মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১০:২১ পূর্বাহ্ন

ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন

-হাসিবুর রহমান বুখারী*


(১৫তম কিস্তি) 

আলোচিত ইয়া’জূজ-মা’জূজের ইতিহাস

১- পরিচয়

ইয়া’জূজ-মা’জূজের দল প্রকাশিত হওয়া ক্বিয়ামতের দশটি বড় আলামতের একটি অন্যতম বড় আলামত। যেমন হুযাইফাহ ইবনু আসীদ আল-গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন আমরা (বিবিধ বিষয়ে) আলোচনা করছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট আবির্ভূত হলেন এবং প্রশ্ন করলেন, তোমরা কী বিষয়ে আলোচনা করছ? উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ কথা শুনে তিনি বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না তোমরা দশটি বিশেষ আলামত দেখবে। অতঃপর তিনি বর্ণনা করলেন, (১) ধুম্র (২) দাজ্জাল (৩) দাব্বাতুল আরয বা ভূমির প্রাণী (৪) পশ্চিমাকাশ হতে সূর্যোদয় হওয়া (৫) মারইয়াম পুত্র ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর অবতরণ (৬) ইয়া’জূজ-মা’জূজ এবং তিনবার ভূখণ্ড ধ্বসে যাওয়া তথা (৭) পূর্ব দিকে ভূখণ্ড ধ্বস (৮) পশ্চিম দিকে ভূখণ্ড ধ্বস (৯) আরব উপদ্বীপে ভূখণ্ড ধ্বস। (১০) এ আলামতসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর এডেনের ভূগর্ভ থেকে এক অগ্ন্যুৎপাতের প্রকাশ ঘটবে, যা তাদেরকে ইয়ামান থেকে হাশরের মাঠ পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।[১]

তাদের পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন আলিম বলেন, তারা শুধু আদম (আলাইহিস সালাম)-এর বংশধর। আদম ও হাওয়ার বংশধর নয়। কারণ হিসাবে বলেন, আদম (আলাইহিস সালাম)-এর একবার স্বপ্নদোষ হয়েছিল। স্বপ্নদোষের মাধ্যমে বীর্যপাত হয়ে মাটির সাথে মিশে গেলে তা থেকে আল্লাহ তা‘আলা ইয়া’জূজ-মা’জূজ জাতি সৃষ্টি করেন’।[২] তবে হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, কথাটি পূর্ব যুগের কোন গ্রহণযোগ্য আলিম কর্তৃক বর্ণিত হয়নি। শুধু কা‘ব আল-আহবার থেকে বর্ণিত হয়েছে। কথাটি সুস্পষ্ট মারফূ‘ হাদীছের বিরোধী, বিধায় তা গ্রহণযোগ্য নয়। মোটকথা তারা তুর্কীদের পূর্ব পুরুষ ইয়াফিসের বংশধর। আর ইয়াফিস হল নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর সন্তান। কাজেই তারা আদম-হাওয়ারই সন্তান।[৩]

ইয়া’জূজ-মা’জূজ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীছের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ইয়া’জূজ-মা’জূজ মানব সম্প্রদায়ভুক্ত। অন্যান্য মানবের মত তারাও নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর সন্তান-সন্ততি। কুরআনুল কারীম স্পষ্টতঃই বলেছে, وَ جَعَلۡنَا ذُرِّیَّتَہٗ  ہُمُ  الۡبٰقِیۡنَ ‘তার বংশধরদেরকেই আমরা অবশিষ্ট রেখেছি’ (সূরা আছ-ছাফ্ফাত : ৭৭)। অর্থাৎ নূহের মহাপ্লাবনের পর দুনিয়াতে যত মানুষ আছে এবং থাকবে, তারা সকলেই বংশপরম্পরায় নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর সন্তান-সন্ততি হিসাবে গণ্য হবে। ঐতিহাসিকগণ এ ব্যাপারে একমত যে, তারা ইয়াফিসের বংশধর। প্রমাণ স্বরূপ ছহীহ বুখারীর নিম্নোক্ত হাদীছটি উল্লেখযোগ্য।

