মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৬:৫৭ পূর্বাহ্ন

জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল-কুরআনের মূল্যায়ন

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


জীবন বলতে মানব জীবনের সার্বিক ক্ষেত্র তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনেতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আন্তর্জাতিক ও আধ্যাত্মিক সহ সামগ্রিক ক্ষেত্রকে বুঝায়। উক্ত ক্ষেত্রগুলো সুন্দর, সহজ এবং শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণভাবে পরিচালনা করার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাকে জীবন ব্যবস্থা বলা হয়। আর পরিপূর্ণ ও চিরস্থায়ী জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা। যেখানে মানব জীবনের সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান পেশ করা হয়েছে।

মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম প্রচলিত কোন ধর্মের নাম নয়। বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থা। কেননা সৃষ্টিকর্তা হিসাবে বান্দার কোন্ বিধানে কল্যাণ ও মুক্তি রয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার পক্ষেই অবগত হওয়া সম্ভব এই কারণে যে, তিনিই বিশ্বজাহানের একমাত্র ও একচ্ছত্র প্রভু ও মালিক। তাই সর্বত্র কল্যাণ ও শান্তির জন্য ইসলামের চূড়ান্ত সংবিধান ও জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনের মত জগদ্বিখ্যাত নির্ভুল গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন। যেখানে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানবতার প্রয়োজনীয় সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যার পরিপূর্ণতা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশাতেই লাভ করেছে। যাতে মানুষের সার্বিক জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সবকিছুরই পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَا فَرَّطۡنَا فِی الۡکِتٰبِ مِنۡ شَیۡءٍ ‘আমরা এই কিতাবে (কুরআনে) কোন বিষয়ই লিপিবদ্ধ করতে ছাড়িনি’ (সূরা আল-আন‘আম : ৩৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَ نَزَّلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ تِبۡیَانًا  لِّکُلِّ شَیۡءٍ ‘আর আমরা আপনার উপরে প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছি’ (সূরা আন-নাহল : ৮৯)। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,لَوْ ضَاعَ لِيْ عِقَالُ بَعِيْرٍ لَوَجَدْتُهُ فِيْ كِتَابِ اللهِ ‘আমার উট বাঁধার একটি দড়িও যদি হারিয়ে যায়, তাহলে আমি তা আল্লাহর কিতাবের মধ্যে খুঁজে পাব’।[১] আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, قد بين لنا في هذا القرآن كل علم، وكل شيء ‘এই কুরআনে প্রত্যেক ইলম ও সকল কিছুর বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে’।[২] তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণভাবে আল-কুরআনে সবকিছুরই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নিশ্চয় আল-কুরআনে পূর্ববর্তী ও ভবিষ্যতের সকল উপকারী ইলম সম্পর্কে সংবাদ রয়েছে। প্রত্যেক হালাল ও হারামের বিধান সম্পর্কেও আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়া মানুষের দুনিয়াবী, দ্বীনি, জীবনপদ্ধতি ও পরকাল সম্পর্কে সকল প্রয়োজনীয় বিষয়ের পূর্ণ আলোচনা আল-কুরআনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে’।[৩] প্রখ্যাত তাবেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, كل حلال وحرام ‘প্রত্যেক হালাল ও হারাম সম্পর্কে’।[৪] আল্লামা সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, في أصول الدين وفروعه، وفي أحكام الدارين وكل ما يحتاج إليه العباد ‘দ্বীনের মূল ও শাখাসমূহের নীতিমালাসমূহ, দুনিয়া ও আখিরাতের বিধি-বিধানসমূহ এবং বান্দার প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে আল-কুরআনে আলোচনা করা হয়েছে’।[৫]

অতএব আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে বিশ্ব মানবতার জন্য পূর্ণাঙ্গ  জীবন  বিধান  হিসাবে প্রেরণ করেছেন এবং তাকে বাস্তবে রূপদান করার দায়িত্ব দিয়ে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে প্রেরণ করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত উক্ত দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে বাস্তবায়নও করেছেন। এক্ষেত্রে সামান্যতম ত্রুটিও করেননি। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

مَا تَرَكْتُ شَيْئًا مِمَّا أَمَرَكُمُ اللهُ بِهِ إِلَّا وَقَدْ أَمَرْتُكُمْ بِهِ وَلَا تَرَكْتُ شَيْئًا مِمَّا نَهَاكُمُ اللهُ عَنْهُ إِلَّا وَقَدْ نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ.

‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন এমন কোন জিনিসই আমি (বর্ণনা করতে) ছাড়িনি। আর আমি তার হুকুম তোমাদেরকে অবশ্যই দিয়েছি। আর আমি এমন কোন জিনিসই ছাড়িনি যা আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছেন। কিন্তু আমি তোমাদেরকে তা অবশ্যই নিষেধ করেছি’।[৬]

আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের যাবতীয় নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা হিসাবে আল-কুরআনকে অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَنۡزَلۡنَاۤ  اِلَیۡکَ الذِّکۡرَ  لِتُبَیِّنَ  لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ  اِلَیۡہِمۡ  ‘আমরা আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে পরস্পরভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল’ (সূরা আন-নাহল : ৪৪)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَاۤ  اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ  فَخُذُوۡہُ ٭ وَ مَا نَہٰىکُمۡ  عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا  ‘রাসূল (ﷺ) তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক’ (সূরা আল-হাশর : ৭)।

জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল-কুরআনের গুরুত্ব সকলের শীর্ষে। কেননা আল-কুরআন হল চূড়ান্ত জীবন ব্যবস্থা। এটি দেশ ও রাষ্ট্রের চিরস্থায়ী সংবিধান। কুরআনের বিধান মানুষের জন্য ন্যায়পূর্ণ বিধান। সকল স্থান, যুগ ও পরিবেশের জন্য কুরআনের বিধান চিরন্তন বিধান। এ বিধান মান্য করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক। মানুষের ঈমান-আক্বীদা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক, কুটনৈতিক, আন্তর্জাতিক প্রভৃতি সহ মানব জাতির ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনের প্রয়োজনীয় সকল আইন ও নীতিমালা এই কুরআনে অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যা লঙ্ঘন করা মহা অপরাধ হিসাবে গণ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

کَانَ النَّاسُ اُمَّۃً  وَّاحِدَۃً ۟ فَبَعَثَ اللّٰہُ النَّبِیّٖنَ مُبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ  ۪ وَ اَنۡزَلَ مَعَہُمُ  الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَ النَّاسِ فِیۡمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡہِ

‘সকল মানুষ একই উম্মত ছিল। অতঃপর আল্লাহ‌ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন। মানুষরা যে বিষয়ে মতভেদ করত তাদের মধ্যে সে বিষয়ে মীমাংসার জন্য তিনি তাদের সঙ্গে সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৩)।

