মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৭:৫০ অপরাহ্ন
তাক্বওয়াই মুক্তির সোপান
আব্দুর রশীদ*

ভূমিকা
মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আল্লাহ তাকে ভাল এবং মন্দ দু’টি কর্মের-ই স্বাধীনতা দিয়েছেন। সাথে সাথে দু’টি কর্মের ফলাফল স্বরূপ জান্নাত অথবা জাহান্নাম নামক চিরস্থায়ী বাসস্থান নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং মানুষ তার চিরস্থায়ী সুখের বাসস্থান জান্নাত লাভের জন্য হয় তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করে ধন্য হবে, নতুবা তাগূত্বী পথ অবলম্বন করে জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে  নিপতিত হবে। বক্ষমাণ প্রবন্ধে আমরা তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

তাক্বওয়ার সংজ্ঞা
‘তাক্বওয়া’ (تَقْوَى) শব্দটি আরবী, যা ‘ওয়াক্বিউন’ (وَقِىٌ) শব্দমূল হতে নির্গত। আভিধানিক অর্থ, আল্লাহর ভয়, আল্লাহভীতি, পরহেজগারী, দ্বীনদারি, ধার্মিকতা ইত্যাদি।[১] শারঈ পরিভাষায় ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাক্বওয়া’ হল, فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ ‘আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা’।[২] আবুবকর আল-জাযায়েরী বলেন, ‘তাক্বওয়া’ হল,

فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَرَسُوْلُهُ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ وَرَسُوْلُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

‘তাক্বওয়া’ হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা’।[৩] অতএব পাপ হবে, এমন কাজ হতে বিরত থাকার নাম ‘তাক্বওয়া’। অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে সকল পাপচার, অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার এবং এ জাতীয় সকল কাজ হতে নিজেকে বিরত রেখে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুসারে সার্বিক জীবন পরিচালনার নাম ‘তাক্বওয়া’।

তাক্বওয়ার অবস্থান
তাক্বওয়ার একমাত্র ও প্রধান স্থান হল, صَدْرٌ তথা বক্ষ বা অন্তর। এটি কোন দৃশ্যমান বস্তু নয়। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, اَلتَّقْوَى هَهُنَا وَيُشِيْرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مِرَارٍ ‘তাক্বওয়া এখানে, একথা বলে তিনি তিনবার নিজের বুকের দিকে ইশারা করলেন’।[৪] তবে অন্তরে আল্লাহভীতি রেখে তদনুযায়ী আমলে প্রয়োগ করাটাও তাক্বওয়ার বাহ্যিক পরিচয়। এমর্মে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ وَلَا إِلَى صُوَرِكُمْ وَلَكِنْ يَّنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ

‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের শারীরিক গঠন ও বাহ্যিক আকৃতির দিকে দৃষ্টি দিবেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল সমূহের দিকে দৃষ্টি দিবেন’।[৫] সুতরাং তাক্বওয়ার পরিচয় লেবাসে নয় বরং তার পরিচয় অন্তরে ও আমলে। বাহ্যিক পোশাক-আশাকে কাউকে মুত্তাক্বী মনে হলেও প্রকৃত মুত্তাক্বী সে নয়। বরং প্রকৃত মুত্তাক্বী সে, যার অন্তরে আল্লাহভীতি অবলম্বনের সাথে সাথে আমলেও তার বাস্তবায়ন ঘটে।

‘তাক্বওয়ার’ বৈশিষ্ট্য
তাক্বওয়ার প্রধান প্রধান বৈশিষ্টগুলো হল গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়াবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, নিয়মিত ছালাত আদায় করা, ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় দান করা, আল-কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, আসমানী কিতাবসমূহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি বা মুত্তাক্বীদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় মহান আল্লাহ বলেন,

اَلَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ- وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ

‘(মুত্তাক্বী তারাই) যারা অদৃষ্ট বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে, ছালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছি তা হতে ব্যয় করে। এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল, তদ্বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩-৪)। অত্র আয়াতসহ পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত ও একাধিক ছহীহ হাদীছ বিশ্লেষণ করলে তাক্বওয়ার যে বৈশিষ্ট্য প্রস্ফুটিত হয় তাহল-

