উত্তম চরিত্রের দুর্ভিক্ষ ও পরিত্রাণের উপায়
উত্তম চরিত্র মানব জীবন গঠনের মূল স্তম্ভ। এর মাধ্যমে মানুষ কল্যাণের দিকে অগ্রগামী হয় এবং সুউচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। সচ্চরিত্র এমন গুণ, যা মানুষের ব্যক্তিত্বকে গঠন করে, তার সংকল্পকে শক্তিশালী করে, নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করে, যাবতীয় অনিষ্ট থেকে সুরক্ষা দেয় এবং মানুষের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনের পথকে সুগম করে। এছাড়া মানবিক মূল্যবোধ গঠন উত্তম চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাইতো কোন সমাজের অধিবাসীগণের মধ্যে যদি উত্তম চরিত্র বিদ্যমান থাকে, তাহলে সে সমাজ হবে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহযোগিতাপূর্ণ একটি শান্তিময় সমাজ। যা প্রতিটি মানুষেরই প্রত্যাশিত বিষয়।
পক্ষান্তরে মানুষের চারিত্রিক অধঃপতন ঘটলে এবং তাদের মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট হলে মানবজাতি ও সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। ক্বওমে নূহ, ক্বওমে হূদ (আদ জাতি), ক্বওমে ছালিহ (ছামুদ ছাতি), ক্বওমে শু‘আইব (মাদইয়ান জাতি), ক্বওমে লূত্ব এবং ক্বওমে মূসা (ফিরআঊন ও তার সঙ্গীদের) ধ্বংসের ইতিহাস তার জ্বাজল্য প্রমাণ বহন করে। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে তাদের অস্তিত্ব ও সভ্যতা চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে। আধুনিক পাশ্চাত্যও ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবমান। কেননা বর্তমানে সভ্যতা-সংস্কৃতির নামে যৌনবাদ, ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতার মত প্রভৃতি চরিত্র বিধ্বংসী নোংরা ও অশ্লীল চিন্তা-চেতনা যেভাবে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে, ফলে মানুষের চারিত্রিক অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে এবং মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষ সূদ-ঘুষ, যেনা-ব্যভিচার ও নেশায় আসক্ত। দুর্নীতি, পাচার, স্বজনপ্রীতি, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে ও শিশু খাদ্যে ভেজাল, অত্যাচার-নির্যাতন, অবৈধ সম্পর্ক, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। অসংখ্য মানুষ খুন, হতাহত এবং আহত হচ্ছে। কত সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। যার মৌলিক কারণ আমিত্ব এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ। মূলত এগুলো মানুষ তখনই করে, যখন দ্বীন থেকে বিরত থাকে কিংবা দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যখন মানুষের দ্বীনদারিতা দুর্বল হয়ে যায় এবং দ্বীনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তাদের মূল্যবোধ শেষ হয়ে যায় এবং তারা চরিত্রহীন হয়ে পড়ে। এতদ্ভিন্ন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ, বস্তুবাদ সহ বিভিন্ন মস্তিষ্ক প্রসূত তন্ত্রমন্ত্রের বিষবাষ্পে মানবজাতি আকণ্ঠ নিমজ্জিত। ইসলামকে বাদ দিয়ে মানুষ এগুলোকেই আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করছে। কোথাও শান্তির লেশমাত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চতুর্দিকে যেন উত্তম চরিত্রের দুর্ভিক্ষ দৃশ্যমান। অথচ চরিত্রবান মানুষ মানেই আদর্শ সমাজ। আর আদর্শ সমাজ মানেই সুন্দর, শান্তিময় পরিবেশ ও উন্নত রাষ্ট্র। এজন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিবেশ সুন্দর করে গড়ে তুলতে উত্তম চরিত্রের বিকল্প নেই। একজন উত্তম চরিত্রবান লোক চাইলে অল্প সময়েই পুরো সমাজকে বদলে দিতে পারে; কারণ উত্তম চরিত্র মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের দিকে ধাবিত করে (ছহীহ বুখারী, হা/৬০৯২)। এ উত্তম চারিত্রিক গুণ দিয়েই মুহাম্মাদ (ﷺ) একটি বর্বর ও অন্ধকারচ্ছন্ন সমাজকে বিশ্ববাসীর জন্য আদর্শ সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই সকল ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আদর্শই শিরোধার্য (সূরা আল-আহযাব: ২১)। অন্যথা ধ্বংস অপরিহার্য (সূরা আন-নূর: ৬৩)।
