রামাযান: তাক্বওয়া ও ক্ষমা লাভের সুবর্ণ সুযোগ
রামাযান, আল্লাহ তা‘আলার অশেষ নে‘মতের মধ্যে অন্যতম বিশেষ নে‘মত। মহান আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা আরেকটি রামাযান পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। এটি যেমন তাক্বওয়া ও সংযম লাভের মাধ্যম, তেমনি ব্যক্তির পরিশুদ্ধ আচার-আচরণ ও তার উন্নত জীবনেরও চূড়ান্ত মাধ্যম। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই দামি, তার মাঝে রামাযানের এই মুহূর্তগুলো সবচেয়ে বেশি দামি। এই মাসে আমল করলে বেশি নেকী হয় এবং মুমিন সাধ্যমত মেহনতের বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমার পুরস্কার লাভে ধন্য হয়। আর এখানেই রয়েছে রামাযানের বিশেষত্ব।
রামাযানের ছিয়াম মানব সত্তাকে গঠন করে, ক্বিয়াম ব্যক্তিত্বকে উজ্জ্বল করে এবং কুরআন আত্মার সততা ও নিষ্কলুষতা আনয়ন করে। রামাযান বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। ইবাদতের মূল উৎস ও সুবর্ণ মৌসুম। এই মাসেই নাযিল হয়েছে মানবতার চূড়ান্ত সংবিধান ও শ্রেষ্ঠ আরোগ্য আল-কুরআন। যার কারণে ইসলাম পেয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদায় অভিষিক্ত। যে কিতাবের দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মর্যাদা লাভের অফুরন্ত সুযোগ। এ মাসের আগমনে আসমান, রহমত ও জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়, শয়তানদের বেড়ি পরানো হয়। সুতরাং বরকত, অনুগ্রহ ও জান্নাত লাভের প্রত্যাশায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাকার অভিপ্রায়ে প্রত্যেক মুসলিমের স্বীয় প্রবৃত্তিকে শিকলবদ্ধ করা ব্যতীত রামাযানে সফলতার বিকল্প কোন পথ-ঘাট নেই। এ মাস তাদের জন্য প্রতিদান ও প্রতিযোগিতার ময়দান, যারা এর মর্যাদা অনুভব করেছে। এটি তাদের জন্য আলো ছড়ানোর উৎস, যারা এর রহস্য অনুধাবন করেছে। এটি মুক্তির মৌসুম তাদের জন্য, যারা তাদের উদ্দেশ্যকে খালিছ করেছে। এছাড়া তাদের জন্য এটি ঈমানের উদ্যান, যাদের অন্তর পবিত্র ও চিন্তা আলোকিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেন, আর এটা (রামাযানের) প্রত্যেক দিন ও রাতেই হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক বান্দার দু‘আ কবুল করেন’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৪৪৩, সনদ ছহীহ)। তিনি আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, রামাযানের রাত্রি ইবাদতে কাটায় এবং ক্বদরের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্ববর্তী (ছগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়’ (ছহীহ বুখারী, হা/৩৭, ৩৮)। সুতরাং সৌভাগ্যবান তো তারাই, যারা এ মাসে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় ছিয়াম পালন করে, পরকালের জন্য পাথেয় সঞ্চয় করে, আল্লাহর রহমতের চাদরে নিজেকে আবৃত করে এবং জান্নাতীদের কাতারে নিজেকে শামিল করে।
পরিশুদ্ধ আত্মা ও সুদৃঢ় তাক্বওয়া অর্জনই ছিয়ামের মৌলিক উদ্দেশ্য। এ জন্য হৃদয়কে নির্মল ও প্রশান্ত করে এবং আত্মাকে স্বচ্ছ ও সজীব করে রামাযানের প্রস্তুতি ও নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। কেননা প্রশান্ত মন যিকরকে সুমধুর ও গভীর অর্থবহ করে, কুরআন তেলাওয়াতের স্বাদ আস্বাদন করায় এবং রাতের ইবাদতে উদ্যমী করে। মন যখন প্রশান্ত হয়, তখন তা আলোকিত হয়; আল্লাহর দিকে অগ্রগামী হয় এবং আল্লাহর নৈকট্যের মিষ্টতা উপভোগ করে। হৃদয়ের স্বচ্ছতা হল হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকা এবং ঘৃণা ও অন্তরের ব্যাধি থেকে পবিত্র থাকা। এগুলো আল্লাহর রহমতকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ইবাদতের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে। হৃদয় যখন ঘৃণা-বিদ্বেষে আচ্ছন্ন থাকে, তখন ছিয়ামের কোন স্বাদ থাকে না এবং ক্বিয়ামের কোন নূর থাকে না। হারাম উপায়ে ছিয়ামের সংযমশীলতা অর্জিত হয় না, বরং হালালের মধুরতা পবিত্রতার প্রশান্তি বয়ে আনে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং কাজ ছাড়েনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৩)। রামাযান হল ক্ষমা লাভের মাস। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি রামাযান মাস পেল। অতঃপর মাস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হল না, সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন (ছহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৪০৯, সনদ ছহীহ)। তাই যাবতীয় অসৎকর্ম ত্যাগ করে সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এটাই রামাযানের আহ্বান (তিরমিযী হা/৬৮২; সনদ ছহীহ)।