(ক) গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়াবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়াবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা তাক্বওয়ার প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ, ফেরেশতা, কবরের আযাব আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি এই গায়েবী বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। কেননা যাকে মানুষ সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পালনকর্তা, জীবনদাতা, মরণদাতা, এক ও অদ্বিতীয় ¯্রষ্টা ইত্যাদি বলে বিশ্বাস করে তাঁকে দেখতে পায় না। এসত্ত্বেও তাঁর প্রতি অনুগত হয়ে ও তাঁর প্রতি ভয় রেখে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদত করে। যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার থেকে বিরত থাকে। জান্নাত পাওয়ার আশায় দান-ছাদাক্বাহ করে। এরাই হল গায়েবের প্রতি বিশ্বাসী মুত্তাক্বী। এদের পরিচয় দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

اَلَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ

‘(মুত্তাক্বী তারাই) যারা অদৃষ্ট বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে, ছালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমরা তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছি তা হতে ব্যয় করে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩)।

(খ) আল-কুরআন সহ সকল আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
তাক্বওয়ার অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, মানব জীবনের অন্যতম সংবিধান মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সহ সকল আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। কেননা এগুলো মানুষের হেদায়াতের জন্য নবী-রাসূলদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। এমর্মে মহান আল্লাহ বলেন,

وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ

‘(মুত্তাক্বী তারাই) যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল, তদ্বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩-৪)।

(গ) আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখা।
তাক্বওয়াশীলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখা। মহান আল্লাহ বলেন, وَ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ‘(মুত্তাক্বী তারাই) যারা পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৪)। আখিরাতের অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, কবরের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী শান্তি ও শাস্তির সূচনায় বিশ্বাস করা। কেননা এটাই আখিরাতের প্রথম মনযিল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

إِنَّ القَبْرَ أَوَّلُ مَنْزِلٍ مِنْ مَنَازِلِ الْآخِرَةِ فَإِنْ نَجَا مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ أَيْسَرُ مِنْهُ وَإِنْ لَمْ يَنْجُ مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ أَشَدُّ مِنْهُ

‘নিশ্চয় কবর হল আখিরাতের মনযিল সমূহের প্রথম মনযিল। কেউ যদি এখানে মুক্তি পায়, তাহলে পরেরগুলো তার জন্য সহজ হবে। আর যদি এখানে মুক্তি না পায়, তাহলে পরেরগুলো তার জন্য অধিকতর কঠিন হবে’।[৬] দ্বিতীয়তঃ হাশরের ময়দানে একত্রিত হয়ে পাপ-পুণ্যের হিসাব দেয়া, পুলছিরাত পার হওয়া, হাওযে কাউসারের পানি পানে ধন্য হওয়া, আল্লাহর দর্শন লাভ করা, জান্নাতের শান্তি লাভ করা অথবা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করা ইত্যাদি।

(ঘ) অপরাধীকে ক্ষমা করা।
তাক্বওয়ার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, অপরকে ক্ষমা করে দেয়া। কেননা যারা তাক্বওয়াশীল তারা চরম অপরাধীকে হাতে পেয়েও প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ধৈর্যধারণ করে। বরং তারা এর পুরস্কার কামনা করে আল্লাহর নিকটে। আর ক্ষমা করা তাক্বওয়ার নিকটবর্তী। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اَنۡ تَعۡفُوۡۤا اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی ‘মাফ করে দেয়াই তাক্বওয়ার নিকটবর্তী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩৭)।

(ঙ) পাপ থেকে বাঁচার জন্য আত্মসচেতনা অবলম্বন করা।
ছোট ও বড় তথা ছগীরা ও কাবীরা সব ধরণের পাপ কাজ থেকে বাঁচার জন্য আত্মসচেতনা অবলম্বন করা তাক্বওয়ার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুতরাং যারা তাক্বওয়াশীল তারা সর্বদাই শয়তান কর্তৃক প্ররোচিত ওয়াসওসার শিকার হতে নিজেদেরকে সচেতন রাখে। আর যদি কখনো তার শিকার হয়ও তৎক্ষণাৎ তওবা-ইস্তেগফার করে ফিরে আসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا اِذَا مَسَّہُمۡ طٰٓئِفٌ مِّنَ الشَّیۡطٰنِ تَذَکَّرُوۡا فَاِذَا ہُمۡ مُّبۡصِرُوۡنَ ‘যারা তাক্বওয়ার অধিকারী হয় তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আত্মসচেতন হয় এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চক্ষু খুলে যায়’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ২০১)।

