মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৮:৫২ পূর্বাহ্ন
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায়
মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*

(৩য় কিস্তি)

তরুণ সমাজের প্রতি সন্ত্রাসের হিংস্র ছোবল
সন্ত্রাসবাদ একটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগজনক সমস্যা। এটি একটি সভ্যতাবিনাশী মানব বিধ্বংসী প্রবণতা। মূলত কোন উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃর্ষ্টি করার প্রচেষ্টাকে ‘সন্ত্রাস’ বলা হয়। আর রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠাননীতিকে সন্ত্রাসবাদ বলে। উক্ত ক্ষমতা লাভের জন্য যারা হত্যাকা- পরিচালনা করে তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতা আজ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। আর দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তরুণ ও যুবসমাজই আজ তাদের প্রধান হাতিয়ার।
বর্তমানে ঠুনকো কোন অভিযোগ আরোপ করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালিত হচ্ছে। আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতা লাভ, প্রেম ঘটিত কারণ, হিংসা-ঈর্ষা, দলীয় ক্যাডারদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা সহ প্রভৃতি কারণে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে মানুষ সন্ত্রাস করে থাকে। পাড়ি জমায় অন্ধকার রাজ্যের পাপাচারে।
বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিটি দেশ ও দেশের জনগণ সন্ত্রাস নামক দানবের আতঙ্কে আতঙ্কিত। ক্রমাগতভাবে সন্ত্রাস বিস্তৃত লাভ করছে। পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থের পর্যায়ে উপনীত হয়ে যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাস বিস্তার লাভ করছে, তেমনি বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসীরা রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত করছে। ফলশ্রুতিতে মানুষ সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছে। এই সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতার মূল টার্গেটই হল তরুণ সমাজ।
কর্মস্থল, ভ্রমণস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সভা-সমাবেশ, দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে যাতায়াতের বাহন, বিপনী কেন্দ্র ও চিত্ত বিনোদনের কেন্দ্রসমূহ এবং অন্যান্য জনসমাগমের স্থানসহ এমন কোন স্থানও নেই, যেখানে মানুষ সন্ত্রাস আতঙ্কে তাড়িত হচ্ছে না। ভ্রান্ত বিশ্বাস ও উগ্র মতবাদ-মতাদর্শের অনুসারীরা সরকারী স্থাপনা, ধর্মীয়স্থান, বিদেশী দূতাবাস, সচিবালয়, রাজনৈতিক কার্যালয়, বিচারালয়, রেলওয়ে স্টেশন, বিমান বন্দর, শপিং সেন্টার, গ্যাস ও তৈল ক্ষেত্র ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ এবং জনসমাগম স্থলকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালিত করে ব্যাপক প্রাণহানী এবং মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি করছে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নাইজেরিয়ায় আমেরিকান দূতাবাসে, ভারতের পার্লামেন্ট ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে, আমেরিকার টুইন টাওয়ারে, বৃটেনের পাতাল রেলে, তুরস্কের বিভিন্ন বিপনী কেন্দ্রে, ফ্রান্সের রেলওয়ে স্টেশনে, জর্ডানের পাঁচ তারকা হোটেলে, পাকিস্তানের ধর্মীয় উপাসনালয়সহ বিভিন্ন স্থানে, সউদী আরবের বিভিন্ন স্থানে, মিশরে শপিং সেন্টারে, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে, বাংলাদেশে আদালতে, ধর্মীয় উপাসনালয়ে, রাজনৈতিক কার্যালয়, হলি আর্টিজেনে এবং সমাবেশে ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে অগণিত মানুষ হত্যা করা হয়েছে, মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে ও অসংখ্য মানুষকে চিরতরে পঙ্গু বানিয়ে দেয়া হয়েছে।[১]
