বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১৪ অপরাহ্ন

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ


আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিষোদগার : চরম অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ


পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিশঃর্ত অনুসারীকে ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। আহল অর্থ অনুসারী, পরিবার ইত্যাদি। আর আল্লাহ তা‘আলা যেমন কুরআনকে অনেক স্থানে ‘হাদীছ’ বলে উল্লেখ করেছেন (সূরা যুমার ২৩), তেমনি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনকে ‘হাদীছ’ বলে উল্লেখ করেছেন (মুসলিম হা/৮৬৭)। আর হাদীছকে তো বহু স্থানে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘হাদীছ’ বলে উল্লেখ করেছেন (বুখারী হা/৯৯)। তাই যারা সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে অগ্রাধিকার দেন তাদেরকেই ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়।

ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল যুগেই এই নামটি সুপ্রসিদ্ধ। যদিও বৈশিষ্ট্যগত নাম হিসাবে আরো কতগুলো নাম বর্ণিত হয়েছে। যেমন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, আহলুস সুন্নাহ, আছহাবুল হাদীছ, ত্বায়েফাতুল মানছূরাহ, ত্বায়েফাতুয যাহেরাহ, সালাফী, ফের্কায়ে নাজিয়াহ প্রভৃতি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উক্ত নামসমূহ সুপরিচিত। ফালিল্লাহিল হামদ। সমাজের সার্বিক সংস্কারই তাদের মূল টার্গেট। কুরআন ও সুন্নাহর দাওয়াতকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়াই তাদের মূল কার্যক্রম। শিরকমুক্ত তাওহীদ ও বিদ‘আতমুক্ত আমল প্রতিষ্ঠাই তাদের মৌলিক লক্ষ্য। যদিও এই মহতী কাজে আঞ্জাম দিতে গিয়ে তাদেরকে নানারূপী নির্যাতন ও যুলমের শিকার হতে হয়।

চিরকালই হিংসুকদের একটি শ্রেণী আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে, বিভিন্ন বাজে নামে তাদেরকে চিত্রিত করেছে, এখনও করছে। কখনো ওহাবী, কখনো লা মাযহাবী, কখনো রাফাদানী, ফরাযী, গাইর মুক্বাল্লিদ ইত্যাদি। বিগত কিছু বছর যাবৎ জঙ্গী, চরমপন্থী বলে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন যে, ‘উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িতদের ৯০ শতাংশই আহলে হাদিস’, যা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে (১১/১২/১৯)। এছাড়াও কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর অপপ্রচারের কারণে বিভিন্ন জেলায় আহলেহাদীছ ভাইয়েরা নানা নির্যাতন, হামলা, মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মসজিদ পুড়িয়ে দেয়ার মত ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। শিরক-বিদ‘আতের জঞ্জাল পরিত্যাগ করে ছহীহ হাদীছকে প্রাধান্য দেয়াই হল তাদের বড় অপরাধ! যেন ইসলামের প্রাথমিক যুগের মত অবস্থা বিরাজ করছে। আসলে এগুলো সবই আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে স্বার্থপরদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ জন্য বহু পূর্বেই আব্দুল ক্বাদির জীলানী (৪৭০-৫৬১ হি.) বলেছেন, ‘জেনে রাখ যে, বিদ‘আতীদের কিছু নিদর্শন রয়েছে, যা দেখে তাদের চেনা যায়। বিদ‘আতীদের লক্ষণ হল আহলেহাদীছদের গালি দেয়া ও বিভিন্ন বাজে নামে সম্বোধন করা। এগুলো সুন্নাতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় গোঁড়ামি ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়।.. কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হল ‘আহলুল হাদীছ’ (গুনিয়াতুত ত্বালেবীন ১/৩৯২ পৃ.)।

আহলেহাদীছগণ যেমন শৈথিল্যবাদী নন তেমনি চরমপন্থীও নন। তারা সর্বদা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে থাকেন। তারা কখনো উগ্রবাদে বিশ্বাস করেন না। কারণ ইসলামের সাথে চরমপন্থা, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। বর্তমানে ইসলামের নামে যে জঙ্গী তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা মূলত প্রাচীন খারেজী আক্বীদার নব সংস্করণ। এই খারেজীরাই উছমান এবং আলী (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-সহ অনেক ছাহাবীকে হত্যা করেছিল। তারাই ইসলামের মধ্যে প্রথম বিভক্তির বীজ বপন করেছে এবং ক্ষতি সাধন করেছে। তাই এই জঙ্গী তৎপরতার ব্যাপারে আহলেহাদীছগণই সর্বপ্রথম দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন (বিস্তারিত দ্র. ড. মুযাফফর বিন মুহসিন প্রণীত ‘ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামতে দ্বীন’ শীর্ষক বই)।

