লৌকিকতামুক্ত কুরবানী : তাওহীদ বাস্তবায়নের উপায়
তাওহীদ বাস্তবায়নের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল ইখলাছ। তাওহীদ ও ইখলাছ পরস্পর পরিপূরক। একটি ব্যতীত অপরটি কল্পনা করা যায় না। তাওহীদ হল ইবাদতের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক গণ্য করা। আর ইখলাছ হল মানব জীবনের সকল কার্মকাণ্ড এক আল্লাহর জন্যই নিবেদন করা। মানুষের জীবনযাত্রার সামগ্রিক পরিমণ্ডলে এতদুভয়ের পরিপূর্ণ সংযোগ না থাকলে জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। দুনিয়ায় সুখ, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তপূর্ণ জীবন থেকে হবে বঞ্চিত আর আখিরাতে হবে জাহান্নামের খড়ি। মহান আল্লাহ কর্তৃক যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণের মৌলিক উদ্দেশ্যই হল, মানুষের সার্বিক জীবনে তাওহীদের বাস্তবায়ন ও ত্বাগূত পরিহারকরণ (সূরা আন-নাহল: ৩৬)। প্রত্যেক নবী-রাসূল শতভাগ সফলতার সাথে সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছেন। যে বিষয়ে কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সন্দেহ-সংশয় ও অপূর্ণতার কোন লেশমাত্র নেই।
আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّکَ وَ انۡحَرۡ ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন’ (সূরা আল-কাওছার: ২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ‘)হে নবী!) আপনি বলুন, আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত’ (সূরা আল-আন‘আম: ১৬২)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর বিধান রেখেছি’ (সূরা আল-হজ্জ: ৩৪)। হাদীছেও রাসূল (ﷺ) ঈদুল আযহাকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ (يَوْمَ الْأَضْحَى) বা কুরবানীর দিন নামে আখ্যায়িত করেছেন (আবূ দাঊদ, হা/২৪১৭; মিশকাত, হা/১৪৩৯, সনদ ছহীহ)। অতএব কুরবানী করা মহান আল্লাহর ইবাদত। যা সম্পাদিত হবে কেবল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, লোক দেখানো ও শ্রুতির জন্য নয়। যার মূল চেতনা হবে মহান আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুযূ‘ হওয়া। সন্তানের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা, স্ত্রীর মহব্বত, সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ ইত্যাদি সবকিছুর উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতি আত্মসমর্পণ করা। এতদ্ভিন্ন ইসলামী শরী‘আতের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ ও যথাযথভাবে আত্মসমর্পণ করা। যা তাওহীদ বাস্তবায়নের মৌলিক দাবী। তাই কুরবানী হবে ইখলাছপূর্ণ আনুগত্য চর্চা ও তাক্বওয়া অর্জনের শ্রেষ্ঠতম উপায়।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, কুরবানীর এই মৌলিক চেতনা থেকে মুসলিমরা আজ ছিটকে পড়েছে। ইবাদতের পরিবর্তে কুরবানী এখন সাধারণ আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়েছে। কুরবানী করাও যে ইবাদত এটা মানুষ বেমালুম ভুলে গেছে। ফলে কার কুরবানী কত বড়, কত সুন্দর, কার কুরবানীর দাম কত, কার কুরবানীর গোশত কত কেজি হল ইত্যাদি নিয়ে কুরবানী দাতার যত চিন্তা-ফিকির। কারো টাকার সাথে গোশতের পরিমাণ কম হলে ‘ঠকেছে’ বলে পশু বিক্রেতার দফারফা করে ছাড়ে। কেউবা অনুমানের চেয়ে গোশত বেশি হওয়ায় ‘জিতেছে’ বলে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠে। এমনকি কার আত্মীয়-স্বজন কী কুরবানী করল সেটা নিয়েও চলে সমালোচনার তীর্যক বাণী।
আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইনস্ট্রগ্রাম প্রভৃতিতে কুরবানীর পশু ও পশুর সাথে ক্রেতার ছবি ছেড়ে দিয়ে গোটা বিশ্বকে জানানোর প্রতিযোগিতা তো মহামারীর রূপ ধারণ করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কুরবানীর পশুর ফ্যাশন শো প্রদর্শনে সকলেই ব্যস্ত। অন্যদিকে ইয়াতীম-মিসকীন ও প্রতিবেশীদের হকও যথাযথ আদায় না করে গোশত ফ্রীজিং করার প্রবণতাও নেহায়েত কম নয়। গোশত সংরক্ষণের জন্য এসময় ফ্রীজ, ডীপ ফ্রীজ ক্রয়ের পরিমাণ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। একশ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত, হারামখোর ও চশমখোররা বাজারের সবচেয়ে দামী পশু ক্রয় করে এবং সেটাকে ফলাও করে প্রচার করে বেড়ায়। টিভি, পত্র-পত্রিকাতে তাদেরকে নিয়ে রিপোর্টও করে থাকে। এলাকায় শোরগোল পড়ে যায়। পাশাপাশি কুরবানীর গোশত কাটাকাটি করা, বণ্টন করা ইত্যাদি কাজের অযুহাতে অনেকেই যোহর এমনকি আছরের ছালাতেও উপস্থিত হয় না। চামড়া, ভূড়ি, পা ইত্যাদি নিয়ে পরিশ্রমের তো কোন শেষ নেই।
এখানেই শেষ নয়, ঈদের দিন বিকালে শুরু হয় অপসংস্কৃতির নামে নোংরামি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও শয়তানী গান-বাজনার রকমারী আয়োজন। ঈদুল আযহার দিনে দেশের অধিকাংশ মুসলিমের মাঝে এরূপ চিত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে। উপরিউক্ত বিষয়গুলো হ্রাসের তুলনায় ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এগুলো সব লৌকিকতা, লোক দেখানো, শ্রুতি ব্যতীত কিছুই নয়। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَنۡ یَّنَالَ اللّٰہَ لُحُوۡمُہَا وَ لَا دِمَآؤُہَا وَ لٰکِنۡ یَّنَالُہُ التَّقۡوٰی مِنۡکُمۡ ‘আল্লাহর কাছে ওগুলোর গোশত এবং রক্ত পৌঁছে না বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া’ (সূরা আল-হজ্জ: ৩৭)। কুরবানী কিংবা অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে দেশের অধিকাংশ মানুষ এই লৌকিকতার রোগে আক্রান্ত। ফলে কুরবানী ও অন্যান্য ইবাদত আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না। এমনকি হাজী ছাহেবগণও কুরবানী করার দৃশ্য, ত্বাওয়াফ কিংবা হজ্জ কেন্দ্রিক বিভিন্ন ইবাদতের ছবি প্রচারে প্রতিযোগিতায় লিল্প হয়ে থাকে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা যেমন খুলূছিয়্যাতের সাথে ইবাদত করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন (সূরা আল-বাইয়্যেনাহ: ৫), তেমনি রাসূল (ﷺ) হজ্জে থাকাবস্থায় সবসময় যে দু‘আ করতেন, সেখানেও লৌকিকতা থেকে মুক্তির বিষয়টি ছিল প্রাধান্যযোগ্য। তিনি হজ্জে দু‘আ করতেন, اَللَّهُمَّ حِجَّةٌ لَا رِيَاءَ فِيْهَا وَلَا سُمْعَةَ ‘হে আল্লাহ! এ এমন হজ্জ, যাতে কোন প্রদর্শনেচ্ছা বা প্রচারেচ্ছা নেই’ (ইবনু মাজাহ, হা/২৮৯০, সনদ ছহীহ)।
পরিশেষে বলব, কুরবানী করার মূল অনুপ্রেরণা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, কোন হালাল জীবিত প্রাণকে শুধু আল্লাহর জন্য যব্হ করা এবং মনের সকল প্রকার কুটিলতা, বক্রতা ও পশুত্বকে কুরবানী করে এক আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর মহব্বত ও দুনিয়ার স্বার্থ একত্রিত হলে সর্বদা আল্লাহর মহব্বতকে অগ্রাধিকার দেয়া। আর দুনিয়ার মহব্বতকে কুরবানী করা। যেমনটি ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) তাঁর সন্তান ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-কে আল্লাহর আদেশ পালনার্থে কুরবানী দিয়েছিলেন। অতএব কুরবানী হোক লৌকিকতামুক্ত ও খুলূছিয়্যাতের সাথে। আর এখানেই রয়েছে তাওহীদের বাস্তবায়ন ও ত্বাগূত বিসর্জনের মূল অনুপ্রেরণা। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে লৌকিকতামুক্ত ইখলাছপূর্ণ কুরবানী করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!