পাশ্চাত্য দর্শন: সমাজ বিপ্লবের পথে চরম অন্তরায়!
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত ইসলাম পরিপূর্ণই থাকবে। এখানে কিছু সংযোজন-বিয়োজনের কোন সুযোগ নেই। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্টযন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ইসলামের দিকনির্দেশনা চির-ভাস্বর। কিন্তু কালক্রমে মানব রচিত কতিপয় জাতীয়-বিজাতীয় দর্শন ও মতবাদ আবিষ্কারের কারণে বাংলাদেশে ইসলামী ‘আক্বীদাহ-বিশ্বাস, রীতি-নীতি ও ইসলামের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য প্রভৃতি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বস্তুবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনার বিষবাষ্পে এদেশের মুসলিম সমাজ অন্ধকার জগতে নিমজ্জিত। যা বর্তমানে সমাজ বিপ্লবের পথে চরম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পাশ্চাত্য দর্শন হতে মুসলিম উম্মাহকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যরূরী।
বস্তুবাদ ও বস্তুপূজাই হলো পাশ্চাত্যের মৌলিক দর্শন। যা গ্রীক ও রোমান সভ্যতার কল্যাণে আবির্ভাব ঘটেছে। যে দর্শন ধর্মীয় অনুভূতি ও আধ্যাত্মিকতা শূন্য এবং ভোগবাদিতা ও পার্থিব আরাম-আয়েশের প্রতি তীব্র আকর্ষণ করে। রোমানরা ছিল স্বজনপ্রীতি, সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা ও জীবন সম্পর্কে নির্ভেজাল বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। এর পাশাপাশি গণতান্ত্রিক যুগের শেষ দিকে রোমে নৈতিক ও চারিত্রিক অধঃপতন, পাশবিক কামনা-বাসনার অবাধ রাজত্ব এবং বিত্ত-বৈভবের এমন এক প্লাবন এসে দেখা দিয়েছিল যে, রোমকরা তাদের মধ্যে একেবারে ডুবে গিয়েছিল এবং সেই নৈতিক শৃঙ্খলা ও বিধানসমূহ- যেগুলো রোমক জাতির প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য ছিল, তা খড়কুটোর মত ভেসে গিয়েছিল এবং সংহতির প্রাসাদে এক ধ্বংসযজ্ঞ কাঁপন সৃষ্টি করেছিল। অতঃপর গ্রীক ও রোমকদের উপরিউক্ত মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে ইউরোপীয় সমাজের লেখক, সাহিত্যিক, সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাদের বস্তুবাদের ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু করেন এবং মানুষের মন-মগজে বস্তুপূজার বীজ বপন করেন। তারা বস্তুবাদকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তারা কখনও উপযোগিতাবাদের দর্শন পেশ করেন আবার কখনওবা পেশ করেন ‘খাও দাও ফুর্তি কর’-এর দর্শন। কেউ ইতিপূর্বে ‘ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা’ এই দর্শন পেশ করেছিলেন। যার মূল থিওরি ছিল ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিষয়, তার সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক থাকবে না।
গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, তা হলো- বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং প্রাচীন গ্রীক ও রোমক সভ্যতা-সংস্কৃতির মধ্যে ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। গ্রীকরা যেমন ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা থেকে মুক্ত ছিল, তেমনি বর্তমান পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে শূন্য। বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতায় যেমন খেল-তামাশা ও বস্তুবাদ সুস্পষ্ট, তেমনি সেটা গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় বিদ্যমান ছিল। অথচ এ পাশ্চাত্য দর্শনের করালগ্রাসে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। গবেষকগণ বলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পশ্চিমা দেশগুলোতে এখনও এমন বহু লোক পাওয়া যাবে, যারা ধর্মীয় ধারা অনুভব করেন, চিন্তা করেন এবং প্রাণপণ চেষ্টা করেন তাদের ধর্ম বিশ্বাস ও সভ্যতার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে। কিন্তু তারা হচ্ছেন ব্যতিক্রম মাত্র। গণতন্ত্রী অথবা ফ্যাসিস্ট, পুঁজিবাদী অথবা সমাজতন্ত্রী বলশেভিক, দিনমজুর অথবা বুদ্ধিজীবীÑইউরোপের যেকোন সাধারণ ও মধ্যম শ্রেণীর মানুষ একটি মাত্র ইতিবাচক ধর্মকেই চেনে ও জানে। আর তা হলো- বস্তুবাদী উন্নতি-অগ্রগতির পূজা। তাদের বিশ্বাস, জীবনকে ক্রমাগত মুক্ত, বাধাবন্ধনহীন ও সহজতর করে তোলা ব্যতিরেকে জীবনের আর কোন