সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৫:২০ পূর্বাহ্ন

অসুস্থ রাজনীতি ও তার কুপ্রভাব


বাস্তব অর্থে রাজনীতি হল, নীতিমালার একটি স্বতন্ত্র রূপ, যা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং জনসাধারণের অধিকার প্রাপ্তির রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী কাঠামোতে রূপান্তরিত করে, যার মাধ্যমে সার্বিক নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা যায়। কেউ বলেন, রাজ্যশাসন নীতি, রাজার ন্যায়বিচার (The King justice), আবার কেউ বলেন, রাজনীতি হল উন্মুক্ত সমাজ পরিচালনার পন্থা। কিন্তু বর্তমানে ক্ষেত্র বিশেষে এটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে রাজনীতি পরিভাষাটি এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীতিহীন ও মন্দ অর্থে যত্রতত্র পরিচিতি পাচ্ছে। যেমন- এটা নিয়ে রাজনীতি করা উচিত না, আমরা রাজনৈতিক চাল চালি না ইত্যাদি। এর কারণ হল, রাজনীতি এখন অসুস্থ, কুৎসিত ও অপরাজনীতিতে পরিণত হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় আইনের লঙ্ঘন, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন, ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্ষমতার লড়াইয়ে পেশী শক্তির ব্যবহার, কালো টাকার ছড়াছড়ি, বিদেশে অর্থ পাচার, নারী পাচার, নতুন প্রজন্মকে বিপদগামী করার জন্য মাদকের বিস্তার, গুম-খুন-ধর্ষণ, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ সবই এখন রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদ, মাদরাসা, ঈদগাহ, জুমু‘আহ, জানাযা, ইসলামী জালসা, সম্মেলন, সমাবেশ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, সমিতি-সংঘ, খেলাধুলা, পরিবার, সমাজ সর্বত্র এই মহামারি প্রবেশ করেছে। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সেক্টরকে বিরাজনীতিকরণের অর্থই হল, রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা, রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া। তাই রাজনীতি এখন ত্রাসের নীতি। এটাই যেন লুটপাট আর ভোগদখলের কেন্দ্রবিন্দু। মেধাহীনরা প্রভাব-প্রতিপত্তি ও স্বজনপ্রীতির বলে রাজনীতির মাঠে বিচরণ করায় দেশ-জাতি অপরাজনীতির মর্মান্তিক শিকার হয়েছে। আসলে এদের কোন পরিচয় নেই। এরা বর্ণচোরা হয়ে যে দলেই থাকুক না কেন, এরা দেশের জন্য কলঙ্ক। সেজন্য কোন মানুষ তাদেরকে শ্রদ্ধা করে না, বরং বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ নামে চিত্রিত করে থাকে। পৃথিবীর সকল মানুষ মনে করে রাজনীতিবিদরা কেউ সত্য কথা বলতে পারে না। কারণ মিথ্যা না বললে নেতা হওয়া যায় না এবং অস্তিত্বও টিকে না।   

