সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিতি

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


(২০তম কিস্তি) 

৯. বিদ‘আতীর যব্হকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ প্রসঙ্গে

আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য অনেকগুলো প্রাণীর গোশত খাওয়া হালাল করেছেন। যেমন গরু, মহিষ, ভেড়া-দুম্বা-ছাগল, হাঁস-মুরগী ইত্যাদি। উক্ত প্রাণীগুলো আল্লাহর নাম নিয়ে যব্হ করলে মুসলিমগণ খেতে পারেন, অন্যথা খেতে পারেন না। কেননা যব্হের সময় আল্লাহর নাম না নিলে মুসলিমদের জন্য ঐ প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা বৈধ নয়। শরী‘আতের স্বতঃসিদ্ধ বিধান হল, মুসলিম ও আহলে কিতাব তথা ইহুদী-খ্রিস্টানদের যব্হকৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা যাবে। কিন্তু কাফের, মুশরিক, মাজূসী তথা অগ্নি উপাসক, মুরতাদ কর্তৃক যব্হকৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা হারাম। এছাড়া বিদ‘আতীদের যব্হকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করা হালাল নয়, যখন তার বিদ‘আত কুফর ও শিরকের পর্যায়ের হয়। এক্ষণে উক্ত আলোচনাকে আমরা  তিনটি স্তরে বিভক্ত করে আলোচনা করব। যা নি¤œরূপ:

প্রথমতঃ মুসলিম ও আহলে কিতাব কর্তৃক যব্হকৃত পশুর গোশত খাওয়া হালাল

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতে, মুসলিমের যব্হকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করা হালাল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

حُرِّمَتۡ عَلَیۡکُمُ الۡمَیۡتَۃُ وَ الدَّمُ وَ لَحۡمُ الۡخِنۡزِیۡرِ وَ مَاۤ اُہِلَّ لِغَیۡرِ اللّٰہِ بِہٖ وَ الۡمُنۡخَنِقَۃُ وَ الۡمَوۡقُوۡذَۃُ وَ الۡمُتَرَدِّیَۃُ وَ النَّطِیۡحَۃُ وَ مَاۤ اَکَلَ السَّبُعُ اِلَّا مَا ذَکَّیۡتُمۡ.

‘তোমাদের জন্য মৃতবস্তু, রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ছাড়া অপরের নামে উৎসর্গীকৃত পশু, গলাটিপে মারা পশু, প্রহারে মৃত পশু, উপর হতে পড়ে মৃত পশু, শৃংগাঘাতে মৃত পশু এবং হিংস্র জন্তুতে খাওয়া পশু হারাম করা হয়েছে। তবে যা তোমরা যব্হ দ্বারা পবিত্র করেছ তা হালাল’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)। উক্ত আয়াতে হারামসমূহের মধ্যে মুসলিম কর্তৃক যা যব্হ করা হয়েছে তাকে হালাল করা হয়েছে।

আর আহলে কিতাব তথা ইহুদী-খ্রিস্টানদের যব্হকৃত পশুর গোশত খাওয়াও হালাল করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلۡیَوۡمَ اُحِلَّ لَکُمُ الطَّیِّبٰتُ ؕ وَ طَعَامُ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ حِلٌّ لَّکُمۡ ۪ وَ طَعَامُکُمۡ حِلٌّ لَّہُمۡ.

‘আজ তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে, আর আহলে কিতাবদের যব্হকৃত জীবও, তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের যব্হকৃত জীবও তাদের জন্য হালাল’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৫)। উক্ত আয়াতে আহলে কিতাবদের যব্হকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করা হালাল হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। উক্ত আয়াতাংশের طَعَامُ ‘খাদ্য’ শব্দটির অর্থ ذَبَائِحُ ‘যব্হ করা’ প্রাণী উদ্দেশ্য।[১] যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘আরব অঞ্চলের খ্রিষ্টানদের যব্হকৃত পশুতে কোন দোষ নেই। তবে তুমি যদি তাকে গায়রুল্লাহ‌র নাম পড়তে শোন, তাহলে খেয়ো না। আর যদি না শুনে থাক, তাহলে মনে রেখ যে, আল্লাহ তাদের কুফুরীকে জেনে নেয়ার পরেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে’।[২]

