খুলূছিয়াত আবশ্যক
খুলূছিয়াত তথা একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার সাথে মুমিন তার জীবনের সবকিছু আল্লাহর নিকট সমর্পণ করবে এটাই ইখলাছের মৌলিক দাবী। কারণ ইখলাছ বিহীন ইবাদত মূল্যহীন, ইখলাছই ইবাদত কবুলের মূল চাবিকাঠি। মানব জীবনের যাবতীয় কল্যাণ ও উন্নতি সাধনে ইখলাছ হল প্রবেশদ্বার। তাছাড়া ত্রুটি-বিচ্যুতি, পদস্খলন, ভ্রষ্টতা, বিভক্তি ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্তির জন্য ইখলাছই একমাত্র মুমিনের রক্ষাকবচ। তাই দুনিয়া ও আখিরাতের সেতুবন্ধনের চূড়ান্ত মাধ্যম হিসাবে সর্বত্র খুলূছিয়য়াতের চর্চা করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে জীবনের প্রতিটি কাজে, প্রতিটি মুহূর্তে খুলূছিয়াত ও তাক্বওয়া চর্চা করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং ছালাত কায়েম করতে ও যাকাত প্রদান করতে, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত সঠিক দ্বীন’ (সূরা আল-বাইয়েনাহ : ৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল কবুল করবেন না, যদি তাঁর জন্য তা খালেছ হৃদয় ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য না হয়’ (নাসাঈ, হা/৩১৪০, সনদ ছহীহ)। তিনি আরো বলেন, তাক্বওয়া হল সকল কাজের মুকুট (মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭৯১; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫৫৫)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইছলাছ বিহীন আমল ঐ মুসাফিরের ন্যায়, যে তার ব্যাগ বালি দ্বারা পূর্ণ করে বহন করে, অথচ তা তার কোন উপকারে আসে না’ (আল-ফাওয়ায়েদ, পৃ. ৪৯)।
দুঃখজনক হল, সেই খুলূছিয়াতের চর্চা বর্তমানে প্রায় শূন্যের কোঠায়। যেন কোরো মাঝেই আল্লাহভীতি ও খুলূছিয়াতের চর্চা নেই। এম.পি, মন্ত্রী, সচিব, আমলা, মেয়র, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেম্বার, সরকারী কর্মকর্তাসহ এধরনের প্রায় সবাই গদি ও পদ স্থায়ীকরণের জন্য সকল অবৈধ পথ ও পন্থা অবলম্বন করছে, আত্মসাৎ ও দুর্নীতির মহা সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। অন্যদিকে অধিকাংশ ইমাম, আলেম, দাঈ, খত্বীব, বক্তা, নেতা, আমীর, পীর, মাশায়েখও খুলূছিয়াতের চর্চা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তারা সাধারণ জনগণকে ইখলাছের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে, অথচ তাদের মধ্যেই খুলূছিয়াতশূন্য কর্মকা- পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা ওপেন সিক্রেট। বর্তমানে রিয়া ও সুম‘আহ তথা লোক দেখানো ও শুনানো কর্মকা- এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কোন্টা ইখলাছ আর কোন্টা রিয়া তা চেনার উপায় নেই। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, দান-ছাদাক্বাহ, ত্রাণ, দাওয়াত, ত্বাওয়াফ, ইফতার, সাহরী, তারাবীহ প্রভৃতি ইবাদত সেলফির জালে আটকে পড়েছে, যেন মানুষকে দেখানোর জন্যই এগুলো করা হচ্ছে। কোথাও ইখলাছের লেশমাত্র নেই। দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ভান করে সামান্য সাহায্য বিতরণ করে তার ছবি পোস্ট করে দ্বীনদার সরল মানুষকে ধোঁকা দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু ধর্মীয় লেবাসধারী ব্যক্তি।
