বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০২ অপরাহ্ন
اَلْحَمْدُ لِلّٰہِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
খুন ও ধর্ষণ : নৈরাজ্যের চরম সীমা অতিক্রম

সমাজে যতগুলো অপকর্ম চলছে তার মধ্যে যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বেশী চলছে খুন ও ধর্ষণ। এ দু’টিই বর্বর ও অসভ্য যুগের অপকর্ম। শহর থেকে গ্রাম, পাড়া, মহল্লা সর্বত্রই এই জঘন্য বিভীষিকা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে। সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। প্রকাশ্যে দিবালোকে এই নোংরা কর্ম সংঘটিত হচ্ছে। সম্মিলিত সন্ত্রাসী চক্র ও তরুণ গ্যাং বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের মুখে এই কুকর্ম করার কারণে সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না; বরং অসহায় নীরব দর্শকের মত চুপ করে থাকে। দায়িত্বরত বিভিন্ন সরকারী বাহিনী থাকলেও নিয়ন্ত্রণের কোন প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের নাকের ডগায় এ সমস্ত কর্ম সংঘটিত হলেও তাদেরকেও দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায়।

পত্রিকার পাতা বা যেকোন মিডিয়ায় চোখ রাখলেই খুনের বড় বড় শিরোনাম লক্ষ্য করা যায়। প্রতিদিনই খুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সন্তানহারা মায়ের আর্তচিৎকার, স্বামীহারা অসহায় নারীর আর্তনাদ এবং স্বজনহারা মানুষের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার কারণে বহু মানুষ বিকারগ্রস্ত হচ্ছে। সংসারের মূল জোগানদাতাকে হারিয়ে বহু পরিবার পথের ভিখারী হচ্ছে। সন্তান অভিভাবকহীন হওয়ার কারণে বিপথে চলে যাচ্ছে; মাদক, সন্ত্রাসসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে আধুনিক যুগেও মানুষ অসভ্য জাতিতে পরিণত হচ্ছে।

