বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৪৬ অপরাহ্ন

স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব: অস্তিত্ব সংকট, কারণ ও সমাধান


বাংলাদেশ বড় কঠিন দুঃসময় অতিবাহিত করছে। বিশেষ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এটি টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের কার্যকরী ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব একটি দেশের মর্যাদাকে উন্নত ও সুসংহত করে। এজন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও কর্মকৌশল দেশ, জনগণ এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে হওয়া বাঞ্চনীয়। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি, দল কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্রের খবরদারী, চোখ রাঙ্গানিকে বিন্দু পরিমাণ পরোয়া করা চলে না। অন্যথা স্বাধীনতা বিপন্ন হবে এবং সার্বভৌমত্বের কবর রচিত হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই ছোট্ট এই ভূ-খণ্ডটি সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে বারবার। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ষড়যন্ত্রের প্রথম বীজ বাপিত হয় ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১২শ মাইল দূরত্ব থাকার পরও প্রতিবেশী হিন্দুরাষ্ট্র ভারতের সাথে যুক্ত না হয়ে বাংলাদেশ ‘পূর্ববঙ্গ’ নামে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত হয়। যদিও কুচক্রী নেহরু-প্যাটেল ও বৃটিশ ভাইসরয় র‌্যাডক্লিফের চক্রান্তে বহু মুসলিম এলাকা ভারতভুক্ত হয়। অতঃপর ভারতীয় চক্রান্তে মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে পাকিস্তান দু’টুকরা হয়ে যায়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গীয় দু’ভাইয়ের মাঝে। মূলত মুসলিম ভূখণ্ডকে দিখণ্ডিত করা, দুর্বল করা এবং ভারতের আধিপত্য বিস্তার করাই মূল উদ্দেশ্য। যার বাস্তবতা ’৭১-এর ৭ দফা ও ’৭২-এর ১২ দফা গোলামী চুক্তি স্বাক্ষর। প্রথমতঃ উক্ত চুক্তির মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ করে পূর্ব বাংলাকে করায়ত্ত করার বন্দোবস্ত করে। ৫৩ বছর ধরে এদেশে ভারত তার সাম্রাজ্যবাদী চেতনা ও আধিপত্যের বিস্তার ঘটায়। উজানে বাঁধ দিয়ে খরা মৌসুমে শুকিয়ে মারে এবং বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি দিয়ে ডুবিয়ে মারে, সীমান্তে হত্যা, চোরাচালান, অবৈধ মাদকের অনুপ্রবেশসহ এ দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সবকিছু দখল করে নিয়েছে ভারত। ফ্যাসিবাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ডামি নির্বাচনে সহযোগিতা ও ভারতীয় ‘র’-এর এজেন্টদেরকে সশস্ত্র বাহিনী ও প্রশাসনিক বিভিন্ন সেক্টরে বসিয়েছে। হত্যা, গুম, খুন, জেল, হামলা, মামলা সহ পিলখান ট্রাজেডি ও শাপলা চত্বরে তাদের দ্বারাই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। বর্তমানে ফ্যাসিবাদের দোসরদের আশ্রয় দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়তঃ স্বাধীনতার মূল স্প্রীট ইসলাম এবং ৮৫ শতাংশ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে চাপিয়ে দেয়া হয় ধর্মহীন মতবাদ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মত নিকৃষ্ট থিওরিগুলোকে। ফলে বিভিন্ন সময়ে তৈরি হয়েছে বাকশাল, স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদ। যার বিষময় ফল হল নিপীড়ন, নির্যাতন, অন্যায়, অত্যাচার, দুর্বৃত্তায়ন, আত্মসাৎ, লুটতারাজ, অর্থপাচার, হত্যা, গুম, খুন, চাঁদাবাজি, যেনা-ব্যভিচার, সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারি, নেশা, মওজুদদারী, মোনাফাখরী ও সিন্ডিকেট প্রভৃতি। এভাবে যুগের পর যুগ স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি করা হয়েছে। যার বাস্তবতা সুস্পষ্ট।

গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন হয়েছে এবং বাংলাদেশ নতুন স্বাধীনতা লাভ করেছে। এর নেপথ্যে ঝড়েছে শত শত তরুণের লাশ, আহত হয়েছে হাজার হাজার অসহায় মানবতা এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে অসংখ্য রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। তদুপরি গঠিত হয়েছে জনগণের কাক্সিক্ষত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যারা অত্যন্ত নমনীয়তা, ধৈর্যশীলতা ও ভদ্রোচিতভাবে সরকার পরিচালনা করছেন। অন্যদিকে বছরের পর বছর অভুক্ত থাকা ক্ষুধার্ত রাজনৈতিক দলগুলোর দৃশ্যমান উল্লম্ফনে সাধারণ জনগণ রীতিমত হতবাক। প্রশ্ন হল: প্রকৃতপক্ষে এদেশের মানুষ কি স্বাধীন হয়েছে, না-কি দেশের তথাকথিত সুশিল, নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও আধিপত্যশীল ভারতের নিকট স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেয়ার গোপন আঁতাত করে চলেছে? যদি তাই না হবে, তাহলে আজও দেশ অস্থিতিশিল কেন? প্রশাসনিক কোন কর্মতৎপরতা নেই, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থেমে নেই, চাঁদাবাজদের খপ্পরে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ। অন্যদিকে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে পরিবেশ উত্তপ্তকরণ, বিচার কার্যক্রমে স্থবিরতা ও দীর্ঘসূত্রিতা, দাগী আসামীদের জেল থেকে মুক্তকরণ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুর্নবাসন প্রভৃতি স্বাধীনকামী মানুষদেরকে আশাহত করেছে।