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ‏ يَقُوْلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ يَا آدَمُ فَيَقُوْلُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِيْ يَدَيْكَ - قَالَ - يَقُوْلُ أَخْرِجْ بَعْثَ النَّارِ ‏.‏ قَالَ وَمَا بَعْثُ النَّارِ قَالَ مِنْ كُلِّ أَلْفٍ تِسْعَمِائَةٍ وَتِسْعَةً وَتِسْعِيْنَ.‏ قَالَ فَذَاكَ حِيْنَ يَشِيْبُ الصَّغِيْرُ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللهِ شَدِيْدٌ.‏ قَالَ فَاشْتَدَّ ذَلِكَ عَلَيْهِمْ.‏ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ أَيُّنَا ذَلِكَ الرَّجُلُ فَقَالَ‏ أَبْشِرُوْا فَإِنَّ مِنْ يَأْجُوْجَ وَمَأْجُوْجَ أَلْفًا وَمِنْكُمْ رَجُلٌ‏.‏ قَالَ ثُمَّ قَالَ‏ وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ إِنِّيْ لَأَطْمَعُ أَنْ تَكُوْنُوْا رُبُعَ أَهْلِ الْجَنَّةِ‏.‏ فَحَمِدْنَا اللهَ وَكَبَّرْنَا ثُمَّ قَالَ‏ وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ إِنِّيْ لَأَطْمَعُ أَنْ تَكُوْنُوْا ثُلُثَ أَهْلِ الْجَنَّةِ‏.‏ فَحَمِدْنَا اللهَ وَكَبَّرْنَا ثُمَّ قَالَ وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ إِنِّيْ لأَطْمَعُ أَنْ تَكُوْنُوْا شَطْرَ أَهْلِ الْجَنَّةِ إِنَّ مَثَلَكُمْ فِي الأُمَمِ كَمَثَلِ الشَّعْرَةِ الْبَيْضَاءِ فِيْ جِلْدِ الثَّوْرِ الأَسْوَدِ أَوْ كَالرَّقْمَةِ فِيْ ذِرَاعِ الْحِمَارِ.‏

আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, মহামহিমান্বিত আল্লাহ (ক্বিয়ামত দিবসে) আহ্বান করবেন, হে আদাম! তিনি উত্তরে বলবেন, আমি আপনার খিদমতে উপস্থিত, আপনার কাছে কল্যাণ কামনা করি কেননা সকল কল্যাণ আপনারই হাতে। মহান আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামী দলকে নিক্ষেপ করার জন্য বের কর। আদাম (আলাইহিস সালাম) জিজ্ঞেস করবেন, কী পরিমাণ জাহান্নামী দল বাহির করব? মহান আল্লাহ বলবেন, প্রতি হাজারে নয়শ’ নিরানব্বই জন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ এটা সেই মুহূর্ত যখন ক্বিয়ামতের ভয়াবহতায় বালক বৃদ্ধ হয়ে যাবে, সকল গর্ভবতী তাদের গর্ভপাত করে ফেলবে আর মানুষকে দেখবে মাতাল সাদৃশ্য যদিও তারা নেশাগ্রস্ত নয়, বস্তুত আল্লাহর আযাব বড়ই কঠিন। রাবী বলেন, কথাগুলো ছাহাবীগণের নিকট খুবই কঠিন মনে হল। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মধ্যে কে সেই মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি? তিনি বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। ইয়া’জূজ ও মা’জূজের সংখ্যা এক হাজার হলে তোমাদের সংখ্যা হবে একজন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, কসম ঐ সত্তার যাঁর হাতে আমার প্রাণ! অবশ্যই আমি আশা রাখি যে, তোমরা জান্নাতীদের এক চতুর্থাংশ হবে। ছাহাবীগণ বলেন, আমরা আল্লাহর প্রশংসা করলাম এবং ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিলাম। এরপর তিনি বললেন, শপথ ঐ সত্তার, যাঁর করতলে আমার প্রাণ! আমি আশা রাখি যে, তোমরা জান্নাতীদের এক-তৃতীয়াংশ হবে। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আমরা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উঠলাম। তিনি আবার বললেন, শপথ ঐ সত্তার, যাঁর হাতের মুঠোয় আমার প্রাণ! আমি অবশ্যই আশা রাখি যে, তোমরা জান্নাতীদের অর্ধেক হবে। অন্য সব উম্মাতের তুলনায় তোমাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে কাল ষাঁড়ের চামড়ায় একটি সাদা চুলের মত। অথবা সাদা দাগ, যা গাধার সামনের পায়ে হয়ে থাকে।[৪]

২- আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে ইয়া’জূজ-মা’জূজ

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তারপর সে (যুলকারনাইন) আরেক পথ অবলম্বন করল। চলতে চলতে সে যখন দুই পর্বত-প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে সে এমন এক সম্প্রদায়কে পেল, যারা তার কথা তেমন বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, ‘হে যুলকারনাইন! নিশ্চয় ইয়া’জূজ ও মা’জূজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে, আমরা কি আপনাকে রাজস্ব বা কর দেব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মাঝে এক প্রাচীর গড়ে দেবেন?’ সে বলল, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তাই উৎকৃষ্ট, সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দ্বারা সাহায্য কর, আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে এক সুদৃঢ় প্রাচীর গড়ে দেব। তোমরা আমার কাছে লোহার পাতসমূহ আনয়ন কর, ‘অবশেষে মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে যখন লৌহস্তূপ দুই পর্বতের সমান হল তখন সে বলল, ‘তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক’। অতঃপর যখন সেটা আগুনে পরিণত হল, তখন সে বলল, ‘তোমরা আমার কাছে গলিত তামা নিয়ে আস, আমি তা এর উপর ঢেলে দিই। এরপর তারা (ইয়া’জূজ ও মা’জূজ) প্রাচীরের উপর দিয়ে অতিক্রম করতেও পারল না এবং নিচ দিয়ে তা ভেদ করতেও পারল না। সে বলল, ‘এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, অতঃপর যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি এসে পড়বে তখন তিনি ওটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন। আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৯২-৯৮)। এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ যুলকারনাইনকে ইয়া’জূজ-মা’জূজের দলকে প্রতিহত করার জন্য বিশাল প্রাচীর নির্মাণের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। যাতে তারা মানুষের মাঝে এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে না পারে।

৩- যুল-কারনাইন কে ছিলেন?

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

هو ملك صالح كان على عهد الخليل إبراهيم عليه الصلاة والسلام، ويقال إنه طاف معه بالبيت ، فالله أعلم

‘তিনি ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আলাইহিস সালাম)-এর যুগের একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সঙ্গে বাইতুল্লাহর ত্বাওয়াফ করেছেন, এ ব্যাপারে আল্লাহই অধিক জ্ঞাত’।[৫] মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنۡ ذِی الۡقَرۡنَیۡنِ ؕ قُلۡ سَاَتۡلُوۡا  عَلَیۡکُمۡ  مِّنۡہُ  ذِکۡرًا

‘আর তারা আপনাকে যুল-কারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। বলুন, অচিরেই আমি তোমাদের কাছে তাঁর বিষয় বর্ণনা করব’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৮৩)। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘যুলকারনাইন নাবী বা ফিরিশতা ছিলেন না, তিনি একজন নেক বান্দা ছিলেন। তিনি আল্লাহকে ভালোবেসে ছিলেন, আল্লাহও তাঁকে ভালোবেসে ছিলেন। আল্লাহর হকের ব্যাপারে অতিশয় সাবধানী ছিলেন, আল্লাহও তার কল্যাণ চেয়েছেন। তাঁকে তাঁর জাতির কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। তারা তাঁর কপালে মারতে মারতে তাঁকে হত্যা করল। আল্লাহ তাঁকে আবার জীবিত করলেন, এজন্য তাঁর নাম হল যুলকারনাইন’।[৬]

ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা যুলকারনাইনের সততার প্রসংশা করেছেন। তিনি একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন এবং পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করেছিলেন। এসব দেশে তিনি সুবিচার ও ইনসাফের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাকে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বপ্রকার সাজ-সরঞ্জাম দান করা হয়েছিল। তিনি দিগি¦জয়ে বের হয়ে পৃথিবীর তিন প্রান্তে পৌঁছেছিলেন- পাশ্চাত্যের শেষ প্রান্তে, প্রাচ্যের শেষ প্রান্তে এবং উত্তরে উভয় পর্বতমালার পাদদেশ পর্যন্ত। এখানেই তিনি দুই পর্বতের মধ্যবতী গিরিপথকে একটি সুবিশাল লৌহ প্রাচীর দ্বারা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে ইয়া’জুজ-মা’জূজের লুটতরাজ থেকে এলাকার জনগণ নিরাপদ হয়ে যায়।[৭]

মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘চারজন ব্যক্তি গোটা বিশ্বের পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যদেশ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। দু’জন মুমিন আর দু’জন কাফির। মুমিন দু’জন হলেন সুলাইমান ইবনু দাঊদ (আলাইহিস সালাম) এবং যুলকারনাইন। আর কাফির দু’জন হল, নামরূদ ও বুখতুনাছ্ছারা।[৮]

৪- বর্তমানে ইয়া’জূজ-মা’জূজ কোথায় অবস্থান করছে?

