তরুণদের মানহাজ বিভ্রান্তি ও তার কুফল
দাওয়াত ও তাবলীগের ময়দানে যুবক ও তরুণ ছাত্রদের উপস্থিতি এখন ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের এই প্রচেষ্টা দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য খুবই কল্যাণকর। ভবিষ্যৎ দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এটা আনন্দের বার্তা বহন করে। কিন্তু তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ আবেগ আর মানহাজ বিহীন চেতনা সেই স্বপ্নকে বিনাশ করে দিচ্ছে। শারঈ জ্ঞানের অভাব ও মানহাজগত ত্রুটির কারণে মুখরোচক মিথ্যা কথা আর আক্বীদা বিরোধী নতুন নতুন উদ্ভট তথ্য ও ব্যাখ্যার কুপ্রভাবে বেলুনের মত হাওয়ায় ভাসছে তারা। মাকাল ফলের মত বিদ‘আতী, মূর্খ ও মানহাজ গোপনকারী মুখোশধারী বক্তাদের ধোঁকায় পড়ে সালাফী আলেমদের গালমন্দ করছে। বিবেকশূন্য হওয়ার কারণে নিজেরা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হচ্ছে এবং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করছে। এদের অধিকাংশই এক নর্দমা থেকে লাফ দিয়ে আরেক নর্দমায় পড়েছে।
ভিতরে ভিতরে কেউ খারেজী চেতনা লালন করছে, কেউ শী‘আ, হুতি, হিজবুল্লাহর জ্বরে আক্রান্ত, কেউ ইখওয়ানী, কেউ ছূফী ইলিয়াসী তাবলীগের কুপ্রভাবে কাতরাচ্ছে, কেউ পীর-ফকীরী প্রতারণার জালে আবদ্ধ। এর পরিণাম যে যন্ত্রণাদায়ক ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ তা অচিরেই উপলব্ধি করবে। ততক্ষণে জীবনের গোল্ডেন টাইম চলে যাবে। তাই এদের যৌবনের স্রোতকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলে সমাজ উপকৃত হবে ইনশাআল্লাহ। তাদেরকে সে পথেই পরিচালিত হতে হবে যে পথ চলে গেছে জান্নাতুল ফেরদাঊসের দিকে, যে পথে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির গ্যারেন্টি রয়েছে। হাদীছের ভাষায় এই পথটার নামই হল ‘মানহাজ’ বা মানহাজুস সালাফ। রাসূল (ﷺ), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম, তাবেঈ-তাবেঈন এ পথেই চলেছেন, যা ‘মানহাজুস সালাফিছ ছালেহ’ বা সালাফে ছালেহীনের মানহাজ বলে পরিচিত।
‘মানহাজ’ অর্থ সরল-সোজা পথ, প্রশস্ত রাস্তা, আলোকিত পথ (আল-মায়েদাহ ৪৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৪৩০, সনদ ছহীহ)। সাধারণত পরিষ্কার, স্পষ্ট পথকেই মানহাজ বলে (ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব, ২/৩৮৩)। ‘সালাফ’ অর্থ ‘অগ্রবর্তী বা গত হওয়া, উপদেশ, শিক্ষা, অগ্রগামী (আন-নিসা : ২২-২৩; আল-মায়েদাহ : ৯৫; আয-যুখরুফ : ৫৬; ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮৬)। রাসূল (ﷺ) তাঁর মেয়ে ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বলেছিলেন, فَإِنِّى نِعْمَ السَّلَفُ أَنَا لَكِ ‘নিশ্চয় আমি তোমার জন্য কতই না উত্তম অগ্রগামী’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০)। সালাফ হলেন, রাসূল (ﷺ), ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের যুগের সৎ ব্যক্তিবর্গ (ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫২; সূরা আলে ‘ইমরান : ১১০)। তাই ‘মানহাজুস সালাফ’ অর্থ হল, রাসূল (ﷺ), ছাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনে এযামের পথ, কর্মপন্থা ও মূলনীতি। তাদের কর্মপন্থা ও ব্যাখ্যাকে যারা ঈমানের সাথে গ্রহণ করবে, তারা মুক্তি পাবে। আর যারা প্রত্যাখ্যান করবে তারা ধ্বংস হবে এবং পথভ্রষ্ট হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তারা যদি তোমাদের ঈমান আনার মত ঈমান আনে, তবে তারা হেদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা ভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে’ (আল-বাক্বারাহ : ১৩৭)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, সালাফদের পথ অনুসরণ না করলে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন (আন-নিসা : ১১৫)। তাই শরী‘আত বুঝার ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যাখ্যা ও মূলনীতি অনুসরণ করা ফরয। এ কারণেই আল্লাহ তাঁদের পথ অনুসরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন (আত-তওবা : ১১৯; আল-হাশর : ৮)। সেজন্য যারা তাদের পথ, রীতি ও মূলনীতির