রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৮:৪২ অপরাহ্ন

মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পরাজয় :


আফগানিস্তান ৯৯ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। বহুবার সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সাঁড়াশি আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। কেবল ১৯১৯ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০২ বছরে এদেশে তিনটি সাম্রাজ্যের পতন হল। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ এবং ১৯৮৯, ১৫ ফেব্রুয়ারীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ২০২১ সালে আমেরিকার পতন হল। ১৯৭৯ সালে আধিপত্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীন আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। বলা যায় ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েতের বিলুপ্তির সূচনা হয়, যা ১৯৯১ সালে ভেঙ্গে যায়। এ সময় আফগানিস্তানে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদরা স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে। এতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের পর আফগানিস্তান গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হয় (১৯৮৯-১৯৯৬)। এরই মাঝে ১৯৯৪ সালে মোল্লা ওমর কর্তৃক তালেবান বা ছাত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যারা পূর্বে আফগান মুজাহিদ নামে পরিচিত ছিল। অতঃপর ১৯৯৬ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসে এবং সরকার গঠন করে। শান্তির জন্য অপেক্ষমাণ আফগানরা তালেবানদের সাদরে গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও সঊদী আরব তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ইসলাম বিরোধী অনেক কিছুই নিষিদ্ধ করে, অন্যান্য মূর্তিসহ দেড় হাজার বছরের পুরাতন বামিয়ানের বিশাল আকৃতির দু’টি মূর্তিও (যথাক্রমে উচ্চতা ৫৫ ও ৩৫ মিটার) ভেঙ্গে দেয়। ফলে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা আফগানিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ও অর্থনৈতিক অবরোধ প্রয়োগ করে। এরই মাঝে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার সন্ত্রাসী হামলায় ধসে পড়ে। আমেরিকা এই হামলার জন্য আল-কায়েদার সাথে তালেবানকেও দায়ী করে। উক্ত প্রমাণহীন অভিযোগে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানের উপর হামলা শুরু করে।

যে আমেরিকা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আফগানদের সহযোগিতা করেছিল, যাদের সহযোগিতা ও স্বীকৃতিতে তালেবান সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারাই লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে তালেবানকে সরিয়ে পুতুল সরকার গঠন করে। সাম্রাজ্যবাদী চক্রের রহস্য বুঝা ভার। আফগানিস্তানকে তালেবানমুক্ত করার জন্য দীর্ঘ ২০ বছর বর্বর হামলা অব্যাহত রাখে আমেরিকা। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই তালেবানের হাতেই আমেরিকার লজ্জাজনক পরাজয় হল। সেনা প্রত্যাহার শুরু করার পর থেকেই তালেবানরা এক এক করে প্রাদেশিক রাজধানী নিয়ন্ত্রণে নেয়। সবশেষে গত ১৫ই আগস্ট কাবুল দখল করে তাদের বিজয় নিশ্চিত করে। আমেরিকার সেবাদাস প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণী পদত্যাগ করে লেজগুটিয়ে বহু অর্থ-সম্পদ লুট করে পালিয়ে যায়। এটা তালেবানের দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ, ধৈর্য ও প্রচেষ্টার ফসল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এটি দ্বিতীয় দীর্ঘতম যুদ্ধাভিযান। যাতে আমেরিকার মোট চারজন প্রেসিডেন্ট (জুনিয়র বুশ, বারাক ওবামা, ট্রাম্প এবং জো বাইডেন) অংশগ্রহণ করেন। সবাইকেই পরাজয় বরণ করতে হল। এই যুুদ্ধে ২.৪১ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। দেশটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখানে ব্যয় করেছে ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার (৯ হাজার কোটি ডলার)। বিনিময়ে পেয়েছে হাজার হাজার মার্কিন সেনার লাশ ও ঐতিহাসিক পরাজয়। আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ লুণ্ঠন করা এবং ক্ষমতাধর চীন ও রাশিয়াকে চাপে রাখা। 

পাশ্চাত্য ও তাদের মদদপুষ্ট দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর স্বাধীনতা হরণ করে বশংবদ সরকারের মাধ্যমে যেভাবে আগ্রাসন চালাচ্ছে, তাতে অচিরেই মুসলিমরা জাগ্রত হবে এবং দখলদারিত্বের অবসান হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ জবরদখল বেশি দিন স্থায়ী হয় না। নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আড়ালে পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্য হল, মধ্যপ্রাচ্যের খনিজ সম্পদ লুণ্ঠন করা, প্রাচীন স্থাপত্য ধ্বংস করা, মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠানকে নস্যাৎ করা, বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে মুসলিমদের ঈমান হরণ করা, বোমার আঘাতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে জাতিকে পঙ্গু করা, পরস্পরের মাঝে যুদ্ধ লাগিয়ে অস্ত্র বিক্রি করা এবং দেশীয় দালালচক্র তৈরি করে ক্ষমতাকে স্থায়ী করা। ফিলিস্তীনে ইসরাঈলকে বসিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া তৈরি করেছে। ইরাক, লিবিয়া, কাশ্মীরসহ বিভিন্ন দেশে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে তারা রাজত্ব করছে। মুসলিম দেশগুলো সচেতন হলে এবং পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হলে অপবিত্র শকুনদের সাম্রাজ্যবাদ থাকবে না ইনশাআল্লাহ। আর এই বিজয়কে তরান্বিত করতে হলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  এবং চার খলীফার শাসনব্যবস্থাকে মডেল হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। বিজাতীয় তন্ত্রমন্ত্র, পুঁজিবাদী চেতনা, সাম্যবাদী আগ্রাসন এবং শী‘আদের ভ্রষ্ট নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসহ সবদিক দিয়ে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ চাহেন তো তখনই খেলাফতের ধারা ফিরে আসবে এবং বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হবে।

এক্ষণে তালেবানদের নিকট মুসলিম জাতির প্রত্যাশা হল, তাদের পুনরুত্থান যেন দেশের জনগণের জান, মাল ও ইয্যতের নিরাপত্তার মাধ্যম হয়, যাতে আবার গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন না হয়। দেওবন্দী বা যেকোন ধ্যান-ধারণা প্রত্যাখ্যান করে তারা কেবল কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। সেখানে যেন কোন চরমপন্থী সংগঠন বা গোষ্ঠী আশ্রয় না পায়। তাদের অন্যতম করণীয় হল, মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলা, মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করা এবং ইসলামী শিক্ষাকে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে সমন্বয় করা। আমরা দু‘আ করি আল্লাহ যেন সমগ্র মুসলিম জাহানকে সাম্রাজ্যবাদীদের হিংস্র ছোবল থেকে মুক্ত করেন, মুসলিম উম্মাহর উপর বিশেষ রহমত নাযিল করেন এবং সর্বত্র স্থায়ী বিজয় দান করেন-আমীন!!




প্রসঙ্গসমূহ »: সাময়িক প্রসঙ্গ

ফেসবুক পেজ