এরা বর্তমানে যুল-কারনাইন বাদশা কতৃক নির্মিত প্রাচীরের ভিতরে অবস্থান করছে। এরা ভূগর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে মহা বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। ক্বিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে তারা দলে দলে মানব সমাজে প্রবেশ করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাবে। তাদেরকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করার মত তখন কোন শক্তি থাকবে না।

عَنْ زَيْنَبَ بِنْتِ جَحْشٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ اسْتَيْقَظَ مِنْ نَوْمِهِ وَهُوَ يَقُوْلُ‏ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوْجَ وَمَأْجُوْجَ مِثْلُ هَذِهِ‏. وَفِيْ رِوَايَةٍ وَحَلَّقَ بِإِصْبَعِهِ الْإِبْهَامِ وَالَّتِيْ تَلِيْهَا.‏ قَالَتْ فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَنَهْلِكُ وَفِيْنَا الصَّالِحُوْنَ قَالَ نَعَمْ إِذَا كَثُرَ الْخَبَثُ‏.‏

যাইনাব বিনতু জাহশ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। একদা নবী (ﷺ) ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় বললেন, ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ আরব বিশ্বে আগত অকল্যাণের দরুন বড়ই পরিতাপ যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। আজ ইয়া’জূজ-মা’জূজ এর দেয়াল এতটুকু পরিমাণ খুলে গেছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ সময় তিনি নিজ হাতের শাহাদাত ও বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা একত্র করে গোলাকার বানিয়ে দেখালেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মাঝে অনেক সৎ লোক থাকা অবস্থায়ও কি আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, যখন পাপাচার অধিক পরিমাণে বেড়ে যাবে।[৯]

৫- ইয়া’জূজ-মা’জূজকে কখন মুক্তি দেওয়া হবে?

বর্তমানে কিছু পথভ্রষ্ট, নামধারী, বিশৃঙ্খলাকারী বক্তা জনসম্মুখে প্রচার করছেন যে, ইয়া’জূজ-মা’জূজ লৌহ ও তাম্র দ্বারা নির্মিত প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ নেয়, বরং তারা মুক্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠের উপর বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। মূলত বর্তমান যুগের অত্যাচারী ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানরাই ইয়া’জূজ-মা’জূজ। তাদের এই ভ্রান্ত ধারণা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের স্পষ্ট বিরোধী।

কুরআনের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ক্বিয়ামতের পূর্বমুহূর্তে তারা মানব সমাজে প্রবেশ করে ব্যাপক অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। তবে নির্দিষ্টভাবে তাদের আগমণ হবে ঈসা (আলাইহিস সালাম) কতৃক দাজ্জালকে হত্যা করার পর। আখেরী জামানায় ক্বিয়ামতের পূর্বে লৌহ নির্মিত প্রাচীর ভেদ করে ইয়া’জূজ-মা’জূজের আগমন সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

حَتّٰۤی  اِذَا  فُتِحَتۡ یَاۡجُوۡجُ وَ مَاۡجُوۡجُ وَ ہُمۡ  مِّنۡ  کُلِّ  حَدَبٍ  یَّنۡسِلُوۡنَ- وَ اقۡتَرَبَ الۡوَعۡدُ الۡحَقُّ فَاِذَا ہِیَ شَاخِصَۃٌ  اَبۡصَارُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ؕ یٰوَیۡلَنَا قَدۡ کُنَّا فِیۡ غَفۡلَۃٍ  مِّنۡ  ہٰذَا بَلۡ کُنَّا ظٰلِمِیۡنَ

‘অবশেষে যখন ইয়া’জূজ ও মা’জূজকে মুক্তি দেয়া হবে, তখন তারা প্রতিটি উঁচু ভূমি হতে ছুটে আসবে। অমোঘ প্রতিশ্রুত কাল আসন্ন হলে আকস্মাৎ কাফিরদের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো এ বিষয়ে উদাসীন ছিলাম না, বরং আমরা ছিলাম সীমালংঘনকারী’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৯৬-৯৭)।

