রবিবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:৪৩ অপরাহ্ন

রাজনৈতিক সংস্কার 


দেশে জাতীয়ভাবে সংস্কার কার্যক্রম চলছে। তন্মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কার অন্যান্য সংস্কারের চেয়ে গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও রয়েছে ইসলামের সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা। সংশ্লিষ্ট সকলকে সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব পালনের কার্যাবলী তিন স্তরে বিভক্ত। যথা: আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। ইসলামে আইনদাতা হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা (আল-আন‘আম: ৫৭; আল-মায়িদাহ: ৫০)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহই হলেন আইনদাতা, আর তাঁর নিকট থেকেই আইন নিতে হবে’ (আবূ দাঊদ, হা/৪৯৫৫)। বর্তমানে সে আইন কেবল আল-কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর মধ্যেই মওজুদ রয়েছে। তাই আইনসভার দায়িত্ব হলো আল-কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুমোদিত আইনই কেবল পাশ করা এবং মানব রচিত সকল আইন পরিত্যাগ করা।

আল-কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত আইন মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক ও ব্যবহারিক জীবনে বাস্তবায়ন করা নির্বাহী বিভাগের কাজ। এক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বশীলবৃন্দ তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সচিব, টিএনও, ডিসি, এসপি ইত্যাদি সকলকে যেমন জনগণের সেবক হতে হবে, তেমনি আল্লাহর আইন জারি ও যথাযথভাবে কার্যকরকরণে কোনরূপ অনীহা, উপেক্ষা, দুর্বলতা ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না। এজন্য প্রশাসন বিভাগকে অত্যন্ত শক্তিশালী, সাহসী ও দৃঢ় হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমরা আমাদের রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়-নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আর আমরা লৌহও দিয়েছি, যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ; এটা এ জন্য যে, আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন কে প্রত্যক্ষ না করেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলদেরকে সাহায্য করে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী’ (সূরা আল-হাদীদ : ২৫)। তাই কোনপ্রকার নমনীয়তা, দুর্বলতা কিংবা দয়া-সহানুভূতি প্রদর্শন করাও যাবে না। আল্লাহর আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ (ﷺ) ছিলেন কর্মদক্ষতার মূর্ত প্রতীক। এক্ষেত্রে তিনি আবার কোনরূপ দুর্বলতা দেখাননি, কোনরূপ সুপারিশ গ্রহণকেও বরদাশত করেননি (আন-নূর: ২; ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৭৫)। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং সর্বত্র আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগই পালন করবে। অনুরূপভাবে এ বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তি দেশের আইনশৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন এবং আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন। মানুষের উপর প্রভুত্ব কায়েম করবেন না। মানুষের উপর কোন রকম যুলুম বা অত্যাচার করবেন না। নিজের বা দলীয় মনগড়া বিধান জনগণের উপর যেমন চাপিয়ে দিবেন না, ঠিক তেমনি নিজ ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কাউকে ব্যবহারও করবেন না। বরং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে তাকে সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা করে সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই’ (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৩৮১)। এক্ষেত্রে আল্লাহভীতি জরুরী ভূমিকা পালন করবে (ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪১)। তাই প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে ধার্মিক, জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও নেতৃত্বদানে দক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচন করা উচিত।

স্বাধীন বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। এজন্য আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। মূলত সে যুগগুলোতে প্রয়োগকৃত বিচারব্যবস্থাই হলো ইসলামী বিচার ব্যবস্থা। ইসলামী বিচার বিভাগের বৈশিষ্ট্য দু’টি। যথা: (১) রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আল-কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেনে চলা এবং (২) একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি প্রণয়ন করা, যার সাহায্যে রাষ্ট্রের নতুন ও বিচিত্র পরিস্থিতিতে ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয়। আর বিচার ব্যবস্থায় আইনের উৎস ৪টি। যথা : (ক) আল-কুরআন (খ) আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ, যার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক বিচারের রায়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। (গ) ইজমা তথা ছাহাবীগের ঐকমত্য এবং (ঘ) ইজতিহাদ বা শরী‘আতের গবেষণা ও সিদ্ধান্ত। আর তা তখনই নেয়া হয় যখন একজন বিচারক কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা থেকে কোন বিষয়ে রায় প্রদানের আইন খুঁজে না পান। অতএব এ বিভাগের সাথে যারা জড়িত থাকবেন তারা বিচার বিভাগের উক্ত বৈশিষ্ট্য ও আইনের উৎসগুলোর ভিত্তিতে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা উৎখাত করে যতসম্ভব দ্রুত ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। হয়রানী, প্রতারণা ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করবেন না। এ প্রসঙ্গে ইসলামের মূলনীতি সুস্পষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা কাফির, যালিম ও ফাসিক’ (আল-মায়িদাহ: ৪৪-৪৫ ও ৪৭)।

