اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ
অসহায় মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন!
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত অসহায় মানুষ এখন সর্বগ্রাসী বন্যার কবলে পড়েছে। প্রায় ৪০টি জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। প্রায় ৩৫% এলাকা প্লাবিত। ১৭টি নদীর ২৭টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। অর্ধকোটি মানুষ এখন বন্যায় ভাসছে। একদিকে এই বানভাসি মানুষের পেটে খাবার নেই, অন্যদিকে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে তারা আক্রান্ত। অনেকের ঘরবাড়িসহ বাস্তুভিটাটুকুও নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। খাদ্য নেই, ঔষধ নেই, মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই, খাওয়ার পানি পর্যন্ত নেই। সর্বত্র হাহাকার। ক্ষুধার যন্ত্রণায় একমুঠো খাবারের জন্য দুস্থ মানুষগুলো পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট ইয়াতীম বাচ্চা নিয়ে গৃহহীন বিধবা মা একটু সাহায্যের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। বন্যা পরিস্থিতি সত্বর স্বাভাবিক হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। করোনার মধ্যেই বন্যার আঘাতে অভাবগ্রস্ত দীনহীন বনুআদম আজ অতিশয় দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। অন্ন-বস্ত্রহীন বহু মানুষ অনাহারে থেকে, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে। কেউ তাদের খবর নিচ্ছে না, সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে না। বরং একশ্রেণীর মানুষরূপী জানোয়ার এই মহা দুর্যোগের মধ্যেও দরিদ্র মানুষের জন্য প্রদত্ত চাল, ডাল, ত্রাণ, টাকা-পয়সা চুরি করছে, আত্মসাৎ করছে। এরা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট, জাহান্নামের কীট (আ‘রাফ ১৭৯; মুসলিম হা/১৮২-১৮৩)। মানবতা আজ এভাবেই বিপন্ন। তাই দুর্ভিক্ষ কবলিত, দুস্থ, পীড়িত, বিপদগ্রস্ত, অভাবগ্রস্ত, ঋণগ্রস্ত, ইয়াতীম, মিসকীন, বিধবা, অচল মানুষদের পাশে দাঁড়ানো সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উপর প্রধান কর্তব্য হয়ে পড়েছে। কারণ কোন একজন দুঃখী মানুষ যদি না খেয়ে দিন কাটায়, তাহলে আমরা মুমিনের কাতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। আমাদের ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, আমল, ইবাদত, সহায়-সম্পদ কোনই কাজে আসবে না।
খাদ্যদ্রব্য ও ঔষধ সরবরাহ করার মর্যাদা : যে সমস্ত সৎকর্মশীল বান্দা ক্বিয়ামত দিবসকে ভয় করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাবার খেতে দেয়, আল্লাহ তাদেরকে সেদিনের যাবতীয় অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন এবং জান্নাতের যাবতীয় নিয়ামত ভোগ করার সুযোগ দিবেন (সূরা দাহর ৫-২২)। যারা ক্রীতদাসকে আযাদ করে, দুর্ভিক্ষের সময় ইয়াতীম ও ধূলায় মলিন অসহায় মানুষকে খাদ্য প্রদান করে, মূলত তারাই ভাগ্যবান (সূরা বালাদ ১১-১৮)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায়, অথচ তার পড়শি ক্ষুধায় কাতর থাকে’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩৩৮৯; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৮২)। অন্য হাদীছে এসেছে, ‘তুমি যদি তোমার অন্তরকে নরম করতে চাও, তাহলে মিসকীনকে খেতে দাও এবং ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দাও’ (আহমাদ, হা/৭৫৬৬; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৮৫৪)। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি নিজের খাদ্য থেকে ইয়াতীমকে খাওয়াবে, পান করাবে, তার জন্য অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে (ত্বাবারাণী কাবীর হা/৬৭০; সনদ ছহীহ, ছহীহ তারগীব হা/২৫৪৩)। অন্যত্র এসেছে, যে ব্যক্তি অসহায় মানুষকে খাবার দেয়, উত্তম কথা বলে, নিয়মিত নফল ছিয়াম রাখে এবং রাত্রিতে তাহাজ্জুদ পড়ে, তাকে আল্লাহ অতি মনোরম জান্নাত দান করবেন (তিরমিযী, হা/১৯৮৪, সনদ হাসান)। অন্য হাদীছে এসেছে, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে-ই, যে অসহায় মানুষকে খেতে দেয় এবং পরিচিত অপরিচিত মানুষকে সালাম দেয় (বুখারী হা/১২)। খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে দেয়া বা কূপ খনন করা সর্বশ্রেষ্ঠ ছাদাক্বা (ইবনু মাজাহ হা/১৬৮১, সনদ হাসান)। পানি ছাদাক্বা করার কারণে বড় পাপ ক্ষমা করে দেন (বুখারী হা/২৩৬৩)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি মিসকীনকে খেতে দিবে, অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করবে, নফল ছিয়াম পালন করবে এবং জানাযায় শরীক হবে, সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে (মুসলিম হা/১০২৮)। অন্যত্র এসেছে, যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় অসুস্থ ব্যক্তির সেবা-শুশ্রুষা করে, তার জন্য রাত-দিন সর্বদা ৭০ হাজার ফেরেশতা দু‘আ করতে থাকে। তাছাড়া তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ফলের বাগান বরাদ্দ থাকবে (তিরমিযী হা/৯৬৯, সনদ ছহীহ)।