তাদের অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক বিস্তারিত ও বিশুদ্ধ হাদীছ হচ্ছে নাওয়াস ইবনু সাম‘আন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছটি। সেখানে দাজ্জালের ফিতনা ও বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে, ‘....অতঃপর ঈসা (আলাইহিস সালাম) ঐ সম্প্রদায়ের নিকট যাবেন, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দাজ্জালের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছেন। ঈসা (আলাইহিস সালাম) তাদের কাছে গিয়ে তাদের মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে জান্নাতে তাদের স্থানসমূহের ব্যাপারে অবগত করবেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর প্রতি এ মর্মে অহী অবতীর্ণ করবেন যে, আমি আমার এমন বান্দাদের আবির্ভাব ঘটাতে যাচ্ছি, যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারোই নেই। অতএব আপনি আমার মুমিন বান্দাদেরকে সমবেত করে তূর পাহাড়ে চলে যান (সে মতে তিনি তাই করবেন)। তখন আল্লাহ তা‘আলা ইয়া’জূজ- মা’জূজের রাস্তা উন্মুক্ত করে দেবেন। তারা মুক্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে এবং তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি হতে ছুটে আসবে‌। তাদের প্রথম দলটি ‘তাবারিয়্যা’ উপসাগরের (ভূমধ্যসাগর) উপকূল দিয়ে অতিক্রমকালে এর সমুদয় পানি পান করে নিঃশেষ করে দিবে। অতঃপর তাদের সর্বশেষ দলটি এ স্থান দিয়ে যাত্রাকালে বলবে, ‘এ সমুদ্রে কোন কালে পানি ছিল কি?’

তারা আল্লাহর নবী ঈসা (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর সাথীদেরকে তূর পর্বতে অবরোধ করে রাখবে। খাদ্যসামগ্রীর ঘাটতির ফলে তাদের নিকট একটি গরুর মস্তক বর্তমানে তোমাদের নিকট একশ’ দীনারের মূল্যের চেয়েও অধিক মূল্যবান বিবেচিত হবে। তখন আল্লাহর নবী ঈসা (আলাইহিস সালাম) এবং তার সঙ্গীগণ কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা ইয়া’জূজ-মা’জূজ সম্প্রদায়ের প্রতি মহামারী স্বরূপ ‘নাগাফ’ নামক এক প্রকারের পোকা পাঠাবেন। যা তাদের ঘাড়ে অবস্থান করবে। এতে তারা সকলেই মরে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারপর ঈসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সঙ্গীগণ পাহাড় হতে যমীনে অবতরণ করবেন। কিন্তু তাঁরা এক বিঘত জায়গাও এমন পাবেন না যথায় তাদের পচা লাশ ও লাশের দুর্গন্ধ নেই। অতঃপর ‘ঈসা (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর সঙ্গীগণ পুনরায় আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা উটের ঘাড়ের মত লম্বা বিরাটাকার এক ধরনের পাখি প্রেরণ করবেন। তারা তাদের লাশগুলোকে ঠোঁটে বহন করে আল্লাহর ইচ্ছানুসারে কোন এক স্থানে ফেলে আসব।

অতঃপর আল্লাহ এমন মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন যার ফলে কাঁচা-পাকা কোন গৃহই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এতে ভূপৃষ্ঠ বিধৌত হয়ে কাঁচের মত স্বচ্ছ উদ্ভিদ শূন্য মৃত্তিকায় পরিণত হবে। অতঃপর পুনরায় ভূপৃষ্ঠকে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হবে যে, হে ভূপৃষ্ঠ! তুমি আবার শস্য উৎপন্ন কর এবং তোমার বারাকাত ফিরিয়ে দাও। সেদিন একটি ডালিম একদল লোকের আহারের জন্য যথেষ্ট হবে এবং এর বাকলের নিচে লোকেরা ছায়া গ্রহণ করবে। দুধের মধ্যে এতই বারাকাত প্রদান করা হবে যে, দুগ্ধবতী একটি উটই একদল মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে, দুগ্ধবতী একটি গাভী একগোত্রীয় মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে, এবং দুগ্ধবতী একটি বকরী এক দাদার সন্তানদের (একটি পরিবারের) জন্য যথেষ্ট হবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত আরামদায়ক ও মনোরম একটি বায়ু প্রেরণ করবেন। এ বায়ু সকল মুমিন লোকদের বগলে গিয়ে লাগবে এবং সমস্ত মুমিন মুসলিমের রূহ কবয করে নিয়ে যাবে। তখন একমাত্র মন্দ লোকেরাই এ পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকবে। তারা গাধার ন্যায় পরস্পর একে অন্যের সাথে প্রকাশ্যে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে। এদের উপরই কিয়ামত সংঘটিত হবে।[১০] আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযীদের বর্ণনায় ইয়া’জূজ-মা’জূজ সম্পর্কে আরো অধিক বিবরণ পাওয়া যায়। যেখানে বলা হয়েছে,