সন্ত্রাসী ঘটনার মাধ্যমেই এশিয়া মহাদেশে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হককে। ফিলিপাইনের জননন্দিত প্রেসিডেন্ট বেনিনগো একুইনোকেও সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট রানা সিংহে প্রেমাদাসাকে প্রাণ দিতে হয়েছে বোমাবাজদের হাতে। লেবাননের সাবেক প্রেসিডেন্ট রফিক হারিরীকেও সন্ত্রাসীদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের বিষফোড়া ইসরাঈলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রবিনও সন্ত্রাসী ইহুদী তরুণের হাতে নিহত হয়েছে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট রিগ্যানও সন্ত্রাসী কর্তৃক গুলীবিদ্ধ হয়েছিল।[২]
ভারতের বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্য স্বাধীনতা আন্দোলন করছে। পাঞ্জাবের শিখ সম্প্রদায়ও স্বাধীন খালিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। এর নেতৃত্ব দিতে থাকে আকালী দলের মাধ্যমে শিখ নেতা হরচান্দ সিং লাঙ্গোয়াল ও সুরঞ্জিত সিং বার্ণালা। শিখদের স্বাধীনতা আন্দোলন দমিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সান্ত জর্নাল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বে পাল্টা উপদল সৃষ্টি করা হয়। ভারত সরকার এই উপদলকে অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সাহায্য করে। এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদেরকে হত্যা করার জন্য এদেরকে অস্ত্র দিয়েও সজ্জিত করে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। কিন্তু শিখদের উপদলের নেতা সান্ত জর্নাল সিং এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, শিখদের পবিত্র স্থান অমৃতস্বরের ‘স্বর্ণ’ মন্দিরকে কেন্দ্র করে তারা এক বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে এবং সারা ভারতব্যাপী সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে থাকে। এদেরকে যে ভারত সরকার সৃষ্টি করেছিল, তারাই অবশেষে কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে ‘স্বর্ণ’ মন্দিরের অভ্যন্তরেই দলবলসহ সান্ত জর্নাল সিংকে হত্যা করে। এরই পরিণতিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও শিখদেরই হাতে প্রাণ হারাতে হয়।[৩]
শ্রীলঙ্কাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলেই শ্রীলঙ্কার তামিল গেরিলাদের প্রতি সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হয় এবং ভারতের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তামিল গেরিলারা গোটা শ্রীলঙ্কা জুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর বড় পুত্র রাজিব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হবার পরে তিনি যখন শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয় সফরে যান, তখন গার্ড অব অর্নার গ্রহণকালে এক সৈনিক তার মাথা লক্ষ্য করে রাইফেলের ব্যাটন দিয়ে আঘাত করে। সে যাত্রা তিনি রক্ষা পেলেও সেই তামিল গেরিলাদের হাতেই শেষ পর্যন্ত তিনিও তার মায়ের অনুরূপ পরিণতি ভোগ করেন। সন্ত্রাস নামক যে দানবকে ইন্দিরা-রাজিব গান্ধী দুধ-কলা দিয়ে হৃষ্টপুষ্ট করেছিলেন, সেই দানবের ছোবলেই মাতা-পুত্রকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ভারতের জনক বলে খ্যাত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে প্রথমে ১৯৩৪ সালে ২৫ জুন পুনে শহরে রেল স্টেশনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয়বার ১৯৪৬ সালে ঐ একই পদ্ধতিতে জুন মাসে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারী তৃতীয়বার হত্যার চেষ্টা করে মদনলাল নামক এক সন্ত্রাসী। এর ১০ দিন পরে ৩০ জানুয়ারী নাথুরাম গডসে নামক এক সন্ত্রাসীর হাতে তাকে প্রাণ হারাতে হয়। পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও সন্ত্রাসীদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছেন।[৪]
মায়ানমারে হাযারো মুসলিম নারী-শিশু ও ভাই-বোনেরা নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছে। পুঁড়ছে বসত ভিটা ও আবাদি জমির ফসল। আরাকানের মাটি রঞ্জিত হচ্ছে নিরীহ শহীদদের বুকের তাজা রক্তে। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই। মুসলিমদের খুন রাঙা লাশ পড়ে রয়েছে যত্রতত্র। আজ বিশ্বময় মুসলিম বনি আদমের সন্তানরা একের পর এক মার খেয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করছে। গগনবিদারী কান্না আর বুকফাঁটা আর্তনাদ করে বলছে, ‘হে আল্লাহ! আমাদের রক্ষা করুন। প্রেরণ করুন কোন সাহায্যকারী। বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিমদের কান্নায় পৃথিবীর আকাশ ভারী হয়ে উঠছে। মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুরা বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তচিৎকার করছে।