সুধী পাঠক! আহলে কিতাবদের যব্হকৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা হালাল হওয়ার ব্যাপারে ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) সালাফদের বড় একটি দল থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ইবুন আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), আবূ উমামাহ, মুজাহিদ, সাঈদ ইবনু জুবাইর, ইকরিমা, ‘আত্বা, হাসান, মাকহূল, ইবরাহীম নাখঈ, সুদ্দী, মুক্বাতিল ইবনু হাইয়ান (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেছেন, ‘তাদের যব্হ মুসলিমদের জন্য হালাল হওয়ার ব্যাপারে আলেমগণের মাঝে ইজমা হয়েছে। কেননা তারা গাইরুল্লাহর নামে পশু যব্হ করলে এবং আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করে যবহ করলে তার গোশত খাওয়া হারাম হওয়া আক্বীদায় বিশ্বাস করে’।[৩] এছাড়া আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ইহুদী কর্তৃক পেশকৃত হাদিয়া বকরী গ্রহণ করেছিলেন এবং তা ভক্ষণও করেছিলেন। হাদীছে এসেছে, আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ يَهُوْدِيَّةً أَتَتِ النَّبِىَّ ﷺ بِشَاةٍ مَسْمُوْمَةٍ فَأَكَلَ مِنْهَا فَجِىءَ بِهَا فَقِيْلَ أَلَا نَقْتُلُهَا قَالَ  لَا. فَمَا زِلْتُ أَعْرِفُهَا فِىْ لَهَوَاتِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ.

‘এক ইয়াহূদী মহিলা নবী (ﷺ)-এর খিদমতে বিষ মিশানো বকরী নিয়ে এল। সেখান হতে কিছু অংশ তিনি খেলেন, অতঃপর মহিলাকে হাযির করা হল। তখন বলা হল, আপনি কি একে হত্যা করবেন না? তিনি বললেন, না। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ)-এর তালুতে আমি বরাবরই বিষক্রিয়ার আলামত দেখতে পেতাম’।[৪] ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মুগাফ্‌ফাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كُنَّا مُحَاصِرِيْنَ قَصْرَ خَيْبَرَ فَرَمَى إِنْسَانٌ بِجِرَابٍ فِيْهِ شَحْمٌ فَنَزَوْتُ لآخُذَهُ فَالْتَفَتُّ فَإِذَا النَّبِىُّ ﷺ فَاسْتَحْيَيْتُ مِنْهُ .

‘আমরা খায়বরের একটি কিল্লা অবরোধ করে রেখেছিলাম। এমন সময়ে এক লোক চর্বি ভর্তি একটি থলে ছুঁড়ে মারল। আমি সেটি উঠিয়ে নেয়ার জন্য ছুটে গেলাম। ঘুরে তাকিয়ে দেখি নবী (ﷺ)। তাঁকে দেখে আমি লজ্জিত হলাম’।[৫]

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল-কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা আহলে কিতাবদের যব্হ ভক্ষণ করা হালাল হিসাবে সাব্যস্ত’।[৬] তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান যুগে ইহুদী-খ্রিস্টানদের যব্হ ভক্ষণ করা অস্বীকারকারী কেউ নেই এবং মুসলিমদের জন্য তাদের যব্হ হারামও নয়। আর যে তা অস্বীকার করবে সে মূর্খ, ক্ষতিগ্রস্ত ও মুসলিমদের ইজমার বিপরীতপন্থী’।[৭]