‏لَقَدْ كَانَ بِهَذِهِ مَرَّةً مَاءٌ ثُمَّ يَسِيرُوْنَ حَتَّى يَنْتَهُوْا إِلَى جَبَلِ الْخَمَرِ وَهُوَ جَبَلُ بَيْتِ الْمَقْدِسِ فَيَقُوْلُوْنَ لَقَدْ قَتَلْنَا مَنْ فِي الْأَرْضِ هَلُمَّ فَلْنَقْتُلْ مَنْ فِي السَّمَاءِ‏.‏ فَيَرْمُوْنَ بِنُشَّابِهِمْ إِلَى السَّمَاءِ فَيَرُدُّ اللهُ عَلَيْهِمْ نُشَّابَهُمْ مَخْضُوْبَةً دَمًا‏.‏ وَفِيْ رِوَايَةِ ابْنِ حُجْرٍ‏ فَإِنِّيْ قَدْ أَنْزَلْتُ عِبَادًا لِيْ لَا يَدَىْ لِأَحَدٍ بِقِتَالِهِمْ‏.‏

‘এখানেও এক সময় পানি ছিল’, এ কথার পর বর্ধিত এ কথাও উল্লেখ রয়েছে যে, এরপর তারা অগ্রসর হতে থাকবে। পরিশেষে তারা ‘জাবালে খামার’ নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছবে। এটা হল- ‘বাইতুল মাক্বদিসের একটি পর্বত’। এখানে পৌঁছে তারা বলবে, ‘আমরা তো পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীকে হত্যা করেছি। এসো, এখন আমরা আকাশের অধিবাসীদের নিঃশেষ করি। এ বলেই তারা আকাশের দিকে তীর ছুঁড়তে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের তীরগুলো রক্তে রঞ্জিত করে তাদের প্রতি আবার ফিরিয়ে দিবেন’। বর্ণনাকারী ইবনু হুজুরের বর্ণনায় এ কথাও বর্ধিত আছে যে, ‘আল্লাহ বলবেন, আমি আমার এমন বান্দাদের আবির্ভাব ঘটিয়েছি, যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি কারো নেই’।[১১]

আবূ হুরায়রাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয় ইয়া’জূজ-মা’জূজ প্রতিদিন সুড়ঙ্গ পথ খনন করতে থাকে। এমনকি যখন তারা সূর্যের আলোকরশ্মি দেখার মত অবস্থায় পৌঁছে যায় তখন তাদের নেতা বলে, আজ ফিরে চলো, আগামী কাল এসে আমরা খনন কাজ সমাপ্ত করব। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা (রাতের মধ্যে) সেই প্রাচীরকে পূর্বের তুলনায় আরো অধিক মজবুত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন। তারা প্রতিদিন এভাবে এই প্রাচীর খুঁড়তে থাকে। অতঃপর যখন তাদের বন্দীত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে আবির্ভাবের সময় হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মানবকুলের মধ্যে পাঠানোর ইচ্ছা করবেন, তখন তারা খনন কাজ করতে থাকবে। পরিশেষে যখন তারা সূর্যরশ্মি দেখার মত অবস্থায় পৌঁছবে তখন ইয়া’জূজ-মা’জূজের সরদার বলবে, 'আজ চলো ‘ইনশাআল্লাহ’ আল্লাহ তা‘আলা চাইলে আগামীকাল সকালে আমরা খনন কাজ সমাপ্ত করে এই দেয়াল ভেঙ্গে ফেলব’। সে তার কথার সাথে ইনশাআল্লাহ বলবে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, সুতরাং তারা ফিরে যাবে। তারা গতকাল দেয়ালটিকে যে অবস্থায় ছেড়ে গিয়েছিল, এবার ফিরে এসে দেখবে যে, ঠিক সেই অবস্থায়ই আছে। অতঃপর তারা অবশিষ্ট খনন কাজ সম্পূর্ণ করে দেয়াল ভেদ করে জনপদে ছড়িয়ে পড়বে এবং সমস্ত পানি পান করে শেষ করে ফেলবে। মানুষজন এদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করবে। এরা আকাশের দিকে লক্ষ্য করে নিজেদের তীর ছুঁড়বে। তাদের তীরগুলোকে রক্ত-রঞ্জিত করে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এরা বলবে, পৃথিবীবাসীর উপর আমরা প্রতিশোধ নিয়েছি এবং আকাশবাসীর উপরও আধিপত্য বিস্তার করে তাদেরকে অধীনস্ত করে নিয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা এদের গলদেশে কীট-পতঙ্গ সৃষ্টি করবেন। ফলে এরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! যমীনের কীট-পতঙ্গ ও জীব-জন্তু এদের মাংস খেয়ে খুব মোটাতাজা হবে, খুব পরিতৃপ্ত হবে এবং এগুলোর দেহে বেশ চর্বি জমবে।[১২]