মায়ানমারের বর্বর সরকার তাদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালাচ্ছে। হত্যা করছে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশু, যুবক, বৃদ্ধাদেরকে। ধর্ষণ করে কলঙ্কিত করছে অসংখ্য মা-বোনদের। বিধবা করছে হাযারো নারীদের। সন্তানহারা করছে অসংখ্য মাকে। স্বামীহারা করছে অসংখ্য স্ত্রীকে। ভাইহারা করছে অসংখ্য বোনকে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের আহাজারীতে পৃথিবীর আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে। গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এভাবে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। নিজ দেশে থাকতে না পেরে তারা বাঁচার আশায় বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সমুদ্র পথে নৌযানে পাড়ি জমাচ্ছে। নৌযান ডুবে তারা সাগরের পানিতে ভাসছে ও ডুবে মরছে। সাগরে ভাসতে ভাসতে শুধু রোহিঙ্গা মুসলিম মরছে না, মানবতারও মৃত্যু হচ্ছে। সুতরাং তাদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসা সকলের মানবিক দায়িত্ব।
নির্যাতনের চিত্রগুলো বিশ্বমিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিভৎস চেহারাগুলো দেখে কার চোখ না অশ্রুসিক্ত হবে? চোখের সামনে ভাই-বোন, মা-বাপ, ছেলে-মেয়েদের যদি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে, শরীরের উপর কামান তুলে মাথার মগজ বের করে ফেলে, চোখের সামনে তাজাদেহ দ্বিখ-িত করে ফেলে, তখন কেমন লাগবে? অথচ বার্মার মুসলিমদের সাথে তাই করা হচ্ছে![৫] আর যারা করছে তারা অধিকাংশ তরুণ ও যুবক।
ইলেক্ট্রিক, প্রিন্ট মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যে চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে তাতে সহজেই অনুমেয় হয় যে, সেদেশের রাষ্ট্রীয়ভাবে লাইসেন্সধারী সন্ত্রাসী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক এই নির্যাতন পরিচালিত হচ্ছে। এদের অধিকাংশ যুবক ও তরুণ। তারা জাতিসত্তা ও নাগরিকত্বের অযুহাত দেখিয়ে মুসলমদের নৃশংসভাবে হত্যা করছে।
সুধী পাঠক! পরাশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের স্বার্থে সৃষ্ট নানা ধরনের জঙ্গী সংগঠনকে অর্থ ও সামরিক সাহায্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। বর্তমানে এই সন্ত্রাস এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মনেই চরম এক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। শান্তিপ্রিয় মানুষের মন থেকে মুছে গিয়েছে স্বস্তি ও নিরাপত্তাবোধ, সে স্থান দখল করেছে উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পৃথিবীর যেখানেই সন্ত্রাসী তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেখানেই মুসলিমদের সাথে এই ঘৃণ্য কর্মের যোগসূত্র আবিষ্কার করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে সিন্ডিকেট সংবাদে একমাত্র মুসলিমদের দিকেই আঙ্গুল তুলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, মুসলিমরাই এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে। শুধু তাই নয়, মুসলিমদের নামের সাথে সাথে সন্ত্রাসের তোকমা লাগানো হচ্ছে। সর্বোত্তম জীবন বিধান পবিত্র ইসলামের নাম যুক্ত করে বলা হচ্ছে, ইসলামী উগ্রবাদী ও ইসলামী মৌলবাদীরাই সর্বত্র সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। এভাবে সর্বত্র ইসলাম ও মুসলিমানদেরকে হেয়-প্রতিপন্ন করার অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দেশে দেশে সময়ে সময়ে যে সমস্ত সন্ত্রাসী কার্যক্রম হয়েছে, তার সবগুলো দেশের তরুণ ও যুব সমাজরাই করেছে। দেশের একশ্রেণীর ক্ষমতার অধিকারীরা তাদের শক্তিশালী গডফাদার। যাদের অর্থায়নে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় তারা প্রকাশ্য দিবালোকের ন্যায় সন্ত্রাস করে থাকে। ফুলের মত সৌরভময় জীবনকে তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে অন্যের ক্রীড়ণকে পরিণত করেছে। মদ, গাজা, ফেনসিডিল, হিরোইন, ইয়াবা সহ প্রভৃতিতে আসক্ত হয়ে যৌবনের শক্তিমত্তা নিঃশেষ করে ফেলছে।

