মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৪:০৭ অপরাহ্ন

তওবার গুরুত্ব ও ফযীলত

-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর*


(২য় কিস্তি)

তওবায় সকল পাপ এমনকি শিরকের পাপও ক্ষমা হতে পারে

তওবার মাধ্যমে মানুষের যে কোন পাপ ক্ষমা হতে পারে। খালেছ অন্তরে তওবা করলে আল্লাহ বান্দার সব অপরাধ ক্ষমা করে দেন। হাদীছে এসেছে-

عن أنس قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ قَالَ اللهُ يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِى وَرَجَوْتَنِى غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلاَ أُبَالِى يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِى غَفَرْتُ لَكَ وَلاَ أُبَالِى يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِى بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِى لاَ تُشْرِكُ بِى شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান! যতদিন তুমি আমাকে ডাকবে এবং আমার নিকট ক্ষমার আশা রাখবে আমি তোমাকে ক্ষমা করব, তোমার অবস্থা যাই হোক না কেন। আমি কারো পরওয়া করি না। আদম সন্তান তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছে অতঃপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব আমি ক্ষমা করার ব্যাপারে কারও পরওয়া করি না। আদম সন্তান তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার দরবারে উপস্থিত হও এবং আমার সাথে কোন শরীক না করে আমার সামনে আস, আমি পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে উপস্থিত হব’।[১]

অত্র হাদীছে বুঝা যায় যে, বান্দা যে পাপই করুক না কেন প্রভুর নিকট ক্ষমা চাইলে তিনি তা ক্ষমা করে দেন। তিনি ক্ষমা করার ব্যাপারে কাউকে পরওয়া করেন না। তিনি কারো শিরক ব্যতীত পৃথিবী ভর্তি পাপও ক্ষমা করে দেন। তিনি সাধরণত শিরকের পাপ ক্ষমা করেন না। তবে যদি মৃত্যুর আগে খালেছ অন্তরে তওবা করতে পারে। আর যাবতীয় শিরকী আক্বীদা পরিহার করে ছহীহ আক্বীদার দিকে ফিরে আসে। তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেও করতে পারেন। নিম্নে আয়াতে কারীমা দু’টি সে দিকেরই ইঙ্গিত বহন করে।

قُلۡ یٰعِبَادِیَ  الَّذِیۡنَ  اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ  لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّہٗ  ہُوَ  الۡغَفُوۡرُ  الرَّحِیۡمُ-وَ اَنِیۡبُوۡۤا اِلٰی  رَبِّکُمۡ وَ اَسۡلِمُوۡا لَہٗ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَکُمُ الۡعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنۡصَرُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, হে আমার বান্দগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। তোমরা ফিরে এসো তোমাদের রবের দিকে এবং তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ কর তোমাদের নিকট শাস্তি আসার পূর্বে। (আযাব এসে গেলে) তখন তোমাদের কোন সাহয্য করা হবে না’ (যুমার ৩৯/৫৩-৫৪)।

উক্ত আয়াতে الَّذِیۡنَ  اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ ‘তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ’ অংশের ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এটা দ্বারা সকল ধরনের পাপ কাজকে বুঝানো হয়েছে। যেমন শিরক, কুফর, নিফাক্ব, হত্যা, পাপাচার ইত্যাদি। এসব পাপে জড়িত হয়েও যদি (আন্তরিকভাবে) তওবা করে, তবে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন’।[২]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ نَاسًا مِنْ أَهْلِ الشِّرْكِ كَانُوا قَدْ قَتَلُوا وَأَكْثَرُوا وَزَنَوْا وَأَكْثَرُوا فَأَتَوْا مُحَمَّدًا ﷺ فَقَالُوا إِنَّ الَّذِى تَقُولُ وَتَدْعُو إِلَيْهِ لَحَسَنٌ لَوْ تُخْبِرُنَا أَنَّ لِمَا عَمِلْنَا كَفَّارَةً فَنَزَلَ وَالَّذِينَ لاَ يَدْعُونَ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ وَلاَ يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِى حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَلاَ يَزْنُونَ وَنَزَلَ قُلْ يَا عِبَادِىَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لاَ تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুশরিকদের কিছু লোক বহু হত্যা করে এবং বেশি বেশি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তারপর তারা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কাছে এল এবং বলল, আপনি যা বলেন এবং আপনি যেদিকে আহ্বান করেন, তা অতি উত্তম। আমাদের যদি অবগত করতেন, আমরা যা করেছি, তার কাফ্ফারা কী? এর প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়- ‘আর যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন ইলাহকে ডাকে না, আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। আরো অবতীর্ণ হল- হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করে ফেলেছ, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না’।[৩] ক্ষমা চাওয়ার মতো চাইতে পারলে শিরকের পাপও আল্লাহ ক্ষমা করবেন।