৬- ইয়া’জূজ-মা’জূজ কি কোন নবীর অনুসরণ করতে পেরেছে?

শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ ঃ বলেন, ‘কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীলগুলো স্পষ্ট প্রমাণিত করে যে, আল্লাহ তা‘আলা কোন ব্যক্তির উপরে হুজ্জাত তথা দলীল বা প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা তার কাছে দ্বীনের দাওয়াত না পৌঁছানো পর্যন্ত তাকে আযাব দেবেন না। এটিই আল্লাহ্ তা‘আলার হিকমাহ বা মহাপ্রজ্ঞা। যেমন তিনি বলেন, ‘আমি সুসংবাদবাহী ও সতর্ককারী রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূল আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। আর আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী’ (সূরা আন-নিসা : ১৬৫)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আর আমি রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দিই না’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১৫)। তিনি আরো বলেন, ‘যখনই জাহান্নামে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তখনই তাদেরকে তার রক্ষীরা জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি?’ তারা বলবে, ‘অবশ্যই আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, কিন্তু আমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী গণ্য করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি, তোমরা তো মহা বিভ্রান্তিতে রয়েছ’ (সূরা আল-মুলক : ৮-৯)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘কাফিরদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন ওরা জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হবে, তখন তার দরজা খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা ওদেরকে বলবে, ‘তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য হতে রাসূল আসেনি, যারা তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের আয়াত আবৃত্তি করত এবং এ দিনের সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তোমাদেরকে সতর্ক করত?’ ওরা বলবে, ‘অবশ্যই এসেছিল, কিন্তু কাফিরদের প্রতি শাস্তির বাক্য বাস্তবায়িত হয়েছে’ (সূরা আয-যুমার : ৭১)।

মোট কথা, আরো বহু আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা রাসূল প্রেরণ না করে কাউকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন না। ইয়া’জূজ-মা’জূজ জাতির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি বা হবে না। তাদের কাছেও কোন না কোন নাবী অবশ্যই প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জাতির নিকট নবী পাঠিয়েছেন। সমস্যা হল সব নবীর নাম জানা যায় না।[১৩] ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা সূক্ষ্ম ও ন্যায় বিচারক’ এই বিশ্বাস রেখে, যাদের কাছে কোন নবীর আগমন ঘটেনি তাদের অবস্থান কোথায় হবে? এ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির চিন্তা করা উচিত, তার নিজের কাছে তো নবীর দাওয়াত পৌঁছে গেছে, এখন তার অবস্থা কী হবে? কার কাছে, কবে, কিভাবে এবং কী পরিমাণ আল্লাহর বাণী পৌঁছেছে? তার সাথে কী আচরণ করা হবে? তা আল্লাহই ভাল জানেন’।[১৪] সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘কার উপর আল্লাহর প্রমাণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কার উপর হয়নি।

এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা হল- মুশরিকদের নাবালক বাচ্চাদের নিয়ে। তাদের কী হুকুম হবে? এ ব্যাপারে স্পষ্ট কথা হলো এই যে, মুমিনদের সন্তানগণ জান্নাতী হবে। কিন্তু কাফির, মুশরিকদের সন্তানদের ব্যাপারে আলিমগণ বিভিন্ন হাদীছের কারণে সর্বমোট চারটি মতে বিভক্ত হয়েছে। যথা: ১- তারা জান্নাতে যাবে।[১৫] ২- তাদের সম্পর্কে কোন কিছু বলা যাবে না।[১৬] ৩- তারা তাদের পিতাদের অনুগমন করবে।[১৭] ৪- তাদেরকে হাশরের মাঠে পরীক্ষা করা হবে। সে পরীক্ষায় যারা পাশ করবে তারা হবে জান্নাতী। আর পাশ না করলে হবে জাহান্নামী। আর এ মতটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত।[১৮] সত্যাম্বেষী আলিমগণ এ মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।[১৯]

