মহব্বতের ফেরিওয়ালাদের হাতে ইসলামের পতাকা তুলে দেয়া হয়। সমাজে যত বিদ‘আত আর বিতর্ক এসবের মূল কারিগরও কিন্তু এরাই।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।




জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ইসরাঈলি বর্বরতায় রক্তাক্ত মানবতা - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
আল-কুরআন এক জীবন্ত মু‘জিযা - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস
বিদ‘আত পরিচিতি (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বাংলাদেশে সমকামিতার গতি-প্রকৃতি : ভয়াবহতা, শাস্তি ও পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১৭তম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের  হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সচ্চরিত্রই মানব উন্নতির চাবিকাঠি - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা - সাজ্জাদ সালাদীন

ফেসবুক পেজ