শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫২ পূর্বাহ্ন

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, না-কি পঙ্গুত্ব?


শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন পঙ্গু, শিক্ষাবিহীন জাতির অবস্থাও তদ্রুপ। শিক্ষা হল ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। শিক্ষার মাধ্যমে যেমন ব্যক্তির নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি সাধিত হয়। কোন জাতিই শিক্ষা ছাড়া তাদের ভাগ্য উন্নয়ন করতে পারেনি। পৃথিবীতে সভ্যতা সৃষ্টির মূল সূত্রই হল শিক্ষা। তাইতো শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসাবে অভিহিত করা হয়। মেরুদণ্ড ছাড়া কোন মানুষ যেমন সচল থাকে না, তেমনি সুশিক্ষা ছাড়া ব্যক্তি হয় পশুতুল্য, জাতির অস্তিত্ব হয় বিপন্ন এবং মানবতা হয় ভূলুণ্ঠিত। এ কারণে যে জাতি যত বেশি সুশিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত।

প্রশ্ন হল- শিক্ষা বলতে আমরা কী বুঝি? শুধুই বিদ্যালয়কেন্দ্রিক রুটিনমাফিক পাঠদানই কি শিক্ষা, না-কি সত্যিকারার্থে উন্নত ও মানুষের মত মানুষ হওয়ায় শিক্ষা? এদেশে শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। গঠিত হয়েছে একের পর এক ‘শিক্ষা কমিশন’। কিন্তু প্রতিটি ‘কমিশন’ শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি শিক্ষা সিলেবাস প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানগত পার্থক্য নিরূপণেও সফল হয়নি। বরং শিক্ষার নামে ধর্মহীন বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। যার মূল লক্ষ্যই ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ও কর্তৃত্ব অর্জন। ফলে একদল ভোগবাদী, স্বার্থপূজারি, অবিবেচক ও অর্বাচিন লোক ব্যতীত কোন উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন, ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত, চারিত্রিক মাধুর্যপূর্ণ ও ত্যাগের মানসিকতা সম্পন্ন নাগরিক উপহার দিতে পারেনি। পারেনি দিতে দেশপ্রেমে জাগ্রত একঝাঁক দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল। তাই কেউ হয়েছে নাস্তিক, কেউ দুর্নীতিপরায়ণ, কেউ সমকামী, কেউ ট্রান্সজেন্ডার, কেউ ধর্মনিরপেক্ষবাদী, কেউ আবার জাতীয়তাবাদী।

ধর্মহীন বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা জনগণকে নীতিহীন পশুতে পরিণত করে। যেনতেন ভাবে দুনিয়া উপার্জনই তার কাছে মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সম্পদ উপার্জনের নেশা তাকে রোবটে পরিণত করে। চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, লুটতরাজ ও দুর্নীতি তার কাছে ধর্মের জায়গা দখল করে। মাদকতা, বিকৃত যৌনাচার, অশ্লীলতা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, গান-বাজনা, নৃত্যানুষ্ঠান হয় তাদের মনোরঞ্জনের একমাত্র খোরাক। ধর্মীয় চেতনার অভাবে ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা, বিবাহ বর্হিভূত শারীরিক সম্পর্ক, পরকীয়া, ধর্ষণ ইত্যাদিতে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আসক্ত। দেশের অধিকাংশ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রী নিপীড়ন, শারীরিক ও মানসিক টর্চার, রক্তপাত, মারামারি, লুণ্ঠন, রাহাজানি, দখলদারিত্ব আজ নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড। অন্যদিকে অফিস-আদালতগুলো দুর্নীতি, অনিয়ম ও সূদ-ঘুষের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। অর্থ পাচার, ব্যাংক লুট এবং মজুদদারীরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে ফেলেছে।

শিক্ষা খাতে পাহাড়সম অনিয়ম আর দুর্নীতি, প্রশ্ন ফাঁস, নিয়োগ বাণিজ্য, সার্টিফিকেট ও মার্কশিট বাণিজ্য, সনদ জালিয়াতিসহ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকুরীতে ৫৬ শতাংশ কোটা মেধাবীদের পঙ্গু করে দিয়েছে। সম্প্রতি বিসিএস ও পিএসসির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস জালিয়াতিতে জড়িত ড্রাইভারসহ ১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার অঢেল সম্পদের হিসাব সচেতন নাগরিকদেরকে হতবিহ্বল করেছে। যার বিক্ষুদ্ধ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনে। মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করে কোটা, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের কারণে দেশের সকল সেক্টর অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের দখলে। সেকারণেই কোটা আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থী জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমেছে। অথচ মেধা অধিকারের যৌক্তিক বিষয়টি সহনশীলতার সাথে বিচার না করে সরকার নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে। লাঠিচার্জ, বুলেট, রাবার বুলেট এবং গুলি চালিয়ে মেধাবীদের হত্যা করেছে এবং অনেককে আহত করে পঙ্গু করে দিয়েছে। শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড তবে শিক্ষার্থীরা হল হৃদপিণ্ড। আর হৃদপিণ্ডের যদি মৃত্যু হয়, পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, না-কি পঙ্গুত্ব?