(চ) কথা-কর্ম ও বিশ্বাসে সত্যবাদী হওয়া।
তাক্বওয়ার বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য হল- সকল কাজে, কথা-কর্ম ও বিশ্বাসে সত্যবাদী হওয়া। কেননা যারা আল্লাহভীরু তারা সত্যপরায়ণ হয়। তারা তাদের ঈমানে যেমন সত্যবাদী তেমনি তাদের কাজ-কর্মেও সৎকর্মপরায়ণ। মহান আল্লাহ বলেন, وَ الَّذِیۡ جَآءَ بِالصِّدۡقِ وَ صَدَّقَ بِہٖۤ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُتَّقُوۡنَ ‘যারা সত্যসহ উপস্থিত হয়েছে এবং তাকে সত্য বলে মেনেছে তারাই তো মুত্তাক্বী’ (সূরা আয-যুমার : ৩৩)।

(ছ) সকল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার করা ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করা।
সাধ্যানুযায়ী ন্যায়বিচার করা ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করা তাক্বওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নিকটাত্মীয় সহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ لِلّٰہِ شُہَدَآءَ بِالۡقِسۡطِ وَ لَا یَجۡرِمَنَّکُمۡ شَنَاٰنُ قَوۡمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعۡدِلُوۡا اِعۡدِلُوۡا ہُوَ اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی وَ اتَّقُوا اللّٰہَ اِنَّ اللّٰہَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে বিধানসমূহ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠাকারী ও ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হয়ে যাও, কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে এর প্রতি উদ্যত না করে যে, তোমরা ন্যায়বিচার করবে না, তোমরা ন্যায়বিচার কর, এটা তাক্বওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে পূর্ণ অবগত’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৮)। নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তাঁর বাবা তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট নিয়ে গেলেন এবং বললেন, আমার এই সন্তানকে আমি একটি গোলাম দান করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি কি তোমার সকল সন্তানকে এরূপ দান করেছ? তিনি বললেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তবে তুমি তা ফেরত নাও। অপর বর্ণনায় আছে, তুমি কি চাও যে, তারা সকলে তোমার সাথে সমানভাবে সদ্ব্যবহার করুক? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তবে এরূপ জায়েয হবে না। অপর বর্ণনায় আছে, নু‘মান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, আমার বাবা আমাকে কিছু দান করলেন। তখন আমার মা আমরাহ বিনতে রাওয়াহা বললেন, আমি এটাতে রাযী না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি এটাতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সাক্ষী না রাখেন। সুতরাং আমার বাবা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট গিয়ে বললেন, আমি আমরাহ বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার এই সন্তানকে একটি উপহার প্রদান করেছি। কিন্তু আমরাহ আমাকে বলেছে, আপনাকে যেন সাক্ষী রাখি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি কি তোমার সকল সন্তানকে এর অনুরূপ দান করেছ? তিনি বললেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমার সকল সন্তানের মধ্যে সমানভাবে সদ্ব্যবহার কর। নু‘মান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, সুতরাং তিনি প্রত্যাবর্তন করলেন এবং স্বীয় দান ফিরিয়ে নিলেন। অপর বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি অন্যায়ের উপর সাক্ষী হই না।[৭]

তাক্বওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
মানবজীবনে তাক্বওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কেননা মানুষের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র মাধ্যম ও মানদ- হল ‘তাক্বওয়া’। তাক্বওয়া ব্যতীত কেউ পার্থিব জীবনে যেমন সম্মান, মর্যাদা ও সফলতা অর্জন করতে পারে না তেমনি পরকালীন জীবনেও মুক্তি পেতে পারে না। তাই মানবজীবনে বিশেষত মুমিন জীবনে তাক্বওয়া অতীব গুরত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন,