দ্বিতীয়তঃ যাদের যব্হকৃত পশুর গোশত হারাম

কাফির, মুশরিক, মুরতাদ, মাজূসী তথা অগ্নি উপাসক ইত্যাদি অমুসলিমদের যব্হকৃত পশুর গোশত খাওয়া হারাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَاۤ اُہِلَّ لِغَیۡرِ اللّٰہِ بِہٖ  ‘আল্লাহ ছাড়া অপরের নামে উৎসর্গীকৃত পশু’ এবং وَ مَا ذُبِحَ عَلَی النُّصُبِ ‘আর যে সমস্ত পশুকে পূজার বেদীর উপর বলি দেয়া হয়েছে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)। মুরতাদদের যব্হ খাওয়া যাবে না। কেননা তারা দ্বীন থেকে বহিষ্কৃত। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ ‘যে তার দ্বীনকে পরিবর্তন করল, তাকে হত্যা কর’।[৮]

তৃতীয়তঃ বিদ‘আতীর যব্হকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করা হালাল, না-কি হারাম?

বিদ‘আতীর বিদ‘আত যদি কুফরী পর্যায়ের হয়, তাহলে তার যব্হ করা প্রাণীর গোশত খাওয়া হারাম। আর যদি কুফরী পর্যায়ের না হয় এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে যব্হ করে, তাহলে সমস্যা নেই। স্মর্তব্য যে, মুসলিমদের মধ্যে পাপী ব্যক্তি কর্তৃক যব্হ করা প্রাণীর গোশত তার পাপের কারণে যেমন নিষিদ্ধ হয় না, তেমনি বিদ‘আতী ব্যক্তির বিদ‘আতের কারণে তার যব্হকৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা হারাম হবে না, যদি তা কুফরী বা শিরকী পর্যায়ের না হয়।

ত্বালহা ইবনু মুর্ছারফ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الرافضة لا تنكح نساؤهم ولا تأكل ذبائحم لأنهم أهل ردة ‘তোমরা রাফেযী (শী‘আদের) কোন মহিলাকে বিবাহ কর না এবং তাদের যব্হসমূহ খেয়ো না। কেননা তারা মুরতাদ’।[৯]

আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ওয়াক্বী‘কে জাহমিয়্যাহ কর্তৃক যব্হকৃত প্রাণী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, لَا تَؤْكُلُ لِأَّنَّهُمْ مُرْتَدُّوْنَ ‘তাদের কিছু খাওয়া যাবে না। কেননা তারা মুরতাদ’।[১০]

ফুযায়ইল ইবনু ঈয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أَكَلَ طَعَامُ الْيَهَوُدِيِّ وَالنَّصْرَانِيِّ وَلَا أَكَلَ طَعَاُم صَاحِبُ بِدْعَةٍ ‘তিনি ইহুদী-খ্রিস্টানদের খাবার খেতেন কিন্তু কোন বিদ‘আতীর খাবার খেতেন না’।[১১]

আহমাদ ইবনু ইউনুস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, إِنَا لَا نَأْكُلُ ذَبِيْحَةَ رَجُلٍ رَافِضِيّ فَإِنَّهُ عِنْدِي مُرْتَدٌّ ‘আমরা রাফেযী (শী‘আদের) যব্হকৃত কিছু খায় না। নিশ্চয় আমার কাছে তারা মুরতাদ’।[১২]

আব্দুল কারীম ইবনু আব্দুল্লাহ আল-হুছাইন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

المبتدع لا يخلو : إما أن تكون بدعته مغلظة مكفِّرة ومخرجة من الملَّة فهذا حكمه حكم المشرك، لا يحل الأكل من ذبيحته .وإما أن تكون بدعته ليست مغلظة ولا مكفِّرة ولا مخرجة من الملة فذبيحته ذبيحة مسلم تؤكل والله أعلم.