স্মর্তব্য ভৌগোলিক নিজস্বতা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নয়। মূলত স্বাধীনতা হল সকল ক্ষেত্র ও বিভাগ থেকে সর্বপ্রকার বৈষম্য, অসাম্য ও অনাচার দূর করে তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সত্যগ্রহণ ও সত্যচর্চার অধিকার লাভ করা। অথচ এদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র নীতিসহ সর্বক্ষেত্রে অশুভ প্রভাব বিস্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের উপরও পড়েছে কালো থাবা। ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য চরম হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোসররা কখনো জুডিশিয়াল ক্যু, কখনো পাহাড়, কখনো সংখ্যালঘু, কখনো আনছার বিদ্রোহ, শ্রমিক আন্দোলন, পল্লী বিদুৎ সহ বিভিন্ন সেক্টরে অন্তর্ঘাত, অপতথ্য ও গুজব উৎপাদনসহ নানাবিধ উপায়ে ষড়যন্ত্র চলমান রয়েছে। যা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বড় হুমকি। এই হুমকি প্রতিরোধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী অপশক্তি, পতিত স্বৈরাচার ও তার মাফিয়া বাহিনীকে যেকোন মূলে রুখে দিতে হবে। বিদেশে পলায়নরত অপরাধীদের দ্রুত দেশে ফিরে এনে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে ভারতে যারা আছে। ফ্যাসিবাদের দোসর ও আমলাদের অপসারণ ও অপরাধীদের বিচার দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। ভারতীয় ‘র’-এর এজেন্ড ও দালালদের চিহ্নিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে, যেমনটা কানাডা সরকার করেছে। মনে রাখতে হবে যে, স্বৈরাচারের দোসরদের আশ্রয় দিয়ে ভারত আবারও প্রমাণ করেছে তারা এদেশের চিরশক্র। এজন্য তাদের সাথে গত ১৫ বছরে করা সকল অবৈধ চুক্তি বাতিল করতে হবে এবং যেকোন মূল্যে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও আধিপত্য রুখে দিতে হবে। রাজনীতি থেকে মাফিয়াতন্ত্র মূলোৎপাটন পূর্বক দলবাজ রাজনীতির নাগিণীর বিষ দাঁত উপড়ে ফেলতে হবে। মানবরচিত ও ঈমান বিধ্বংসী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক মতবাদগুলো বাতিল করতে হবে এবং তদস্থলে ইসলামী নীতি-আদর্শ, বৈশিষ্ট্য ও যুগান্তকারী কর্মকৌশলের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। কেননা ইসলামের আইন ও বিধান সকল যুগে মানবজাতির জন্য চিরকল্যাণকর। এর কল্যাণ স্পর্শে রাষ্ট্র নবজীবন লাভ করবে এবং সর্বদা উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অগ্রসরমান থাকবে।


সর্বোপরি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে মুসলিমদেরকে ইসলামের সামগ্রিক আযাদী চেতনায় জাগ্রত হতে হবে। নিজেদের ঈমান, আমল ও আদর্শবোধ জাগ্রত করা ও তদোদ্দেশ্য নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ ও তার যথাযথা বাস্তবায়ন করতে হবে। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অস্তিত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে হলে ঈমান, আমল ও আদর্শ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। মহান আল্লাহ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হেফাযত করুন-আমীন!




প্রসঙ্গসমূহ »: রাজনীতি
ইসলামী শিক্ষা : উন্নত জাতি গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম - সম্পাদকীয়
নাগরিকের রাষ্ট্রচিন্তা - সম্পাদকীয়
অর্থ সংকট ও মূল রহস্য - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ : অমার্জনীয় ধৃষ্টতার আস্ফালন - সম্পাদকীয়
শী‘আ প্রীতি ও সঊদী বিদ্বেষ - সম্পাদকীয়
শৃঙ্খলাপূর্ণ উন্নত সমাজ কাঠামো কাম্য - সম্পাদকীয়
রামাযান : ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্যে কিছু কথা - সম্পাদকীয়
মহামারীর কারণ ও পরিত্রাণের উপায় - সম্পাদকীয়
আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিষোদগার : চরম অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ - সম্পাদকীয়
সালাফী মানহাজ : পরিচিতি ও অনুসরণের আবশ্যকতা - সম্পাদকীয়
খুন ও ধর্ষণ : নৈরাজ্যের চরম সীমা অতিক্রম - সম্পাদকীয়
রাহুমুক্ত বাংলাদেশ: সর্বত্র সংস্কার প্রয়োজন - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