বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৮ অপরাহ্ন

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ

রামাযান থেকে আমরা কী শিক্ষা নিব?


আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (বাক্বারাহ ১৮৩)।
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা রামাযানের প্রত্যেক দিন এবং রাতে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন (তিরমিযী হা/৬৮২; ইবনু মাজাহ হা/১৬৪২, সনদ ছহীহ)। অন্য হাদীছে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করবে, তার বিগত জীবনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানে রাত্রির ছালাত আদায় করবে, তার বিগত জীবনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রি জাগবে, তার বিগত জীবনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৮)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘রামাযান শুরু হলে জান্নাত, রহমত ও আসমানের সমস্ত দরজা খুলে দেয়া হয়’ (বুখারী হা/১৮৯৮; মিশকাত হা/১৯৫৬)।

রামাযানে ছিয়াম রাখার পাশাপাশি আরো বেশ কিছু ইবাদত রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে অসংখ্য রহমত, বরকত, ক্ষমা ও নেকী পাওয়া সম্ভব।
(ক) দীর্ঘ সময় নিয়ে সারা মাস তারাবীহর ছালাত আদায় করা
(খ) বেশী বেশী দান-ছাদাক্বাহ করা
(গ) বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা
(ঘ) ছিয়াম অবস্থায় বেশী দু‘আ করা
(ঙ) ছায়েমকে ইফতার করানো
(চ) ক্বদরের রাত্রি পাওয়ার জন্য ইবাদতে মনোযোগী হওয়া
(ছ) ই‘তিকাফ করা
(জ) ফিতরা আদায় করা ইত্যাদি।

উক্ত আমলসমূহের মাধ্যমে যেগুলো অর্জন করার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোই রামাযানের আসল প্রাপ্য। যেমন-
*(১) তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা। আর তাক্বওয়াই মুমিন জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। তাক্বওয়ার স্থান হল, ক্বলব বা অন্তর। যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অর্জন করবে সে ব্যক্তি যেমন আল্লাহর ক্ষমা, রহমত ও জান্নাত পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে, তেমনি তাকে কোন পাপ, হারাম কাজ, মিথ্যা কথা, প্রতারণা, ধোঁকা, আত্মসাৎ, দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, সূদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, গান-বাজনা, যেনা-ব্যভিচার, বেহায়াপনা, নগ্নতা, জাহেলিয়াত অর্থাৎ আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কোন কর্ম তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এটাই তাক্বওয়া। ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ তা‌‌‌‌’আলা এবং রাসূল (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা আদেশ করেছেন তা পালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকাই হল ‘তাক্বওয়া’ (মাজমূউল ফাতাওয়া ২৭/৩৯)। আমরা কি এই তাক্বওয়া অর্জন করতে পারি?

*(২) আল্লাহর কাছ থেকে পাপসমূহ ক্ষমা নেয়া। হাদীছগুলো প্রমাণ করে রামাযানের অন্যতম লক্ষ্যই হল, বান্দার পাপসমূহ ধ্বংস করা, পুড়িয়ে ফেলা। এ জন্যই এই মাসের নাম ‘রামাযান’। আর ক্ষমার অধিকার কেবল আল্লাহর। বান্দাকে ক্ষমা করা তাঁর বিশেষ গুণ। তিনি ক্ষমা করাকে পসন্দ করেন। অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া পাপসমূহ থেকে এমনভাবে তওবা করতে হবে, যাতে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় যে, আল্লাহ ক্ষমা করেছেন (আ‘রাফ ১৫৬; যুমার ৫৩; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫০, সনদ হাসান)। এক্ষেত্রে অবশ্যই তওবার মৌলিক শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। যেমন- (ক). পাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা; (খ). কৃত পাপের জন্য সর্বদা আফসোস করা ও অনুতপ্ত হওয়া; (গ). আর পাপ করবে না মর্মে অঙ্গীকার করা; (ঘ). বান্দার হক্ব নষ্ট করলে তা ফেরত দেয়া বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে ক্ষমা নেয়া। আরো কিছু শর্ত আছে। এবার উপলব্ধির বিষয় ক্ষমার মাসে আমি ক্ষমা পেলাম কি-না। ক্ষমা ও রহমত পাওয়ার মাধ্যমগুলো যথাযথ পূরণ করলাম কি-না।