‘বিদ‘আতী (নি¤েœর দু’টি অবস্থা থেকে) মুক্ত নয়, যখন তার বিদ‘আত ভ্রষ্ট ও কুফরী পর্যায়ের হয় এবং যা তাকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিস্কার করে দেয়, তাহলে এক্ষেত্রে তার উপর মুশরিকের ন্যায় হুকুম বর্তাবে; তার পক্ষ থেকে যব্হকৃত কিছু খাওয়া বৈধ হবে না। আর যখন তার বিদ‘আত ভ্রষ্ট ও কুফরী পর্যায়ের না হবে এবং যা তাকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিস্কার করে না দেয়, তখন তার যব্হ করা যেন মুসলিমের যব্হ করাই মতই, যা তুমি খাবে। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক জ্ঞানী’।[১৩]

শায়খ ইবনু বায (১৩৩০-১৪২০ হি./১৯১২-১৯৯৯ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আক্বীদা সম্পর্কে অজানা ব্যক্তির, পাপের ব্যাপারে উদাসীন, জানা সত্ত্বেও হারাম কাজ করে এবং জিনদের নিকট দু‘আ করা যায় মর্মে বিশ্বাস করে এরূপ ব্যক্তি কর্তৃক প্রাণী যবহ করা হলে, তার গোশত ভক্ষণ করা যাবে কি-না মর্মে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘যদি কোন মুসলিম সম্পর্কে শিরকের বিষয়টি জানা না যায়, তাহলে হালাল হবে। যদি সে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং তার পক্ষ থেকে কোন কুফরী সম্পর্কেও জানা যায় না, এরূপ ব্যক্তি যদি যব্হ করে, তাহলে তা হালাল হবে। আর যদি তার সম্পর্কে জানা যায় যে, সে কোন শিরকে আকবার বা বড় শিরকের সাথে জড়িত যেমন জিনের কাছে দু‘আ করা, মৃত ব্যক্তিকে আহ্বান করা এবং তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা ইত্যাদি সব শিরকে আকবারে লিপ্ত থাকে, তাহলে তার যব্হকৃত কিছু খাওয়া যাবে না’।[১৪] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নোংরা বিদ‘আতের দিকে আহ্বান করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত নয় এবং তাদের যব্হকৃত কিছু ভক্ষণ করাও বাঞ্ছনীয় নয়’।[১৫]

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন (১৩৪৭-১৪২১ হি./১৯২৯-২০০১ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ)-কে নাছীরিয়্যাহ সম্প্রদায়ের যব্হকৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

النصيرية وغيرهم من أهل البدع ينظر في بدعتهم؛ إذا كانت بدعتهم تكفر فإنه لا يجوز أكل ذبائحهم؛ لأنه لا يجوز أكل ذبائح الكفار إلا أهل الكتاب -اليهود والنصارى- وأما إذا كانت البدعة لا تُكفر فلا بأس أن نأكل ذبائحهم،.

‘নাছীরিয়্যাহ ও অন্যরা তাদের বিদ‘আতের কারণে বিদ‘আতীদের অন্তর্ভুক্ত। যখন তাদের বিদ‘আত কুফরী পর্যায়ের হবে, তখন তাদের যব্হকৃত কিছু ভক্ষণ করা বৈধ হবে না। কেননা আহলে কিতাব তথা ইহুদী-খ্রিস্টান ব্যতীত কাফেরদের যব্হকৃত কিছু ভক্ষণ করা বৈধ নয়। আর যখন বিদ‘আত কুফরী পর্যায়ের না হবে, তখন তাদের যব্হকৃত কিছু ভক্ষণ করাতে কোন সমস্যা নেই’।[১৬]

সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, 

أما إن لم يعرف حال الذابح لكن الغالب على من يدعي الإسلام في بلاده أنهم ممن دأبهم الاستغاثة بالأموات والضراعة إليهم فيحكم لذبيحته بحكم الغالب فلا يحل أكلها .