মানব জীবনের প্রয়োজনীয় সকল দিক-নির্দেশনা আল-কুরআনে বিদ্যমান রয়েছে। সালাফগণ আমাদের সামনে কুরআন-সুন্নাহ গবেষণা করে মানব জাতির জীবন-যাপন পদ্ধতির পরিপূর্ণ সমাধান তুলে ধরেছেন। সুতরাং জীবন ব্যবস্থা হিসাবে কুরআনের এই সর্বজনীনতার ব্যাপারে কোন অপূর্ণতার কথা চিন্তাই করা যায় না। যা প্রকৃতপক্ষেই পরিপূর্ণ এবং অতুলনীয়। সুন্দর ও কল্যাণকর। এতে নতুনভাবে কোন কিছুর সংযোজন বা বিয়োজন করার কোন অবকাশ নেই। কুরআনী সংবিধান অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয়। যা পরিবর্তন করা অধিকার কারো দেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে যারাই এ জীবন ব্যবস্থার নির্ধারিত নীতিমালা পরিপন্থী পথ ও পদ্ধতির অনুসরণ করবে তারা সঠিক পথ থেকে পথভ্রষ্ট হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَفَغَیۡرَاللّٰہِ اَبۡتَغِیۡ حَکَمًا وَّ ہُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ  اِلَیۡکُمُ الۡکِتٰبَ مُفَصَّلًا ؕ وَ الَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰہُمُ الۡکِتٰبَ یَعۡلَمُوۡنَ اَنَّہٗ مُنَزَّلٌ مِّنۡ رَّبِّکَ بِالۡحَقِّ فَلَا تَکُوۡنَنَّ  مِنَ الۡمُمۡتَرِیۡنَ- وَ تَمَّتۡ  کَلِمَتُ رَبِّکَ صِدۡقًا وَّ عَدۡلًا ؕ لَا مُبَدِّلَ لِکَلِمٰتِہٖ ۚ وَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ- وَ اِنۡ تُطِعۡ  اَکۡثَرَ مَنۡ  فِی الۡاَرۡضِ یُضِلُّوۡکَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ اِنۡ یَّتَّبِعُوۡنَ اِلَّا الظَّنَّ  وَ اِنۡ  ہُمۡ  اِلَّا یَخۡرُصُوۡنَ- اِنَّ  رَبَّکَ ہُوَ اَعۡلَمُ مَنۡ یَّضِلُّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ۚ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ

‘(হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন) তবে কি আমি আল্লাহকে বর্জন করে অন্য কাউকে মীমাংসাকারী ও বিচারকরূপে অনুসন্ধান করব? অথচ তিনিই তোমাদের কাছে এই কিতাবকে বিস্তারিতভাবে অবতীর্ণ করেছেন, আর আমি যাদেরকে কিতাব দান করেছি তারা জানে যে, এ কিতাব আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতেই যথার্থ ও সঠিকভাবে অবতীর্ণ করা হয়েছে, সুতরাং আপনি সন্দেহ পোষণকারীদের মধ্যে শামিল হবেন না। আপনার প্রতিপালকের বাণী সত্যতা ও ইনসাফের দিক দিয়ে পূর্ণতা লাভ করেছে, তাঁর বাণী পরিবর্তনকারী কেউই নেই, তিনি সবকিছু শুনেন ও সবকিছু জানেন। (হে নবী (ﷺ))! আপনি যদি দুনিয়াবাসীদের অধিকাংশ লোকের কথার অনুসরণ করেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ হতে বিভ্রান্ত করে ফেলবে, তারা তো নিছক ধারণা ও অনুমানেরই অনুসরণ করে, আর তারা ধারণা ও অনুমান ছাড়া কিছুই করছে না। কোন ব্যক্তি আল্লাহর পথ হতে বিভ্রান্ত হয়েছে তা আপনার প্রতিপালক নিশ্চিতভাবে অবগত আছেন, আর তিনি হেদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কেও খুব ভালভাবে জ্ঞাত আছেন’ (সূরা আল-আন‘আম : ১১৪-১১৭)।  অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ مُہَیۡمِنًا عَلَیۡہِ فَاحۡکُمۡ  بَیۡنَہُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ وَ لَا تَتَّبِعۡ اَہۡوَآءَہُمۡ عَمَّا جَآءَکَ مِنَ الۡحَقِّ لِکُلٍّ جَعَلۡنَا مِنۡکُمۡ شِرۡعَۃً وَّ مِنۡہَاجًا

‘আর আমরা এ কিতাবকে আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যা হকের সাথে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেরও সত্যতা প্রমাণকারী এবং ঐ কিতাবসমূহের সংরক্ষকও। অতএব আপনি তাদের পারস্পরিক বিষয়ে আল্লাহর নাযিলকৃত এই কিতাব অনুযায়ী মীমাংসা করুন। এটা পরিত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী কাজ করবেন না। তোমাদের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আমরা নির্দিষ্ট শরী‘আত এবং নির্দিষ্ট পন্থা নির্ধারণ করেছি’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৮)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ثُمَّ جَعَلۡنٰکَ عَلٰی شَرِیۡعَۃٍ  مِّنَ الۡاَمۡرِ فَاتَّبِعۡہَا وَ لَا تَتَّبِعۡ  اَہۡوَآءَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ

‘এরপর আমরা আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ শরী‘আতের উপর। সুতরাং আপনি তার অনুসরণ করুন, মূর্খদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না’ (সূরা আল-জাছিয়াহ : ১৮)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী (১৩০৭-১৩৭৬ হি.) বলেন, ‘আপনার জন্য আমি পূর্ণাঙ্গ শরী‘আত প্রদান করেছি, যাতে করে আপনি প্রত্যেক কল্যাণকর কাজে আহ্বান করতে পারেন এবং প্রত্যেক মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতে পারেন। সুতরাং আপনি তাই অনুসরণ করুন। কেননা এটা সৌভাগ্য, সংস্কার ও সফলতার মানদ-। সাথে কোন জ্ঞানহীন প্রবৃত্তিপূজারীদের অনুসরণ করবেন না’।[৭]

অতএব উক্ত আয়াতগুলো থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হওয়া এই আল-কুরআন মানব জাতির প্রয়োজনীয় সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেছে। এ ব্যাপারে কোন সংশয় প্রকাশ করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। কেননা আল্লাহর বাণী সত্য ও ইনসাফে পরিপূর্ণ, যা পরিবর্তন করার অধিকার কারো নেই। অতএব দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষের মনগড়া বিধানের আলোকে পরিচালিত হওয়া যাবে না। কোন জাতি, কোন গোত্র কিংবা কোন রাষ্ট্র যদি আল-কুরআনের চূড়ান্ত সংবিধানের ব্যতীত অন্য কোন বিধানের আলোকে পরিচালিত হয় তাহলে নিঃসন্দেহে তা ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে।

ইসলাম ইবাদত ও মু‘আমালাত তথা জাগতিক কার্যক্রমের মাঝে সমন্বিত একটি দ্বীন। মুসলিমদের সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন, প্রশাসনিক কার্যক্রম ও রাজনৈতিক কর্মকা- সহ জাগতিক বিষয়গুলো সম্পর্কেও ইসলামে পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল-কুরআন তথা ইসলাম যে চূড়ান্ত মানদ- এ বিষয়ে দু’টি মূলনীতি রয়েছে। যথা :

(ক) একটি হল ‘ইবাদতে তাওকীফী’ তথা কুরআন-সুন্নাহর অলংঘনীয় দলীল, যা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো নেই। আর যা শরী‘আতসিদ্ধ নয় তা বিদ‘আত হিসাবে প্রত্যাখ্যাত।[৮] যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ প্রভৃতি। শরী‘আতে এগুলোর ব্যাপারে যে বিধানগুলো আরোপ করা হয়েছে সেগুলো সর্বদা অপরিবর্তনশীল। যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই গ্রহণ করতে হবে।

(খ) ‘ইবাদতে মু‘আমালা’ বা বৈষয়িক জীবনে পালনীয় ঐচ্ছিক ‘ইবাদত। সেগুলো হল- বৈষয়িক জীবনে ইচ্ছামাফিক যেকোন কাজ করা। যেমন, ডাক্তারী, শ্রমজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষক, শিক্ষক ইত্যাদি। তবে এগুলো পালনের জন্য শরী‘আত বান্দাকে সুনির্দিষ্ট মূলনীতি দিয়েছে, যার অনুসরণ করা আবশ্যক। ইসলামে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কৃত ‘ইবাদতের যেমন নীতিমালা রয়েছে, তেমনি মু‘আমালা বা ঐচ্ছিক দুনিয়াবী কাজের ব্যাপারেও ইসলামের সুস্পষ্ট নীতিমালা বিদ্যমান। নিম্নে কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হল :

