বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩২ অপরাহ্ন

প্রচলিত কুসংস্কার : মুসলিমদের জন্য মরণব্যাধি ক্যান্সার


কুসংস্কার হল যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাস। বিভিন্ন প্রথা ও রেওয়াজের ভিত্তিতে যেসব নীতি প্রচলিত আছে সেগুলোই কুসংস্কার। ইসলামী শরী‘আতের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে বহু নতুন কুসংস্কারের উদ্ভব ঘটেছে। তখনই রাশিফল, হস্তরেখা, ভাগ্য পরীক্ষার মত যুক্তিহীন বিষয় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। মা-বাবার নামে মাযারে, খানকায়, গাছতলায়, তীর্থস্থানে পশু মানত করার ঘটনা বহুল প্রচলিত। গ্রাম-শহর সর্বত্রই কুসংস্কার ছেয়ে আছে। পরীক্ষায় যাওয়ার আগে ডিম খাওয়া যাবে না, প্রথম কাস্টমারকে বাকী দেয়া যাবে না, জোড়া কলা খেলে জমজ বাচ্চা জন্ম হয়, কাক ডাকলে বিপদ আসে, দোকানের প্রথম কাস্টমারকে ফেরত দেয়া কুলক্ষণ, বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে দেয়া, পেঁচা অশুভ ইত্যাদি। মুসলিম সমাজে ধর্মের নামে অসংখ্য কুসংস্কার চালু আছে। কবরপূজা, মাযারপূজা, পীর-ফকীরের পূজা, দরবেশ-বুজুর্গের পূজা, গাছ, পাথর, পুকুর, মাছ, কুমির, কচ্ছপ, কবুতরপূজা, মৃত পীরের অসীলায় সাহায্য চাওয়া, সিজদা করা, দু‘আ করা, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক মনে করা ইত্যাদি সবই ধর্মীয় কুসংস্কার। রাজনীতির নামেও অসংখ্য কুসংস্কার চর্চা করা হয়। শহীদ মিনার, বেদী, স্মৃতি সৌধ, প্রতিকৃতি, শিখা চিরন্তন, শিখা অনির্বাণ, পতাকা ও দিবসকে শ্রদ্ধা জানানো, ফুল দিয়ে ভক্তি প্রদর্শন করা, খাম্বার সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা, কুর্নিশ করা ইত্যাদি। ইসলামের সাথে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, পূঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিজাতীয় মতবাদের সংমিশ্রণও জাহেলী কুসংস্কার এবং ত্বাগূতী চিন্তাধারা।

কুসংস্কারের নামে যে সমস্ত প্রথা চালু আছে, সেগুলোর অধিকাংশই শিরক, যা মুমিনের ঈমান ও আমল নষ্ট করে দেয় এবং ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। ঈমানের সবচেয়ে বড় দুশমন হল, শিরক, কুফর, ত্বাগূত ও নিফাক। অথচ এগুলোর মধ্যেই অধিকাংশ মুসলিম হাবুডুবু খাচ্ছে। কুসংস্কারের পূজা করতে গিয়ে কখন যে একজন ব্যক্তি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে মুশরিক হয়ে গেছে তা সে টেরই পায়নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে, তাদের অধিকাংশই মুশরিক’ (সূরা ইউসুফ : ১০৬)। তিনি আরো বলেন, ‘মনে রেখো, আল্লাহর কাছেই রয়েছে তাদের কুলক্ষণসমূহের চাবিকাঠি। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই তা বুঝে না’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৩১)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে কোন বিষয়কেই অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত (আবূ দাঊদ, হা/৩৯১০)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘কুলক্ষণ বা দুর্ভাগ্যের ধারণা যে ব্যক্তিকে তার স্বীয় প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে দূরে রাখল, সে মূলত শিরক করল’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/৭০৪৫)।

প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উচিত অন্ধভাবে কোনকিছু বিশ্বাস না করা। কারণ শয়তান মানুষের সামনে মিথ্যাকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে এবং সারাজীবন ভুল পথে চলার প্ররোচনা দিয়ে থাকে (সূরা ইবরাহীম : ২২)। কোন ব্যক্তি যখন ইবলীস শয়তানের ফাঁদে পড়ে যায়, তখন সে জীবনের সবকিছুতেই সন্দেহ ও সংশয়ের শিকার হয়। এর ফলে সে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করতে পারে না। তখন সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করে থাকে। এ প্রসঙ্গে ‘উমর ইবনুল খাত্ত্বাব  (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘ইসলামের বন্ধনগুলো এভাবে একটি একটি করে খুলে যাবে, এমনকি এক পর্যায়ে মুসলিমদের মধ্যে এমন মানুষ তৈরি হবে, যারা জাহিলিয়াত সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবে’ (মুখতাসার সীরাতুর রাসূল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩)। অর্থাৎ সত্য-মিথ্যা, তাওহীদ-শিরক, সুন্নাত-বিদ‘আত সব মিশ্রিত করে ফেলবে।

আলেম সমাজের উচিত ছিল ঈমান বিধ্বংসী এ সমস্ত শিরক-বিদ‘আত ও জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। কিন্তু দুঃখজনক হল, অধিকাংশ কথিত আলেম এই কুসংস্কারকে ধর্মব্যবসার হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং কুরআনকে তাবীযের কিতাব বানিয়ে ফেলেছে। এরা আলেম নয়, পকেট পূজারী। সমাজে শিরক-বিদ‘আতকে চালু রেখে তারা বিনাপূজির ব্যবসা করছে। তাই মাযারপূজা, কবরপূজা, পীরপূজা, তাবীয-কবযকে জায়েয করার জন্য বিদ‘আতী মোল্লারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। দ্বীন বিক্রি করে জীবিকা অর্জন করে তারা আগুন ভক্ষণ করছে (সূরা বাক্বারাহ ১৭৪)। এই শ্রেণীর আলেমদের জিহ্বা জাহান্নামের কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়া হবে (ইবনু হিব্বান, হা/৫৩, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৯১)। এ সমস্ত পথভ্রষ্ট জাহেলদের থেকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।

তাওহীদপন্থী আলেমদের দায়িত্ব হল, প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। শিরক-বিদ‘আত ও জাহিলিয়াতের ধ্বংসাত্মক পরিণাম সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা, বিদ‘আতী মোল্লাদের মুখোশ খুলে দেয়া। প্রতিটি ঘরে সালাফী মানহাজের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া এবং তাওহীদের দুর্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। যার ফলে শয়তানের এজেন্টদের অপবিত্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে এবং কুসংস্কার বিতাড়িত হবে ইনশাআল্লাহ। শায়খ ছালিহ আল-ফাওযান বলেন, ‘তিনটি জিনিসের মাধ্যমে কুসংস্কার মুকাবিলা করা যেতে পারে। (১) আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা। (২) মনবল দৃঢ় রাখা এবং (৩) আল্লাহ্র কাছে বেশি বেশি দু‘আ করা’ (ই‘য়ানাতুল মুস্তাওফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ, ২য় খ-, পৃ. ১৪)। আল্লাহ তা‘আলা কুসংস্কারের মত ঈমান বিধ্বংসী ক্যান্সার থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন-আমীন!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ




প্রসঙ্গসমূহ »: সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