০১. আল্লাহর নির্দেশ পালন।
মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে পৃথিবীতে নবী-রাসূল সহ যত মানুষ এসেছেন বা আসবেন তাদের সকলের প্রতি মহান আল্লাহ তাক্বওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

وَ لَقَدۡ وَصَّیۡنَا الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ اِیَّاکُمۡ اَنِ اتَّقُوا اللّٰہ

‘নিশ্চয় তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, আমরা তাদেরকে ও তোমাদেরকে আদেশ করেছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর’ (সূরা আন-নিসা : ১৩১)। যথাসাধ্য তাক্বওয়া অবলম্বন করা প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমের একান্ত যরূরী। মহান আল্লাহ্র বাণী, فَاتَّقُوا اللّٰہَ مَا اسۡتَطَعۡتُمۡ ‘তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর’ (সূরা আত-তাগাবুন : ১৬)। অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَ قُوۡلُوۡا قَوۡلًا سَدِیۡدًا ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’ (সূরা আল-আহযাব : ৭০)। এভাবে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে তাক্বওয়া অবলম্বনের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। এত্থেকে সহজেই তাক্বওয়ার গুরুত্ব অনুমিত হয়।

০২. রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহ নবী-রাসূলগণের উপদেশ ও নির্দেশ পালন।
তাক্বওয়া ব্যতীত পৃথিবীতে কোন নবী-রাসূল সফলতা অর্জন করতে পারেননি। এ ব্যাপারে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মহান আল্লাহ বিশেষভাবে অবগত করেছেন। সাধারণ মানুষ হিসাবে তার ছাহাবায়ে কেরামসহ সমস্ত উম্মাতও সফলতা অর্জন করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। তাই একাধিক ছহীহ হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলকে তাক্বওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি যখনই কোন বড় কিংবা ছোট সেনাদলের ওপর কাউকে আমীর নিযুক্ত করতেন, তখন তাকে একান্তভাবে তাক্বওয়া অবলম্বন বা আল্লাহকে ভয় করার জন্য আদেশ করতেন এবং সাধারণ মুসলিম যোদ্ধাদেরকেও তাক্বওয়া অর্জনের উপদেশ দিতেন।[৮] এমনকি তিনি স্বীয় কন্যা ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কেও তাক্বওয়াশীল হওয়ার উপদেশ দিয়ে বলেছেন, فَاتَّقِي اللهَ وَاصْبِرِيْ فَإِنِّيْ نِعْمَ السَّلَفُ أَنَا لَكِ ‘অতএব তুমি আল্লাহকে ভয় কর, পরহেযগার হও এবং ধৈর্যধারণ কর। আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রযাত্রী’।[৯] আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ব্যক্তিকে বললেন, أُوْصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ وَالتَّكْبِيْرِ عَلَى كُلِّ شَرَفٍ ‘আমি তোমাকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি। আর প্রত্যেক উচ্চস্থানে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার জন্য উপদেশ দিচ্ছি’।[১০] এভাবে বহু হাদীছ থেকে তাক্বওয়া অবলম্বনের গুরুত্বের বিষয়টি অতি সহজেই স্পষ্ট হয়।

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পূর্বে সকল নবী-রাসূল স্ব-স্ব উম্মতদেরকে তাক্বওয়া অবলম্বনের উপদেশ ও নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর সম্প্রদায় রাসূলদের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভ্রাতা নূহ (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি তাক্বওয়া অবলম্বন করবে না? (সূরা আশ-শু‘আরা : ১০৫-১০৬)। ‘আদ সম্প্রদায় রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল যখন তাদের ভ্রাতা হূদ (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি তাক্বওয়া অবলম্বন করবে না? (সূরা আশ-শু‘আরা : ১২৩-১২৪)। ছামূদ সম্প্রদায় রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল। যখন তাদের ভ্রাতা ছালিহ (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? (সূরা আশ-শু‘আরা : ১৪১-১৪২)। লূত (আলাইহিস সালাম)-এর কওম রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল। যখন তাদের ভ্রাতা লূত তাদেরকে বললেন, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? (সূরা আশ-শু‘আরা : ১৬০-১৬১)। মূসা (আলাইহিস সালাম)ও তৎকালীন অত্যাচারী বাদশাহ ফেরাঊনের নিকটে যেয়ে তাকে আল্লাহভীতির উপদেশ দেন (সূরা আশ-শু‘আরা : ১০-১১)।

