নারী বিষয়ে ইসলামবিরোধী সংস্কার প্রস্তাব বাতিল করুন
দীর্ঘ ১৬ টি বছর স্বৈরাচার ও দুর্নীতিবাজ নরপশুদের দৌরাত্ম্যে দেশ গভীর খাদে নিমজ্জিত হয়। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে দেশ তথাকথিত বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হয়। লুটপাট, পাচার ও আত্মসাতের নোংরা রাজনীতিতে দেশের জনগণের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। ফলে স্বৈরাচারী যালিম সরকারের প্রতি দীর্ঘদিনের লালিত ক্ষোভ ও বিদ্বেষ অগ্নি স্ফুলিঙ্গের ন্যায় বিকশিত হয়। ফুসে উঠে ছাত্রসমাজ। বিক্ষোভের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় স্বৈরাচার ইবলীস হাসিনা ও তার দোসররা। দ্বিতীয় বারের মত স্বাধীনতা অর্জন করে মানুষের মাঝে আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে মানুষ নতুন বাংলাদেশ গড়ার এক দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করে।
গণঅভ্যুত্থান ও গণবিপ্লব পরবর্তী দেশে সর্বজনীন মতৈক্য প্রতিষ্ঠা ও উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ মোট ১১টি কমিশন গঠিত হয়। উক্ত কমিশনসমূহের মধ্যে ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন’ গত ১৯ এপ্রিল রোজ শনিবার প্রধান উপদেষ্টার নিকট সুপারিশ প্রস্তাবনা জমা দেয়। যেখানে এমন অনেক সুপারিশ রয়েছে যেগুলো সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে তা দেশের সংবিধান, বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধেরও পরিপন্থী। যেমন: নারী অধিকার ও নারী-পুরুষ সমতার পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান, সকল ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, ত্বালাক্ব, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারী করা, সন্তানের উপর নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা, যৌনপেশাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত না করা এবং যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এ কমিশন এগুলোকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে করণীয় হিসাবে উল্লেখ করেছে।
অতঃপর পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের করণীয় হিসাবে যা উল্লেখ করেছে তাহল- ‘মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ-১৯৬১’ সংশোধন করে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা, মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের সম্পত্তিতে ৫০-৫০ ভাগ নিশ্চিত করা, ‘সাক্ষ্য আইন-১৯৭২’ সংশোধন করে নারীদের সাক্ষ্যগ্রহণে বৈষম্য দূরীকরণ, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসাবে ফৌজদারী আইনে অন্তর্ভুক্তকরণ, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন আলোচনায় নারীবিদ্বেষী প্রচার-প্রচারণা নিষিদ্ধ করতে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা। অতঃপর আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন হিসাবে উল্লেখ করেছে যে, দেশে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রতিষ্ঠিত হবে, রাষ্ট্র হবে ইহজাগতিক ও মানবিক এবং সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ হবে সমান, দক্ষ ও মর্যাদাসম্পন্ন ইত্যাদি (দ্র.: নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন)। এছাড়া উক্ত কমিশনের সাব-টাইটেল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীদের প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষ এর সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’। অর্থাৎ কমিশনের মূল উদ্দেশ্যই হল- সকল ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিলোপ সাধন ও নারী-পুরুষের মাঝে সমতা বিধান নিশ্চিতকরণ।
স্মর্তব্য যে, বাংলাদেশের মূল স্টেকহোল্ডার হল এ দেশের জনগণ। যেকোন জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়া বাঞ্ছনীয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উক্ত সুপারিশমালা পেশ করে এ কমিশন একদিকে যেমন দেশের সংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হওয়ায় ইসলামী মূল্যবোধেরও চরম বিরোধী কাজ করেছে। কেননা ইসলামে গণিকাবৃত্তি ও তার থেকে উপার্জিত আয়কে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য ধর্মগুলোতেও এটি নিষিদ্ধ ও ঘৃণিত হিসাবে বিবেচিত। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গণিকাবৃত্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা দেয়া একান্তই অগ্রহণযোগ্য। গণিকাবৃত্তিকে শ্রম হিসাবে বৈধতা দিলে তা যৌনতার বাণিজ্যিকীকরণকে উৎসাহিত করবে, যা সমাজে ভোগবাদী মানসিকতা ও পারিবারিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি করবে। নারী পাচার ও শিশু নিপীড়নের পথ প্রশস্ত করবে এবং সমাজে নারীর মর্যাদাহানির মাধ্যমে গভীর সংকট সৃষ্টি হবে। উল্লেখ্য, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, অষ্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, জার্মানী, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, গ্রীস, ইন্দোনেশিয়া সহ বিশ্বের ১৫টি রাষ্ট্রে গণিকাবৃত্তিকে পেশাগত কারণে শ্রম অধিকার আইনে শ্রমিক হিসাবে মর্যাদা দিয়েছে। কোন কোন দেশ তো তাদেরকে চিকিৎসা ও অবসর ভাতাও প্রদান করে। কিন্তু ঐ সমস্ত দেশগুলোর সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বলতে কিছুই নেই। যা বিশ্বের সচেতন মানুষ মাত্রই অবগত।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিধানের সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের অস্তিত্বের উপর একটি সুপরিকল্পিত আঘাত। এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে দেশের ধর্মীয় ভারসাম্য, পারিবারিক কাঠামো ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। কমিশনের সুপারিশমালার ২৫ পৃষ্ঠায় মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পত্তি দেয়ার দাবী জানানো হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন মূলত আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত উত্তরাধিকার বিধান দ্বারা রচিত। এটিকে বাতিল করার অর্থ কুরআনী আইনের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়া।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে যা কখনো সম্ভব হওয়ার কথা না। ইসলামে যিনাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু প্রস্তাবিত নারী কমিশনের সুপারিশমালাতে যিনার বিরুদ্ধে তো কিছু বলা নেই, বরং যিনাকে উৎসাহিত করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হল- নারী বিষয়ক কমিশনের সদস্যবৃন্দের মধ্যে যেমন পুরুষ কোন সদস্য নেই, তেমনি ইসলামী ভাবধারাসম্পন্ন কোন উচ্চশিক্ষিত মহিলাও অনুপস্থিত। প্রশ্ন হল- নিজেরাই বৈষম্যের মধ্যে থেকে তারা কিভাবে নারীদের প্রতি বৈষম্য দূরীভূত করবেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলাম নারীদেরকে যে সম্মান দিয়েছে কোন ধর্ম, দর্শন, মতবাদ, চেতনা ঐরূপ সম্মান ও মর্যাদা দেইনি, দিতে পারবেও না। এটি সমাজের নৈতিক কাঠামোর দিক থেকে যেমন এক ভয়াবহ সিদ্ধান্ত, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিক বিকাশেও প্রস্তাবটি অন্ধকার ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে নারীকে শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার অপসংস্কৃতি আরো বৈধতা পাবে, যা নারীর ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একদিকে রাষ্ট্র নারী অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলবে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীকে বিক্রির পণ্য হিসাবে বৈধতা দেয়ার প্রস্তাব রাখবে, এটি এক ভয়াবহ দ্বিচারিতা। এমন অবস্থান নারীকে অবমাননার দিকে ঠেলে দেবে এবং সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের পথকে আরো প্রশস্ত করবে। ফলে সমাজে এক গভীর নৈতিক ও মানবিক সংকটের সৃষ্টি হবে, যার প্রভাব পড়বে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে ও পরবর্তী প্রজন্মের মূল্যবোধ গঠনের উপরে। যে দুঃসাহস পূর্বের কোন সরকার দেখায়নি।
অতএব, স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিরোধী কোন প্রস্তাবনা যেন বাস্তবায়িত না হয়। অনতিবিলম্বে ইসলাম বিরোধী ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন-২০২৫’ বাতিল করা হোক। অন্যথা এর পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।
পরিশেষে বলতে চাই, স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মানুষ তার ধর্মীয় চেতনা ও অনুভূতি লালন ও পালন করতে যেন কোনরূপ বাধার সম্মুখীন না হয় ইন্টেরিম গভর্মেন্টের নিকট এটিই আমাদের প্রত্যাশা। আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রকার ষড়যন্ত্র থেকে বাংলাদেশকে সংরক্ষণ করুন ও আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করুন- আমীন!