লক্ষ্য নেই অথবা চলতি কথায় প্রকৃতি-নিরপেক্ষ হওয়াই তার ধর্ম। বিরাট বিরাট কারখানা, সিনেমা, রাসায়নিক গবেষণাগার, নাচঘর তথা নৃত্যকলা ভবন, পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে এ ধর্মের মন্দির আর তার পুরোহিত হলো ব্যাংকার, ইঞ্জিনিয়ার, অভিনেতা- অভিনেত্রী, শিল্পপতি ও অর্থবিত্তের অধিকারী কৃতবিদ্যা পুরুষ। ক্ষমতা ও আনন্দের এ নেশার অপরিহার্য পরিণাম হয়েছে যেখানে-সেখানে স্বার্থের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এর ফল হচ্ছে এমন এক ধরনের মানুষ সৃষ্টি, যাদের নীতিবোধ নিছক উপযোগবাদের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ এবং যার ভালো-মন্দের সর্বোচ্চ মাপকাঠি হচ্ছে একমাত্র বস্তুবাদী সাফল্য ও কামিয়াবী।
প্রাচ্যের আরেকজন মুসলিম গবেষক বলেন, ‘পাশ্চাত্যের লোকেরা প্রকৃতিগতভাবেই বস্তুবাদী তথা বস্তুপূজারী, স্বভাবগতভাবে কঠিন হৃদয় ও লেনদেনের ব্যাপরে অত্যন্ত কঠোর। তারা স্বভাবত স্বার্থপর, বিদ্বেষপরায়ণ ও প্রতিশোধপরায়ণ। মনে হয়, উন্নত নীতি-নৈতিকতা ও মহৎ প্রেরণার ভেতর থেকে এখন তাদের কাছে কিছুই অবশিষ্ট নেই, যা প্রাচ্যের খ্রিষ্টধর্ম তাদের দিয়েছিল। একজন জার্মানীর কথাই ধরুন, মেজাজগতভাবে শুষ্ক ও প্রকৃতিগতভাবে রূঢ ও কর্কশ। তার মতে, একজন দুর্বল মানুষের বেঁচে থাকার কোনই অধিকার নেই। তার কাছে শক্তি, হ্যাঁ, কেবল শক্তিই শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য লাভের একমাত্র হাতিয়ার। আর শক্তির উৎস হলো অর্থ-বিত্ত। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অবশ্যই মর্যাদা দেয়, কিন্তু তা দেয় অর্থ-বিত্তের খাতিরে। তারা সম্মান লাভে আগ্রহী, কিন্তু তা-ও অর্থ-বিত্তের স্বার্থে। গ্রীক ও ইতালিয়ানরা প্রকৃতিগত ভাবে স্বার্থপর ও স্বাধীন মত প্রকাশকারী। তাদের মতে প্রজ্ঞা বা বুদ্ধিবৃত্তি স্বাধীনতা ও বল্গাহীনতার অপর নাম। আর জীবন বলা হয় বেহায়াপনাকে, সৌন্দর্য ও পোশাক-পরিচ্ছদের অপর নাম সম্মান এবং অপরের উপর প্রাধান্য ও বিজয় লাভ করাই হলো ইজ্জত লাভ’ (তাবাই‘ঊল ইসতিবদাদ ওয়া মাসায়ি‘ঊল ইতসি‘বাদ, পৃ. ৭৩-৭৪)। উপর্যুক্ত আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পূর্ণ বস্তুবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেখানে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতকে স্বীকার তো করাই হয় না, এমনকি তার প্রয়োজনও অনুভব করা হয় না। অথচ বাংলাদেশের মুসিলম সমাজ আজ এ পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতার দিকে ধাবমান। মুসলিমদের পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি সহ প্রত্যেক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী দর্শন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে।
গ্রীক-রোমানদের আদলে গড়ে উঠা পাশ্চাত্যের নোংরা বস্তুবাদী দর্শনের আলোকে এদেশের রাষ্ট্র ও জনগণ শাসিত হচ্ছে। তাদেরই চিন্তার ফসল হলো বর্তমানে প্রচলিত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি। যেগুলো সবই ইসলামের চির শাশ্বত বিধানের পরিপূর্ণতা, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য এবং গৌরবান্বিত ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ভুলূণ্ঠিত করেছে। তাই বাংলাদেশে সমাজ বিপ্লব সফল করতে হলে পাশ্চাত্যের এসকল বস্তুবাদী দর্শনের ভয়াবহ আক্রমণ থেকে মুসলিমদেরকে সংরক্ষণ করতে হবে। পুনর্জ্জীবিত করতে হবে ইসলামের হারিয়ে যাওয়া জীবনাদর্শকে। আর এজন্য নির্ভেজাল তাওহীদ ও মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর আদর্শের পরিপূর্ণ অনুসরণ, আনুগত্য ও সেখানে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কোন বিকল্প নেই। কেননা তিনি হলেন বিশ্ব মডেল। তাঁর আদর্শই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। তাই সকল ধর্ম, দর্শন ও মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সর্বশ্রেষ্ঠ মডেল হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। যেমন ছাহাবায়ে কিরাম রাসূল (ﷺ)-কে মেনে নিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে পাশ্চাত্য দর্শনের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করুন। আমীন!!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
প্রসঙ্গসমূহ »:
সম্পাদকীয়