মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬ অপরাহ্ন

নীতিবোধের সংকট!


মানুষের জীবন গড়ার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল নীতিবোধ। নীতিহীন মানুষ নির্বোধ পশুর সমতুল্য। তাই আগে যাদের মধ্যে নীতির গন্ধ পাওয়া যেত না, তাদেরকে সমাজের মানুষ এড়িয়ে চলত, ঘৃনা করত। এমনকি অপরাধীরাও পাপবোধের কারণে সমাজকে এড়িয়ে চলত। গণ্যমান্য ব্যক্তি, মসজিদের ইমাম, শিক্ষক কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ তাদেরকে ভাল হওয়ার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু বর্তমানে সততা ও নীতিবোধের অস্তিত্ব আদৌ খুঁজে পাওয়া যায় না। অধিকাংশ মানুষ গর্হিত পাপাচারে ডুবে থাকার কারণে তাদের আত্মবোধ নষ্ট হয়ে গেছে এবং অন্তকরণ পাথরের চেয়েও কঠিন হয়ে গেছে। ফলে ভাল-মন্দ যাচাইয়ের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে (সূরা আল-বাক্বারাহ ৭৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৪)। তাই মানব সমাজে নীতিবোধ সম্পন্ন একশ্রেণীর মানুষ থাকা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)।

মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণই নীতিবোধ। ইসলাম মানব জীবনের সকল পর্যায়ে নীতিবোধকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ তাক্বওয়াই মানুষের সামগ্রিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মানবজীবনের সার্বিক উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সফলতার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটা একদিনে অর্জন করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন ধারাবাহিক ও নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ। এক্ষেত্রে সুন্দর ব্যবস্থপনা, নিয়মিত অনুশীলন ও চর্চা আবশ্যক। মানুষের জীবনের সততা, মহানুভবতা, ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আদর্শিক গুণাবলী ও আত্মশুদ্ধির ফসল হচ্ছে নীতিবোধ। এই নীতিবোধই মানুষের জীবনের মূল চাবিকাঠী, যা সামগ্রিক জীবনকে আলোকময় করে। নীতিবোধের শিক্ষা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তুমি ক্ষমার নীতি গ্রহণ কর। লোকদের সৎকাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৯৯)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/২৭৩; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৪৫)।

ন্যায়পরায়ণতা সকল অন্যায়-অত্যাচার, যুলুম-নির্যাতন, অনিয়ম ও স্বার্থপরতার কষাঘাত থেকে পরিত্রাণের এক সাহসী ও প্রতিবাদী শক্তি। কোন জাতি যখন অনৈতিকতার দুর্গন্ধ নর্দমায় পতিত হয়, তখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। আর এ অবক্ষয় রোধে তখন নীতিবোধ ও নৈতিকতার জাগরণই হয় একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, বিশ্বময় আজ সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নীতিবোধের দুর্ভিক্ষ চলছে। সর্বত্রই চরম সংকট বিরাজমান। শিক্ষাখাত থেকে নীতিবোধ ছুড়ে ফেলে দুর্নীতি ও নোংরামি দ্বারা কলুষিত করা হচ্ছে। চিকিৎসা খাতও অবনতির চরম পর্যায়ে। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত করে নীরবে মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে দ্বিধা করছে না। নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে অদক্ষ লোকবল নিয়োগ, পদোন্নতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার তো থেমে নেই। সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও অসৎকর্ম মহামারি আকার ধারণ করেছে। অন্যের সফলতা কারো সহ্য হয় না। সুযোগ পেলেই বিপদে ফেলার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। কারও বিপদে সাহায্য না করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখে, সেলফি তুলে ও ভিডিও করে। যারা সাহায্য করতে আসেন, তারা এটাকে ব্যবসা হিসাবে দেখেন। ফেসবুক/ইউটিউবে লাইভ করেন, ভিউ-ফলোয়ার ও ভক্ত বাড়ানোর জন্য। অন্যের নামে কুৎসা রটানো, অপদস্ত করা নীতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে, আমিই ভালো, আমিই সফল হব। সবকিছু আমারই হতে হবে। আমার থেকে অন্য কেউ ভালো থাকতে পারবে না। অন্যদিকে নিজের অনৈতিকতা ঢাকার জন্য চরমভাবে মিথ্যাচারে নিমজ্জিত। তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতার আড়ালে আকাম-কুকাম সবই করে যাচ্ছে। আজকাল মিথ্যা বলাটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। যে ব্যক্তি যত পরিমাণ মিথ্যা বলতে পারে তাকে তত পরিমাণ বুদ্ধিমান মনে করা হয়। মিথ্যা ও প্রতারণা গুনাহের কাজ, এ বিশ্বাসটি মানুষের হৃদয় থেকে উঠে যাচ্ছে। তাই সবসময় কথা ও কাজে সততা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়া এবং মিথ্যার অভিশপ্ত গ্লানি থেকে বেঁচে থাকা যরূরী।

অতএব মানবমনে নীতিবোধ জাগ্রতকরণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। যেমন ক. ঈমান ও তাক্বওয়া সম্পর্কে সচেতন হওয়া। কারণ এটা আল্লাহ ও বান্দার মাঝের সেতুবন্ধন। তাক্বওয়া অর্জনে মানুষ পাপ কাজ থেকে যেমন বিরত থাকে তেমনি সৎকাজে উদ্বুদ্ধ হয়। খ. পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করা। কারণ ছালাত বান্দাকে যাবতীয় পাপাচার থেকে বাধা দান করে (সূরা আল-আনকাবূত : ৪৫)। গ. কুরআন তেলাওয়াত করা ও অনুধাবন করা। পবিত্র কুরআনের প্রভাবে ঈমান ও বিশ্বাস দৃঢ় হয়। সততা ও নীতিবোধ জাগ্রত হয়। মানুষ যখন বিশ্বাসী হয়, তখন তার মধ্যে সততার প্রভাব পড়ে। ঘ. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শের যথাযথ অনুসরণ করা। কারণ নীতিবোধের সবকিছুই তাঁর চরিত্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ঙ. ছাহাবীদের জীবনী চর্চা করা। চ. যিকিরের অভ্যাস করা। দুর্বল ঈমানের সুস্থতার জন্য যিকির খুবই উপকারী। আল্লাহর যিকির অন্তরে ঈমানের বীজ বপন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করে তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রাখো, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর শান্তি পায়’ (সূরা আর-রা‘দ : ২৮)। চ. যাবতীয় হারাম কর্মের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নীতিবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!!




প্রসঙ্গসমূহ »: সম্পাদকীয়
ইলিয়াসী তাবলীগ নিষিদ্ধের নেপথ্যে - সম্পাদকীয়
ইসলামী দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি ও ফলাফল - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সালাফী মানহাজ : পরিচিতি ও অনুসরণের আবশ্যকতা - সম্পাদকীয়
­­অসহায় মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন! - সম্পাদকীয়
আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিষোদগার : চরম অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ - সম্পাদকীয়
নারী পোশাকের স্বাধীনতা ও প্রগতিবাদীদের ভ্রান্তি বিলাস - সম্পাদকীয়
খুলূছিয়াত আবশ্যক - সম্পাদকীয়
নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠায় আলেম সমাজের ভূমিকা - সম্পাদকীয়
ইসলাম ও মানবাধিকার - সম্পাদকীয়
সার্বিক নিরাপত্তা আবশ্যক - সম্পাদকীয়
ঈদে মীলাদুন্নবী : শী‘আদের সৃষ্ট অভিশপ্ত অনুষ্ঠান - সম্পাদকীয়
শী‘আ প্রীতি ও সঊদী বিদ্বেষ - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