সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১০:২৪ পূর্বাহ্ন

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ

রামাযান ও তাক্বওয়া 


রামাযান তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন, দু‘আ কবুল হওয়া, রহমত, বরকত লাভ করা, ক্ষমা প্রাপ্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত নিশ্চিত করার এক অনন্য মাস। রামাযানের মর্যাদার কারণে আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক রাতে ও দিনে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন (তিরমিযী, হা/৬৮২; মিশকাত, হা/১৯৬০, সনদ ছহীহ)। 

উক্ত সাফল্য নির্বিঘ্নে অবিরত ধারায় নাযিলের জন্য সারাটা মাস আসমানের সমস্ত দরজা, জান্নাত ও রহমতের সমস্ত দরজা খুলে রাখা হয়। অন্যদিকে অগ্রগামী বান্দা যেন কোন ইবাদতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সে জন্য শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয় (ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৮-১৮৯৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯)। 

তাই রামাযান মাসের ইবাদতের সাথে অন্য মাসের কোন ইবাদতকে তুলনা করার সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখজনক হল, আমরা এই বরকতপূর্ণ মাস থেকে তেমন কিছুই অর্জন করতে পারছি না। ব্যবসা-বাণিজ্য আর দুনিয়ার ভোগ-বিলাশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও রামাযানের ইবাদতগুলো যথাযথভাবে পালন করারর জন্য কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করি না। দুনিয়াবী ব্যস্ততায় বিভোর থাকি। ফলে রামাযান শেষে প্রাপ্তিটা হয় শূন্য। তবে এরই মাঝে যারা মুক্তি পেতে চায়, তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে একজন প্রকৃত মুসলিম ও তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টা করে থাকে।

রামাযানের ছিয়ামের প্রধান ও মৌলিক উদ্দেশ্য হল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন, যা বান্দার সার্বিক কল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী ভিত্তি। এ কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের বহু স্থানে বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তাক্বওয়া যাবতীয় কর্মের মুকুট (মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭৯১, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫৫৫)। এ জন্য তিনি প্রত্যেক  খুৎবার শুরুতেই তাক্বওয়ার আয়াত পাঠ করে আল্লাহভীতি অর্জনের নির্দেশ দিতেন (আলে ইমরান : ১০২; নিসা : ১; আহযাব : ৭০;  নাসাঈ, হা/১৪০৪, সনদ ছহীহ)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)সহ সালাফগণ সর্বদা তাক্বওয়া অর্জনের অছিয়ত করতেন (আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, ৪৬১২; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮৫, ১৭৩১; ছহীহ বুখারী, হা/২৯৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৩৫২, ৮৩৬৭)। কারণ কোন মুমিনের হৃদয়ে তাক্বওয়া ঠাঁই পেলে তার দ্বারা কখনো অন্যায় কর্ম সংঘটিত হতে পারে না। বরং সে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি বেশি মনোযোগী হবে এবং পাপ থেকে লক্ষ-কোটি মাইল দূরে থাকবে। কোন পাপ তাকে স্পর্শই করতে পারবে না। 

তাক্বওয়া হল- ‘আল্লাহর নির্দেশিত কাজ করা এবং তাঁর নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করা’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২০)। কেউ বলেন, ‘ফরয-ওয়াজিব পালন করা, হারাম পরিত্যাগ করার সাথে সাথে সন্দেহজনক কর্মগুলো বর্জন করা। আর নফল আমল করা এবং মাকরূহ কাজকে বর্জন করাকে তাক্বওয়া বলে’ (জামিঊল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৫৯)। আর মুমিনের তাক্বওয়া তখনই পূর্ণতা লাভ করে যখন অণু পরিমাণ পাপ করতে গিয়েও আল্লাহর ভয়ে তা থেকে বিরত থাকে (ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ, পৃ. ১৯)। উল্লেখ্য, তাক্বওয়ার মূল কথা হল- এটি অন্তরের আমল (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪)। আর অন্তরের আমল দ্বীনের মূলনীতি ও মূলভিত্তি। এটি ব্যতীত কোন আমল বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় না। এ জন্য মুমিন যখন তাক্বওয়া অবলম্বন করে ছিয়াম রাখে, তখন সে প্রবৃত্তিকে লাগাম পরিয়ে রাখে। মূলকথা তাক্বওয়া উত্তম চরিত্রের সংরক্ষক, নিঃসঙ্গতার সঙ্গী ও ধ্বংস এবং যাবতীয় অনাচার থেকে মুক্তির রক্ষাকবচ।  