তরুণদের প্রতি সন্ত্রাসের হিংস্র ছোবলের কারণসমূহ
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিলে স্পষ্টভাবে প্রস্ফুটিত হয় যে, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের হিংস্র ছোবলের অসহায় শিকার হয়েছে বিশ্বের তরুণ ও যুব সমাজ। নিম্নে কিছু কারণ সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল :
ক. ধর্ম বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা
একটি জাতির বিকাশ ও টিকে থাকা নির্ভর করে তাদের জ্ঞানগত উৎকর্ষতার উপরে। আর একটি সুন্দর ও সঠিক আর্দশ শিক্ষা ব্যবস্থাই তার মাধ্যম। শিক্ষা মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে। মূলত শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজ তার সমগ্র উন্নতি এবং প্রবৃদ্ধি সাধন করতে সক্ষম হয়। আর সে শিক্ষা হতে হবে নিঃসন্দেহে ধর্মভিত্তিক। এজন্য ইসলামে শিক্ষা অর্জনকে ফরয করা হয়েছে। ইসলামের প্রথম বাণীই হল শিক্ষা সংক্রান্ত। মহান আল্লাহ বলেন,

اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ

‘পড়! তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আল-‘আলাক্ব : ১)। হাদীছে এসেছে,

طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরয’।[৬] কিন্তু বর্তমানে ধর্মবিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হচ্ছে। যদিও পৃথিবীতে সকল ধর্ম মানুষকে সন্ত্রস্ত করা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
খ. দারিদ্রতা ও বেকারত্ব
সন্ত্রাসের হিংস্র ছোবলের খোরাক যে তরুণ প্রজন্ম তার পিছনে সর্বাধিক সক্রিয় কারণ হল- দারিদ্রতা ও বেকারত্ব। দারিদ্র এমন অর্থনৈতিক অবস্থা, যখন একজন মানুষ জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান অর্জনে এবং স্বল্প আয়ের কারণে জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করার সক্ষমতা হারায়। সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাচারিতা ও আগ্রাসন, জনসংখ্যার চাপ, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদির মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ দারিদ্র সৃষ্টি করে। আর বেকারত্ব কাজের অভাবে অনিচ্ছাকৃত কর্মহীনতা। বেকার বলতে শ্রমশক্তির সেই অংশকে বুঝানো হয়, যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সন্ধান করা সত্ত্বেও কোন কাজ পায় না। বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে (২০০২-০৩ এবং ২০০৫-০৬) ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হয়েছে, যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও কোন কাজ পায়নি।[৭] অন্যদিকে একজন মানুষ যখন তার পেশা হিসাবে কাজ খুঁজে না পায়, তখন সে পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়াকে বেকারত্ব বলে।[৮]
সুধী পাঠক! বর্তমানে তরুণ ও যুবসমাজ দারিদ্র ও বেকারত্বের কষাঘাতে জর্জরিত। ফলশ্রুতিতে তারা সহজেই সন্ত্রাসীদের শিকারে পরিণত হয়। কেননা সেখানে অবৈধভাবে অঢেল অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে। ফলে দারিদ্র ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছে মনে করে সেটাকেই সে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে নেয়। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে যরূরীভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা একান্ত প্রয়োজন।