‘যদি যব্হকারীর অবস্থা জানা না থাকে এবং তার দেশে ইসলামের দাবিদারদের অধিকাংশই এমন হয় যে, তারা মৃতদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে থাকে, তাহলে তিনি প্রচলিত বিধান অনুসারে তার যব্হের বিচার করবেন। তাই তা খাওয়া জায়েয নয়’।[১৭] এমনকি কাজের মাধ্যমে বিদ‘আতী ও মুশরিকদের সাথে যারা থাকে তাদের যব্হকৃত প্রাণীর গোশতও ভক্ষণ করা যাবে না।[১৮]

‘ইসলাম ওয়েব’ ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘মুসলিম দেশগুলোর যব্হকৃত প্রাণী সংক্রান্ত মূলনীতি হল, সেগুলো হালাল। কারণ যারা ইসলাম মেনে চলে তাদের মূল হল যে, তাদের ইসলাম কর্তৃক এটা বৈধ হিসাবে বিচার করা হয়। আর যদি তারা বিদ‘আতী হয় এবং তাদের বিদ‘আত যদি কুফরী পর্যায়ের না হয়। অথবা এটাও হতে পারে যে, যারা বিপথগামী সম্প্রদায়ের দিকে সম্পৃক্ত কিন্তু তারা তাদের দ্বীনের মূলনীতিকে বিশ্বাস করে না এবং তাদের মধ্যে অজ্ঞ অনুসারীও রয়েছে। অতএব তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ স্থাপন এবং তাদের সন্দেহ দূর করা ছাড়া, এই লোকদের কুফর ও ফিসক্ব হিসাবে বিচার করা হয় না। যদি তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং তাদের থেকে সন্দেহ দূরীভূত হয়, তবে তারা ইসলামের মধ্যেই অবশিষ্ট থাকবে। অতএব এমতাবস্থায় মৌলিকভাবে তাদের যব্হ জায়েয। আর যদি প্রমাণ সহ কুফরী বিদ‘আতের অস্তিত জানা যায় এবং হালাল যব্হের বিষয়টি লিখিত না হয়, তাহলে কুফরী বিদ‘আতের হুকুম বিজয় লাভ করবে অর্থাৎ তার যব্হ হালাল হবে না’।[১৯]

সঊদী আরবের প্রখ্যাত সালাফী বিদ্বান শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আমরা একটি শী‘আ সমাজে বসবাস করি। এছাড়া আপনি জানেন যে, ইসলামের দাবীদার শী‘আদের আক্বীদা কিতাব ও সুন্নাহ বিরোধী। এমতাবস্থায় কি আমাদের জন্য তাদের যব্হ করা প্রাণীর গোশত খাওয়া জায়েয, যে গোশত তারা বাজারে বিক্রয় করে কিংবা কবর ও মৃত ব্যক্তির জন্য নযর করে থাকে? উল্লেখ্য, যব্হের সময় তারা আল্লাহর নাম উল্লেখ করে থাকে।

উত্তরে মুহতারাম শায়খ বলেন, ‘যব্হ হালাল হওয়ার জন্য শর্ত হল, যব্হকারীকে অবশ্যই মুসলিম ও আহলে কিতাব হতে হবে। সাথে সাথে যব্হের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ‘বিসমিল্লাহ’ তথা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে হবে। এজন্য মুশরিক, মাজূসী বা অগ্নি উপাসক কিংবা মুরতাদ কর্তৃক যব্হকৃত প্রাণী হালাল নয়। কেননা তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না। আর শী‘আদের আক্বীদা ও কর্মকা-সমূহের কারণে তারা ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত। তাদের কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা হল, কুরআনুল কারীম পরিবর্তন করা, তাদের ইমামগণ ইলমে গায়েবের অধিকারী এবং তারা যাবতীয় ভুল ও অপরাধ থেকে মুক্ত। তারা মৃত ব্যক্তিদের নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করে, আল্লাহকে ব্যতীত তাদেরকে আহ্বান করে, তাদের কবরসমূহে সিজদা করে, আম্বিয়া ও রাসূলগণের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছাহাবীদেরকে গালীগালাজ করে এবং তাদেরকে কাফের ঘোষণা দেয়।[২০]  এরূপ কুফরী  আক্বীদা ও কর্মকা-ে যারা বিশ্বাসী, তারা ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত এবং তাদের যব্হ হালাল নয়’।[২১]