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ إِنَّ عَبْدًا أَصَابَ ذَنْبًا وَرُبَّمَا قَالَ أَذْنَبَ ذَنْبًا فَقَالَ رَبِّ أَذْنَبْتُ وَرُبَّمَا قَالَ أَصَبْتُ فَاغْفِرْ لِي فَقَالَ رَبُّهُ أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ غَفَرْتُ لِعَبْدِي ثُمَّ مَكَثَ مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ أَصَابَ ذَنْبًا أَوْ أَذْنَبَ ذَنْبًا فَقَالَ رَبِّ أَذْنَبْتُ أَوْ أَصَبْتُ آخَرَ فَاغْفِرْهُ فَقَالَ أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ غَفَرْتُ لِعَبْدِي ثُمَّ مَكَثَ مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ أَذْنَبَ ذَنْبًا وَرُبَّمَا قَالَ أَصَابَ ذَنْبًا قَالَ قَالَ رَبِّ أَصَبْتُ أَوْ قَالَ أَذْنَبْتُ آخَرَ فَاغْفِرْهُ لِي فَقَالَ أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ غَفَرْتُ لِعَبْدِي ثَلَاثًا فَلْيَعْمَلْ مَا شَاءَ

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘কোন বান্দা অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক আমি অপরাধ করেছি, তুমি তা ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, (হে আমার ফিরিশতাগণ!) আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দিবেন? (তোমরা সাক্ষি থাক) আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর আল্লাহ যতদিন চাইলেন ততদিন অপরাধ না করে থাকল। আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার অপরাধ করেছি তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দিবেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর সে অপরাধ না করে থাকল যতদিন আল্লাহ চাইলেন। আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক আমি আবার আর এক অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। সে যা ইচ্ছা করুক’।[৪]

অত্র হাদীছে প্রমাণ করে খালেছ তওবায় যে কোন ধরনের পাপ ক্ষমা হয়ে যায়। ‘যে যা ইচ্ছা করুক’ সে ব্যক্তি যেমনই পাপ করুক আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করবেন। এমন কি এর মধ্যে শিরকের পাপও থাকতে পারে।

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ أَنَّ امْرَأَةً مِنْ جُهَيْنَةَ أَتَتْ نَبِىَّ اللهِ ﷺ وَهِىَ حُبْلَى مِنَ الزِّنَى فَقَالَتْ يَا نَبِىَّ اللهِ أَصَبْتُ حَدًّا فَأَقِمْهُ عَلَىَّ فَدَعَا نَبِىُّ اللهِ ﷺ وَلِيَّهَا فَقَالَ أَحْسِنْ إِلَيْهَا فَإِذَا وَضَعَتْ فَائْتِنِى بِهَا فَفَعَلَ فَأَمَرَ بِهَا نَبِىُّ اللهِ ﷺ فَشُكَّتْ عَلَيْهَا ثِيَابُهَا ثُمَّ أَمَرَ بِهَا فَرُجِمَتْ ثُمَّ صَلَّى عَلَيْهَا فَقَالَ لَهُ عُمَرُ تُصَلِّى عَلَيْهَا يَا نَبِىَّ اللهِ وَقَدْ زَنَتْ فَقَالَ لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ سَبْعِينَ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ وَهَلْ وَجَدْتَ تَوْبَةً أَفْضَلَ مِنْ أَنْ جَادَتْ بِنَفْسِهَا لِلهِ تَعَالَى