ইসলামে বিচারকের অবস্থা বর্ণনায় রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা প্রজা সাধারণের উপর দায়িত্বশীল করেন অথচ সে যখন মারা যায় তখনও সে প্রজা সাধারণগণের প্রতি প্রতারণাকারী থাকে, তাহলে তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত হারাম করে দেন’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২)।

তাই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি শরী‘আতের মূলনীতি অনুসরণ করেই রাজনীতির ময়দানে বিচরণ করবেন। মিথ্যা, প্রতারণা ও শঠতার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকবেন। অর্থ ও নেতৃত্বের নেশায় মত্ত হবেন না। অস্ত্রের মহড়া দেখিয়ে ত্রাসের রাজ্য কায়েম করবেন না। রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করবেন।
ক. রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের পদ্ধতি অনুসরণ করবেন। এক্ষেত্রে মানব রচিত আধুনিক বা প্রাচীন কোন পদ্ধতি বা মতবাদকে সমর্থন ও গ্রহণ করবেন না (আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭)।
খ. আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি শার‘ঈ আইন প্রয়োগ করবেন এবং এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করবেন। আল্লাহ প্রদত্ত আইনের বিরোধিতা করে নতুন কোন আইন রচনা করবেন না। কারণ তিনি আইন প্রণেতা নন; বরং আইনের প্রয়োগকারী মাত্র।
গ. মুসলিম ব্যক্তি মাত্রই যেন ছালাত আদায় করে সে জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করবেন (সূরা আল-হজ্জ : ৪১)। তাই রাজনীতির প্রধান কর্মসূচি হল ছালাত প্রতিষ্ঠা করা।
ঘ. শরী‘আত বিরোধী প্রচলিত যাবতীয় মতবাদ ও দর্শন, নিয়ম-নীতি বাতিল ও উচ্ছেদ করবেন। যার জন্য আল্লাহ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে প্রেরণ করেছিলেন (সূরা আছ-ছাফ্ : ৯)। যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর জীবদ্দশায় বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
 
সুতরাং মুসলিম হিসাবে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি আল্লাহর বিধান লংঘন করে ত্বাগূতের আইন ও বিধানের তাবেদারী করতে পারেন না। কখনো শয়তানী নীতির সামনে মাথা নত করতে পারেন না। বরং তিনি ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠায় হবেন আপোসহীন এবং আভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হবেন রুদ্র কঠোর, কাউকে  কখনো পরোয়া করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা দেশের রাজনৈতিক সংস্কার সাধন পূর্বক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখুন। আমীন! 
 

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّیۡعُ الۡعَلِیۡمُ






প্রসঙ্গসমূহ »: সম্পাদকীয়
আশ‘আরী ও মাতুরীদী মতবাদের কুপ্রভাব - সম্পাদকীয়
আলেমের মর্যাদা - সম্পাদকীয়
ইসলামী দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি ও ফলাফল - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
খ্রিষ্টান মিশনারী : হুমকির মুখে ইসলাম ও বাংলাদেশ - সম্পাদকীয়
প্রতারণার পরিণাম - সম্পাদকীয়
উত্তম চরিত্রের দুর্ভিক্ষ ও পরিত্রাণের উপায় - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
বাবরি মসজিদের রায় : ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায় - সম্পাদকীয়
হাদীছ অস্বীকারের পরিণাম - সম্পাদকীয়
­­অসহায় মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন! - সম্পাদকীয়
অবৈধ সম্পর্কের পরিণাম - সম্পাদকীয়
মহামারীর কারণ ও পরিত্রাণের উপায় - সম্পাদকীয়
ইসকন: মুসলিম নিধনে হিন্দুত্ববাদী ইহুদী আগ্রাসন - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