বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৩ অপরাহ্ন

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ

বাবরি মসজিদের রায় : ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায়


ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ১৫২৮ সালে ৯৩৫ হিজরী মোতাবেক বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকী। তিনিই সম্রাট বাবরের নামে ‘বাবরি মসজিদ’-এর নামকরণ করেন। এর দুই বছর আগে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যহীরুদদ্দীন মুহাম্মাদ বাবর। তাই এটা প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন মসজিদ।

দীর্ঘদিন পর ১৮৫৩ সালে সর্বপ্রথম উক্ত মসজিদকে কেন্দ্র করে হিন্দুরা ধর্মীয় বিবাদের সূচনা করে। মসজিদের স্থানে পূর্বে রামমন্দির ছিল বলে বিতর্কের সৃষ্টি করে। ১৮৮৫ সালে ফৈজাবাদের জেলা আদালতের দারস্থ হয়ে বাবরি মসজিদের বাইরে সামিয়ানা তৈরি করে শ্রী রামচন্দ্রের মূর্তি স্থাপনের আবেদন জানায় মহন্ত রঘুবীর দাস। তখন ব্রিটিশ আদালত উক্ত আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু উক্ত বিবাদ থেমে থাকেনি। হিন্দুরা আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে থাকলে মুসলিমদের উত্তর প্রদেশ সেন্ট্রাল সুন্নী ওয়াক্ফ বোর্ড আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হয়।

অতঃপর কোন প্রকার আইনি সমাধান ছাড়াই ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ক্ষমতায় থাকাকালে মসজিদটি ধ্বংস করে দেয়া হয়। এর মূলে ছিল ৬ এপ্রিল ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি ও করসেবকরা। তবে কংগ্রেসও কম দায়ী নয়। উক্ত দাঙ্গায় দুই হাজার লোক নিহত হয় এবং প্রায় ৯ হাজার কোটি ভারতীয় রুপির সম্পদ বিনষ্ট হয়, যা ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার। এরপর থেকে আইনি লড়াই চলতে থাকে।

সর্বশেষ গত ৯ নভেম্বর ২০১৯ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করেন যে, মসজিদের স্থানে হবে রামমন্দির। আর বিকল্প জায়গায় হবে মসজিদ। প্রমাণ হিসাবে পেশ করা হয় পুরাতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট। যেখানে বলা হয়েছে যে, মসজিদের নীচে প্রাচীন একটি কাঠামো ছিল। আরেকটি দাবী করা হয়েছে যে, হিন্দুরা ঐ স্থানকে রামের জন্মস্থান হিসাবে বিশ্বাস করত। অথচ উক্ত প্রাচীন কাঠামোকে যেমন মন্দিরের কাঠামো হিসাবে প্রমাণ করা যায়নি, তেমনি উক্ত বিশ্বাসেরও ঐতিহাসিক কোন বাস্তব ভিত্তি পাওয়া যায়নি। সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর তথ্যের উপর ভিত্তি করে উক্ত বিতর্কিত রায় দেয়া হয়েছে। মূলত হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারকে খুশি করতেই সুপ্রিম কোর্ট এই পক্ষপাতমূলক রায় ঘোষণা করেছে। তাই ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এই রায়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন এবং ভারতীয় সংবিধানের চরম অমর্যাদাকর মূহূর্ত বলে মন্তব্য করেছেন। সাথে সাথে এটাও বলে দিয়েছেন যে, বাবরি মসজিদ অক্ষত থাকলে এ ধরনের রায় দেয়া সম্ভব হত না।

উক্ত রায়কে বিশ্বমুসলিম জনমত প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কারণ এতে যেমন ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ধর্মীয় সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে, তেমনি জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ঘোষিত মানবাধিকার সনদকেও লঙ্ঘন করা হয়েছে। ফলে বিশ্বমুসলিমদের কাছে এই রায় গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রায়ে যে পাঁচ একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে সেটার জন্যও মুসলিমরা ভিখারী নয়। তাছাড়া এই রায়ে অন্যান্য মুসলিম স্থাপনাগুলোও এখন চরম হুমকির মুখে পড়বে। ইতিমধ্যেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেই হুমকি দিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, এখানে মুসলিম জাতিসত্তার অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে। কারণ শুধু বাবরি মসজিদ নয়, যে কোন স্থানের একটি মসজিদ সেখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের শক্ত ভিত ও তার প্রতীক। একটি মসজিদকে সরিয়ে দেয়া মানে মুসলিম জাতিসত্তার ভিতকে উপড়ে ফেলা বলেই মনে করে মুসলিমরা। তাই এই রায়ের মধ্যে দিয়ে সেই জাতিসত্তার প্রতি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যে অসম্মান প্রদর্শন করেছে, তাতে তীব্র ক্ষোভের কারণ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

ইতিহাসের কোথাও দেখা যায় না যে, যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধ-পরবর্তী বিজিত অঞ্চলে মুসলিমদের দ্বারা ধর্মীয় কারণে কোন নারী, শিশু, বৃদ্ধ লাঞ্ছিত হয়েছে কিংবা কোন ধর্মীয় স্থাপত্য ধ্বংস করে সেখানে মুসলিম স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়েছে। যদি সেটাই হত তাহলে বিখ্যাত নালন্দা বিহার, সারনাথ, সাঁচি, চৈত্য, মথুরা, কাশী, গয়া অসংখ্য স্থাপত্য নিদর্শন পর্যটকদের চোখে পড়ত না। মুসলিমরা উপমহাদেশে শক্তি প্রদর্শন করেননি, তারা ইসলামী সভ্যতা ও আদর্শ প্রচার করেছিলেন মাত্র। তারা যুগে যুগে মানুষকে অন্ধকার পথ পরিত্যাগ করে আলোর পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। সে আহ্বান জবরদস্তিমূলক কিংবা সহিংস ছিল না।

অতএব সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বজায় রাখার স্বার্থে উক্ত রায় পুনর্বিবেচনা করে সেখানে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্তই হতে পারে শান্তিপূর্ণ সমাধান। কারণ ৫০০ বছরের বৃহৎ একটি প্রাচীন মসজিদ নিয়ে এ ধরনের অনুমান ভিত্তিক বিতর্ক কখনোই কাম্য নয়। পবিত্র স্থান মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়ার কারণে সারা পৃথিবীর মুসলিমদের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে বছরের পর বছর। আবার সেখানে নতুন করে মন্দির তৈরির রায় কল্যাণকর কোন সমাধান হতে পারে না। এটা কেবল ঘৃণা আর বিদ্বেষই ছড়াবে। মসজিদ আল্লাহ্র ঘর। আর আল্লাহই সর্বোত্তম অভিভাবক। তাই কোন একদিন আল্লাহর পক্ষ থেকেই চূড়ান্ত ফায়ছালা নেমে আসবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে নিরাপত্তা দান করুন এবং তাঁর নিদর্শনকে সংরক্ষণ ও সম্মানিত করুন-আমীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ




ফেসবুক পেজ