বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১৫ অপরাহ্ন
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ
দুর্নীতি : সমাজ বিধ্বংসী মারণাস্ত্র

আইন ও নীতিবিরুদ্ধ প্রত্যেক বিষয়ই দুর্নীতি। এটি অন্ধকার জগতের অপরাধকর্মের প্রধান হাতিয়ার। মানবসমাজের সকল পরিমণ্ডল এর সর্বগ্রাসী ভয়ংকর থাবায় আক্রান্ত। বৈষয়িক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রের সকল স্তর দুর্নীতির প্রলয়ঙ্করী আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অবাধ্য গতিতে ছুটে চলেছে দুর্নীতির ত্রাস। সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা সম্প্রসারণসহ মানব উন্নয়নের সকল ক্ষেত্র দুর্নীতির বিষবাষ্পে সংক্রমিত হয়েছে। মূলত অসততা, অবৈধ পন্থা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিবর্গের আইন বহির্ভূত আচরণ, আদর্শ ও মূল্যবোধ পরিপন্থী চেতনা প্রভৃতিই এর জন্য দায়ী।

দুর্নীতি বিগত সময়ের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। যদিও ইতিপূর্বে দেশ টানা পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের মত লজ্জাজনক উপাধিতে ভূষিত হয়েছিল। এখন দেশের সবচেয়ে বেশী দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হল চিকিৎসা, প্রশাসন ও শিক্ষা। চিকিৎসা পাওয়া নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক অধিকার। অথচ দুর্নীতি-লুটপাট আর অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায় আকণ্ঠ ডুবে আছে স্বাস্থ্য খাত। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ইচ্ছামত প্রেসক্রিপশন, নিম্নমানের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়, অতিরিক্ত ভিজিট গ্রহণ, ওষুধের বাড়তি মূল্য ইত্যাদি কারণে এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বিভিন্ন আইটেমের চিকিৎসা সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি ও ওষুধপত্র কেনার ক্ষেত্রে যে ভয়ংকর লুটপাট হয়েছে, তাতে আঁতকে উঠার মত। ১০-১২ হাজার টাকা দামের অটোস্কোপ মেশিন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকায়, ১৫ হাজার টাকার ব্লাড ওয়ার্মার মেশিন ৯ লাখ ৩২ হাজার টাকায়, ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দামের এমআরআই মেশিন ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কিনেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরকম নোংরা ও বীভৎস দুর্নীতি ঘটেই চলেছে প্রতিনিয়ত।

অন্যদিকে দুর্নীতির মহোৎসবের কারণে শিক্ষাখাত আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন। এ খাতে প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের ১৫% বরাদ্দ থাকলেও বাজেটের মাত্র ৫ শতাংশ প্রকৃত কাজে ব্যয় হয়। বাকি ১০ শতাংশই দুর্নীতিতে খেয়ে ফেলে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ভয়ংকর ব্যাপার হল, আমাদের শিশু-কিশোররা জানতে পারছে যে, তাদের শিক্ষকরা টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেন, ফেল করলেও পাস করিয়ে দেন অথবা পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস করে দেন। প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য তো চোখে পড়ার মত। শিক্ষা প্রশাসনে অনিয়ম-দুর্নীতি, হয়রানি, ভোগান্তি ও ঘুষবাণিজ্য যেন অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’।

এছাড়া রাজস্ব খাতে বছরে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়ে থাকে। ভিত্তিহীন অতিরিক্ত প্রকল্পে ব্যয় দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নেয় বিদ্যুত খাতের কর্তৃপক্ষ। এমনিভাবে কাস্টমস, পাসপোর্ট-ভিসা অফিস, নিয়োগ ও পদন্নোতি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সচিবালয়, সরকারী-বেসরকারী অফিস আদালত, বিভিন্ন পণ্য আমদানী ও রপ্তানী, সরকারী-বেসরকারী স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রত্যেকটি খাতে দুর্নীতির ভয়াল চিত্র বিদ্যমান। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, রাষ্ট্রের সব খাত মিলিয়ে দুর্নীতির পরিমাণ কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশ, যাতে ক্ষতির পরিমাণ ৬৫ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। হলমার্ক কেলেঙ্কারী, ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, শেয়ার বাজার লুণ্ঠনসহ আরো অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।

চাঁদাবাজ ও ভূমিদস্যুদের কথা উল্লেখ করার তো কোন প্রয়োজনই নেই। শুধু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবনের বালিশ ও চাদর ক্রয়ে যে অভিনব দুর্নীতি হয়েছে, তাতে ইবলীস শয়তানও লজ্জা পেয়েছে। যেখানে একটি বালিশের দাম দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা এবং ৩০টি চাদর নীচ থেকে খাটে তোলার জন্য প্রতিটির খরচ দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা, হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের একটি পর্দায় খরচ দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। দলীয় নেতা, আমলা, রাজনীতিবিদ, এনজিও কর্মকর্তা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত কর্মকর্তাসহ অসাধু ব্যক্তিরাই মূলত এ সমস্ত দুর্নীতির লালনকারী।

উক্ত ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন আপোসহীন অপ্রতিরোধ্য শুদ্ধি অভিযান। দুর্নীতিবাজ যেই হোক, যে পর্যায়ের ও যে পদেরই হোক তাকে আইনের আওতায় নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি ও কোন প্রকার সুপারিশ আশ্রয় পাবে না। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে সম্ভ্রান্ত পরিবারের জনৈকা মহিলা চুরি করলে হাত না কাটার সুপারিশ করা হয়। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গর্জে উঠে বলেন, তোমাদের পূর্বের লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। মনে রেখ, যদি আজ মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত, তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম (ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৩৩)। সমাজ বিনির্মাণের জন্য এরূপ দ্ব্যর্থহীন পদক্ষেপই কাম্য। আল্লাহ আমাদেরকে সর্বক্ষেত্রে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ





প্রসঙ্গসমূহ »: সাময়িক প্রসঙ্গ

ফেসবুক পেজ