বলা বাহুল্য, দেশের এই সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কিন্তু দেশের সাধারণ জনগণ নয়, বরং ধর্মহীন শিক্ষায় শিক্ষিত (?) ব্যক্তিরাই মূলত এজন্য দায়ী। কেননা তারাই সকল স্তরে পরিচালকের ভূমিকায় বিদ্যমান। অতএব শিক্ষার গুণগত মান পর্যালোচনা সাপেক্ষে ধর্মহীন বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা মূলোৎপাটন করতে হবে। আর জীবনমুখী ও নৈতিকতা সম্পন্ন নাগরিক তৈরির কার্যকরী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। অন্যথা রাষ্ট্র আবারো পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ গোলামীর জীবন বরণ করতে বাধ্য হবে।

অতএব জাতি সার্বিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করার আগেই সরকারকে সচেতন হতে হবে। জাতি পঙ্গু হলে সরকার ও রাষ্ট্র পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা একটি সামগ্রিক বিষয়। যোগ্য, দক্ষ ও কল্যাণকামী নাগরিক তৈরি করার নামই শিক্ষা। সত্যিকার শিক্ষা নিঃসন্দেহে একজন মানুষকে সত্যিকার মানুষে রূপান্তরিত করে। পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদী শিক্ষা স্বার্থপর, ভোগবাদী, লুটেরা এবং সার্টিফিকেট-সর্বস্ব একদল গ্র্যাজুয়েট উৎপাদন করে। যা কখনোই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে না। যদি কোন জাতি প্রকৃতপক্ষে মজবুত ও টেকসই মেরুদণ্ড তৈরি করতে চায়, তাহলে প্রয়োজন গণমুখী, জ্ঞানভিত্তিক এবং সত্যিকার মানুষ গড়ার শিক্ষা। আর এক্ষেত্রে দু’টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া অপরিহার্য।
প্রথমতঃ তাওহীদের শিক্ষা। এই শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক মানুষের উপর আবশ্যক (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)। কেননা মানুষের মাঝে যখন তার স্রষ্টা আল্লাহর ক্ষমতা ও পরকালের জবাবদিহিতার চেতনা জাগরূক থাকবে, তখন তার পক্ষে কোন রকম অন্যায়-অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। আর এটাই তাওহীদী শিক্ষার মূল অনুপ্রেরণা (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৮১)।
দ্বিতীয়তঃ জীবনের সকল ক্ষেত্রে নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা। কেননা তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় মহান ব্যক্তিত্ব (সূরা আল-আহযাব: ২১)। মহান আল্লাহ সকলকে তাওহীদের জ্ঞান অর্জন করে উন্নত ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করার তাওফীক দান করুন এবং সকল প্রকার অনাচার থেকে দেশকে মুক্ত করুন-আমীন!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّیۡعُ الۡعَلِیۡمُ






রাহুমুক্ত বাংলাদেশ: সর্বত্র সংস্কার প্রয়োজন - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পরাজয় : - সম্পাদকীয়
নীতিবোধের সংকট! - সম্পাদকীয়
প্রচলিত রাজনীতি ও মানবতার করুণ পরিণতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ধর্ষণ, খুন, গুম, নারী নির্যাতন : মধ্যযুগীয় বর্বরতার নব-সংস্করণ - সম্পাদকীয়
ঈদে মীলাদুন্নবী : শী‘আদের সৃষ্ট অভিশপ্ত অনুষ্ঠান - সম্পাদকীয়
ইসলামী দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি ও ফলাফল - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
শী‘আদের ধ্বংসযজ্ঞ ও আমাদের করণীয় - সম্পাদকীয়
সামাজিক অনাচার: আশু প্রতিরোধ যরূরী - সম্পাদকীয়
নারী পোশাকের স্বাধীনতা ও প্রগতিবাদীদের ভ্রান্তি বিলাস - সম্পাদকীয়
ত্বাগূতী রাজনীতি অভিশাপ ও করুণ পরিণতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
কুরআন মাজীদের হক্ব আদায় করুন! - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