শেষ বিচারের দিনে কাফির, মুশরিকরা যেন, অজুহাত উত্থাপন করতে না পারে যে, হে আল্লাহ! কোন কাজে আপনি সন্তুষ্ট আর কোন কাজে আপনি অসন্তুষ্ট হন, তা আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি। জানতে পারলে অবশ্যই আমরা আপনার সন্তুষ্টির পথ অবলম্বন করতাম। পথভ্রষ্ট লোকেরা যাতে এহেন অজুহাত পেশ করতে বা বাহানার আশ্রয় নিতে না পারে, তজ্জন্য আল্লাহ্ তা'আলা স্পষ্ট নিদর্শনসহ নাবীগণকে প্রেরণ করেছেন এবং তারা সর্বস্ব উৎসর্গ করে সত্য পথ প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহর অহী এমন এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ যার মোকাবেলায় অন্য কোন প্রমাণই কার্যকর হতে পারে না। ক্বুরআনুল কারীম এমন এক অকাট্য দলীল যার সামনে কোন অযুক্তি টিকতে পারে না। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, ‘যদি আমি ওদেরকে তাঁর (অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর) পূর্বে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম তাহলে ওরা বলত,  ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করলেন না কেন? করলে আমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার পূর্বেই আপনার নিদর্শন মেনে নিতাম’ (সূরা ত্বো-হা : ১৩৪)। সুতরাং কাল ক্বিয়ামতের মাঠে কেউ আল্লাহর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নিয়ে উঠতে পারবে না যে, আল্লাহ তাদেরকে কোন সুযোগ দেননি, কিংবা তাদের কাছে কোন নবী প্রেরণ করেননি।[২০]

*মুর্শিদাবাদ, ভারত।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯০১ ‘কিতাবুল ফিতান’; আবূ দাঊদ, হা/৪৩১১; তিরমিযী, হা/২১৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৮৭৮।
[২]. আল-মাসাইলুল মানছুরাহ, ফাতাওয়া ইমাম নাবাবী, পৃ. ১১৬-১১৭।
[৩]. ফাৎহুল বারী, ১৩শ খণ্ড, পৃ. ১০৭।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৪৮, ৪৭৪১,৬৫৩০; ছহীহ মুসলিম, হা/২২২; মুসনাদ আহমাদ, হা/ ১১২৮৪।
[৫]. ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ র্দাব ইবনে উছাইমীন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬০।
[৬]. ফাৎহুল বারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৮৩, সনদ ছহীহ।
[৭]. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২২-১২৫।
[৮]. তাফসীর আত্ব-ত্বাবারী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৩৩।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৪৬, ৩৫৯৮, ৭০৫৯, ৭১৩৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৮০, ২৮৮১; তিরমিযী, হা/২১৮৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৫৩।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৭ ‘কিতাবুল ফিতান’;  তিরমিযী, হা/২২৪০; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৬২৯।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৭ ‘কিতাবুল ফিতান’।
[১২]. তিরমিযী, হা/৩১৫৩; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৮০; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৭৩৫৮।
[১৩]. আযওয়াউল বায়ান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৫।
[১৪]. ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২১৩৭৯৭।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৪০৪৭; মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৫৮।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮৩১, ৪৮৩১।
[১৭]. মুসনাদে আহমদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪৮।
[১৮]. মুসনাদে আহমাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৪।
[১৯]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, সূরাহ্ বাণী ইসরাঈলের ১৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা।
[২০]. ফাতাওয়া আল-লাজনাতুদ্ দায়িমাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৫-১৪৬।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ সৃষ্টিজগৎ
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ফাযায়েলে কুরআন (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
শিক্ষাদানে নববী পদ্ধতি ও কৌশল - হাসিবুর রহমান বুখারী
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৮তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সুন্নাতের রূপরেখা - মাইনুল ইসলাম মঈন
বাউল মতবাদ (শেষ কিস্তি) - গোলাম রহমান
মূর্তিপূজার ইতিহাস - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী

ফেসবুক পেজ