মানুষের চরম সংকট!
‘মানুষ’ (مأنوس) আরবী শব্দ। যার মধ্যে স্নেহ, ভালবাসা, মমতা, ভদ্রতা, অন্তরঙ্গতা, সততা ইত্যাদি মানবীয় গুণ দেয়া হয়েছে, তাকে ‘মানুষ’ বলে।
একই শব্দ থেকে নির্গত ‘ইনসান’ ও ‘ইনসানিয়াত’ শব্দের অর্থ প্রশংসনীয় গুণাবলী বা মনুষ্যত্ব, প্রকৃত মানুষ, মানবতা, মানুষের মধ্যে থাকা উচিত এমন সদ্গুণ। সেখান থেকেই বলা হয় ‘ইনসানে কামেল’ বা সমুদয় মানবীয় গুণ যার ভিতর পরিপূর্ণভাবে বর্তমান।
উক্ত অর্থের ‘মানুষ’ কি এখন সচরাচর দেখা যায়? দুই চোখ, দুই কান, দুই হাত-পা ও মাথাবিশিষ্ট মানুষ আকৃতির অবয়ব থাকলেই কি তাকে ‘মানুষ’ বলা যায়? না, যার মধ্যে মানবীয় গুণ নেই, সে মানুষ নয়- অমানুষ, নর নয়- বানর। সমাজে এই অমানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর।
তাই দার্শনিক ডায়োজিনিস সম্পর্কে বলা হয় যে, He used to stroll about in full daylight with a lamp; when asked what he was doing, he would answer, "I am looking for a man" [Laërtius & Hicks 1925, VI : 41]. তিনি একদিন ভরদুপুরে লণ্ঠন হাতে ধীরে ধীরে চলছিলেন। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে বলেন, ‘আমি আসলে মানুষ খুঁজছি’।
রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি সেক্টরই অমানুষে ভরপুর। কিছু মানুষ থাকলেও তারা কোণঠাসা। সততার দৃষ্টান্ত পেশ করতে পারেন না। তারা অবহেলিত, নানাভাবে নির্যাতিত। অমানুষের ভিড়ে তাদের খুঁজেও পাওয়া যায় না। তাই সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষের বড়ই অভাব! সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হল, অমানুষগুলো যে মানুষ না- সেই অনুভূতিটুকুও তারা হারিয়ে ফেলেছে। যদিও তারা উচ্চ ডিগ্রীধারী, বিভিন্ন শ্রেণীর ক্যাডার। এরা যেহেতু মনুষ্যত্বহীন তাই এদের পরিচয় হল ধূর্ত, ক্রিমিনাল, ভণ্ড, মুনাফিক, মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ, দুর্নীতিবাজ, হারামখোর, সূদখোর, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী, লুচ্চা-লম্পট, ধর্ষক, নরখাদক ইত্যাদি। এদের পরিচয় ‘মানুষ’ হতে পারে না।
এই অমানুষের সংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমাজে সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, দেশপ্রেম, নৈতিকতা উঠে যাচ্ছে। তাই এই অমানুষরাই উন্নত দেশ গড়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা যারা আত্মসাৎ করে, ক্ষুধার্ত-পীড়িত মানুষের আহার চাল, ডাল, ত্রাণ যারা চুরি করে, তারা দেশের সম্পদ না শত্রু? যাদের কাছে নিরীহ মানুষের জান-মাল নিরাপদ নয়, তারা নেতা না নরকের আবর্জনা?
যারা শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের মহড়া দেয়, হত্যা, সন্ত্রাস ও ধর্ষণের রাজ্য কায়েম করে, তারা জাতির ভবিষ্যৎ না-কি ভয়ানক বিভীষিকা? অফিস-আদালতে যারা ফাইল আটকে রেখে, বিভিন্ন ছলচাতুরী করে ঘুষ খাচ্ছে, কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করছে, ভিনদেশে বিশাল বিশাল অট্টালিকা তৈরি করছে, তারা দেশের সন্তান না সমস্যা? ইঞ্জিনিয়ার সামান্য কলমের খোঁচায় মুহূর্তেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, দেশকে ভঙ্গুর বানাচ্ছে, অর্থনীতির শিকড় কাটছে। নিম্ন মানের উপকরণ দিয়ে কাজ করতে গিয়ে উদ্বোধনের আগেই তা ধ্বসে পড়ছে। তারা কি ইঞ্জিনিয়ার না......?
আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, যে যতটুকু আত্মসাৎ করেছে তা বহন করে সে ক্বিয়ামতের মাঠে হাযির হবে (সূরা আলে ইমরান : ১৬১)। দুর্নীতির অর্থই তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে এবং পুড়িয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার বানাবে (ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২-৮৩)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি দায়িত্ব নেয়ার পর খিয়ানত করে মারা গেলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিবেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭১৫১)।
মানুষ গড়ার কারিগর খ্যাত শিক্ষাগুরুরা আজ কোচিং-প্রাইভেট ব্যাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। তাদের কাছে এখন ছাত্রছাত্রী নিরাপদ নয়। ক্লাসেই তারা বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও কুরুচীপূর্ণ স্বভাব শিক্ষা দিচ্ছেন। এভাবেই প্রকৃত শিক্ষা উঠে যাচ্ছে আর মূর্খতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে রয়েছে, ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, মূর্খতা বৃদ্ধি পাবে, ব্যভিচার বেড়ে যাবে, মদ্যপান বৃদ্ধি পাবে’ অপর এক বর্ণনায় আছে, ‘ইলম কমে যাবে এবং মূর্খতা প্রকাশ পাবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/৫২৩১, ৫৫৭৭)।
ডাক্তারগণ নিজের কর্মস্থল বাদ দিয়ে ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখতে অধিক আগ্রহী। সামান্য কমিশনের আশায় রোগীকে বাহুল্য টেস্টের ফিরিস্তি দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। ঔষধ কোম্পানীর কমিশনের লোভে নিম্নমানের ঔষধ লিখতে তাদের হাত কাঁপে না। গরীব রোগীদের সাথেও নির্দয় আচরণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। তারা তাদের নিষ্ঠা, সততা ও মর্যাদার কথা ভুলে গেছেন।
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘রোগীর শুশ্রুষাকারী ততক্ষণ জান্নাতের বাগানে থাকে, যতক্ষণ রোগীর কাছে অবস্থান করে’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৮)। ‘সত্তর হাজার ফিরিশতা আল্লাহর নিকট তাদের জন্য দু‘আ করতে থাকেন’ (আবূ দাঊদ, হা/৩০৯৮, সনদ ছহীহ)। এমনকি ‘ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া’ খ্যাত বহু আলেমও আজ নীতিভ্রষ্ট ও পথচ্যুত। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, শঠতা, লৌকিকতা, ধর্মব্যবসা, পেটপূঁজা, গীবত ও তোহমতের দোষে জর্জরিত। সদাচরণ ও তাক্বওয়ার বয়ানে মাঠ গরম করলেও নিজের মধ্যে তার লেশমাত্র পাওয়া যায় না। কাজের চেয়ে প্রচার-প্রচারণায় বহুগুণ বেশি। সাধারণ মানুষকে প্রতারণায় ফেলে মুহূর্তেই জিরোকে হিরো বলে চালিয়ে দিতে পারেন।
তাবেঈ বিদ্বান যিয়াদ ইবনু হুদাইর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে বলেছেন, তুমি কি জান, ইসলামকে কিসে ধ্বংস করে দেয়? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, আলেমদের পদস্খলন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে মুনাফিকের বিতর্ক এবং শাসকদের ভ্রষ্টতা’ (দারেমী, হা/২১৪; মিশকাত, হা/১৬৯, সনদ ছহীহ)। জাতির বিবেক খ্যাত বহু সাংবাদিক স্বীয় নিরপেক্ষতা হারিয়ে একমুঠো ক্ষুদ-কুঁড়োর আশায় মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনে মশগুল। পুলিশ থেকে শুরু করে অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তার ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ঘুষ বাণিজ্য, মাদক চোরাচালান, নারী নির্যাতন এমনকি গুম-খুন, ধর্ষণের মত অপরাধে তাদের সম্পৃক্ততায় মানুষ আজ রীতিমত হতবাক। যাদের কাছে মানুষ নিরাপত্তা পাবে, তারাই আজ রক্ষক নামের ভক্ষক। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয় নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে অধীনস্ত জনগণের প্রতি অত্যাচার করে’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩)।
জাতি এই গ্যাঁড়াকল থেকে মুক্তি চায়। অমানুষদের বিষাক্ত ছোবল হতে নিষ্কৃতি চায়। সর্বত্র সৎ-নিষ্ঠাবান মানুষের সাক্ষাৎ চায়! দুর্নীতির মূলোৎপাটনকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তার সন্ধান চায়! আর ঐ নির্ভীক ন্যায়পরায়ণ মানুষ গড়ার মূলসূত্র হল ‘তাক্বওয়া’। তাক্বওয়া ও পরকালীন জবাবদিহিতামূলক জীবন গঠন করতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। কারণ আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি সে-ই, যে সবচেয়ে বেশি পরহেযগার (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)।
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তাক্বওয়াই হচ্ছে সার্বিক কল্যাণের মূল চাবিকাঠি (মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭৯১, সনদ ছহীহ)। তিনি বলেন, পরহেযগার এবং নিষ্কলুষ ব্যক্তি এমন (১) যার মধ্যে পাপ নেই (২) সীমালংঘন নেই (৩) খিয়ানত নেই (৪) হিংসা নেই (ইবনু মাজাহ, হা/৪২১৬, সনদ ছহীহ)। অন্য হাদীছে এসেছে, তুমি যেখানে যেভাবে থাকবে, তাক্বওয়া অবলম্বন করবে (তিরমিযী, হা/১৯৮৭, সনদ হাসান)। তাক্বওয়া, পরকালীন জবাবদিহিতা ও সদাচরণের ভিত্তিতে প্রকৃত মানুষ তৈরি হয়। তাই আসুন! আমরা সর্বত্র আল্লাহভীতি অবলম্বন করি এবং তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!