আবু নুজাইদ ইমরান ইবনু হুসাইন খুযাঈ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত যে, জুহাইনা গোত্রের একটি নারী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট হাযির হল। সে অবৈধ মিলনে গর্ভবতী ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি দ-নীয় অপরাধ করে ফেলেছি তাই আপনি আমাকে শাস্তি দিন। সুতরাং আল্লাহর নবী (ﷺ) তার আত্মীয়কে ডেকে বললেন, তুমি একে নিজের কাছে যত্ন সহকারে রাখ এবং সন্তান প্রসবের পর একে আমার নিকট নিয়ে এসো। সুতরাং সে তাই করল। (অর্থাৎ প্রসবের পর তাকে তাঁর কাছে নিয়ে এলো)। আল্লাহর নবী (ﷺ) তার কাপড় তার (শরীরের) উপর মযবুত করে বেঁধে দেয়ার আদেশ দিলেন। অতঃপর তাকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলার আদেশ করলেন। অতঃপর তিনি তার জানাযার ছালাত পড়ালেন। উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি এই মেয়ের জানাযার ছালাত পড়ালেন, অথচ সে ব্যভিচার করেছিল? তিনি বললেন, (উমার! তুমি জান না যে,) এই স্ত্রী লোকটি এমন বিশুদ্ধ তওবা করেছে, যদি তা মদীনার ৭০ জন লোকের মধ্যে বণ্টন করা হত তা তাদের জন্য যথেষ্ট হত। এর চেয়ে কি তুমি কোন উত্তম কাজ পেয়েছ যে, সে আল্লহ্র জন্য নিজের প্রাণকে কুরবান করে দিল’।[৫]

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ كَانَ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ رَجُلٌ قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ إِنْسَانًا ثُمَّ خَرَجَ يَسْأَلُ فَأَتَى رَاهِبًا فَسَأَلَهُ فَقَالَ لَهُ هَلْ مِنْ تَوْبَةٍ قَالَ لَا فَقَتَلَهُ فَجَعَلَ يَسْأَلُ فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ ائْتِ قَرْيَةَ كَذَا وَكَذَا فَأَدْرَكَهُ الْمَوْتُ فَنَاءَ بِصَدْرِهِ نَحْوَهَا فَاخْتَصَمَتْ فِيهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلَائِكَةُ الْعَذَابِ فَأَوْحَى اللهُ إِلَى هَذِهِ أَنْ تَقَرَّبِي وَأَوْحَى اللهُ إِلَى هَذِهِ أَنْ تَبَاعَدِي وَقَالَ قِيسُوا مَا بَيْنَهُمَا فَوُجِدَ إِلَى هَذِهِ أَقْرَبَ بِشِبْرٍ فَغُفِرَ لَهُ

আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘বণী ইসরাঈলের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল যে, নিরানব্বইজন মানুষকে হত্যা করেছিল। অতঃপর সে ফৎওয়া জিজ্ঞেস করার জন্য বের হল এবং একজন দরবেশের নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করল, এরূপ ব্যক্তির জন্য তওবা আছে কি? তিনি বললেন, নেই। সে তাকেও হত্যা করল এবং বার বার লোকদেরকে জিজ্ঞেস করতে থাকল। এক ব্যক্তি বলল, অমুক গ্রামে যাও অমুককে জিজ্ঞেস কর। এসময় তার মউত এসে গেল এবং মৃত্যুকালে সে স্বীয় সিনাকে ঐ গ্রামের দিকে কিছু বাড়িয়ে দিল। অতঃপর রহমতের ফিরিশতা ও আযাবের ফিরিশতা দল পরস্পর ঝগড়া করতে লাগল কারা তার রূহ নিয়ে যাবে। এসময় আল্লাহ তা‘আলা ঐ গ্রামকে বললেন, তুমি মৃতের নিকট আস আর তার নিজ গ্রামকে বললেন, তুমি দূরে সরে যাও। অতঃপর ফিরিশতাদের বললেন, তোমরা উভয় দিকের দূরত্ব মেপে দেখ। মাপে তাকে এই গ্রামের দিকে এক বিঘত নিকটে পাওয়া গেল। সুতরাং তাকে মাফ করে দেয়া হল’।[৬]