০৩. তাক্বওয়া মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট পরিচ্ছদ ও পাথেয়।
তাক্বওয়া মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট পরিচ্ছদ বা ভুষণ। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ قَدۡ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکُمۡ لِبَاسًا یُّوَارِیۡ سَوۡاٰتِکُمۡ وَ رِیۡشًا وَ لِبَاسُ التَّقۡوٰی ذٰلِکَ خَیۡرٌ ذٰلِکَ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ لَعَلَّہُمۡ یَذَّکَّرُوۡنَ

‘হে বানী আদম! আমি তোমদের লজ্জাস্থান আবৃত করার ও বেশভুষার জন্য তেমাদের পোশাক পরিচ্ছদের উপকরণ অবতীর্ণ করেছি (বেশভুষার তুলনায়) তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির পরিচ্ছদই সর্বোত্তম পরিচ্ছদ। এটা আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহের অন্যতম নিদর্শন। সম্ভবতঃ মানুষ এটা হতে উপদেশ গ্রহণ করবে’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ২৬)।

তাছাড়া তাক্বওয়া মানুষের সর্বোত্তম পাথেয়ও বটে। এটা মানুষকে মহান আল্লাহর নিকটসহ সর্বমহলে সম্মানিত ও সমাদৃত করে। মহান আল্লাহ আরো বলেন,

وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ

‘আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিঃসন্দেহে সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাক্বওয়া। হে জ্ঞানীগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৭)।

০৪. তাক্বওয়াশীলরা আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন।
মানুষের অর্থ-সম্পদ, বংশ, গোত্র ইত্যাদি কোনকিছুই আল্লাহর নিকট ধর্তব্য নয়। বরং তাঁর নিকটে বান্দাদের মধ্যে সর্বোত্তম ও অধিক মর্যাদাসম্পন্ন সে, যে সর্বাধিক তাক্বওয়াশীল। যেমন তিনি বলেন, اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمۡ ‘তোমাদের নিকট সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাক্বী’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)। তাছাড়া মহান আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে তাক্বওয়াশীলদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে থাকেন। এমর্মে তিনি বলেন, وَ اللّٰہُ وَلِیُّ الۡمُتَّقِیۡنَ ‘আর আল্লাহ মুত্তাক্বীদের বন্ধু (সূরা আল-জাছিয়া : ১৯)। এভাবে বহু আয়াত ও ছহীহ হাদীছ থেকে তাক্বওয়া অবলম্বনের গুরুত্বের বিষয়টি অতি সহজেই অনুমিত হয়।

[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]

* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ইবরাহীম মুছত্বফা ও সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, তা.বি.), পৃ. ১০৫২; ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ৫ম সংস্করণ, ২০০৩), পৃ. ২১৯।
[২]. মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ, আত-তাক্বওয়া (জেদ্দা : মাজমূ‘আ যাদ, ১৪৩০ হি.), পৃ. ৭।
[৩]. জাবির ইবনু আবু বকর আল-জাযায়েরী, আইসারুত তাফাসীর লি-কালামিল উ‘লা আল-কাবীর (মদীনা মুনাওয়ারা : মাকতাবাতুল ‘উলূম ওয়াল হিকাম, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৫৮৬।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯।
[৫]. ছহীহ মুসলিম হা/৬৭০৭।
[৬]. তিরমিযী, হা/২৩০৮; ইবনু মাজাহ, হা/৪২৬৭; মিশকাত, হা/১৩২।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬২৩; মিশকাত, হা/৩০১৯।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৩১; মিশকাত, হা/৩৯২৯।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০; মিশকাত, হা/৬১২৯।
[১০]. ইবনু মাজাহ, হা/২৭৭১, সনদ হাসান।




ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা - সাজ্জাদ সালাদীন
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৫ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বিদ‘আত পরিচিতি (২৯তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৮তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আল-কুরআন সম্পর্কে অমুসলিম মনীষীদের মূল্যায়ন - রাফিউল ইসলাম
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)

ফেসবুক পেজ