সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৩:৩২ অপরাহ্ন

রামাযান : ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্যে কিছু কথা


সিন্ডিকেট অর্থ গুদামজাত করা, মওজুদ করে রাখা। খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যজাত অন্যান্য জিনিস মওজুদ করাকে সিন্ডিকেট বলে। আর যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষায় খাদ্যদ্রব্য জমা করে রাখে তাকে মওজুদদার বলে। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নিজের প্রয়োজন মুক্ত থাকা এবং জনগণের প্রয়োজন সত্ত্বেও মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা থেকে বিরত থাকাকে সিন্ডিকেট বা মওজুদদারী বলে’ (ফাৎহুল বারী, ৪/৩৪৮ পৃ.)। আবূ দাঊদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ জিনিস গুদামজাত করা নিষেধ? তিনি বললেন, মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস। অর্থাৎ যাতে মানুষের জীবন ও জীবিকা রয়েছে’। ইমাম আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য বাজারজাত করার পথে প্রতিবন্ধক হয় সেই মওজুদদার’ (নাইলুল আওত্বার, ৫/২৬২ পৃ.)।

রামাযান রহমত, বরকত, ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার মাস; আল্লাহর সাক্ষাৎ ও জান্নাত লাভের মাস। গোটা মাসে আল্লাহ তা‘আলা রহমতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেন। অথচ রামাযান আসলেই সিন্ডিকেট ও কালোবাজারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষ করে তেল, চাল, ডাল, আটা, আলু, ডিম, দুধ, মাংস, খেজুর, ছোলা ইত্যাদি ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। নিম্নবৃত্ত, নিম্ন মধ্যবৃত্ত ও মধ্যবৃত্ত মানুষ তাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। এই রহমতের মাসেও তারা স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করতে পারে না। দরিদ্র, অসহায়, মিসকীন, বিধবা, ইয়াতীম হতভাগাদের দিকেও ঐ সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর চোখ পড়ে না। এ সমস্ত ক্ষুধার্ত লোকগুলো অনাহারে দিন কাটালেও হারামখোরদের অন্তর কাঁপে না। আসলে তারা মানুষ নামের কলঙ্গ। তারা এর ভয়াবহ পরিণামের কথা ভুলে গেছে।

বেশি লাভের আশায় পণ্য মওজুদ করে রাখা, সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতারণার ফাঁদ পাতা, পণ্যের দাম বাড়াতে দালালি ও কালোবাজারি করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। এছাড়া এই সিন্ডিকেট যে শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে হয় তা কিন্তু নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। যেমনÑ গাড়ির টিকিট। টিকিট থাকা সত্ত্বেও টিকিট নেই এরকম অজুহাত দেখিয়ে গাড়ির মালিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেয়ার জন্যও কিন্তু সিন্ডিকেট করে। ঈদ ও ঈদ পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ সিন্ডিকেটের হিংস্র ছোবলে পড়ে। এটা স্পষ্ট যুল্ম ও সীমালঙ্ঘন। আল্লাহ তা‘আলা যালিমের পরিণাম সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করে যুল্ম করতে চায়, আমরা তাকে বেদনাদায়ক শাস্তি দেব’ (আল-হজ্জ: ২৫)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি (জনগণের জীবিকা সঙ্কীর্ণ করে) খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে, সে বড় অপরাধী’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৫; মিশকাত, হা/২৮৯২)। যুল্ম ক্বিয়ামতের দিন জান্নামের অন্ধকারে ফেলে দিবে (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৭৯)। দুনিয়ায় এদের উপরে চতুর্দিক থেকে আল্লাহর গযব নাযিল হবে। নিজে ধ্বংস হবে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হবে। সন্তান-পরিবারসহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আল্লাহ ছেড়ে দিবেন না (ছহীহ বুখারী, হা/৪৬৮৬; সূরা হূদ ১০২; ইবরাহীম ৪২-৪৩)।

ব্যবসায় লাভের চিন্তা অবশ্যই থাকবে। তা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। তবে তা হতে হবে সৎভাবে, ন্যায্য উপায়ে, মানুষের কল্যাণচিন্তা মাথায় রেখে। কাউকে জিম্মি করে বা অজ্ঞতার সুযোগে বেশি লাভ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। নবী করীম (ﷺ)-এর আমলে এক সময় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেল। লোকগণ অনুরোধক করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। নবী করীম (ﷺ) বললেন, মূল্যের গতি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। সঙ্কীর্ণতা ও প্রশস্ততা আনয়নকারী একমাত্র তিনিই এবং তিনিই রিযিকদাতা। আর আমি এই চেষ্টাই থাকি যে, আমি আল্লাহর কাছে এই অবস্থায় সাক্ষাৎ করি যেন আমার ওপর তোমাদের কারও জানের বা মালের প্রতি কোন অন্যায়-অবিচারের দাবি না থাকে’ (তিরমিযী, হা/১৩১৪; আবু দাঊদ, হা/৩৪৫১, সনদ ছহীহ)। অতএব কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি লাভ করার অপচেষ্টা একটি সামাজিক অপরাধ। সামাজিকভাবেই একে প্রতিরোধ করতে হবে।

তাই দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে সিন্ডিকেট, যাতায়াত ভাড়া নির্ধারণে সিন্ডিকেট, সরকারি কাজের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট, নিয়োগ বাণিজ্যে সিন্ডিকেট সহ সকল অপকর্ম রোধে নিঃশর্তভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শুধু আইন থাকলেই হবে না, আইন প্রয়োগ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। কেউ যেন রাজনৈতিক ও দলীয় প্রভাব খাটাতে না পারে। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিদপ্তর এই সিন্ডিকেট উচ্ছেদে শক্ত ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে, পাশাপাশি বাজার মনিটরিং আরো শক্তিশালী করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল গঠন করতে পারে। ইসলামী অর্থনীতির বাজার ব্যবস্থাপনার প্রচলন এবং তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রামাযান যে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির মাস; ক্ষমা ও জান্নাত লাভের মাস সেটা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। হারাম ব্যবসা ও দুর্নীতির আসর বসিয়ে এই মাসের মর্যাদ নষ্ট করা যাবে না। অতএব রামাযানে সিন্ডিকেটের মত অভিশাপ থেকে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রক্ষা করুন এবং অভিশপ্ত সিন্ডিকেটরদেরকে হেদায়াত দান করুন-আমীন!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّیۡعُ الۡعَلِیۡمُ


 




প্রসঙ্গসমূহ »: সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