আল্লাহ তা‘আলা অপরাধী তওবা করলে কিভাবে ক্ষমা করেন তার চমৎকার দৃষ্টান্ত উক্ত হাদীছগুলোতে ফুটে উঠেছে। ক্ষেত্রবিশেষ তিনি ক্ষমাপ্রার্থী বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য বিস্ময়কার কৌশলও অবম্বন করে থকেন। অপরাধ স্বীকার করে তাঁর নিকট নত শিরে তওবা করলে তিনি ক্ষমা করার ব্যাপারে কাউকে তোয়াক্কা করেন না। উমুককে আল্লাহ ক্ষমা করবেনা না, এরূপ কথা কারো বলা শোভনীয় নয়। এমন কথা বলা আল্লাহর অপসন্দনীয়। কেননা তিনি তো তাকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ جُنْدَبٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ حَدَّثَ أَنَّ رَجُلاً قَالَ وَاللهِ لاَ يَغْفِرُ اللهُ لِفُلاَنٍ وَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ مَنْ ذَا الَّذِى يَتَأَلَّى عَلَىَّ أَنْ لاَ أَغْفِرَ لِفُلاَنٍ فَإِنِّى قَدْ غَفَرْتُ لِفُلاَنٍ وَأَحْبَطْتُ عَمَلَكَ أَوْ كَمَا قَالَ

জুনদুব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহর কসম! আল্লাহ অমুককে মাফ করবেন না। তখন আল্লাহ বললেন, কে আছে যে আমাকে কসম দিতে পারে বা আমার নামে কসম খেতে পারে যে, আমি অমুককে ক্ষমা করব না। যাও আমি তাকে ক্ষমা করলাম এবং তোমার আমল নষ্ট করে দিলাম। তিনি অনুরূপ বলেছেন’।[৭]

ইস্তিগফার ও তওবার মধ্যেই মুমিনের প্রকৃত সফলতা বিদ্যমান

ভুল সংশোধন করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার মধ্যেই মুমিনের প্রকৃত সফলতা রয়েছে। অপরাধ থেকে তওবা ও ইস্তিগফার করার মধ্যে লজ্জার কোন কারণ নেই। কারণ ক্ষমা চাচ্ছি এমন সত্তার নিকট সবেচেয়ে বড়। যাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। তাঁর সাথে তুলনা করারও কিছুই নেই। এমন প্রভুর নিকট ক্ষমা চাইতে লজ্জা বা দ্বিধা-সংশয় কিসের? তার নিকট অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়াতেই প্রকৃত সফলতা। নিজেদের জীবনের যাবতীয় ভুলগুলো সংশোধন করে তওবা করতে পারলে পরকালীন জীবনে সাফল্য লাভ করা সম্ভব। অন্যথা অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছাই হতে হবে। যারা ভুল সংশোধন করে তওবা করে তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন। আর তাদের পরকালে কোন দুশ্চিন্তা গ্রাস করবে না। এমর্মে এরশাদ হচ্ছে-

فَمَنۡ اٰمَنَ وَ اَصۡلَحَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ  وَ لَا  ہُمۡ  یَحۡزَنُوۡنَ

‘অতঃপর যারা ঈমান আনে ও নিজেকে সংশোধন করে নেয় তাদের নেই কোন ভয়, নেই কোন দুশ্চিন্তা বা দুঃখ’ (আন‘আম ৬/৪৮)। তিনি অন্যত্র বলেন,

فَمَنِ اتَّقٰی وَ اَصۡلَحَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ

‘আর যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয়, তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হবে না এবং তারা চিন্তিও হবে না’ (আ‘রাফ ৭/৩৫)।

فَاَمَّا مَنۡ تَابَ وَ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا فَعَسٰۤی اَنۡ  یَّکُوۡنَ مِنَ الۡمُفۡلِحِیۡنَ