সামাজিক ব্যবস্থা : জীব হিসাবে মানুষকে জানতে হবে যে, শান্তিপূর্ণ সমাজ কাঠামো বিনির্মাণে ইসলামের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রয়েছে। যেমন, ১. সকল মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, যদিও নিকটাত্মীয় হয় (সূরা আল-মায়িদাহ : ৮; সূরা আন-নিসা : ১৩৫)। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে এক বৈপ্লবিক ও আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হন।[৯] ২. প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান ও দয়া প্রদর্শন করা (সূরা আল-ফুরকান : ৬৩)। আবূ উমামা আল-বাহেলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন দেখলেন, খারেজী মতাদর্শের প্রায় সত্তরজন লোককে মৃত্যুদ- দিয়ে তাদের মাথা দামেস্কের মসজিদের সম্মুখে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তখন তিনি বললেন, শয়তান এদেরকে কোথায় নিয়ে গেল! এরপর তিনি কাঁদলেন। তখন লোকেরা বলল, আপনি এদের মত মানুষের জন্য কাঁদছেন? তখন তিনি বললেন, ‘কেন কাঁদব না? তারাতো আগে ইসলামের অনুসারী ছিল’।[১০] ৩. সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজের নিষেধ করা : এটি ইসলামী দা‘ওয়াতের মৌলিক স্তম্ভ এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য (সূরা আলি ‘ইমরান : ১০৪)। ৪. জবাবদিহিতা : রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষ দায়িত্বশীল। সুতরাং তার সেই দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে’।[১১] ৬. আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা : রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ঈমানের অধিকতর নিরাপদ বন্ধন হল আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা’।[১২]

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : প্রত্যেক মুসলিমকে ইসলামের অনুশাসন মেনে অর্থনৈতিক কারবার করার প্রতি নির্দেশনা প্রদান করেছে। বৃহত্তর, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যবসার ক্ষেত্রেও মানুষকে সর্বদা ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতির উপর পরিচালিত হতে হবে। এমনকি একজন ব্যক্তি বিশেষও ইসলামের বিধানাবলী মেনেই তার আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করবে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমকে এক্ষেত্রে ইসলামের দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। সাধারণ মূলনীতিগুলো হল যথাক্রমে- হালাল মালের ব্যবসা করা[১৩], যাবতীয় সূদী লেনদেন থেকে বিরত থাকা[১৪], ঘুষ ও প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া[১৫] এবং মূল্য বৃদ্ধির জন্য কোন মাল মওজূদ না রাখা ইত্যাদি।[১৬]

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা : রাষ্ট্রীয় পরিম-লেও ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা। সংশ্লিষ্ট সকলকে সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব পালনের কার্যাবলী তিন ভাগে বিভক্ত। যথা : আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ।[১৭] ইসলামে আইনদাতা হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা (সূরাহ আল-আন‘আম : ৫৭)।[১৮] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اَفَحُکۡمَ الۡجَاہِلِیَّۃِ یَبۡغُوۡنَ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰہِ حُکۡمًا لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ  ‘তারা কি জাহিলিয়াতের আইন চায়? বিশ্বাসীগণের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম হুকুমদাতা আর কে হতে পারে?’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৫০)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, إِنَّ اللهَ هُوَ الْحَكَمُ وَإِلَيْهِ الْحُكْمُ ‘আল্লাহই হলেন আইনদাতা, আর তাঁর নিকট থেকেই আইন নিতে হবে’।[১৯] আর সে আইন কেবল আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মধ্যেই মওজুদ রয়েছে। তাই আইনসভার দায়িত্ব হল আল-কুরআন ও সুন্নাহ কর্তৃক অনুমোদিত আইনই কেবল পাশ করা এবং মানব রচিত কোন আইন পাশ না করা।

আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নির্দেশিত আইন মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক ও ব্যবহারিক জীবনে বাস্তবায়ন করা নির্বাহী বিভাগের কাজ। এক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বশীলবৃন্দ যেমন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সচিব, টিএনও, ডিসি, এসপি ইত্যাদি সকলকে যেমন জনগণের সেবক হতে হবে, তেমনি আল্লাহর আইন জারি ও যথাযথভাবে কার্যকরকরণে কোনরূপ অনীহা, উপেক্ষা, দুর্বলতা ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না। এজন্য প্রশাসন বিভাগকে অত্যন্ত শক্তিশালী, সাহসী ও দৃঢ় হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَقَدۡ  اَرۡسَلۡنَا  رُسُلَنَا بِالۡبَیِّنٰتِ وَ اَنۡزَلۡنَا مَعَہُمُ  الۡکِتٰبَ وَ الۡمِیۡزَانَ لِیَقُوۡمَ النَّاسُ بِالۡقِسۡطِ  وَ اَنۡزَلۡنَا الۡحَدِیۡدَ فِیۡہِ بَاۡسٌ شَدِیۡدٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَ لِیَعۡلَمَ اللّٰہُ  مَنۡ یَّنۡصُرُہٗ وَ رُسُلَہٗ  بِالۡغَیۡبِ  اِنَّ اللّٰہَ  قَوِیٌّ عَزِیۡزٌ

‘নিশ্চয় আমরা আমার রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়-নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি লৌহও দিয়েছি, যাতে রয়েছে প্রচ- শক্তি ও রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ; এটা এই জন্য যে, আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন কে প্রত্যক্ষ না করেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলদেরকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী’ (সূরাহ আল-হাদীদ : ২৫)। উক্ত আয়াতে ‘আল-হাদীদ’ বা লৌহ বলে প্রশাসনিক শক্তিকে বুঝানো হয়েছে।[২০] এমনকি কোনপ্রকার নমনীয়তা, দুর্বলতা কিংবা দয়া-সহানুভূতি প্রদর্শন করাও যাবে না (সূরাহ আন-নূর : ২)।

আল্লাহর আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ (ﷺ) ছিলেন কর্মদক্ষতার মূর্ত প্রতীক। এক্ষেত্রে তিনি যেমন কোনরূপ দুর্বলতা দেখাননি, তেমনি কোনরূপ সুপারিশ গ্রহণ করাকেও বরদাশত করেননি।[২১] রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং সর্বত্র আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগই পালন করবে। অনুরূপভাবে এ বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তি দেশের আইনশৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন এবং আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন। মানুষের উপর প্রভুত্ব কায়েম করবেন না। মানুষের উপর কোন রকম যুলুম বা অত্যাচার করবেন না। নিজের মনগড়া বিধান জনগণের উপর চাপিয়ে দিবেন না। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কাউকে ব্যবহারও করবেন না। বরং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে তাকে সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, لَاطَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِىْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা করে সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই’।[২২] এক্ষেত্রে আল্লাহভীতি যরূরী ভূমিকা পালন করবে। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,

إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَعَدَلَ كَانَ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرٌ وَإِنْ يَأْمُرْ بِغَيْرِهِ كَانَ عَلَيْهِ مِنْهُ

‘ইমাম বা শাসক ঢালস্বরূপ। তার নেতৃত্বে যুদ্ধ করা হয় এবং শত্রুর ক্ষতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। সে যদি তাক্বওয়া ও ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করে, তবে তার জন্য সে পুরস্কৃত হবে। আর যদি ন্যায় ব্যতীত অন্য কিছু আদেশ করে তবে সে পাপের জন্য দায়ী হবে’।[২৩] এজন্যই তো তাদের মর্যাদাও অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় একদিন পাহারা দেয়া, সমস্ত দুনিয়া ও তার উপরের যাবতীয় সম্পদ হতে উত্তম’।[২৪] এজন্য প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে ধার্মিক, জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও নেতৃত্বদানে দক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচন করা উচিত।