গ. অভিভাবকদের অসচেতনতা
সন্তানদের ব্যাপারে অভিভাবকদের অসচেতনতা তরুণ সমাজের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। অভিভাবকগণ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানদেরকে পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ মনে করেন, অথচ সন্তান কার সাথে যোগাযোগ করছে, গভীর রাত পর্যন্ত জেগে সন্তান কী করছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে, কার সাথে অতিরিক্ত সময় অতিবাহিত করছে, অনলাইনে কতক্ষণ সময় ব্যয় করছে ইত্যাদি বিষয়গুলো অভিভাবকের খেয়াল রাখা যরূরী। ইসলাম সন্তান-সন্তনি লালন-পালনের জন্য পিতা-মাতা উপর অনেক দায়িত্ব অর্পণ করেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ

‘তোমাদের প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। আর তোমাদের সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে’।[৯] সন্তানদেরকে ছোট বেলা থেকে ছালাতের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ইসলামের নির্দেশনা রয়েছে। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

مُرُوا الصَّبِىَّ بِالصَّلَاةِ إِذَا بَلَغَ سَبْعَ سِنِيْنَ وَإِذَا بَلَغَ عَشْرَ سِنِيْنَ فَاضْرِبُوْهُ عَلَيْهَا

‘তোমরা সন্তাদেরকে ছালাতের নির্দেশ প্রদান কর, যখন তাদের বয়স সাত বছর হয়। অতঃপর যখন তাদের বয়স দশ বছর হবে, তখন ছালাতের জন্য তাদের প্রহার কর’।[১০] অতএব শৈশবকাল থেকে সন্তানদেরকে দ্বীনি শিক্ষা প্রদান করা উচিত। ফলে তারুণ্যের শক্তিমত্তা সে শয়তানী কর্মকা-ে ব্যয় করবে না, বরং সে সন্ত্রাসী কার্যক্রম সহ সকল প্রকার অন্যায় ও পাপাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে।

ঘ. অসৎসঙ্গী
অসৎসঙ্গীর কারণে তরুণ সমাজ সন্ত্রাসের হিংস্র ছোবলে পরিণত হচ্ছে। মানব জীবনে সঙ্গীর গুরুত্ব অনেক। মানুষের জীবনে সৎভাবে জীবন-যাপনের জন্য অনেকটা সঙ্গীর সৎ-অসৎ হওয়াটা নির্ভর করে। সঙ্গী যদি নেশাখোর, মাতাল ও চোরা কারবারের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে স্বাভাবিবভাবে তার প্রভাব পড়ে। এজন্য ইসলাম এ ব্যাপারে আপোসহীন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ مُوْسَى رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَثَلُ الْجَلِيْسِ الصَّالِحِ وَالْجَلِيْسِ السَّوْءِ كَمَثَلِ صَاحِبِ الْمِسْكِ وَكِيْرِ الْحَدَّادِ لَا يَعْدَمُكَ مِنْ صَاحِبِ الْمِسْكِ إِمَّا تَشْتَرِيهِ أَوْ تَجِدُ رِيْحَهُ وَكِيْرُ الْحَدَّادِ يُحْرِقُ بَدَنَكَ أَوْ ثَوْبَكَ أَوْ تَجِدُ مِنْهُ رِيْحًا خَبِيْثَةً