কিন্তু দেখা যায় যারা ছিয়াম পালন করছে তাদের অধিকাংশই জঘন্য সব অপকর্মের মধ্যে ডুবে আছে। সূদ-ঘুষ ও হারাম উপার্জন, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন, গান-বাজনা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, মিথ্যাচারের মধ্যেই মত্ত। হারামখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা রামাযানের মধ্যেও খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করছে, সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে, প্রতারণা করছে আবার ছিয়ামও রাখছে। হারাম অর্থ দিয়েই সাহারী ও ইফতারীর ব্যবস্থা করছে। বুঝা যাচ্ছে, ছিয়াম পালন করে ও বাহারি ইফতার আয়োজন করে কোন লাভ হচ্ছে না। ছিয়াম ও রামাযানের মৌলিক উদ্দেশ্য ব্যহত হচ্ছে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথার সাথে কত সুন্দর মিল পাওয়া যাচ্ছে, যে ব্যক্তি ছিয়াম পালন অবস্থায় মিথ্যা কথা ও অপকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না, তার পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহর নিকট কোন মূল্য নেই (ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৩ ও ৬০৫৭)। অন্য হাদীছে এসেছে, অনেক ছিয়াম পালনকারী আছে, যারা শুধু পিপাসাই উপভোগ করে (ইবনু মাজাহ, হা/১৬৯০, সনদ হাসান)। এর মূল কারণ হচ্ছে ‘তাক্বওয়া’ কাকে বলে এবং এর দাবী ও তাৎপর্য সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না, জানার চেষ্টাও করে না। 

দ্বিতীয়তঃ সব প্রস্তুতি হয়ে থাকে লোক দেখানো। ছিয়াম রাখা, তারাবীহ পড়া, ইফতার করা, কুরআন তেলাওয়াত করা কোন কিছুর মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি, একাগ্রতা, ইখলাছ কিছুই থাকে না। মুসলিম ঘরের সন্তান ছিয়াম না রাখলে মানুষ বলবে কী! ইফতার পার্টিতে যেতে হবে তাই ছিয়াম না রাখলে কেমন হয়! গর্বের সাথে প্রচার করে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও আমি একটি ছিয়ামও ছাড়িনি! এগুলো সব লৌকিকতা। জনগণ ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে ভাল মানুষ সাজার জন্য, মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্যই এই প্রতারণার সাইনবোর্ডকে বেছে নিয়েছে। অথচ অন্তরটা অপবিত্র ইবলীসের বিশাল সাম্রাজ্য। তার মধ্যে তাক্বওয়ার লেশমাত্র নেই। কারণ তাক্বওয়া কখনো দেখা যায় না (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪)। 

তৃতীয়তঃ ছিয়াম পালন করলেও বহু মানুষ শিরক ও কুফরী আক্বীদা এবং জাহেলী মতবাদের সাথে জড়িত, যা ঈমান ও ইসলামকেই নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া রাসূল ফ-এর দেখানো পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করে বিদ‘আতী পদ্ধতিতে ছিয়াম পালন করার কারণে ছিয়ামসহ কোন ইবাদতই কবুল হচ্ছে না (সূরা আল-কাহ্ফ : ১১০; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৩)। সাহারী, তারাবীহ, ইফতারী, দান-ছাদাক্বা, কুরআন তেলাওয়াত, ই‘তিকাফ, ক্বদর রাত্রি জাগরণ, ফিতরা ইত্যাদি কোন ইবাদতেই রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকা নেই, সব চলছে বিদ‘আতী তরীকায়। ফলে আমল কবুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

অতএব রামাযানের এই অঢেল রহমত, বরকত ও প্রকৃত সুফল পেতে চাইলে তাক্বওয়ার তাৎপর্য উপলব্ধি করা প্রত্যেক মুমিনের উপর আবশ্যক। সর্বত্র আল্লাহভীতির প্রয়োগ না থাকলে ইখলাছের সাথে ইবাদত করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এছাড়া তাওহীদ ও সুন্নাহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে শিরক, বিদ‘আত, ত্বাগূত ও জাহেলিয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে ইবাদত করতে পারলে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ। ছিয়ামের বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাক্বওয়া অর্জনের পথ সহজ করে দিন-আমীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ




প্রসঙ্গসমূহ »: ছিয়াম-রামাযান

ফেসবুক পেজ