আধুনিক রাজনীতিতে পৃথিবীবাসী নতুন দু’টি ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে- (ক) ‘অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস’ (খ) ‘পোস্ট-ট্রুথ’। ‘অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস’ বা ‘বিকল্প তথ্য’ হল, রাজনীতির এক ভয়াবহ প্রবণতা, মিথ্যাচার, মতিভ্রম, কর্তৃত্ববাদীদের একটা বড় হাতিয়ার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রক্রিয়া। ক্ষমতাসীনরা দেখাতে চান যে, তারা চাইলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতে পারবেন। মূলত এ ধারায় সত্যের বাস্তবতা অস্বীকার করে মিথ্যাকে গ্রহণযোগ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়। আর ‘পোস্ট-ট্রুথ’ হচ্ছে প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করে আবেগ এবং বিশ্বাসের বশীভূত হওয়া। এটি এমন একটি পরিস্থিতি, যা মানুষ সত্যের বদলে আবেগপ্রবণ হয়ে যুক্তির আলোকে অসত্যকে গ্রহণ করে নেয়। এটা এক ধরনের মিথ্যা আধিপত্যের গর্জন, যা অন্যদেরকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি এ দু’টি মিথ্যা কৌশলের উপরই আবর্তিত হচ্ছে। সত্যকে ধামাচাপা দেয়া, একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করে আরেকটি অতি বাস্তব প্রেক্ষাপটকে ঢেকে দেয়া, সত্যকে মিথ্যা বলা, মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করা, দুর্নীতিকে উন্নয়ন বলা, উন্নয়নকে দুর্নীতি বলা ইত্যাদিই হল বর্তমান রাজনীতির আসল চরিত্র। তাই প্রত্যেকটি মানুষ এই অপরাজনীতির শিকার। সর্বত্রই এর কুপ্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এগুলো করে লাভ কী? নিজের পরিণাম নিজেই ডেকে আনা। মিথ্যা সাময়িক বিজয় এনে দিতে পারলেও স্থায়ী হয় না। কারণ যুল্ম, অন্যায়, অপরাধ ও পাপের ধ্বংসাত্মক প্রায়শ্চিত্ত একদিন ভোগ করতেই হবে। এটা অনিবার্য, অবধারিত। এই প্রভাব পড়তে পারে মর্যাদা ও সম্মানের উপর, যা মুহূর্তের মধ্যে নস্যাৎ হয়ে চিরন্তন লাঞ্ছনার মধ্যে নিমজ্জিত হবে। তখন সর্বত্র গ্লানি আর তাচ্ছিল্য ভোগ করতে হবে। এর প্রভাব পড়তে পারে স্বাস্থ্যের উপর, যাতে ক্যান্সার বা অন্য কোন মরণব্যাধিতে হার্ড, কিডনি, লিভার বিকল হয়ে যেতে পারে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি হয়ে যেতে পারে, সম্পদ ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে, পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, দাপট-ক্ষমতা, নেতৃত্ব মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে। এগুলো আল্লাহর গযবের কারণ। যা বাস্তবে আগেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে ইনশাআল্লাহ। মানুষ যখন ন্যায়ের পথ ছেড়ে অন্যায়ের পথে ধাবিত হয়, তখন আল্লাহ তাকে সংকীর্ণ জীবনে বন্দী করে ফেলেন (সূরা ত্ব-হা : ১২৪)। তাকে শঙ্কা ও খাদ্যসংকটে নিমজ্জিত করেন (সূরা আন-নাহল : ১১২)।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি তোমার অপকর্ম তোমাকে তাৎক্ষণিক গ্রাস না করে, তাহলে তুমি প্রতারিত হয়ো না, কারণ ৪০ বছর পর হলেও তোমাকে তার শাস্তি ভোগ করতে হবে’। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অপকর্ম অন্তরকে বিকল করে দেয় এবং চিরদিনের জন্য লাঞ্ছনার গর্তে নিক্ষেপ করে। এদের জন্য পরকালে আরো ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মিথ্যা হতে দূরে থাক’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩০)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘সাবধান! তোমরা মিথ্যা পরিহার করবে। কারণ মিথ্যা পাপাচারের দিকে ধাবিত করে এবং পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। কোন ব্যক্তি মিথ্যাচারের পথে ধাবিত হলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র কাছে চরম মিথ্যাবাদী হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৭)।

অতএব সত্য ও ন্যায়ের পথ ছাড়া বান্দার কোন গতি নেই। কারণ এই পথেই প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর যাবতীয় অসত্যের পরিণাম ধ্বংস। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই সত্যের ধারক হবে। কেননা সত্যবাদিতা কল্যাণের দিকে পথ দেখায় এবং কল্যাণ জান্নাতের দিকে পথ দেখায়। কেউ সত্যের পথ অবলম্বন করলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র কাছে সত্যাশ্রয়ী বলে তালিকাভুক্ত হয়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৭)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় না, তাদেরকে প্রতিদান স্বরূপ দেয়া হবে (জান্নাতে) বালাখানা এবং তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা দেয়া হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৭২-৭৫)। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যাবতীয় অসৎ পন্থা পরিহার করে সৎ পথে চলার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ



 

 

 




প্রসঙ্গসমূহ »: রাজনীতি সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