আবু মূসা (রাযিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হল- কস্তুরীওয়ালা ও কামারের হাপরের ন্যায়। কস্তুরীওয়ালা হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার নিকট হতে তুমি কিছু খরিদ করবে কিংবা তার নিকট হতে তুমি সুবাস পাবে। আর কামারের হাপর হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দিবে কিংবা তুমি তার নিকট হতে দুর্গন্ধ পাবে।[১১]

ঙ. সহিংস রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা
রাজনীতি বর্তমানে গু-াতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সহিংসা, নৃশংসতা, অত্যাচার, গুম-খুন, হরতাল, ভাংচুর, পেট্টোল বোমা নিক্ষেপ, দুর্নীতি, প্রতারণা ইত্যাদিতে আক্রান্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের কাণ্ডারী সদৃশ যুবসমাজই দেশের বিবেকহীন জড়পদার্থ একশ্রেণীর শিক্ষিত মূর্খদের বলীর পাঠাতে পরিণত হয়েছে। কাউকে জোরপূর্বক সহিংস রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করানো হচ্ছে, কেউবা অর্থ উপার্জনের আশায় নেতার কথায় মারামারি-কাটাকাটি করছে, তোয়াক্কা করছে না আইন-কানুন, ন্যায়-অন্যায়। যেন দেশ পশুর রাজ্যে পরিণত হয়েছে। যেখানে মানুষের বিবেচনাবোধ কোন কাজ করে না, বিবেক তাড়িত হয়ে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে না, যাদের কারণে মা-বোনেরা নিরাপত্তাহীনতায় রাস্তায় বের হতে পারে না। মুরুব্বীদের সম্মান করতে তারা যেন আজ ভুলেই গেছে। আর এগুলো সবই হয়েছে যারা আইনকে তোয়াক্কা করেন না, ন্যায়-অন্যায় বুঝেন না, ক্ষমতা, শক্তি ও অর্থের দাপট দেখিয়ে সমাজে ত্রাসের রাজত্ব করেন, তাদের সন্ত্রাসী কাজের মাধ্যমে। তারা পশুর চেয়ে অনেক নীচে নেমে গেছে। কারণ পশুদের মাঝে মানবতাবোধ ও সহানুভূতির আচরণ পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু মানুষ নামে ঐ নরপশুদের নিকট সেগুলোও এখন অনুপস্থিত। অথচ চলমান এই সহিংস ও নৃশংস রাজনীতি কষ্মিনকালেও ইসলাম সমর্থন করে না। এই সমর্থনহীন পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ততার কারণে তরুণ সমাজ ধ্বংসের অতলতলে তলিয়ে যাচ্ছে। অতএব হে তরুণ সমাজ সাবধান!
                                                                                                       (চলবে ইনশাআল্লাহ)

* পি-এইচ.ডি. গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
১. মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে ইসলাম (ঢাকা : গ্লোবাল পাবলিকেশন্স নেটওয়ার্ক, ১ম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৫), পৃ. ৭; http://xeroxtree.com/pdf/ shontras_o_jongibad_domone_islam.pdf|
২. সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে ইসলাম, পৃ. ৭-৮।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮।
৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮-৯।
৫. দৈনিক আমাদের অর্থনীতি, ১৫.০৯.২০১৭, মুহাম্মাদ কামাল হোসেন, আরাকানের কান্না।
৬. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮; সনদ হাসান, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৯১৩।
৭..http://bn.banglapedia.org/index.php.
৮..https://bn.wikipedia.org/wiki.
৯. ছহীহ বুখারী, হা/৮৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৯; মিশকাত, হা/৩৬৮৫।
১০. আবুদাঊদ, হা/৪৯৪; তিরমিযী, হা/৫৭২।
১১. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৩৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬২৮; মিশকাত, হা/৫০১০।




মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৫তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (ত্রয়োদশ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (২৮তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
যুলমের পরিচয় ও পরিণাম - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন

ফেসবুক পেজ