রামাযান মাস কুরআনের মাস। এতে কুরআন তেলাওয়াতের এমন স্বাদ রয়েছে যা হৃদয়কে আনন্দ ও উৎসাহে সজীব করে তোলে। এতে এমন মিষ্টতা রয়েছে যা আত্মাকে নৈকট্য লাভে অনুপ্রাণিত করে। এর আয়াত অন্তরকে আলোকিত করে, শব্দমালা মনকে আনন্দে উদ্বেলিত করে, তেলাওয়াতের সুর হৃদয়কে ভালোবাসায় সিক্ত ও কোমল করে। এজন্য রামাযানকে করতে হবে কুরআনময়। কেননা কুরআন ক্বিয়ামতের দিন তার তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে এবং তার সুপারিশ কবুল করা হবে (শু‘আবুল ঈমান, হা/১৯৯৪, সনদ ছহীহ)। তাক্বওয়ার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি দান-ছাদাক্বাহ করা। যা রবের প্রতি আস্থা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করে। রবের দেয়া রিযিকের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে। ফেরেশতাদের দু‘আয় অন্তর সিক্ত করে, মনের ব্যাধি দূর করে এবং পুরস্কার নিশ্চিত করে। এজন্য বান্দার উচিত রামাযান মাসে বেশি বেশি দান-ছাদাক্বাহ করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমনটা করতেন। তিনি রামাযানে প্রবাহিত বাতাসের বেগের চেয়েও বেশি দান করতেন (ছহীহ বুখারী, হা/৬)। রামাযান দু‘আ কবুলের মাস। এ মাসে দু‘আর ধ্বনি শোনা যায়, আত্মাগুলো দু‘আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় এবং হৃদয়গুলো আল্লাহর নৈকট্যের ছায়ায় প্রশান্তি অনুভব করে। রাতের নিস্তদ্ধতায় দু‘আ ঊর্ধ্বগামী হয়, রবের নিকটবর্তী হয় (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৫)। কাজেই দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে, তিনি দু‘আ শ্রবণ করবেন ও ডাকে সাড়া দিবেন। রামাযানে কত দু‘আই না কবুল করা হয়; কত হৃদয় অন্ধকার রাতে সেজদার মাঝে সৌভাগ্য লাভ করে। রামাযানের শেষ দশকে এমন একটি মহিমান্বিত রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি তা হতে বঞ্চিত হয় সে সর্বপ্রকার মঙ্গল হতে বঞ্চিত হয়। আর এটা হতে কেউই বঞ্চিত হয় না চির বঞ্চিত ব্যক্তি ব্যতীত (মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৪৯৩; সনদ ছহীহ)। আখেরাতের দীর্ঘ ও অফুরন্ত জীবনের জন্য দুনিয়া থেকে পাথেয় জমাতে সালাফগণ এ রাতকে সামনে রেখে আত্মিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত হতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রামাযানের শেষ দশকে ইবাদত করার জন্য এত পরিশ্রম করতেন, যা অন্য সময়ে করতেন না (ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭৫)। শেষ দশক তিনি ইবাদতের জন্য কোমর বেঁধে ফেলতেন। রাত্রি জেগে নিজে ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবারকেও জাগাতেন (ছহীহ বুখারী, হা/২০২৪)। তিনি রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন (ছহীহ বুখারী, হা/২০২৬)।
রামাযান মাস প্রশিক্ষণের মাস। এ মাস কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণ করতে, প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরতে এবং জিহ্বাকে ছিয়াম নষ্টকারী বিষয়সমূহ থেকে সংযত রাখতে অনুপ্রাণিত করে। সারাদিন অভুক্ত থাকা, ক্বিয়ামুল লাইলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা, আনুগত্যের কাজে মনের সাথে সংগ্রাম করা এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে দুর্বলতাকে প্রতিরোধ করার মাধ্যমে তার সংকল্প শক্তিশালি হয় এবং ইচ্ছাশক্তি মজবুত হয়। কাজেই যে ব্যক্তি নিজ নফসের উপর বিজয় লাভ করে, তার ঈমান হয় উন্নত এবং ইসলামের প্রতি হয় দৃঢ় মনোবল। ফলে সে আর কখনো প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে না এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে শিথিলতায় সন্তুষ্ট হয় না। নিঃসন্দেহে দুনিয়া ও আখেরাতে তারাই সফল এবং তারাই জান্নাতী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবার ভয়ে ভীত হল এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ হতে দূরে রাখল, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল’ (সূরা আন-নাযি‘আত: ৪০-৪১)। মহান আল্লাহ সকলকে তাক্বওয়া অর্জনের তাওফীক্ব দান করুন এবং আমাদের জন্য রামাযানকে কল্যাণ ও বরকতময় করুন-আমীন!!
প্রসঙ্গসমূহ »:
সম্পাদকীয়