অতএব আহলেহাদীছদেরকে চরমপন্থী জঙ্গীদের সাথে জড়িয়ে মন্তব্য করা ও অপপ্রচার চালানো গর্হিত অন্যায় ও অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। আহলেহাদীছদের সম্পর্কে যদি কারো স্বচ্ছ ধারণা থাকে, তাহলে এ ধরনের কটু মন্তব্য করতে পারবেন না। তাদের সম্পর্কে জানার জন্য অসংখ্য মাধ্যম রয়েছে। সারা দেশে তাদের হাজার হাজার মসজিদ, মাদরাসা, দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরী ও সংস্থা আছে। বিশাল বিশাল ইসলামী সম্মেলন, সমাবেশ, সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মন্ত্রী, এমপিসহ জনপ্রতিনিধিগণও উপস্থিত থাকেন। তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সংস্কার সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষায় লেখা বড় বড় মনীষীর অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী সাইয়েদ আহমাদ, শাহ ইসমাঈল, এনায়েত আলী, বেলায়েত আলী, তিতুমীর প্রমুখ সিপাহসালার আহলেহাদীছ আক্বীদারই প্রচারক ছিলেন। সঊদী আরব, কুয়েতসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশেই আহলেহাদীছ বা সালাফী আক্বীদার মানুষ রয়েছে। তারা সর্বত্রই কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক জীবন যাপন করেন এবং দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তাই ঢালাও মন্তব্য করা বিভ্রান্তি সৃষ্টির নামান্তর।

সন্ত্রাসী, মদখোর, খুনী, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ ছালাত পড়লেও, মাথায় টুপি দিলেও যেমন মুছল্লী হতে পারে না, তেমনি জঙ্গী, চরমপন্থী, উগ্রবাদী সেজে জোরে আমীন বললে, রাফঊল ইয়াদায়েন করলেও আহলেহাদীছ হতে পারে না। আহলেহাদীছ হওয়ার প্রধান শর্ত হল বিশুদ্ধ আক্বীদা। যারা সার্বিক জীবনে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদা ও আমলের যথাযথ অনুসরণ করে থাকেন তারাই মূলত ‘আহলেহাদীছ’। সেজন্য চরমপন্থী খারেজীদের সাথে আহলেহাদীছদের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। মূলত অপরাধী, সন্ত্রাসী চক্রের কোন পরিচয় নেই। সুতরাং অপরাধ কর্মের সাথে যেই জড়িয়ে পড়বে তাকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এখানে কোন ছাড় দেয়া যাবে না। তাই বলে পুরো কওমকে দোষারোপ করা মোটেও কাম্য নয়।

আহলেহাদীছদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকার পরও যারা অপপ্রচার চালাবে তারা জ্ঞানপাপী। তাদের জন্য আল্লাহর কাছে হেদায়াত কামনা করছি। আল্লাহ তা‘আলা চিরকালই আহলেহাদীছদেরকে যাবতীয় চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করেছেন এবং তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। তাই তিনিই ফায়ছালা নাযিল করবেন ইনশাআল্লাহ। কারণ রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যদ্বাণী চিরদিন আহলেহাদীছদেরকে শক্তি সঞ্চার করে থাকে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে গেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে চিরদিন একটি দল হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে। বিরোধীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবেই থাকবে’ (ছহীহ মুসলিম হা/১৯২০)। আল্লাহ এই বিজয় কাফেলাকে সার্বিকভাবে সর্বত্র নিরাপত্তা দান করুন-আমীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ




প্রসঙ্গসমূহ »: সুন্নাত নীতি-নৈতিকতা
অসুস্থ রাজনীতি ও তার কুপ্রভাব - সম্পাদকীয়
মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ : অমার্জনীয় ধৃষ্টতার আস্ফালন - সম্পাদকীয়
নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠায় আলেম সমাজের ভূমিকা - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
আশ‘আরী ও মাতুরীদী মতবাদের কুপ্রভাব - সম্পাদকীয়
হাদীছ অস্বীকারের পরিণাম - সম্পাদকীয়
রাজনৈতিক সংস্কার - সম্পাদকীয়
মানহাজের বিরোধিতা ও তার পরিণাম - সম্পাদকীয়
রামাযান : ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্যে কিছু কথা - সম্পাদকীয়
বাবরি মসজিদের রায় : ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায় - সম্পাদকীয়
দুর্নীতি : সমাজ বিধ্বংসী মারণাস্ত্র - সম্পাদকীয়
সার্বিক নিরাপত্তা আবশ্যক - সম্পাদকীয়
নাগরিকের রাষ্ট্রচিন্তা - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