‘কিন্তু যে ব্যক্তি (তার জবীনে) তওবা করেছিল আর ঈমান এনেছিল আর সৎ আমল করেছিল, আশা করা যায় সে সাফল্যম-িতদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (ক্বাছাছ ২৮/৬৭)। অনুরূপ অপর এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,

اِلَّا مَنۡ تَابَ وَ اٰمَنَ وَ عَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَاُولٰٓئِکَ یُبَدِّلُ اللّٰہُ سَیِّاٰتِہِمۡ  حَسَنٰتٍ ؕ وَ کَانَ  اللّٰہُ  غَفُوۡرًا  رَّحِیۡمًا

‘তারা ব্যতীত (তারা পরকালে শস্তি হতে মুক্ত) যারা ব্যক্তি তওবা করবে, ঈমান আনবে, আর সৎ আমল করবে। মহান আল্লাহ এদের পাপগুলোকে নেকীতে পরিবর্তিত করে দেবেন; আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু’ (ফুরক্বান ২৫/৭০)।

উপরিউক্ত আয়াতগুলোর দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে তওবা ও ইস্তিগফারের গুরুত্ব ও ফযীলত স্পষ্ট হয়ে যাবে। যারা নিজেদের অপরাধগুলো স্বীকার করে নিবে সাথে ভুলগুলোও শুধরিয়ে নিবে তারা পরকালে ভীত-সন্ত্রস্ত হবে না। তারা শেষ দিবসে দুঃখ বা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকবে। তাদের জীবন সাফল্য ম-িত হবে। ভুল সংশোধন করে তওবা করত সঠিক আমল করলে অতীতের সমস্ত পাপ মহান আল্লাহ নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। তিনি অপরাধ তো ক্ষমা করবেনই। বরং তার কৃত পাপ নেকী দ্বরা বদল করে দিবেন। একজন মুমিন মুসলিমের এর চেয়ে বড় সফলতা আর কী হতে পারে?

বুরায়দা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা মায়েয ইবনে মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে পবিত্র করুন। তিনি বললেন, ‘আক্ষেপ তোমার প্রতি, চলে যাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তওবা কর’। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি চলে গেলেন এবং সামান্য একটু দূরে গিয়েই পুনরায় ফিরে আসলেন এবং আবারও বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে পবিত্র করুন। নবী করীম (ﷺ) এবারও তাঁকে পূর্বের ন্যায় বললেন। এইভাবে তিনি যখন চতুর্থবার এসে বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা! আমি তোমাকে কোন্ জিনিস হতে পবিত্র করব? তিনি বললেন, যিনা হতে। তাঁর কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (ছাহাবাদেরকে) জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটি কি পাগল’? লোকেরা বলল, না তো? তিনি পাগল নন। তিনি আবার বললেন, ‘লোকটি কি মদ পান করেছে’? তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তাঁর মুখ শুঁকে দেখেন; কিন্তু মদের কোন গন্ধ তাঁর মুখ হতে পাওয়া গেল না। অতঃপর তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি সত্যই যিনা করেছ’? তিনি বললেন, জি হ্যাঁ। এরপর তিনি রজমের নির্দেশ দিলেন, তখন তাঁকে রজম করা হল। এই ঘটনার দুই/তিন দিন পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (ছাহাবাদের সম্মুখে) এসে বললেন, তোমরা মায়েয ইবনে মালেকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা সে এমন তওবাই করেছে, لَقَدْ تَابَ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ أُمَّةٍ لَوَسِعَتْهُمْ ‘যদি তা সমস্ত উম্মতের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হয়, তবে তা সকলের জন্য যথেষ্ট হবে’।[৮]

