কুরআনে কারীমের মর্যাদা
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন বিশ্বমানবতার জন্য স্থায়ী ও চূড়ান্ত সংবিধান। আল-কুরআন যেমন সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ, তেমনি সর্বার্ধিক সম্মানী ও মর্যাদাপূর্ণ কালাম। সর্বশ্রেষ্ঠ মু‘জিযা হিসাবে শব্দের গাঁথনি, ভাষার নৈপুন্য, ছন্দময় বাক্য এবং উন্নত বালাগাত-ফাছাহাত সমৃদ্ধ এক বিষ্ময়কর সংবিধান। এর প্রভাবেই তমসাচ্ছন্ন জাহেলিয়াত বিদূরীত হয়েছিল। বঞ্চিত মানবতা ফিরে পেয়েছিল তাদের ন্যায্য অধিকার। ভ্রান্ত আক্বীদা, উদ্ভট চেতনা এবং বস্তাপচা সব মতবাদ বিতাড়িত হয়েছিল। তাই কুরআনের মত অতুলনীয় কিতাব আর দ্বিতীয়টি নেই। এতে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের পূর্ণাঙ্গ সমাধান, দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তি, কল্যাণ ও নিরাপত্তার চিরন্তন চ্যালেঞ্জ। আসলে কুরআন সকল জ্ঞানের উৎসমূল, হেদায়াতের সমষ্টি, রহমত এবং বরকতের অফুরন্ত ভা-ার। জীবন সংশোধনের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার, হৃদয়ের আরোগ্য এবং ক্ষুধার্ত আত্মার প্রকৃত খোরাক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমরা মুসলিমদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ, পথ নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদ স্বরূপ আপনার উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা আন-নাহল : ৮৯)। যা সন্দেহ ও ত্রুটির সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে। এমনকি তাতে সম্মুখ ও পশ্চাৎ থেকে মিথ্যা প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। কেননা তা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২; সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ : ৪১-৪২)।
আল-কুরআন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর মারফতে সত্যসহ অবতীর্ণ হয়েছে। এটি সরাসরি আল্লাহর কালাম, যা সৃষ্ট বস্তু নয়। এর দ্বারা তাওরাত, যাবূর ও ইনজীল সহ পূর্বের সমস্ত আসমানী কিতাবের হুকুম রহিত হয়েছে। ক্বিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত এটিই সর্বশেষ আসমানী কিতাব। এর পরে আর কোন কিতাব অবতীর্ণ হবে না। তাই আল্লাহ তা‘আলা নিজেই এই কিতাবকে হেফাযত করার দায়িত্ব নিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমরাই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণকারী’ (সূরা আল-হিজর : ৯)। অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয় তা (কুরআন) সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদেরই’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৭)। এটিই কুরআনের অনন্য অলৌকিকত্ব।
প্রত্যেক মুসলিমের উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল, কুরআনের মুছহাফকে যথাযথ সম্মান করা এবং এর মর্যাদা রক্ষা করা। কারণ আল্লাহর কালাম কুরআনের প্রতি তুচ্ছজ্ঞান করা এবং তার অবমাননা করা কুফরী (ফাতাওয়াউল ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৬৬২০০)। কুরআনের অবমাননা করা বড় কুফরীর শামিল। তাই কেউ এমন অপরাধ করলে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে (সূরা আত-তাওবাহ : ৬৫-৬৬; আল-মাজমূঊ, ২য় খণ্ড, ১৭০)। সে মুরতাদ বলে গণ্য হবে। যে কেউ এমন গর্হিত অন্যায় করলে তার রক্ত হালাল হবে (ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪২৫)। সুতরাং কুরআনের মর্যাদার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কুরআনের মুছহাফের উপর কোনকিছু রাখা যাবে না। সর্বদা সবকিছুর উপরেই রাখতে হবে (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩১৯)। কুরআনের মুছহাফ বাম হাত দিয়ে গ্রহণ করা যাবে না (ছহীহ বুখারী, হা/১৬৮)। মুছহাফের দিকে দ্রুতগতিতে পায়ের কদম ফেলা যাবে না (ফাতাওয়াউল ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৬৬২০০)।
কুরআন খোলা রাখাও অসম্মানের শামিল। কারণ কুরআনে কারীম আল্লাহর নিদর্শন। আর তাঁর নিদর্শনকে সম্মান করা প্রত্যেক মানুষের জন্য ওয়াজিব (সূরা আল-হজ্জ : ৩২)। মুছহাফের সাথে টেস দেয়া, এর দিকে পা প্রসারিত করা, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা এবং উপর দিয়ে অতিক্রম করাও মর্যাদার হানি। অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন, অপবিত্র স্থানে রাখা, মুছহাফ নিয়ে টয়লেটে যাওয়া, অশ্লীল ও অসম্মানজনক স্থানে কিছু অংশ লেখা কিংবা ঝুলিয়ে রাখা, সংবাদপত্রে লেখা অপমানজনক (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৪) । শত্রু দেশগুলোতে এটি নিয়ে ভ্রমণ করাও নিষিদ্ধ (ছহীহ বুখারী, হা/২৯৯০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৬৯; মিশকাত, হা/২১৭৯)। আর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ক্যালিগ্রাফি করে টাঙ্গিয়ে রাখা কিংবা আলঙ্কারিক প্লেট, ফলক, কাঠ বা এ জাতীয় কোনকিছুতে কুরআনের আয়াত লেখা নিষিদ্ধ। এগুলোর মাধ্যমে কুরআনকে তুচ্ছজ্ঞান করা হয় এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয় (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫, ২৮, ২৯)।
গত ১৩ অক্টোবর বুধবার কুমিল্লার নানুয়ার দিঘিরপাড়ে হিন্দুদের পূজা মন্ডপে মূর্তির কোলে কুরআন রেখে পবিত্র কুরআনের অবমাননা করা হয়েছে, যা চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে এরূপ নোংরা কাজ সংঘটিত হবে এমনটি কেউ কল্পনাও করেনি। এই জঘন্য কর্মের সাথে যে বা যারাই জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথা আল্লাহর পক্ষ থেকে অতিসত্বর গযব নাযিল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তখন এই গযব থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। কারণ এর পূর্বেই যারাই এধরনের অন্যায় কর্মে লিপ্ত হয়েছে, তারাই অবর্ণনীয় গযবের শিকার হয়েছে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়েছি যে তিনি বলেছেন, ‘কুমিল্লার ঘটনায় কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যে ধর্মেরই হোক না কেন বিচার করা হবেই। এমন শাস্তি দেয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে না পারে’। উক্ত ঘোষণা যেন অপরাজনীতির শিকার না হয় এবং কোন নির্দোষ ব্যক্তি যেন ষড়যন্ত্রের বলি না হয়। হে আল্লাহ! আপনি কুরআনে কারীমের মর্যাদাকে অক্ষুণœ রাখুন এবং কুচক্রী মহল থেকে আমাদের দেশকে হেফাযত করুন-আমীন!!