ধর্ষণ বর্তমানে অত্যন্ত ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। অফিসে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, চলন্ত বাসে পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা এমনকি রাস্তার পাগলী প্রতিবন্ধী পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। গণধর্ষণের ঘটনা এখন স্বাভাবিক রূপ নিয়েছে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হল, গণহারে ধর্ষণ করার পর নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। কখনো গলায় ফাঁস দিয়ে, কখনো দেহকে টুকরা টুকরা করে, কখনো আগুন দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, কখনো তাজা মানুষকে হাত, পা, মুখ বেঁধে বস্তার মধ্যে পুরে পানিতে ফেলে দিয়ে বা মাটির নীচে পোঁতে দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এরকম বীভৎস ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। কিছু ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ জানতে পারছে। আর বেশীর ভাগই গোপন থেকে যাচ্ছে। একশ্রেণীর মানবরূপী পশুর মাধ্যমে এগুলো ঘটছে। চলতি বছরে শুধু জানুয়ারী মাসেই দেশে ৫২টি ধর্ষণ, ২২টি গণধর্ষণ এবং ৫টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অন্য একটি হিসাবে বলা হয়েছে, বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪০০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে সারা দেশে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একটি সংস্থা জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ১৮২ জন নারী গণধর্ষণ, ৬৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৬৯৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর শুধু শিশু ধর্ষণ হয়েছে ৩৫৬ জন। তার মধ্যে ২২ জন মারা গেছে। ২০১৯ সালে যে পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙ্গে যাবে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
উক্ত জঘন্য বিভীষিকার পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এগুলো এখন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র মহামারির মত ছড়িয়ে পড়েছে। আর এর প্রভাব এত বেশী, যা জাহেলী যুগকেও হার মানিয়েছে। এই নোংরা পরিণতি থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপও নিতে হবে। (ক) ধর্মীয় অনুশাসনকে অবজ্ঞা করা। অন্য সবক্ষেত্রে যতই উন্নতি হোক নৈতিক উন্নয়ন না হলে কেউ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। আর নৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ইসলামের বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা। যদিও একশ্রেণীর অমানুষ আল্লাহ ও পরকালভীতিকে অবজ্ঞা করে সমাজে নাস্তিক্যবাদ ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে। তারাই সমাজকে কলুষিত করছে। অথচ ইসলামী অনুশাসন চর্চা করেই মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূর করেছিলেন। তাক্বওয়া ও নৈতিকতার প্রভাব এত বেশী ছিল যে, একাকী একজন মহিলা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। পথের মধ্যে কোথাও বাধার সম্মুখীন হয়নি (বুখারী, হা/৩৫৯৫)। কঠিন শাস্তির কথা জানার পরও অপরাধ করে পরকালে বাঁচার জন্য অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করেছে। কেবল ইসলামই এরূপ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে (মুসলিম, হা/১৬৯৫)। (খ) অভিভাবকদের দায়িত্বে অবহেলা। অধিকাংশ অভিভাবক নিজ ছেলেমেয়েকে বল্গাহীনভাবে ছেড়ে দিয়ে রাখে। দুর্নীতির অঢেল অর্থ কোন হিসাব ছাড়াই তাদের হাতে দিয়ে দেয়। সারা রাত নানা অনৈতিকতার মধ্যে কাটিয়ে শেষ রাতে বাড়ি ফিরে। এটা নিয়ে অভিভাবকের কোন মাথা ব্যথা নেই। এভাবেই এক সময় খুন, গুম, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
(গ) নগ্ন সাইটগুলোর কুপ্রভাব ও মোবাইলের অপব্যবহার। ইন্টারনেট আর মিডিয়ার সুবাদে উলঙ্গ ও অশ্লীল ছবি, ভিডিও প্রকাশ করা হচ্ছে। ইউটিউব, ফেসবুক, হাজার হাজার নগ্ন চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, বই ও বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে অসংখ্য হারামখোর ব্যবসায়ী এখন রমরমা ব্যবসা করছে। ফলে সর্বত্র যৌনাচার ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসের গতিতে। এ সমস্ত নগ্ন দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে গোপনে ও প্রকাশ্যে দেখার কারণে যৌন আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো জাহেলিয়াত এবং পরিণাম সরাসরি জাহান্নাম। এ সমস্ত কুকর্মে জড়িত লোক ছালাত পড়লেও, ছিয়াম পালন করলেও, মুসলিম হলেও জাহান্নামে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই (আহমাদ, হা/১৭২০৯, সনদ ছহীহ)। কারণ আল্লাহ তা‘আলা গোপন ও প্রকাশ্য যাবতীয় বেহায়াপনাকে হারাম করেছেন (আ‘রাফ : ৩৩)। (ঘ) নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী দায়ী সহশিক্ষা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও হাজার হাজার কোচিং সেন্টারে একই সঙ্গে পড়ালেখা ও চলাফেরার কারণে ছেলেমেয়ের মাঝে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড নামের জঘন্য অপসংস্কৃতি এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান, অফিস-আদালত, পার্ক, বার্ষিকী, শিক্ষা সফর ও বিয়ে বাড়ীতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সমাজে বেলেল্লাপনা ছড়ানোর অন্যতম কারণ। শারঈ দৃষ্টিতে এগুলো সবই হারাম। নারী-পুরুষ পরস্পরে যেন অন্যের প্রতি দৃষ্টি না দেয় সেজন্য কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে (নূর : ৩০-৩১)। (ঙ) আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা। সমাজে খুন, ধর্ষণ, মাদক, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, আত্মসাৎ সহ অসংখ্য অপরাধ চললেও প্রশাসন যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারে না। কোন কোন ক্ষেত্রে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হলেও ফাঁকফুকুরে ছাড়া পেয়ে যায়। এছাড়া বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতা তো আছেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থার কিছু অমানুষও এ সমস্ত অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি অনেক সময় ভয়ংকর চিত্র বেরিয়ে আসে। তাদের বিরুদ্ধেও নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা (চ) অপরাজনীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। সমাজে বড় বড় অপরাধ ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ এটা। এখন চলছে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জয়জয়কার। যারা সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে তারাই যদি অসাধু ও দুর্নীতিবাজ হয়, তাহলে কখনই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং সুনাগরিকও তৈরি হবে না।
এ অবস্থায় সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির প্রশিক্ষণ। কারণ দ্বীনের বুঝ আর পরকালভীতিই কেবল মানুষকে যাবতীয় অপরাধ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যাবতীয় অপকর্মের ছোঁয়া থেকে হেফাযত করুন এবং সার্বিক নিরাপত্তা দান করুন-আমীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ




প্রসঙ্গসমূহ »: সাময়িক প্রসঙ্গ
ইসলামী দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি ও ফলাফল - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
অবরুদ্ধ কাশ্মীর : বিশ্ব মোড়লরা নীরব - সম্পাদকীয়
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পরিচয় - সম্পাদকীয়
তরুণদের মানহাজ বিভ্রান্তি ও তার কুফল - সম্পাদকীয়
ইলিয়াসী তাবলীগ নিষিদ্ধের নেপথ্যে - সম্পাদকীয়
ইসলামী শিক্ষা : উন্নত জাতি গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম - সম্পাদকীয়
সালাফী দাওয়াত ও বিদ‘আতীদের সন্ত্রাসী আগ্রাসন - সম্পাদকীয়
লৌকিকতামুক্ত কুরবানী: তাওহীদ বাস্তবায়নের উপায় - সম্পাদকীয়
সালাফী মানহাজ : পরিচিতি ও অনুসরণের আবশ্যকতা - সম্পাদকীয়
সমকামিতার ভয়ঙ্কর পরিণতি - সম্পাদকীয়
অবৈধ সম্পর্কের পরিণাম - সম্পাদকীয়
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পরাজয় : - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