ইয়াতীম, মিসকীন, বিধবা ও অভাবগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিদান : আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ১৯৫)। অন্যত্র বলেন, ‘তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তিনি তার বিনিময় প্রদান করবেন’ (সূরা সাবা : ৩৯)। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করলে তিনি পূর্ণ প্রতিদান দান করবেন (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭২)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা যমীনবাসীর উপর দয়া কর, আসমানের অধিবাসী তোমাদের উপর দয়া করবেন’ (তিরমিযী হা/১৯২৪, সনদ ছহীহ)। অন্যত্র বলেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ ঐ বন্দার উপর রহমত নাযিল করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার অন্য ভাইয়ের সহযোগিতা করতে থাকে’ (মুসলিম হা/২৬৯৯)। অন্য হাদীছে এসেছে, যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকীনের ভরণ-পোষণের চেষ্টা করে সে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত নেকী লাভ করে অথবা সে ঐ ব্যক্তির মত, যে দিনে নফল ছিয়াম পালন করে এবং রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে (বুখারী হা/৬০০৬)। এছাড়া গোপন ছাদাক্বার অসীলায় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দেন (বুখারী হা/৩৩২১; তিরমিযী হা/২৬১৬, ৬১৪; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩১৬৮; সিলসিলাহ ছহীহাহ হা/১৯০৮, সনদ ছহীহ)। বিপদের সময় ছাদাক্বাহ করলে আল্লাহ মহা বিপদকেও দূর করে দেন (বুখারী হা/১০৪৪, ১৪৬২)। মরণকালে মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দান করেন এবং জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়ে দেন (মুনাফিকূন ১০; আহমাদ হা/১৮৫৫৭, সনদ ছহীহ ফজর ২৭-৩০)। ছাদাক্বাহ কবরে প্রজ্জ্বলিত জাহান্নামের আগুনকেও মুহূর্তের মধ্যে নিভিয়ে দেয় (ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৮৮; সনদ ছহীহ, সিলসিলাহ ছহীহাহ হা/৩৪৮৪; ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৯৪৩৮, সনদ হাসান)। দানকারী আরশের ছায়ায় কিংবা ছাদাক্বার ছায়ায় ক্বিয়ামতের মাঠে অবস্থান করবে (বুখারী হা/৬৬০; ইবনে হিব্বান হা/৩৩১০)। ছাদাক্বা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে এবং পুলছিরাত অতিক্রমে বিরাট ভূমিকা রাখবে (বুখারী হা/১৪১৩; মুসলিম হা/২২৩)। দানের ফযীলতের শেষ নেই।
সম্পদ-সম্মান বৃদ্ধি ও জান্নাত লাভের মাধ্যম : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এমন ব্যক্তি কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম কর্য প্রদান করবে? তাহলে তার সেই কর্যকে তার জন্য তিনি বহু গুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। আর আল্লাহই সীমিত ও প্রসারিত করে থাকেন’ (বাক্বারাহ : ২৪৫)। হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তোমরা হিসাব ছাড়াই দান করতে থাক, আমিও তোমাদের হিসাব ছাড়াই ব্যয় করব’ (বুখারী হা/৪৬৮৪, ২৫৯১)। দরিদ্র মানুষকে দুধ পানের জন্য ছাগল দান করাও শ্রেষ্ঠ আমল। আর এর বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাত দান করেন (বুখারী হা/২৬৩১)। অন্য হাদীছে এসেছে, দানকারী ছাদাক্বার দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে (বুখারী হা/১৮৯৭)। অসহায় মানুষের ঋণ মওকূফ করে দিলে বা অবকাশ দিলে, আল্লাহ তার বিনিময়ে ঐ ব্যক্তিকে জান্নাত দান করবেন এবং যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন (মুসলিম হা/১৫৬০)।
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে যাবতীয় বালা-মুছীবত, দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করুন এবং বিপন্ন মানবতার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার তাওফীক্ব দান করুন। সেই সাথে যারা সর্বদা দীনহীন মানুষের পাশে থাকেন, আল্লাহ তাদের উপর বেশী বেশী রহমত ও বরকত নাযিল করুন, তাদের জান ও মালের হেফাযত করুন এবং জান্নাতুল ফেরদাঊসের জন্য কবুল করে নিন -আমীন!!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
প্রসঙ্গসমূহ »:
যাকাত ও ছাদাক্বা