اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُশৃঙ্খলাপূর্ণ উন্নত সমাজ কাঠামো কাম্য
মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন-যাপনের অভিব্যক্তিই সমাজ। মানুষ সমাজে জন্মগ্রহণ করে, সমাজেই লালিত-পালিত হয় এবং সমাজ থেকেই বিদায় নেয়। মূলত সমাজ হল বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণী, বংশ ও পেশার মানুষ একত্রে বসবাস করে। তাই সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন একটি উন্নত ও সুশৃঙ্খল সমাজ কাঠামো, যে কাঠামোর মৌলিক ভিত্তি হবে ঈমান ও তাক্বওয়া।
যে রাষ্ট্র ঈমান ও তাক্বওয়ার উপর যতবেশি ভিত্তিশীল হবে, সে রাষ্ট্রের সমাজ কাঠামো ও পারস্পরিক সৌহার্দবোধ ততবেশি সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হবে। কিন্তু আজ অধিকাংশ দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো জরাগ্রস্ত ভঙ্গুর। বিশেষ করে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই নাজুক। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতি বলতে কিছু নেই।
দলীয় দ্বন্দ্ব ও অসংখ্য নোংরা অপকর্ম সমাজকে অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, খুন, গুম, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ, শিশু পাচার, হামলা-মামলা ইত্যাদি নৃশংস অবস্থা বিরাজ করছে। অবাধ যৌনাচার, পতিতাবৃত্তি, শ্লীলতাহানি, লাম্পট্য, বেহায়পনা, নগ্নতা, গান-বাজনাসহ নানা অশ্লীলতায় সমাজ ছেয়ে গেছে। দুর্নীতি, আত্মসাৎ, মাদক, জুয়া, লটারি, সূদ-ঘুষের অভিশাপে সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।
সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সহিষ্ণুতা, উদারতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, সৌজন্যবোধ, মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলীর যেন লেশমাত্র নেই। তাই শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য কোথাও অগ্রগতি নেই। এ জন্য মূল দায়ী হল বস্তুবাদী শিক্ষা এবং নাস্তিক্যবাদী চেতনা। কারণ এখানে আল্লাহভীতি ও ধর্মীয় শিক্ষাকে চরমভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। অথচ তাক্বওয়া ভিত্তিক সমাজ কাঠামোই সুন্দর মানুষ তৈরির অপরিহার্য মাধ্যম, যা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম একটি ভারসাম্যপূর্ণ উন্নত সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহিলী সমাজ ব্যবস্থা সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধ সমাজে পরিণত হয়েছিল (আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ১৪৫, ২৩৭)।
একটি উন্নত, সুসংহত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজ কাঠামো তৈরি করার জন্য কতিপয় উপাদান আবশ্যক। যেমন-
(ক) তাওহীদী আক্বীদার পুণর্জাগরণ : তাওহীদ হল আল্লাহর একত্ব। ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক গণ্য করাই তাওহীদ (ই‘আনাতুল মুসতাফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ, পৃ. ২৫)। আর আক্বীদা হল কর্ম ছাড়া কোন বিষয়ে সন্দেহাতীত চূড়ান্ত বিশ্বাস। তাই আল্লাহকে না দেখে, ফেরেশতা, জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর, ক্বিয়ামত, কবরের শাস্তি ইত্যাদি অদৃশ্য বিষয় না দেখে শুধু কুরআন-সুন্নাহর বর্ণনায় সুদৃঢ় বিশ্বাস করার নামই তাওহীদী আক্বীদা। এটাই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব।
(খ) তাক্বওয়া অবলম্বন করা : আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনা করা এবং মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে শারঈ হুকুম লঙ্ঘন না করাই তাক্বওয়া (তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৩)। আর মানুষ যখন তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত হবে, তখন তার নিকট থেকে যাবতীয় অনৈতিক কাজ ও ভোগবাদী চেতনার বিলুপ্তি ঘটবে।
(গ) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, এটা তাক্বওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে, তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক অবহিত’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৮)।
(ঘ) পরস্পর সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করা : যা দ্বারা একে অন্যের সুখে-দুঃখে ভাগিদার হবে (ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৮০)।
(ঙ) পরস্পরে ইসলামী সাহায্যের অঙ্গীকার করা : যা দ্বারা নব্য জাহেলিয়াতের সকল গোত্রীয় বিবাদ-বিসম্বাদ বিলুপ্ত হবে এবং যাবতীয় কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজ বিদূরিত হবে (আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ১৪৫)।
(চ) প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান ও দয়া প্রদর্শন করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই যারা যমীনে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের সম্বোধন করে, তখন বলে ‘সালাম’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৬৩)।
(ছ) সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজের নিষেধ করা : এটি ইসলামী দাওয়াতের মৌলিক স্তম্ভ এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য। সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধির বিস্তার লাভের অন্যতম উপায় (সূরা আলে ‘ইমরান : ১০৪)।
(জ) জবাবদিহিতা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অনন্তর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস’ (সূরা আন-নাযিয়াত : ৪০-৪১)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষ দায়িত্বশীল। সুতরাং তার সেই দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/৮৯৩)।
(ঝ) আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা : রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ঈমানের অধিকতর নিরাপদ বন্ধন হল আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা’ (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৯৮)।
(ঞ) দ্বীনী শিক্ষার সম্প্রসারণ : দ্বীনী শিক্ষা উন্নত সমাজ কাঠামো বিনির্মাণের মেরুদণ্ড। এজন্য এ শিক্ষা অর্জন করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে (ইবনু মাজাহ, হা/২২৪, সনদ ছহীহ)।
(ট) জীবনধারায় বৈপ্লবিক আদর্শের প্রবর্তন করা : আধ্যাত্মিক চেতনায় উজ্জীবিত প্রেরণাবোধের ফলে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন এক জীবনধারা প্রবর্তন করেছিলেন, যা মানব ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং নযীরবিহীন (আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ১৪৫)। সেই বৈপ্লবিক আদর্শই হল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ।
উপরিউক্ত উপাদানগুলো যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সমাজ হবে সুন্দর ও উন্নয়নমুখী। তাই সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ঈমান ও তাক্বওয়ার ভিত্তিতে একটি সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!