সুধী পাঠক! উক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, বিদ‘আতীর বিদ‘আত যদি সুস্পষ্টরূপে কুফরী ও শিরকী বিদ‘আত হয়ে থাকে, তাহলে সর্বসম্মতক্রমে তার যব্হকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করা যাবে না। কিন্তু বিদ‘আত যদি শিরকী ও কুফরী পর্যায়ের না হয়, তাহলে ভক্ষণ করা যাবে। নি¤েœর হাদীছটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য : আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ قَوْمًا قَالُوْا لِلنَّبِىِّ ﷺ إِنَّ قَوْمًا يَأْتُوْنَا بِاللَّحْمِ لَا نَدْرِىْ أَذُكِرَ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ أَمْ لَا فَقَالَ سَمُّوْا عَلَيْهِ أَنْتُمْ وَكُلُوْهُ قَالَتْ وَكَانُوْا حَدِيْثِى عَهْدٍ بِالْكُفْرِ.

‘একদল লোক নবী (ﷺ)-কে বলল, কতক লোক আমাদের নিকট গোশ্‌ত নিয়ে আসে। আমরা জানি না যে, পশু যব্হের সময় বিসমিল্লাহ বলা হয়েছিল কি-না। তখন নবী (ﷺ) বললেন, তোমারাই এর উপর বিসমিল্লাহ পড় এবং তা খাও। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, প্রশ্নকারী দলটি ছিল কুফর থেকে নতুন ইসলাম গ্রহণকারী’।[২২]

 (ইনশাআল্লাহ চলবে)

 

 


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

[১]. ছহীহ বুখারী, ‘কিতাবুয যাবাহি ওয়াছ ছাইদ’-২, ‘বাবু যাবাইহি আহলিল কিতাব’-২২।

[২]. ছহীহ বুখারী, ‘কিতাবুয যাবাহি ওয়াছ ছাইদ’-২, ‘বাবু যাবাইহি আহলিল কিতাব’-২২।

[৩]. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৩য় খ-, পৃ. ৪০।

[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬১৭।

[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫০৮।

[৬]. ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩৫তম খ-, পৃ. ২১৬।

[৭]. ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩৫তম খ-, পৃ. ২১২।

[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫০৭।

[৯]. ইবনু বাত্তাহ, আল-ইবানাহ আছ-ছুগরা, পৃ. ১৬১।

[১০]. ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আস-সুন্নাহ, ১ম খ-, পৃ. ১১৭, আছার নং-৩৮।

[১১]. ইবনু বাত্তাহ, আল-ইবানাহ আছ-ছুগরা, পৃ. ১৬১।

[১২]. লালকাঈ, শারহু ঊছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিহ সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, ৮ম খ-, পৃ. ১৫৪৬, আছার নং-২৮১৭।

[১৩]. বারনামায ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, ফৎওয়া নং-৯০৫০, ‘খাদ্যদ্রব্য’ অনুচ্ছেদ।

[১৪]. মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল আহওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খ-, পৃ. ৩৯৯।

[১৫]. যঃঃঢ়ং://নরহনধু.ড়ৎম.ংধ/ভধঃধিং/১৩৩৭২/.

[১৬]. মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন, লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৫, প্রশ্ন নং-৫০।

[১৭]. ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমাহ, ২২তম খ-, পৃ. ৪৩২।

[১৮]. ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমাহ, ১ম খ-, পৃ. ২১৭।

[১৯]. ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-২২৯১৫৬, ১২৫৬২৮, ১৪৪৯, ৯৫৩১১, ১২২৬৩৫।

[২০]. বি. দ্র. : ফাতাওয়া সওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-১১৪৮, ১০২৭২, ২১৫০০।

[২১]. মাওক্বিউল ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, পৃ. ১১৭৮, ফৎওয়া নং-৬০০৪৬।

[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫০৭।




ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : মুহাম্মদ ইমরান বিন ইদরিস
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৯ম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
রামাযানের খুঁটিনাটি - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ইসলামে ব্যবসায়িক মূলনীতি - ছাদীক মাহমূদ
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
সচ্চরিত্রই মানব উন্নতির চাবিকাঠি - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (১২তম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন

ফেসবুক পেজ