ফিলিস্তীন ও ইহুদী আধিপত্যবাদ
‘ফিলিস্তীন’ নামটি উচ্চারণ করলেই মনে হয় যেন এক ভয়াবহ অগ্নিগর্ভ, মুসলিম হত্যায় প্রবাহিত রক্তের মহাসাগর, লাখ লাখ ছিন্নভিন্ন লাশের মরুভূমি। বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, গুলা-বারুদ ও বিস্ফোরণের চিহ্নিত ভূখণ্ড; সাম্রাজ্যবাদী মারণাস্ত্রের পরীক্ষাগার। পশ্চিমা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে প্রতিদিন স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র অসহায় মানুষের উপর টন টন বোমা বর্ষণ করছে। হাজার হাজার নারী-শিশুকে হত্যা করছে। ইসরাঈলী সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে মেডিকেল, শরণার্থী শিবির, ত্রাণ বিতরণকারী কর্মীরাও রেহাই পাচ্ছে না। ফিলিস্তীন বা প্যালেস্টাইন আধুনিক মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সাক্ষী। অথচ এই ফিলিস্তীন হল, নবী-রাসূলদের দেশ। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পৃথিবীর দ্বিতীয় ইবাদতগৃহ এবং মুসলিমদের প্রথম ক্বিবলা মাসজিদুল আক্বছা।
ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) কা‘বা ঘর প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পর বায়তুল মাক্বদিস প্রতিষ্ঠা হয় (ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৬৬)। অতঃপর দীর্ঘ প্রায় এক হাজার বছর পর সুলায়মান (আলাইহিস সালাম) বৃহৎ আকারে সংস্কার করেন। হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করা একটি স্বাধীন জাতিকে নিজ দেশ থেকে উৎখাত করে চির অভিশপ্ত একটি ইতর জাতিকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার অপপ্রচেষ্টাই এই দীর্ঘ কলঙ্কের সূচনা করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে এক বিষফোঁড়া তৈরি করা। আরব রাষ্ট্রগুলোকে ধোঁকা দিয়ে জাতিসংঘ অনৈতিকভাবে ইসরাঈল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তাড়াহুড়া করে জাতিসংঘ এই ঘৃণিত কাজের সূত্রপাত ঘটায়। ইসরাঈল নামক এই অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোই দায়ী। আর এটা ছিল তাদের অনেক পূর্ব পরিকল্পনার কুটকৌশল। বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেট উইনস্টন চার্চিল ১৯২০ সালে মধ্যপ্রাচ্যে সফরে এসে বলেছিলেন,
"It as may well happen. There should be created in our little time by the bank of the river Jordan a Jewsish state under the protection of the British crown which might comprise three or four million Jews, an event will have occurred in the history of the world which would be from every point of view beneficial and would be especially in harmony with the truest interests of the British Empire."
‘এমনটিও ঘটতে পারে যে, বৃটেনের অধীনে জর্ডান নদীর তীরে আমাদের অল্প সময়ে একটি ইহুদী রাষ্ট্র সৃষ্টি হবে, যা ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ ইহুদীকে জায়গা দিবে। এটি বিশ্ব ইতিহাসে সকল দিক থেকেই লাভজনক হবে। আর এটা সত্যিকার অর্থেই বৃটিশ রাজ্যের স্বার্থে শান্তিপূর্ণভাবে একং ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে’।
উক্ত পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিমারা ফিলিস্তীনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। ফিলিস্তীনে ১৯১৮ সালে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৬,০০০। ১৯২৫ সালে হল ১,০৮,০০০, ১৯৩৫ সালে ৩০০,০০০। ১৯৪৮ সালে ৫,৪০,০০০ এবং বর্তমানে এই সংখ্যা ৬৯,৩০,০০০ বৃদ্ধি পায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ মে ১৯৪৮ রাত বারটা এক মিনিটে ইসরাঈর রাষ্ট্র ঘোষণা করল ইহুদীরা। ডেভিড বেন গুরিয়েন এই ঘোষণা দেয়। দশ মিনিটের ভিতর যুক্তরাষ্ট্র ইসরাঈকে স্বীকৃতি দিল। এরপরে সোভিয়েত ইউনিয়নও স্বীকৃতি দিল। মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি হল। পশ্চিমারা ক্রমেই ইহুদীদেরকে মরণাস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করেছে এবং মুসলিম স্থায়ী বাসিন্দাকে নিশ্চিহ্ন করার নীল নকশা তৈরি করেছে। ফলে একদিকে গণহত্যা চালায় অন্যদিকে বিতাড়িত করতে থাকে। এভাবে যুদ্ধ, নির্যাতন, ক্ষুধা, পীড়া ফিলিস্তীনবাসীর নিত্য সঙ্গী হয়ে যায়। এদের জীবনের অপর নাম হয়ে যায় যুদ্ধ ও মৃত্যু। জর্ডানের ৬০% মানুষ প্যালেস্টাইন বংশদ্ভূত হয়। সেখান থেকে ৬,৫০,০০০ ফিলিস্তীনীকে উৎখাত করে ২৫,০০০ ইহুদীর বসতি স্থাপন করেছে। এ সমস্ত এলাকায় লাখ লাখ ফিলিস্তীনীকে তারা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করে।