স্বাধীন বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। এজন্য আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশিদুনের যুগে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। মূলত সে যুগগুলোতে প্রয়োগকৃত বিচারব্যবস্থাই হল ইসলামী বিচার ব্যবস্থা। ইসলামী বিচার বিভাগের বৈশিষ্ট্য দু’টি। যথা : (ক) রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আল-কুরআন ও সুন্নাহকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেনে চলা এবং (খ) একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি প্রণয়ন করা, যার সাহায্যে রাষ্ট্রের নতুন ও বিচিত্র পরিস্থিতিতে ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয়।[২৫]

আর বিচার ব্যবস্থায় আইনের উৎস ৪টি। যথা : (ক) পবিত্র কুরআন (খ) আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ, যার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক বিচারের রায়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। (গ) ইজমা‘ তথা ছাহাবীগের ঐকমত্য এবং (ঘ) ইজতিহাদ বা ব্যক্তিগত গবেষণালব্ধ মতামত ও সিদ্ধান্ত। আর তা তখনই নেয়া হয় যখন একজন বিচারক কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা‘ থেকে কোন বিষয়ে রায় প্রদানের আইন খুঁজে না পান।[২৬]

অতএব এ বিভাগের সাথে যারা জড়িত থাকবেন তারা বিচার বিভাগের উক্ত বৈশিষ্ট্য ও আইনের উৎসগুলোর ভিত্তিতে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা উৎখাত করে যতসম্ভব দ্রুত ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। হয়রানী, প্রতারণা করবেন না। এ প্রসঙ্গে ইসলামের মূলনীতি সুস্পষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা কাফির, যালিম ও ফাসিক’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৪-৪৫ ও ৪৭)। ইসলামে বিচারকের অবস্থা বর্ণনায় নিচের হাদীছটি যথেষ্ট। বুরাইদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

اَلْقُضَاةُ ثَلَاثَةٌ وَاحِدٌ فِى الْجَنَّةِ وَاثْنَانِ فِى النَّارِ فَأَمَّا الَّذِىْ فِى الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِى الْحُكْمِ فَهُوَ فِى النَّارِ وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِى النَّارِ

‘বিচারক তিন প্রকার। এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতী, আর দুই শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামী। (১) যে বিচারক সত্য উপলব্ধি করে এবং তদনুযায়ী বিচার করে, সে জান্নাতী (২) যে বিচারক সত্য উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু তদনুযায়ী বিচার করে না, সে জাহান্নামী। (৩) আর এক শ্রেণীর বিচারক সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। অজ্ঞতার ভিত্তিতে বিচার করে, সেও জাহান্নামী’।[২৭] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা প্রজা সাধারণের উপর দায়িত্বশীল করেন অথচ সে যখন মারা যায়, তখনও সে প্রজা সাধারণগণের প্রতি প্রতারণাকারী থাকে, তাহলে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দেন’।[২৮] এগুলো ছাড়াও শিষ্টাচার ও শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ইসলামের দিক-নির্দেশনাগুলো সম্পর্কে যথাযথ ধারণা অর্জন করা যরূরী।

মানব রচিত আইন দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা করার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী

শরী‘আত বিরোধী মানব রচিত মনগড়া আইনের ভিত্তিতে পরিবার, সমাজ ও দেশ পরিচালনা করা শরী‘আতের স্পষ্ট লঙ্ঘন। কেননা আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছ হল আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সংবিধান। এটা ব্যতীত কোন কিছুই চূড়ান্ত হতে পারে না। কেননা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও যেহেতু আল্লাহকে একক গণ্য করতে হবে, সেহেতু কোন ব্যক্তি শরী‘আত বিরোধী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার অধিকার রাখে না। মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা কাফের’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা যালেম’ এবং
 وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ  الۡفٰسِقُوۡنَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারা ফাসেক্ব’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪৫ ও ৪৭)।

অতএব শরী‘আত বিরোধী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে আল্লাহ্র অধিকার ভুলূণ্ঠিত হয়। তাছাড়া এটা আল্লাহকে অপমান করার শামিল। যা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল-কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সার্বিক জীবনে আল-কুরআন তথা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবে রূপদান করার তাওফীক দান করুন। আমীন!!