* (৩) জান্নাত লাভ করা। রামাযানে আল্লাহ জান্নাতের সমস্ত দরজা খোলা রাখেন। অন্যদিকে প্রত্যেক রাতে ও দিনে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। আল্লাহ ছিয়াম পালনকারীকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন (বুখারী হা/২৮৪০; তিরমিযী হা/১৬২৪)। তাছাড়া ছিয়াম জাহান্নামের ঢাল (বুখারী হা/১৯০৪; ইবনু মাজাহ হা/১৬৩৯)। তাই এ মাসেই জান্নাতুল ফেরদাঊস নিশ্চিত করতে হবে। কী পরিমাণ আমল-ইবাদত, তওবা, ইস্তিগফার করলে এই আস্থা অর্জন করা সম্ভব, তা নিজেকেই ভাবতে হবে। কারণ আগামীতে এই সুযোগ আবার আসবে এই আশা করা বোকামি ও অর্থহীন। তাই জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারলাম কি-না এবং আল্লাহ আমাকে মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করলেন কি-না সে চিন্তাই বেশী করতে হবে।
* (৪) আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ প্রতিদান লাভ করা এবং তাঁর দীদার বা সাক্ষাৎ পাওয়া (বুখারী হা/১৯০৪)।
* (৫) ক্বিয়ামতের মাঠে বিপদের মুহূর্তে ছিয়ামের সুপারিশ পেয়ে ধন্য হওয়া (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১৮৩৯, সনদ ছহীহ)।
* (৬) রামাযানের বরকত ও কল্যাণ লাভ করা (নাসাঈ হা/২১০৬, সনদ ছহীহ)। উক্ত প্রতিদানগুলো পাওয়ার জন্য আমরা রামাযানকে কতটুকু কাজে লাগাতে পারছি, সেটারই হিসাব মিলাতে হবে।

মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হল, রামাযানের পূর্বেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা। অন্যথা রামাযানের শেষে আফসোস করে কোন ফায়েদা হবে না। মনে হবে রহমতের মাস চলে গেল কিন্তু অসহায়, মিসকীন, বিধবা, ইয়াতীম, দুস্থ, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না! গোপনে খাবার, দান, ছাদাক্বাহ পৌঁছাতে পারলাম না! অধিক সংখ্যক মানুষকে ইফতার করাতে পারলাম না! প্রত্যেক রাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করে তারাবীহর ছালাত আদায় করা উচিত ছিল, কিন্তু সেটাও হল না, ব্যস্ততার কারণে ক্বদরের রাত্রিগুলোও জাগা হল না, রাতের গভীরে চোখের পানি ফেলে আল্লাহকে কিছু বলব, তারও সময় পেলাম না, কুরআন মাজীদ একবারও খতম দেয়া সম্ভব হল না! ছিয়াম অবস্থায় বেশী বেশী দু‘আ করারও সুযোগ হল না! পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ওয়াক্তমত আদায় করা ফরয, কিন্তু রহমত-বরকতের এ মাসেও তা আদায় করতে পারিনি, দ্বীন শিক্ষার জন্যও সময় দিতে পারিনি, তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক আলোচনাতেও অংশগ্রহণ করতে পারিনি! শুধু দুনিয়ার কাজেই ডুবে থাকলাম! রামাযানের রহমত থেকে এভাবেই বঞ্চিত হলাম! অন্যদিকে ছিয়াম রেখেও যত অপকর্ম সবই করে গেলাম। ছিয়াম আমার উপর কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি। তাই যাবতীয় অন্যায় কাজে আবার জড়িয়ে পড়লাম। এখন কি নিজেকে মুমিন মনে হয়, নাকি মুনাফিক? যদি মৃত্যু চলে আসে, তাহলে কী হবে? কবরের শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কি? জান্নাতের দাবী করতে পারব কি? আল্লাহকে কী বলব? তাহলে রামাযান থেকে কী পেলাম! কী শিক্ষা নিলাম! আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রামাযান থেকে প্রকৃত শিক্ষা নেয়ার তাওফীক্ব দান করুন এবং এই মাসের বিশেষ রহমতে চলমান মহামারি-দুর্যোগকে উঠিয়ে নিন-আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ




দুর্নীতি : সমাজ বিধ্বংসী মারণাস্ত্র - সম্পাদকীয়
লৌকিকতামুক্ত কুরবানী: তাওহীদ বাস্তবায়নের উপায় - সম্পাদকীয়
মানহাজের বিরোধিতা ও তার পরিণাম - সম্পাদকীয়
প্রচলিত কুসংস্কার : মুসলিমদের জন্য মরণব্যাধি ক্যান্সার - সম্পাদকীয়
উত্তম চরিত্রের দুর্ভিক্ষ ও পরিত্রাণের উপায় - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
খুলূছিয়াত আবশ্যক - সম্পাদকীয়
ত্বাগূতী রাজনীতি অভিশাপ ও করুণ পরিণতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
তরুণদের মানহাজ বিভ্রান্তি ও তার কুফল - সম্পাদকীয়
কুরআন মাজীদের হক্ব আদায় করুন! - সম্পাদকীয়
মহামারীর কারণ ও পরিত্রাণের উপায় - সম্পাদকীয়
রাহুমুক্ত বাংলাদেশ: সর্বত্র সংস্কার প্রয়োজন - সম্পাদকীয়
অবৈধ সম্পর্কের পরিণাম - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