স্মর্তব্য যে, মানুষের আক্বীদা, ঈমান ও মানহাজ সবই আভ্যন্তরীণ বিষয়। পক্ষান্তরে চরিত্র, আচার-আচরণ ও পারস্পরিক লেনদেন বাহ্যিক বিষয়। মানুষ মূলত এই বাহ্যিক আচরণের উপর ভিত্তি করেই অন্যের সাথে পরিচিত হয়, আত্মীয়তা গড়ে তোলে এবং ভাল-মন্দ মূল্যায়ন করে থাকে। সুতরাং বিশুদ্ধভাবে আক্বীদা ও মানহাজকে ধারণ করার পর সর্বপ্রথম কাজ হল- উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া। অন্যদিকে এই দ্বীন এবং আক্বীদা থেকেই মূলত চরিত্র ও মূল্যবোধের সৃষ্টি। যা শরী‘আতের বিধি-বিধান প্রতিপালনের মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে। এই মূল্যবোধের কারণেই মানুষ অন্যদের সাথে ভাল আচরণ করে থাকে। এজন্য উত্তম চরিত্র গঠন হলেই দ্বীনের সুরক্ষা হবে। অন্যথা দ্বীন ভূলুণ্ঠিত হবে। কেননা দ্বীন ও সচ্চরিত্র একে অপরের পরিপূরক। একটি ছাড়া অপরটি অচল। অতএব উত্তম চরিত্র হল প্রত্যেক স্তরের প্রতিটি মানুষের সকল হক আদায় করা, ইহসান করা, সৎকাজ করা, অসৎকাজে নিজে বিরত থাকা ও অপরকে বিরত রাখা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখা, অন্তর পরিচ্ছন্ন রাখা, সুন্দর ব্যবহার করা, সত্য কথা বলা, ন্যায়বিচার করা, ওযর কবুল করা, ক্ষমা করা, সহযোগিতা করা, উদারতা দেখানো, পাপের কাজ পরিত্যাগ করা, ভাল গুণে গুণান্বিত হওয়া। আর মানুষের বিষয়াবলী নিয়ে সমালোচনা, তাদের দোষ খোঁজ করা, তাদের কথা ও কাজের বর্ণনা এবং তাদের গোপনীয়তা অনুসন্ধান করা থেকে বিরত থাকা, কঠোরতা, অভদ্রতা, দুর্ব্যবহার ও ভ্রু কুঞ্চিত করা পরিত্যাগ করা, তাড়াহুড়া, সহিংসতা ও অস্থিরতা পরিহার করা। গীবত-তোহমত, চোগলখুরী ইত্যাদি ত্যাগ করা। যে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করা, যে যুলম করেছে তাকে ক্ষমা করা এবং অন্যায় দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আপনি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করুন, সৎকাজের আদেশ দিন এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলুন’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৯৯)। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘তিনটি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে উত্তম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। যথা: নিষিদ্ধ কাজগুলো এড়িয়ে চলা, হালাল অন্বেষণ করা এবং নিজের পরিবার-পরিজনের প্রতি উদার হওয়া’ (নাযরাতুন নাঈম, ৫/১৫৮৪)।
চরিত্র সৃষ্টিগত স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য। এই চরিত্র, আচার-আচরণ, লেনদেন, কষ্ট ও পরিশ্রমের মাধ্যমে যেমন অর্জন করা যায়, তেমনিভাবে পরহেযগার ও হক্বপন্থী উলামায়ে কেরামের সাহচর্য গ্রহণ ও মেলামেশার মাধ্যমে অর্জিত হয় এবং শিষ্টাচারের মাধ্যমে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। এমনকি পর্যায়ক্রমে তা পূর্ণ যোগ্যতা ও নিয়মিত স্বভাবে রূপান্তরিত হয়। ফলে সে সকলের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়। নবী (ﷺ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় জ্ঞান শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত হয় আর ধৈর্যের মাধ্যমে সহনশীলতা অর্জিত হয়। যে কল্যাণ অনুসন্ধান করে তাকে তা দেয়া হয় এবং যে অকল্যাণ থেকে মুক্তি পেতে চায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়’ (বাইহাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১০২৫৪, সনদ হাসান)। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, ‘উত্তম চরিত্র গুনাহগুলোকে গলিয়ে দেয় যেমন সূর্যের তাপ বরফকে গলিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে বদ চরিত্র মানুষের নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয় যেমন সিরকা মধুকে নষ্ট করে দেয়’ (তান্বীহুল গাফিলীন, পৃ. ৪৬৩)। পরিশেষে বলব, আল্লাহ তা‘আলা অধঃপতিত মুসলিম জাতির হারানো ঐতিহ্য আখলাক্বে হাসানাহ তথা উত্তম চরিত্রকে পুনরুদ্ধার করার তাওফীক দান করুন। প্রতিটি মুসলিমকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী করুন। শিশু-যুবক-পৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য সহ সকল নারী-পুরুষকে যাবতীয় খারাপ চরিত্র থেকে রক্ষা করুন। আমীন!!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
প্রসঙ্গসমূহ »:
সম্পাদকীয়