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতী, আযওয়াউল বায়ান ফী ইযাহিল কুরআন বিল কুরআন (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খ্রি.), ২য় খ-, পৃ. ৪২৯।
[২]. ইমাম ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারুত ত্বাইয়েবা, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৪র্থ খ-, পৃ. ৫৯৪।
[৩]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৪র্থ খ-, পৃ. ৫৯৪-৫৯৫।
[৪]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৪র্থ খ-, পৃ. ৫৯৪।
[৫]. আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), পৃ. ৪৪৬।
[৬]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/১৩২২১; মুসনাদুশ শাফেঈ, হা/১১৫৩; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৮০৩।
[৭]. شرعنا لك شريعة كاملة تدعو إلى كل خير وتنهى عن كل شر من أمرنا الشرعي { فَاتَّبِعْهَا } فإن في اتباعها السعادة الأبدية والصلاح والفلاح-দ্র. : তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৭৭৭।   
[৮]. শাইখ সালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান, ‘আকীদাতুত তাওহীদ, পৃ. ৫৮।   
[৯]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৭৯১।
[১০]. আবূ ইসহাক ইবরাহীম আশ-শাতিবী, আল-ই‘ছিসাম, ১ম খ- (মিশর : আল-মাকতাবাতুজ তিজারিয়্যাতিল কুবরা, তা.বি.), পৃ. ৫৪।
[১১] ছহীহ বুখারী, হা/৮৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৯।
[১২]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৯০৬৪; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৯৮।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০১৫, ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩৩০; দারিমী, হা/২৭১৭।   
[১৪]. সূরাহ আল-বাক্বারাহ : ২৭৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৮; ইবনু মাজাহ, হা/২২৭৪; মিশকাত, হা/২৮০৭।     
[১৫]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৮০; মিশকাত, হা/৩৭৫৩; সনদ ছহীহ।     
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৫; মিশকাত, হা/২৮৯২।     
[১৭]. মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম, আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, তা.বি.), পৃ. ১৫৭।     
[১৮]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৪০১।     
[১৯]. আবী দাঊদ, হা/৪৯৫৫; নাসাঈ, হা/৫৩৮৭; সনদ ছহীহ।     
[২০]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৮ম খ-, পৃ. ২৭-২৮; তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৪২।     
[২১]. أَتَشْفَعُ فِى حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ গ্ধ . ثُمَّ قَامَ فَاخْتَطَبَ ، ثُمَّ قَالَ ্র إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ ، وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ ، وَايْمُ اللَّهِ ، لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ ابْنَةَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا গ্ধ -দ্র. : ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৭৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৮৮।     
[২২]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৩৮১।
[২৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪১।
[২৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮৯২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৯২৩।     
[২৫]. ড. মুহাম্মাদ আয-যুহাইলী, তারীখুল কাযা ফিল ইসলাম (বৈরূত : দারুল ফিকরিল মু‘আসির, ১৯৯৫ খ্রি.), পৃ. ৮৪।     
[২৬]. ড. ‘আলী মুহাম্মাদ আস-সাল্লাবী, আল-খালীফাতুল আওয়াল আবূ বাকর আস-সিদ্দীক শাখসিয়্যাতুহু ওয়া ‘আসরুহু (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ৭ম সংস্করণ, ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি.), পৃ. ১৪২।   
[২৭]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৭৩, সনদ ছহীহ।    
[২৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২। 




প্রসঙ্গসমূহ »: কুরআনুল কারীম
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
মীলাদুন্নবী ও আমাদের অবস্থান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১১তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৯ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
হজ্জ ও ওমরার সঠিক পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
বিদ‘আত পরিচিতি (১৭তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ক্যারিয়ার : শিক্ষক নিবন্ধনের প্রস্তুতির ধরন ও বিষয়াবলী - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১৫তম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
যিলহজ্জ মাসের আমল ও তার ফযীলত - মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