সুধী পাঠক! অপরাধ করার পর মহান প্রভুর নিকট আত্মসর্পণ করলে তিনি বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি ক্ষমাশীলতার দিকে দিয়ে অনন্য সত্তা। মানুষ যে অপরাধই করুক না কেন তাঁর নিকট ক্ষমা পাওয়া সম্ভব। শিরকে আকবার করেও যদি ক্ষমা চাওয়ার মতো চাওয়া যায় তাহলে তিনি তা ক্ষমা করে দিবেন। তাঁর নিকটে নত হয়ে ক্ষমা চাইলে তিনি বান্দাকে ফেরত দেন না। তওবা কবুলের জন্য নিম্নের কয়েকটি শর্তের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরী।

প্রথমতঃ ইলাছের সাথে তওবা করতে হবে। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তা হতে হবে। লোক দেখানো বা অন্য কাউকে সন্তুষ্ট করা জন্য নয়।

দ্বিতীয়তঃ যে পাপের জন্য তওবা করছে সে গুনাহ বন্ধ করতে হবে।

তৃতীয়তঃ কৃত পাপকর্মের জন্য আন্তরিকভাবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হতে হবে।

চতুর্থতঃ ভবিষ্যতে উক্ত পাপকর্মে পুনরায় লিপ্ত হবে না বলে দৃঢ়  প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। এটি তওবার শর্তগুলোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত।

পঞ্চমতঃ অপরাধটি যদি অন্যের হক্ব বা অধিকার নষ্ট করার হয়ে থাকে; তাহলে সেই অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। রবের অধিকার নষ্ট করলে সেই আমলে ফিরে আসতে হবে। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহর তওবা সংক্রান্ত বাণিটি স্মরণযোগ্য :

وَ لَیۡسَتِ التَّوۡبَۃُ لِلَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ السَّیِّاٰتِ ۚ حَتّٰۤی  اِذَا حَضَرَ اَحَدَہُمُ الۡمَوۡتُ قَالَ  اِنِّیۡ تُبۡتُ الۡـٰٔنَ  وَ لَا الَّذِیۡنَ یَمُوۡتُوۡنَ وَ ہُمۡ کُفَّارٌ ؕ اُولٰٓئِکَ اَعۡتَدۡنَا لَہُمۡ عَذَابًا  اَلِیۡمًا

‘এমন লোকদের তওবা কাজে আসে না যারা গুনাহ করতেই থাকে। অতঃপর মৃত্যুর মুখোমুখী হলে বলে, আমি এখন তওবা করছি এবং (তওবা) তাদের জন্যও নয় যাদের মৃত্যু হয় কাফির অবস্থায়। এরাই তারা যাদের জন্য ভয়াবহ শস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি’ (নিসা ৪/১৮)।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* পরিচালক, ইয়াসিন আলী সালাফী মাদরাসা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী, হা/৩৫৪০; দারেমী, হা/২৭৮৮; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৫৪৮৩; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১২৭; মিশকাত, হা/২৩৩৬, হাদীছ ছহীহ।
[২]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৮০; তাফসীরে মুনীর, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২০৭।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮১০; ছহীহ মুসলিম, হা/১২২; আবুদাউদ, হা/৪২৭৪; নাসাঈ, হা/৪০০৩, ৪০০৪; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩৫২২।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৫০৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯২৪৫; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৭৬০৮; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৭০৮৭; মিশকাত, হা/২৩৩৩।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৯৬; আবুদাউদ, হা/৪৪৪০; তিরমিযী, হা/১৪৩৫; নাসাঈ, হা/১৯৫৭; ইবনু মাজাহ, হা/২৫৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৮৭৪; দারেমী, হা/২৩২৫।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৭০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬১৫; ছহীহুল জামে‘, হা/৪৪৫৯; মিশকাত, হা/২৩২৭।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬২১; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৬৭৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৬৮৫; মিশকাত, হা/২৩৩৪।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৯৫; দারাকুৎনী, হা/৩১৭৫; ত্বাবারণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৪৮৪৩; ছহীহুল জামে‘, হা/৯৪৬; মিশকাত, হা/৩৫৬২।




প্রসঙ্গসমূহ »: আত্মশুদ্ধি
এমফিল ও পিএইচডি : গবেষণার প্রকৃতি ও পদ্ধতি - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৯ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (৮ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
নফল ছালাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমের শ্রেষ্ঠত্ব (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী

ফেসবুক পেজ