বহিরাগত ইহুদীদের অত্যাচার থেকে ফিলিস্তীনীদেরকে মুক্ত করার জন্য আপোসহীন মেজায নিয়ে এগিয়ে এলেন ইয়াসির আরাফাত। প্রতিষ্ঠা করেন পি.এল. ও (Palestine Liberation Organisation (PLO))। তবে পি.এল.ও প্রতিষ্ঠা করতে সময় লেগেছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অল্প দিনের মধ্যেই পি.এল.ও সমগ্র বিশ্বে একটি জনপ্রিয় সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু উক্ত মুক্তি সংগ্রামকে দুর্বল করতে এবং ফিলিস্তীনীদেরকে বিভক্ত করতে পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ইয়াসির আরাফাত পি.এল.ও -এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর থেকে ইয়াসির আরাফাত নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ১৯৯৬ সনের মার্চ মাসে প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আর ২০০৪ সালের ১১ই নভেম্বর ফিলিস্তীনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত মারা যান। তিনি ১২ অক্টোবর হঠাৎ অসুস্থ হন। প্যারিসের সামরিক হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। অতঃপর দীর্ঘ ৮ বছর পর সুইজারল্যান্ডে পরিচালিত ৯ মাসের তদন্তে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। অনলাইন আল-জাযীরার এক রিপোর্টে উক্ত গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়।
অভিশপ্ত ইহুদী জাতি থেকে মুক্তি পেতে এবং মুসলিমদের প্রথম ক্বিবলা বায়তুল মাকদিসকে মুক্ত করতে ফিলিস্তীনীরা অনেক প্রচেষ্টা সংগ্রাম করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এর মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনও তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হল ‘ফাতাহ’ (فتح)। এর অর্থ বিজয়। এর পূর্ণরূপ (حركة التحرير الوطني الفلسطيني) বা ফিলিস্তীনী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। ইয়াসির আরাফাত ও তার সহযোদ্ধাদের মাধ্যমে ১৯৫৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে এটি পি.এল. ও (Palestine Liberation Organisation)- এর সাথে একীভূত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
পরবর্তীতে নবজাগরণ বা ইন্তিফাযা (انتفاضة)-এর বিশেষ প্রয়োজনে তৈরি হয় ‘হামাস’ (حماس)। এর অর্থ উদ্দীপনা। এর পূর্ণরূপ (حركة المقاومة الإسلامية) ‘হারাকাতুল মুক্বাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়াহ’ বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৯৮৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর এটা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শুরুতে এটি মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তীন শাখা হিসাবে পরিচালিত হত। এর সদর দপ্তর গাযায়। এই সংগঠন মিশরের ইখওয়ানী আক্বীদায় বিশ্বাসী। এদের মিত্র ইরান, সিরিয়া, কাতার, আফগানিস্তান, হিযবুল্লাহ। হামাস ২০০৬ সালে ফাতাহ সমর্থকদেরকে গাযা উপত্যকা থেকে সরিয়ে দিয়ে গাযা শাসন করছে। অন্যদিকে ফাতাহ শাসন করছে ফিলিস্তীনের পশ্চিম তীর। ২০০৭ সালে উভয়ের মাঝে প্রচুর সংঘাত হয়। এই আদর্শগত বিভক্তি ফিলিস্তীনকে দুর্বল করে দিয়েছে। ইসরাঈল নামধারী ইহুদীরা আরো বেশি সুযোগ পেয়েছে।
বর্তমানে ফিলিস্তীনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়াই এর একমাত্র স্থায়ী সমাধান। আর ইহুদীরা যে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছে সেখানে তাদেরকে ফেরত পাঠানো। কারণ চরম লাঞ্ছনার সাথেই এদেরকে পৃথিবীতে থাকতে হবে। কোথাও স্থায়ী জায়গা হবে না (সূরা আলে ইমরান: ১১২)। পশ্চিমা প্রভুদের করুণা ছাড়া তারা এক ঘণ্টাও মধ্যপ্রাচ্যে টিকতে পারবে না। আর এই সমাধানের জন্য সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে। সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করে মুসলিমদের প্রথম ক্বিবলাকে অপবিত্র ইহুদীদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে হবে এবং গাযার ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে হবে, আল্লাহ যেন ফিলিস্তীনকে হেফাযত করেন, ইহুদীদেরকে এখান থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং মুসলিম উম্মাহকে যেন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেন-আমীন!!