অর্থ সংকট ও মূল রহস্য
দেশ বর্তমানে চরম অর্থ সংকটে ভুগছে। ঋণের বোঝা আর ডলার সংকট পুরো অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর ফলে লেনদেনে দেখা দিয়েছে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি, কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দেখা দিয়েছে জ্বালানি সংকট, অসহনীয় হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতি। ঋণ পরিশোধের চাপ যেমন বেড়েছে, তেমনি বাড়তি মুনাফার হারও বেড়েছে। অর্থনীতির চাকা থমকে গেছে। একটি শিশু লাখ টাকার উপর ঋণের বোঝা দিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে পথে নামিয়ে দিচ্ছে। আকাশচুম্বী খেলাপি ঋণে অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে একধরনের বন্ধ্যাত্ব। ১০ শতাংশ ধনীর হাতে ৪১ শতাংশ আয়। অর্থ পাচার, সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজি এবং পুঁজিবাদের আগ্রাসনে দেশ আজ এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।
বহুরূপী দুর্নীতিবাজরা সাধারণ দরিদ্র মানুষের রক্ত চুষে কালো টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। অবৈধ টাকা উপার্জনই এদের মূল পেশা। চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, দখলবাজী, অস্ত্রবাজী করে একজন টোকাই শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। এরা যখন অর্থ রাখার আর জায়গা পায় না তখন সেই কালো টাকা বিদেশে পাচার করে। স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, নিকটাত্মীয়, দূর আত্মীয় সবার নামে বিদেশের ব্যাংকে টাকা জমা রাখে, বাড়ি কিনে। অর্থ সন্ত্রাস করে ভদ্র চোরেরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। দেশের অর্থনীতিকে পুঙ্গ করে দেয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে অর্থ পাচার। গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা, যা বিগত দুই অর্থবছরের মোট বাজেটের কাছাকাছি। এছাড়া পাচারের এই অর্থ দেশের বর্তমান জিডিপির ৩১ শতাংশ। বর্তমানে জিডিপির আকার ৩৫৫ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার না হলে দেশে বর্তমানে জিডিপির আকার ছাড়িয়ে যেত সাড়ে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। গত ১ দশক ধরে প্রতি বছরে ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। যা দিয়ে দু’টি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, আন্ডার ওয়াটার টানেল এবং দেশের বড় বড় মেগাপ্রকল্প খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা যেত (কালের কণ্ঠ, ৬ জুলাই ২০২১; দৈনিক যুগান্তর, ৪ মার্চ ২০২০)।
প্রতি বছর যে পরিমাণ টাকা দেশ থেকে পাচার হয়েছে তা ১১ বিলিয়নেরও বেশি। যে দেশের রিজার্ভ ৪০ থেকে ৪৫ বিলিয়ন ডলার, সে দেশে বছরে পাচার হচ্ছে ১১ বিলিয়নেরও বেশি। দীর্ঘ সময় ধরে পাচার হওয়ার কারণে এই করুণ পরিণতির শিকার হয়েছে দেশ। আর আমদানি-রপ্তানির অসামঞ্জস্যতার ভয়াবহ ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত ডলার চাহিদা থাকার কারণে রেকর্ড পরিমাণ বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে। ফলে ডলারের মূল্য যতটা বেড়েছে, টাকার মান ততটাই কমে গেছে। তাই বছরের এই সময়গুলোতে গার্মেন্টস সেক্টরে যে পরিমাণ অর্ডার হত, তা হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে অর্থ পাচারের কারণে রিজার্ভ কমে গেছে। টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে রেমিটেন্সও কমেছে। এতে রিজার্ভ ডলারের যে গতি ছিল তাও থমকে গেছে এবং হুন্ডিতে লেনদেন বেড়েছে।
স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, এই চরম সংকটের গোপন রহস্য হল অর্থ পাচার। আর দুর্নীতিবাজ প্রশাসন ও আমলারাই এই অর্থ পাচারের মূল নায়ক। তারাই এই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। প্রত্যেকটি সেক্টরে এ ধরনের ভদ্র দানবগুলো থাকার কারণে কোথাও সততা নেই। ফলে অবৈধ লেনদেন ছাড়া দেশের মানুষ কোন সেবাই নিতে পারে না। দলীয় নেতা, সরকারী আমলা, রাজনীতিবিদ, এনজিও কর্মকর্তা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সবাই দুর্নীতিতে আসক্ত। শুধু একটি হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে যে ভয়ংকর লুটপাটের চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বুঝা যায় দেশের সবকিছুই দুর্নীতির কালো রক্তে রঞ্জিত।
১০-১২ হাজার টাকা দামের অটোস্কোপ মেশিন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকায়, ১৫ হাজার টাকার ব্লাড ওয়ার্মার মেশিন ৯ লাখ ৩২ হাজার টাকায়, ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দামের এমআরআই মেশিন ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ক্রয় করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবনের বালিশ ও চাদর ক্রয়ে যে অভিনব দুর্নীতি হয়েছে, তাতে বুঝা যায় যে, দুর্নীতিবাজরাই দেশের কর্ণধার। একটি বালিশের দাম দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা এবং ৩০টি চাদর নীচ থেকে খাটে তোলার জন্য প্রতিটির খরচ দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা, হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের একটি পর্দায় খরচ দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। এগুলো দু’একটি উদাহরণ মাত্র। আর মেগাপ্রকল্পগুলোর চিত্র বর্ণনা করলে তো ইবলীস শয়তানও খুব নাখোশ হবে। কারণ এরকম বীভৎস দুর্নীতি প্রতিনিয়তই হচ্ছে। তাহলে এ সমস্ত অবৈধ সম্পদ তারা রাখবে কোথায়? তাই অর্থ পাচারের প্রতিযোগিতা।
যতদিন দুর্নীতির লাগাম টেনে না ধরা হবে ততদিন দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হবে না। প্রথমে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত নিয়ে আসার। দ্বিতীয়তঃ আর কোন দুর্নীতিবাজ যেন অর্থ পাচার করতে না পারে সেজন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করা। তৃতীয়তঃ যারা দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা। সে যে পর্যায়ের ও যে পদেরই হোক। মনে রাখতে হবে, ‘বেড়ায় যেন ক্ষেত না খায়’ এবং কোন স্বজনপ্রীতি যেন আশ্রয় না পায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে সম্ভ্রান্ত পরিবারের জনৈকা মহিলা চুরি করলে, তার হাত না কাটার সুপারিশ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গর্জে উঠে বলেন, ‘তোমাদের পূর্বের লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। মনে রেখ, যদি আজ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত, তবে আমি তাঁর হাত কেটে দিতাম (ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৩৩)। ঘুণে ধরা সমাজকে সংস্কারের জন্য এরূপ দ্ব্যর্থহীন পদক্ষেপই কাম্য। উপযুক্ত সময়ে আপোসহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলেই দেশে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আসবে এবং সংকট কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ। আর এজন্য ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের দেশকে হেফাযত করুন এবং আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি দান করুন-আমীন!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