অনুসরণ করে তারাই সালাফী। বিশেষ করে বিভিন্ন ভ্রান্ত ফের্কার উদ্ভব হওয়ার পর যারা ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদা ও মানহাজকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে থেকেছেন। তাদের মানহাজকে ‘সালাফী মানহাজ’ বলা হয়। এখানে বিদ‘আতী ফের্কার কোন স্থান নেই (সাফারীনী, লাওয়ামিঊল আনওয়ার আল-বাহিয়্যাহ, ১/২০)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, মানহাজ শব্দটি আক্বীদার চেয়েও ব্যাপক। কারণ মানহাজ আক্বীদা, ইবাদত, আখলাক, অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতিসহ মুসলিমের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যই আবশ্যক (ড. ছালিহ আল-ফাওযান, আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ, পৃ. ৭৬)। একজন মুসলিম প্রতিটি ক্ষেত্রেই সালাফদের মানহাজকে প্রাধান্য দিবে। কেউ যদি কোন একটি বিষয়ে মানহাজকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে সে সালাফী নয়। ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মানহাজ হল ঐ সমস্ত সুন্দর পদ্ধতি যা অনুসরণ করলে আক্বীদা, আমল ও ইবাদতের মাসআলাসমূহের সঠিক ও বিশুদ্ধ পন্থা নিশ্চিত হয়’ (এটা সালাফদের মানহাজ নয়, পৃ. ২২)।
ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অন্য কাউকে অনুকরণ করতে চায়, তাহলে সে যেন যারা মারা গেছেন তাঁদের অনুকরণ করে। আর তাঁরা হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছাহাবীগণ। তারা এ উম্মতের সবচেয়ে উত্তম লোক; অন্তরের দিক থেকে তারা নেককার, ইলমের দিক থেকে গভীর, কৃত্রিমতা প্রকাশে খুবই কম। তারা এমন এক কাফেলা, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর ছাহাবী হিসাবে মনোনীত করেছেন এবং দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চয়ন করেছেন। সুতরাং তোমরা চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে এবং পথ চলার ক্ষেত্রে তাঁদের অনুকরণ কর; কারণ তাঁরা সকলেই ছিলেন সঠিক পথ ও হেদায়াতের উপর’ (ইমাম বাগাভী, শারহুস সুন্নাহ, হা/১০৪, ১/২১৪)। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদের কাছে আক্বীদা ও সুন্নাতের মূলনীতি হচ্ছে, রাসূল (ﷺ)-এর ছাহাবীগণ যে পথের উপর ছিলেন তা আঁকড়ে থাকা, তাদের অনুসরণ-অনুকরণ করা। কারণ তাঁরা অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। আর বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করা। প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। তর্ক-বিতর্ক পরিত্যাগ করা। কেননা তা আহলুস সুন্নাহর বৈশিষ্ট্য নয়। বরং ঝগড়া, তর্ক-বিতর্ক করা বিদ‘আতীদের বৈশিষ্ট্য’ (লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ, ১১/৫)।
রাসূল (ﷺ)-এর যুগেই যখন মানহাজের অনুসরণ ছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিল না, তখন বর্তমান অসংখ্য ভ্রষ্টতার মাঝে মানহাজের অনুসরণ ছাড়া একজন মুসলিম কিভাবে জান্নাতের পথ খুঁজে পাবে? প্রশ্নই আসে না। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘ইহুদীরা বিভক্ত হয়েছে ৭১ দলে, খ্রীস্টানরা বিভক্ত হয়েছে ৭২ দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। একটি ব্যতীত সবই জাহান্নামে যাবে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ঐ জান্নাতী দল কোনটি? তিনি বলেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপর আছি, তার উপর যারা থাকবে’ (তিরমিযী, হা/২৬৪১, সনদ ছহীহ)। অন্য হাদীছে এসেছে, ‘ভ্রান্ত ফের্কাগুলো অসংখ্য বিদ‘আত সৃষ্টি করবে এবং মানুষকে বিপদগামী করবে’ (আবূ দাঊদ, হা/৪৫৯৭, সনদ হাসান)। এই হাদীছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে পথভ্রষ্ট ফের্কাগুলো থেকে সাবধান থাকতে হবে এবং মানহাজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করতে হবে, যেন বাতিলরা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সালাফে ছালেহীনের মানহাজ বুঝার তাওফীক্ব দান করুন, তাঁদের পথে পরিচালিত করুন এবং জান্নাতে তাঁদের সাথে একত্রিত করুন-আমীন!!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
প্রসঙ্গসমূহ »:
সম্পাদকীয়