মূলত ইন্টারনেট নির্ভর ভঙ্গুর চিন্তা-চেতনা খুলূছিয়াতের চর্চা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ফেইসবুকের কোন্ বক্তব্যে কিংবা স্টাটাসে কত ভিউ বাড়ল, কতটা লাইক পড়ল, কতটা শেয়ার হল, কে কী কমেন্টস করল ইত্যাদির পিছনেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হচ্ছে। অথচ উক্ত বক্তব্য সঠিক না জাল, তথ্যভিত্তিক না অনুমান নির্ভর, সেটা যাচাই করার সময় নেই, যোগ্যতাও নেই। কিন্তু লাইক দিন, শেয়ার করুন, সাবস্ক্রাইব করুন এই মাতলামির ওয়ায করতে কখনো ভুলে না। ভিউ বাড়ানোর জন্য তড়িঘড়ি করে লাইভে এসে উল্টা-পাল্টা কিছু বলতে পারলেই নিজেকে স¤্রাট মনে হয়। যারা কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক আলোচনা শুনতে চান তাদেরকেও হারামখোর ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা বিপদে ফেলেছে। তারা বক্তব্যের মধ্যে নোংরা এ্যাড ও নগ্ন ছবি সংযোগ করে দ্বীনি আলোচনা শুনার পরিবেশ নষ্ট করছে। এছাড়া মুরীদ কর্তৃক পীরকে খুশি করা, ভক্ত কর্তৃক বক্তাকে খুশি করা, কর্মী কর্তৃক নেতা-নেত্রীকে খুশি করাই যেন উন্নয়নের মানদ- হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাটুকারিতা, তেলবাজী আর জি হুজুরই মুখ্য। এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির কোন স্থান নেই। মানুষকে খুশি করা, মানুষের মুখে নিজের প্রশংসা শুনা, নিজের কর্মকা-, লেখনী ও বক্তব্যের প্রশংসার জন্যই যাবতীয় পরিশ্রম বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এখানে খুলূছিয়াত, আখেরাত, বিশ্বস্ততা, একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা ও নিবেদিতপ্রাণের কোন মূল্য নেই, লৌকিকতাই সব।
খুলূছিয়াতের শূন্যতার জন্য কিছু বিষয় দায়ী। (ক) রিয়া ও সুম‘আহ তথা মানুষকে দেখানোর জন্য ও শুনানোর জন্য কাজ করা অর্থাৎ লৌকিকতা প্রদর্শন করা, যা শিরকের দরজা উন্মুক্ত করে ও ইখলাছকে বিনষ্ট করে (ইবনু মাজাহ, হা/৪২০৪; মিশকাত, হা/৫৩৩৩, সনদ হাসান)। (খ) আত্ম প্রশংসা, যা খুলূছিয়াতকে ধ্বংস করে দেয় (সূরা আন-নাজম : ৩২)। (গ) আত্ম অহমিকা, যা তাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তিনটি ধ্বংসাত্মক বিষয় রয়েছে- অধিক কৃপণতা, মনোবৃত্তি ও আত্ম অহমিকা প্রকাশ করা’ (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৫৪৫২, সনদ হাসান)। (ঘ) কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করা। এটি অন্তরের সাথে মিশ্রণ হয়ে ইখলাছকে ধ্বংস করে দেয় (সূরা আল-জাছিয়া : ২৩)। (ঙ) আমলের ক্ষেত্রে মানুষের প্রশংসায় আনন্দিত হওয়া (মুখতাছার মিনহাজুল কাসেদীন, পৃ. ২০০)। (চ) দুনিয়াদার বন্ধু। বন্ধু যদি দুনিয়াদার ও লৌকিকতা প্রদর্শনকারী হয়, তাহলে ইখলাছ বিনষ্ট হয়। কেননা মানুষ তার বন্ধুর চরিত্র অনুসরণ করে থাকে (মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩৯৮; মিশকাত, হা/৫০১৯, সনদ হাসান)। (ছ) জাগতিক চিন্তায় মোহগ্রস্ত হওয়া। যা মানুষের আখেরাতকে ভুলিয়ে দেয় ইত্যাদি। উক্ত ভয়ংকর ব্যাধিগুলো থেকে নফসকে বিরত রাখতে না পারলে ইখলাছ যেমন ধ্বংস হবে তেমনি সমাজ অগ্নিগর্ভে পরিণত হবে।
অতএব সর্বাগ্রে নিয়তকে খালেছ ও পরিচ্ছন্ন করতে হবে এবং সকল কাজে ইখলাছকেই আবশ্যক করে নিতে হবে। মুমিন ব্যক্তি তার সকল কর্ম কেবল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্যই সম্পাদন করবে। এভাবেই সর্বত্র খুলূছিয়াতের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে ইখলাছ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মক বিষয় থেকে হেফাযত করুন এবং মুখলিছ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন-আমীন!!
প্রসঙ্গসমূহ »:
তারবিয়াত