সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১২:৩৯ অপরাহ্ন

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ

ইসলাম ও মানবাধিকার


‘মানবাধিকার’ কথাটি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও উচ্চারিত শব্দ। কিন্তু অধিকার বলতে আসলে কী বুঝায়, তা বর্তমান বিশেষজ্ঞদের সংজ্ঞায় এখনো পরিষ্কার হয়নি। তবে মানবাধিকার বলতে বর্তমানে যা বুঝানো হচ্ছে, তাহল- সর্বত্র সকল স্তরের মানুষের জন্য সার্বজনীন, সহজাত এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হল ‘মানবাধিকার’। প্রতিটি মানুষ এই অবিচ্ছেদ্য অধিকার ভোগ করবে এবং সব জায়গায় ও সবার জন্য সমানভাবে তা প্রযোজ্য হবে। কখনো অন্যের ক্ষতি সাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। এ জন্য স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হল, এসব অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা।

দুঃখজনক হল, মানবাধিকারের উক্ত দাবী বর্তমানে পৃথিবীর কোন দেশেই বা অঞ্চলেই বিদ্যমান নেই। এটা কেবল কাগজ আর বুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর কারণ হল, বিভিন্ন দেশ, সংস্থা, মতবাদ, দর্শন ও অঞ্চল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজেদের মত মানবাধিকারের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছে। প্রয়োজনে সংশোধন ও পরিবর্তন করে থাকে। পাশ্চাত্য দেশগুলোর এক সংজ্ঞা, সমাজতন্ত্রের আরেক সংজ্ঞা। আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের মানবাধিকার আইন ভিন্ন ভিন্ন। এক দেশের সাথে অন্য দেশের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। তাই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোন ক্ষেত্রেই সেখানে বিশ্বজনীন কোন মানদণ্ড নেই। এ জন্য কোথাও মানবাধিকারের চিহ্ন নেই। এর মূল কারণ হল এগুলো সব কল্পনাপ্রসূত, আপেক্ষিক ও স্বার্থনির্ভর। ফলে যারা মানবাধিকারের বুলি আওড়ায় তারাই সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে থাকে। ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, আরাকান, সোমালিয়া, বসনিয়া, চেচনিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক প্রভৃতি দেশের নির্যাতিত মানবতার ক্ষেত্রে বিশ্ব মোড়লদের দ্বিমুখী আচরণ দীর্ঘদিন যাবৎ বিশ্ববাসী অবলোকন করছে।

সাম্রাজ্যবাদীরা অন্য রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ ও হামলা করলে বলা হয় শান্তিকামী আর মুসলিম দেশগুলো আত্মরক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করলে তারা বলে সন্ত্রাসী-জঙ্গী গোষ্ঠী। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী ঐ মহাদেশের মূল বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ান গোটা সম্প্রদায়কেই দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। নতুন বিশ্ব গড়া ও তথাকথিত উন্নতির কথা বলে তারা আফ্রিকা মহাদেশের কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের জাহাজ বোঝাই করে পশুর মত ধরে নিয়ে গিয়ে নিজেদের দাসে পরিণত করে। এসব গোলাম যথারীতি ক্রয়-বিক্রয় হত। আফ্রিকার যে উপকূল থেকে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হত তার নামই হয়ে গেছে ‘দাস উপকূল’। এ আমদানীকৃত গোলামদের বংশধর এখনও অবশিষ্ট আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা প্রকৃত অধিকার লাভ করতে পারেনি। এটা নাকি মানবাধিকারের চূড়ায় অধিষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের চরিত্র। তাহলে অন্য রাষ্ট্রগুলোর কী অবস্থা? এই হল তথাকথিত মানবাধিকার।

ইসলামে উক্ত তথাকথিত মানবাধিকারের কোন স্থান নেই, বরং উক্ত দ্বিমুখী নীতির বিরুদ্ধেই ইসলামের অবস্থান। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামে মানবাধিকারের ধারণাও ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ। মনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন হল ইসলাম (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৯)। যা সর্বকাল ও সকল বিষয়ের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ। তাই আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন কোন্ নীতি আদর্শ অনুসরণ করলে মানুষের অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষিত হবে। সে জন্য আল্লাহ নিজেই সংবিধান দিয়েছেন এবং তা কার্যকর করার জন্য প্রত্যেক জাতির মাঝে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। মানবজাতির সার্বিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সবশেষে নবী ও রাসূল হিসাবে মনোনীত করেছেন মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে। নিপীড়িত, অত্যাচারিত ও অধিকার হারা মানবতার মুক্তির মূল সূত্র তিনিই প্রদর্শন করেছেন। তারই আলোকে প্রণীত হয়েছে ‘মদীনা সনদ’, যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানবাধিকার সনদ বলে পরিচিত। উক্ত সনদে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষ করে জান-মাল এবং সম্মানের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য এই সনদ চিরন্তন অবদান রেখেছে। এছাড়া মক্কা বিজয় ও বিদায় হজ্জের ভাষণ মানবাধিকার রক্ষার ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সমরনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উত্তরাধিকার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রত্যেকটি বিষয় স্থান পেয়েছে। 

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, খুন-গুম, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতিসহ যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার, নারীর মর্যাদা রক্ষা ও তার অধিকার নিশ্চিত করা, ক্রীতদাসের অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, সংখ্যালঘু ও অমুসলিমদের অধিকার, প্রতিবেশীর অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, শিক্ষা-সভ্যতা, সংস্কৃতিসহ তামাম জিন্দেগীর সবকিছুর মূলনীতি আল্লাহ প্রেরিত সংবিধানে রয়েছে। সেই আইন ও বিধানের শাসন যথাযথভাবে কার্যকর ও প্রতিষ্ঠার কারণেই পরপর তিনটি যুগকে স্বর্ণ যুগ বলা হয়েছে (ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৫০)। পরবর্তীতে পৃথিবীর আর কোন ধর্ম, দর্শন, মতবাদ মানবজাতিকে শান্তির বার্তা উপহার দিতে পারেনি, বরং ইসলামী জীবন বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্ন কল্পনানির্ভর যত মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে, পৃথিবীতে তত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান হল চূড়ান্ত, চিরন্তন, নির্ভেজাল ও নির্ভুল। আর অন্য সবকিছু অসত্য ও বাতিল, যার পরিণাম ভ্রষ্টতা (সূরা আন‘আম : ১১৫; সূরা ইউনুস : ৩২)।

অতএব বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সকল প্রকার ত্বাগূতী জীবন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে আমাদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকেই ফিরে যেতে হবে। এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ)-কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন (সূরা ছফফ : ৯)। আমরা যেদিন সেই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে পারব সেদিনই প্রকৃত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। তার আগে সম্ভব নয় (সূরা বাক্বারাহ : ২৫৬)। আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে ইসলাম বুঝার এবং এর ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে জীবন পরিচালনা করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ





ফেসবুক পেজ